অনেকে মনে করেন কীর্তন ভাবপ্রধান সংগীত৷ অর্থাৎ চিত্তে বিশেষ বিশেষ ভাব-সৃষ্টিই কীর্তনের প্রয়োজন৷ সুতরাং কীর্তনে সুর ও তাল গৌণ ব্যাপার৷ তালের কথা পরে বলিতেছি৷ কিন্তু সাধারণভাবে ইহা বলা আবশ্যক যে, সংগীতকলা সুর ও তাল ব্যতীত সিদ্ধ হইতে পারে না৷ কীর্তন যদি সংগীতের একটি প্রকারভেদ হয়, তাহা হইলে ইহার সুরশিল্প ও তাল-নৈপুণ্য উভয়ই বিচারের বিষয় হওয়া উচিত৷ সুরের দৈন্য বা অভাব বা ক্রটি থাকিলে সে সংগীতে যে উচ্চাঙ্গের সংগীত বলিয়া পরিগণিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, ইহা এক প্রকার সর্বসম্মত সত্য৷ সুতরাং সংগীতের মধ্যে কীর্তনের স্থান বিচার করিতে হইলে প্রথমেই সুর ও তালের দিকে লক্ষ্য করিতে হইবে৷ ভাবের দোহাই দিয়া সুর ও তালের দায়িত্ব হইতে কোনও ক্রমেই অবসর গ্রহণ করা যাইতে পারে না৷
অনেকের মনে এইরূপ একটা ধারণা আছে যে, যেহেতু কীর্তন ভাবপ্রধান সংগীত সেই হেতু সাধারণ সংগীতের মাপকাঠি দিয়া ইহার বিচার করিতে যাওয়া উচিত নহে৷ এই ধারণা ঠিক কিনা তাহার বিচার করিতে হইলে ‘ভাব’ বলিতে কি বুঝায়, তাহার অলোচনা আবশ্যক হইয়া পড়ে৷ কিন্তু, দুঃখের বিষয়, ‘ভাব’ সম্বন্ধে আমাদের অনেকের মধ্যে কোনও পরিস্ফুট ধারণা আছে বলিয়া বোধ হয় না৷ ‘ভাব’ অর্থ যদি ভক্তি হয়, তবে অবশ্য কীর্তন ভাবময় সংগীত৷ কীর্তন ব্যতীত অন্য সংগীতেও ভক্তির প্রাধান্য যে নাই, তাহা নহে৷ ‘ভাব’ যদি বিহ্বলতা বা আবেশ অর্থে গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলে কীর্তনে যে উহা অধিক পরিমাণে আছে, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই৷ গায়ক বা শ্রোতার মনে যখন এই বিহ্বলতা আসে, তখন আর সুর বা তালের অনুসন্ধান থাকিতে পারে না৷ এরূপ ভাববিহ্বলতা সংগীতমাত্রেই থাকিতে পারে এবং অনেক স্থলে দেখিতেও পাওয়া যায়৷ গায়ক যেন কোনও দৈব প্রেরণার বশীভূত হইয়া তন্ময়ভাবে গান করিতেছেন৷ বস্তুতঃ এইরূপ গানেই মানুষের হৃদয় বিগলিত হয় — সে কীর্তনই হউক, বাউলই হউক বা উচ্চাঙ্গের বৈঠকী সংগীতই হউক৷ কীর্তনগায়কের সুরশিল্পে এই লক্ষ্যটি থাকে, একথা স্বীকার করা যাইতে পারে৷ কিন্তু তাহাতে সুর ও তালের প্রতি উপেক্ষা আছে, এরূপ বলা চলে না৷
‘ভাব’ বলিতে যদি মনোভাব বুঝায়, তাহা হইলে অর্থের কথা আসিয়া পড়ে৷ অর্থাৎ এই প্রশ্ন উঠে যে, সংগীতে সুর প্রধান অথবা কথা প্রধান? সুর এবং কথার সম্বন্ধ লইয়া অনেক তর্ক-বিতর্ক এ-পর্যন্ত হইয়াছে । বিশেষজ্ঞেরা এসম্বন্ধে একমত হইতে পারেন নাই৷ কেহ কেহ মনে করেন যে সেই সংগীতই শ্রেষ্ঠ যাহা কথাকে অতিক্রম করিয়া শুধু সুরের বিনাসুতের মালা গাঁথিতে পারে৷ সুরবিস্তারের দ্বারা যেখানে চিত্তকে অভিভূত করিয়া তোলা যায়, তাহাই সংগীতের আত্মা ‘সুর ও সংগতি’ নামক গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ এইরূপ মত ব্যক্ত করিয়াছিলেন৷ কিন্তু কবিবর মনেপ্রাণে কথা বা কাব্যসংগীতের উপাসক ছিলেন বলিয়া মনে হয়৷ সুরের আবেদন যদি কথার সহযোগে পরিপূর্ণ, নিবিড় ও মর্মস্পর্শী হইয়া উঠে, তাহা হইলে তাহাকে অগ্রাহ্য করা যায় কি ? কীর্তনে সুরের আবেদন যথেষ্ট আছে৷ বৈষ্ণব গীতকারেরা শ্রুতির নিপুণ কারুকার্যে সুরকে পরম উপভোগ্য করিয়া তুলিবার চেষ্টা করেন৷ উচ্চাঙ্গ কীর্তনে সুরের যেরূপ সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখা যায়, তাহাতে একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে সুরকে ইহারা যথেষ্ট উচ্চ স্থানেই বসাইয়াছিলেন৷ কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, কীর্তন শুধু গীত নহে, কীর্তনগন সুরের বিলাসমাত্র নয়, কীর্তনের সুরশিল্প শুধু সংগীতের বিকাশের জন্য কল্পিত নয়৷ কীর্তন সুর, কাব্য ও ধর্মের ত্রিবেণী৷ ইহার কোনটিকে উপেক্ষা করা চলে না৷ সুরের আবেদনে প্রাণ মাতিয়া উঠিবে, কাব্যের অলঙ্কারে ও শব্দের ঝংকারে চিত্ত মুগ্ধ হইবে এবং ধর্মের প্রেরণায় অশ্রু কম্প পুলক প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাব হৃদয়ে জাগিবে— ইহাই সংক্ষেপে কীর্তনসংগীতের অভিপ্রায়৷ কবিগুরু আমাকে নিজমুখে বলিয়াছিলেন যে, পৃথিবীর মধ্যে আর কোথাও এরূপ সমন্বয়ের চেষ্টা দেখা যায় না৷ কথা ও সুর কীর্তনসংগীতে যেভাবে মিশিয়াছে, তাহা বাস্তবিকই চিরদিন ভাবুকজনের বিস্ময় উৎপাদন করিবে৷ একথা ভুলিয়া গেলে চলিবে না যে, শ্রীচৈতন্যের সময় হইতে কীর্তনসংগীত বৈষ্ণবধর্মের প্রধান বাহন হইয়াছে৷ গানের দ্বারা মনঃসংযোগের চেষ্টা, গানের দ্বারা একাগ্রতা আনয়ন, গানের দ্বারা প্রাণে ব্যাকুলতার সৃষ্টি, এক কথায় গানের মাধ্যমে ভজন সাধন উপাসনা— ইহা যেরূপ বৈষ্ণবধর্মেই দেখা যায় এরূপ আর কুত্রাপি নহে৷
‘ভাব’ সম্বন্ধে পূর্বেই অষ্ট সাত্ত্বিকের কথা বলা হইয়াছে৷ সেগুলি এই অশ্রু, কম্প, স্বেদ, পুলক, বৈবর্ণ্য, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ ও প্রলয় বা মূর্ছা৷ কীর্তন এইসকল ভাবের উদ্দীপক৷ এই সকল ভাবকে সাত্ত্বিক বিকার বলা হয় তখনই যখন শারীরিক প্রয়োজনে নিষ্পন্ন না হইয়া ইহারা নির্মল অন্তঃকরণপ্রবৃত্তি হইতে সমুত্থিত হয়৷ সাংসারিক বা শারীরিক কোন দুঃখ নাই,অথচ অবিরলধারে অশ্রু ঝরিতেছে, থাকিয়া থাকিয়া দেহ কাঁপিয়া উঠিতেছে, মূহুর্মূহুঃ রোমাঞ্চ (পুলক) হইতেছে, ঘর্মের উদ্‌গমে শরীর আর্দ্র হইয়া উঠিয়াছে এবং পরিশেষে সংবিৎ লোপ হইয়া গায়কও শ্রোতা ভূতলে লুণ্ঠিত হইতেছেন— এ দৃশ্য কীর্তনের আসরে সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়৷ বিশুদ্ধ অনাবিল সাধুচিত্তবৃত্তি হইতে সমুদ্ভূত বলিয়া ইহাদিগকে সাত্ত্বিক ভাববিকার বলা হয়৷ ইহার সবগুলি ভাবেরই যে একত্র বিকাশ দেখা যায় তাহা নহে৷ ইতিহাস হইতে যতদূর জানা যায় তাহাতে শ্রীচৈতন্যদেবে প্রায়ই এই অষ্ট সাত্ত্বিকের একত্র বিকাশ দেখিতে পাওয়া যাইত৷ এইসকল ভাব নির্মল কৃষ্ণপ্রেম হইতে সঞ্জাত হয়৷ কৃষ্ণনাম শুনিয়া বা শ্রীকৃষ্ণের বিরহে শ্রীরাধার এইরূপ অষ্ট সাত্ত্বিকের উদয় হইত৷ সেইজন্য শ্রীরাধাকে মহাভাব-স্বরূপিণী বলা হইয়া থাকে৷
প্রেমের পরম সার মহাভাব-জানি৷
মহাভাবস্বরূপিণী রাধাঠাকুরাণী
– চৈতন্যচরিতামৃত

শ্রীরাধা যখন কৃষ্ণনাম শুনিয়া অবশ হইতেছেন, তখন এই সাত্ত্বিকভাবের আবির্ভাব বুঝিতে হইবে৷
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে৷
– চণ্ডীদাস

কৃষ্ণনাম শুনিয়া মহাপ্রভুরও এইরূপ আবেশ হইত, সেইজন্য তাঁহাকেও বলা হয় ‘রসরাজ-মহাভাব’৷ ‘রসরাজ’ অর্থে রসিকশেখর বা মূর্তিমান মধুর রস৷
ভাবের আর একটি অর্থ হইতেছে রস৷ অতএব এই প্রসঙ্গে রসের উল্লেখ করা কর্তব্য৷