রবীন্দ্রনাথ একদিন কথা-প্রসঙ্গে শ্রীমান্‌ দিলীপ রায়কে বলিয়াছিলেন — “কীর্তনের আখর কথার তান ৷” আখরের ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ণ ব্যাখ্যা আছে বলিয়া আমি জানি না ৷ অভিজ্ঞ কীর্তনীয়ার কীর্তন যিনি শুনিয়াছেন, তিনিই আখরের মাধুর্য উপভোগ করিয়াছেন ৷ আখর পদাবলী-সাহিত্যের অন্তর্নিহিত রস-ভাণ্ডারের কুলুপ খুলিবার কুঞ্চিকা ৷ আখরকে পদের ব্যাখ্যা বলিলে আসল কথাটাই যেন বলা হয় না ৷ পদে যাহা বলা হয় নাই, অনেক সময়ে আখরে তাহা প্রকাশ পায় ৷ সুতরাং এক অর্থে আখরকে পদের ব্যঞ্জনা বলিতে পারি ৷
আসরে দাঁড়াইয়া গান করিতে করিতে আখরের সৃষ্টি করিতে পারেন এমন কীর্তনীয়া মাত্র দুই-একজনকেই দেখিয়াছি ৷ কীর্তনের আখর অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়াই সৃষ্টি করা হইয়াছে ৷ ইহা গুরুপরম্পরা প্রাপ্ত সম্পদ্‌ ৷ কীর্তনীয়াগণকে আখরের সৃষ্টি করিতে হয়৷ পদের বিষয়বস্তু প্রায় ধ্যানমগ্ন হইয়াই চিন্তা করিতে করিতে যে আখর তাহার মনের মধ্যে গুঞ্জন করিয়া ফিরিতে লাগিল, তিনি সেই আখর দোহার এবং বাদকদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া ও গাহিয়া কন্ঠস্থ করিতে বিস্মৃত হন না ৷ এমনই ভাবে আখরের উৎপত্তি হয় ৷ সেই আখর গুরুর মুখ হইতে শিষ্য পাইয়া থাকেন ৷
সর্বক্ষেত্রে সম্ভব না হইলেও প্রাচীন কীর্তনীয়াগণ প্রায়ই দুইটি আখরে অন্তিম মিল রাখিবার চেষ্টা করিতেন ৷ রসিকদাস খণ্ডিতা গাহিতেছেন —(শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)
রাধে জয় রাজপুত্রী মন জীবনদয়িতে, আখর দিলেন — “আর আমার কেউ নাই, এইবার আমায় দয় কর ৷ স্থান দাও রাই শ্রীচরণে, কেনা দাস বলি এ অধীনে ৷৷” গণেশ দাস গান গাহিতেছেন —
(শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সখীর উক্তি)
ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা নিলাজ কানাই
আমরা পরের নারী ৷
পর পুরুষের পবন পরশে
সচেলে সিনান করি ৷
আখর দিতেন— “হোর যা কানাই ছুঁয়োনা ৷ আমরা পরের নারী, হে কানাই ও ছুঁয়ো না ৷ আমরা পরের নারী হে ৷ পর পুরুষ তো দূরের কথা, তার গায়ের বাতাস সহিতে নারি ৷ বাতাস যদি গায়ে লাগে — আমরা সচেলে সিনান করি ৷”
অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ গাহিতেছেন— “অপরূপ পেখলুঁ রামা ৷ কনকতলা অবলম্বনে উয়ল হরিণীহীন হিম ধামা?” আখর— “সোনার লতায় চাঁদের উদয় ৷ ভাগ্যে ছিল তাই দেখিলাম ৷ অকলঙ্ক চাঁদ উঠেছে ৷ এমন অপরূপ কে দেখেছে ৷৷” ফটিক চৌধুরী আখর খুব কমই দিতেন ৷ কিন্তু যখন দিতেন দুই-একটার মধ্যে মিল পাওয়া যাইত ৷ একদিন গান শুনিলাম (শ্রীরাধার প্রতি সখীর উক্তি) “না যাইও যমুনা জলে তরুয়া কদম্বতলে, চিকণ কালা করিয়াছে থানা ৷ নব-জলধর রূপ মুনি মন মোহে গো তেঁই জলে যেতে করি মানা ৷৷” আখর— “সখি মানা করিহে যেও না ৷ যমুনার জলে যেও না ৷ কদমতলায় যেও না৷ চিকণ কালা পেতেছে থানা৷ তেঁই তোমারে করি মানা৷” আখর— “সখি মানা করিহে যেও না৷ যমুনার জলে যেও না ৷ কদমতলায় যেও না ৷ চিকণ কালা পেতেছে থানা ৷ তেঁই তোমারে করি মানা ৷”
* * *
প্রায় সকল কীর্তনীয়ার মধ্যেই প্রচলিত কতকগুলি বাঁধা আখর আছে ৷ যেমন শ্রীকৃষ্ণের রূপ দেখিয়া শ্রীরাধা, কিংবা শ্রীরাধার রূপ দেখিয়া শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন— “রূপ বর্ণনা হয় না ৷ বর্ণনাতীত রূপ বর্ণনা হয় না ৷ যে দেখেছে তার বাক্‌ নাই, যে বলবে তার নয়ন নাই ৷ নয়ন দেখেছে সে বলতে নারে ৷ বদন বলবে দেখে নাই তারে ৷৷” আরও বাঁধা আখর অনেক আছে ৷ একটার কথা বলি ৷ শ্রীরাধার কটির কিঙ্কিণী বাজিতেছে ৷ কীর্তনীয়া আখর দেন “বাজে কিঙ্কিণী ৷ কিং কিনি কিনি, বাজে কিঙ্কিণী ৷ কি কিনি কি কিনি বাজে কিঙ্কিণী ৷ রাধার মন কিনি ৷ রাধার মন দিয়ে রাধারমণ কিনি ৷৷”
শ্রীরাধার পূর্বরাগে— “এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি দেখয়ে আপনা ভুলি ৷” রসিক দাসের পুত্র রাধাশ্যাম আখর দিতেন— এলাইয়া বেণী— ফুলের গাঁথনি— দেখে কাল কেশে, কাল কে — সে? কাল কেশে ৷ শ্রীরাধা পূর্বরাগে “বিরতি আহারে, রাঙ্গা বাস পরে যেমন যোগিনী পারা ৷” অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্য নন্দকিশোর দাস আখর দেন— “আহা রে আহা রে ৷ রতি নাই আহারে ৷”
কথার পিঠে কথা দিয়া মিল রাখিয়া কথার মালা গাঁথা বাঙ্গলীর চিরন্তন অভ্যাস ৷ ছেলে-ভূলানো ছড়ায় মিল, মায়েদের ঘুমপাড়ানিয়া গানে মিল, খনার বচনে মিল, প্রবাদে প্রবচনে মিল—মিল নাই কোথায়? পল্লী-জননীর কণ্ঠে আজিও ধ্বনিত হয়—
খোকন গেল মাছ ধরতে
বড়গঙ্গার বিলে ৷
ছিপ, নিয়ে গেল কোলাব্যাঙ
মাছ নিয়ে গেল চিলে ৷৷

খনা বলেছেন—
কোদাল কুড়ুলে মেঘের গা ৷
মন্দ মন্দ দিচ্ছে বা’ ৷৷
যাও শ্বশুর বাঁধ গে আল ৷
আজ না হয় হবে কাল ৷৷
(বৃষ্টির পূর্বাভাস)

প্রবচন —
তোমার জানি তায় জানি ৷
তোমাদের তেঁতুল বেচা গাঁ জানি ৷
আমার কাছে ঘুরিও না
কাঁচা সূতোর জংদানি ৷

এই সমস্ত উদাহরণ হইতে বুঝিতে পারা যায় বাঙ্গালার ঐতিহ্য বজায় রাখিয়াই কীর্তনীয়াগণ পদাবলীর আখরেও মিল রাখিবার চেষ্টা করিতেন ৷
বাল্যকাল হইতেই রসিক দাস, গণেশ দাস, অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি দেশবিখ্যাত কীর্তনীয়াগণের গান শুনিয়া শুনিয়া আমার এমন একটা অভ্যাস দাঁড়াইয়া গিয়াছে যে, সময়ে সময়ে গানের আসরেই আখর দিয়া বসি ৷ এ অভ্যাস বহুদিনের ৷ এবং এজন্য কীর্তনীয়াগণের কাহাকেও বিরক্ত হইতে দেখি নাই ৷ দেখিয়াছি তাঁহারা সে আখর আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করিয়াছেন ৷ একদিনের কথা বলি ৷ শ্রীখণ্ডের শ্রীগৌরগুণানন্দ ঠাকুরের মাতৃশ্রাদ্ধে গান করিয়া গণেশ দাস কলিকাতায় আসিয়াছেন ৷ শ্রাদ্ধোপলক্ষে অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায়, ফটিক চৌধুরী এবং গণেশ দাস আমন্ত্রিত হইয়াছিলেন ৷ অপর দুইজন শ্রীখণ্ড হইতেই অন্যত্র গান করিতে গিয়াছিলেন, গণেশ আসিয়াছিলেন কলিকাতায় ৷ শ্রাদ্ধে আমন্ত্রিত হইয়া যাইতে পারি নাই ৷ গণেশ দাস আসিয়াছেন, ভবানী-পুরে গান হইবে শুনিয়া দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহধর্মিণী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী, জামাতা সুধীর রায় ও কন্যা অপর্ণা দেবীকে লইয়া গান শুনিতে গেলাম ৷ বাসন্তী দেবী ও অপর্ণা দেবী মেয়েদের মধ্যে বসিলেন, আমি এবং রায় মহাশয় ভক্ত বামাচরণ বসুর পাশে স্থান পাইলাম ৷ গণেশ দাস যখন শ্রীচৈতন্যপার্ষদ শ্রীমুরারি গুপ্তের রচিত আক্ষেপানুরাগের পদ গাহিতে লাগিলেন — “সখি হে ফিরিয়া আপন ঘরে যাও”, আসরের নরনারী যেন অস্থির হইয়া উঠিলেন ৷ মধুকণ্ঠ গায়ক গণেশ দাস— ভাবোদ্বেলিত কণ্ঠে গাহিলেন— “স্রোত বিঘার জলে এ তনু ভাসায়েছি কি করিবে কুলের কুকুরে ৷” আমি আখর দিলাম “বৃথা চীৎকার করবে ৷ কুলে ঘুরে মরবে”৷ গণেশ দাস প্রণাম করিয়া দুই-তিনবার আখরটি গাহিলেন ৷ আসরে হরিধ্বনি উঠিল ৷ বামাচরণ বসুসার্থক আখর সার্থক আখর বলিয়া পদধূলি গ্রহণ করিলেন ৷
পদাবলী বি. এ., এম. এ. শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীগণের পাঠ্য হইয়াছে ৷ শিক্ষিত সমাজ কীর্তনের সমাদর করিতেছেন ৷ ছাত্রছাত্রীগণ কীর্তন শিখিতেছেন ৷ এই পরিবেশে কীর্তনের আখরকে নূতনরূপে উপস্থাপিত করিবার দিন আসিয়াছে ৷ পদাবলীর ভাষা ও ছন্দের সঙ্গে মিল রাখিয়া পদের অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনাকে পরিস্ফুট করিবার জন্য নূতন আখরের সৃ্ষ্টি করিতে হইবে ৷ সেই সঙ্গে পদাবলীর কবিত্ব, বৈষ্ণব পদাবলীর আচার্য-সম্মত সিদ্ধান্ত প্রভৃতির কথাও মনে রাখিতে হইবে ৷ এই পথে সুরকার, কীর্তনগায়ক, সুরসিক সাহিত্যিক এবং বৈষ্ণব-শাস্ত্রজ্ঞ—সকলেরই সহযোগিতা প্রয়োজন ৷
রসিক দাসের শিষ্য অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তাঁহার শিষ্য নন্দকিশোর দাস ৷ নন্দকিশোরের শিষ্য রথীন ঘোষ ৷ আমি এই চারি পুরুষের গান শুনিতেছি ৷ “ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার তিলে তিলে আইসে যায়”— শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগিণী শ্রীরাধার পূর্বরাগের এই পদে রথীন ঘোষ আমার শিখানো আখর দেন— “দণ্ডে শতবার রে, আসে আর যায় দণ্ডে শতবার৷” (কোথায় আসে কোথায় যায় ?) “অন্তপুর আর বাহির দুয়ার৷” ( কে যায় আসে ? যিনি রাজাবরোধে বন্দিনী) “আঙ্গিনা বিদেশে যাহার ৷” আমার মনে হয় এখন এইরূপ আখরেরই প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হইয়া দাঁড়াইয়াছে ৷
শোরী মিঞার টপ্পা শুনিয়াছিলাম কোন গায়কের মুখে—
কাগা তুম্‌ সব খাও
মেরা নজর বাঁচাকে,
পিয়াকো দেখনে আশ ৷
ইহারই আবার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া রকমারি পুনরাবৃত্তি — “কাগা তুম সব খাও, চুন্‌ চুন্‌ মারো, স্রিফ নজর বাঁচাকে , পিয়াকো দেখনে আশ ৷”
একবার কলিকাতায় এক কীর্তনায়ার আসর হইতে উঠিয়া আসিয়াছিলাম ইহারই অনুবাদ শুনিয়া — শ্রীরাধার উক্তি মাথুর গানে—

সর্ব অঙ্গ খেয়োরে কাক
না খেয়ো মোর আঁখি ৷
ব্রজে এলে শ্যাম যেন
তার রূপ দেখি ৷৷

আমাদের গ্রামে একটি বালক-সঙ্গীতের কৃষ্ণযাত্রার দল আসিয়াছিল ৷ আমি মাথুর গান শুনিতে ভালবাসি না ৷ তথাপি অধিকারীর বিশেষ অনুরোধে আসরে গিয়া বসিলাম, অধিকারী মাথুর পালা আরম্ভ করিলেন ৷ কিছুক্ষণ পরে শুনিলাম যে ছেলেটি শ্রীরাধা সাজিয়াছে, সে ঠিক ঐ আখরই সুর করিয়া আবৃত্তি করিতেছে ৷ আমি উঠিয়া আসিলাম— বলিলাম শরীর ভাল নাই ৷ এক শিখ বন্ধুর নিকট শুনিয়াছিলাম — গ্রন্থসাহিবে শেখ ফরিদের একটি শ্লোকের অংশ আছে, তাহার অনুবাদ — “কাক তুই আমার অস্থিপঞ্জর খুঁড়িয়া সকল মাংস খাইয়াছিস্‌ ৷ আমার এই চোখ দুটি স্পর্শ করিস্‌ না ৷ কারণ, আমি এখনো প্রিয়কে দেখিবার আশা রাখি ৷”
শোরী মিঞাই বলুন, আর শেখ ফরিদই বলুন— শ্রীরাধার দেহ কাকে স্পর্শ করিবে, ইহা আমার নিকট একান্তই অসহ্য উক্তি ৷
কোথায় যেন রেডিওতে একদিন কীর্তন শুনিতেছিলাম ৷ গায়িকা বোধ হয় মথুরার দূতীর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে কিছু বলিতেছিলেন ৷ শ্যামচন্দ্র শুনিতে পান নাই, কিংবা না শোনার ভান করিয়াছিলেন, তাই গায়িকা শ্যামকে তিরস্কার করিতেছিলেন— “শ্যাম হয়েছে কালা হাতী ৷” সুরেই তিনি বলিতেছিলেন ৷ প্রথমটা বুঝিতে পারি নাই ৷ দ্বিতীয়বার শুনিয়া বুঝিলাম এবং রেডিওটি বন্ধ করিয়া দিলাম ৷