শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দাভ্যাং নমঃ।।
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্যয়েবচ।
পতিতানাং পাবনেভ্যঃ বৈষ্ণবেভ্যঃ নমঃ নমঃ।।
বন্দিব শ্রীগুরুদেব আনন্দ করিয়া।
পুনঃ পুনঃ প্রণাম করোঁ ভূমেতে পড়িয়া।।
যাহার প্রসাদে সর্ব্ব সিদ্ধি অব্যাহতি।
তাহার চরণ বিনু অন্য নাহি গতি।।
কৃপা করি প্রভু মোরে বৈষ্ণব জানাইলা ।
বৈষ্ণব জানিহ বুলি উপদেশ কৈলা।।
সেই আজ্ঞা বলে লইনু বৈষ্ণব শরণ।
বৈষ্ণব আজ্ঞাতে পাইনু সন্ধান ভজন।।
পতিত পাবন প্রভু বৈষ্ণব গোসাঞি।
যে না ভজে বৈষ্ণব তার কভু সিদ্ধি নাই।।
অনন্য হৈয়া করে বৈষ্ণব শরণ।
সব অকারণ বিনা বৈষ্ণব চরণ।।
সর্ব্বশাস্ত্র জানে করে সদা নিত্য গান।
তথাপি তাহাতে কৃষ্ণের নাহি অবধান।।
কলি প্রতি কহিল প্রভু অনেক বিধানে।
তাহারে বিষয় যাতে কহিল কারণে।।
আমা ভজে যে না পূজে বৈষ্ণব চরণ।
তাহারে বিষয় কর কহিল কারণ।।
তথাহি দশম স্কন্ধে–
নৃত্যন্তি গায়ন্তি জপন্তি নিত্যং যদায়মানাং তবনাম গ্রহণ।
তথাপি লোকানু ভজন্তি ভক্ত্যা নস দৈবম(ন্ত্র) বিষয়ো ভবিষ্যতি।।
অতএব ভজ ভাই বৈষ্ণব চরণ।
কায় মন বাক্যে লও চরণে শরণ।।
বিদ্যা ধন জাতি কুল নাহিক যাহার।
বৈষ্ণব হইলে সেই পূজ্য সভাকার।।
আমি অতি হীন দুষ্ট মোরে কৃপা কৈল।
ইহাতেই বৈষ্ণবের মহিমা জানিল।।
বৈষ্ণব গোসাঞি জাতি কুল নাহি চান।
সবেই এক নামাএ(?) শ্রদ্ধা ভক্তি পান।।
সেই শ্রদ্ধা লক্যে (?) প্রবিষ্ট হয়েন হৃদয়ে।
প্রবেশিয়া হৃদি মাঝে প্রেম প্রকাশয়ে।।
বর্ষান্তের জল বৃষ্টি সদা সেই স্থানে।
বসিতে না পাই হয় পর্ব্বত প্রমাণে।।
কোন স্থানে নীর যদি এক সন্ধি পায়।
তবহি তাহা ভাঙ্গি সকল ভাসায়।।
এমন বৈষ্ণবের শরণ যে না লয়।
অমৃত তেজিয়া যেন বিষ ভক্ষয়।।
মনুষ্য হইয়া যে বৈষ্ণব না ভজিল।
হেনই দুর্লভ জন্ম বৃথা মাত্র গেল।।
দশনে ধরিয়া তৃণ করি নিবেদন।
দম্ভ কপট ছাড়ি ভজ বৈষ্ণব চরণ।।
জানি বা না জানি মুই শ্রীগুরু আজ্ঞায় ।
সব তেজি লইনু শরণ বৈষ্ণবের পায়।।
শরণ লইনু মাত্র বৈষ্ণব চরণে।
কৃপা করি দিলা মোরে ভজন সন্ধানে।।
তাহা পাঞা মোর মনে আনন্দ হইল।
বুঝিব পয়ার করি মনে ইচ্ছা হৈল।।
বুঝিতে নারিলে সুখ নাহি হয় মনে।
নিবেদন কৈল তাহা শ্রীগুরুচরণে।।
মোর মাথে পাদ ধরি আপনে কহিলা।।
বুঝহ পয়ার করি মোর আজ্ঞা হৈলা।।
বৈষ্ণবের প্রাঙ্গণে বদরি মূলে বসি।
এই আজ্ঞা দিলা মোরে কৃপা দৃষ্টে হাসি।।
শ্রীগুরু আজ্ঞায় মোর এতেক সাহসা।
বৈষ্ণব চরণে তেঞি এতেক ভরসা।।
শ্রীব্রজ মণ্ডল আগে করিব বর্ণন।
স্বয়ং ভগবান মাতে ব্রজেন্দ্র নন্দন।।
তার মধ্যে বৃন্দাবন করিব বর্ণন।
অনুক্ষণ যাঁহা রাধাকৃষ্ণের ক্রীড়ন।।
নন্দাদি বন্দিব আগে আর যশোমতি।
সব মতে জানেন যেহোঁ কৃষ্ণের পিরিতি।।
শ্রীকুণ্ডের গোবর্ধন বন্দিব একমনে।
নিত্যলীলা কৃষচন্দ্র করে যেই খানে।।
শ্রীকুণ্ডের মহিমা আমি কি কহিতে জানি।
সেই সব লিখি যাহা সাধু মুখে শুনি।।
শরণ লইনু মুঈ অষ্ট সখীর পায়।
অষ্ট সখীর কুঞ্জ আগে করিব নির্ণয়।।
আগেতে করিব শ্রীকুণ্ডের বর্ণন।
অত্যন্ত প্রেয়সী কৃষ্ণের হয় সেই জন।।
কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় রাধাঠাকুরাণী।
অতএব কুণ্ডের মহিমা শাস্ত্রেতে বাখানি।।
তথাহি —
যথা রাধা প্রিয়া বিষ্ণোস্তস্যা কুণ্ডং প্রিয়ং তথা।
সর্ব্ব গোপীসু সৈবৈকা বিষ্ণোরত্যন্তবল্লভা।।
চারিদিকে রতনের বান্ধা চারি ঘাট।
প্রতি ঘাঠ উপরেতে মণ্ডপ সুঠাট।।
রত্নময় বান্ধা তাহাঁ তাহার উঠান।
ঘাটের দুই পাশে মণি কুটির সুঠান।।
মণ্ডপের পাশে আছে বৃক্ষ শাখাগণ।
নানা পুষ্পে নানা বস্ত্রে হিল্লোলা দোলন।।
দক্ষিণে চম্পক বৃক্ষ রত্ন হিল্লোলা।
রাধাকৃষ্ণ সেই স্থানে করে নানা খেলা।।
পূর্ব্বে অগ্নি কোণে শ্যামকুণ্ড মধ্যে রত্নস্তম্ভ ।
মধ্যে সেইত বন্ধে আছে অবলম্ব।।
কুঞ্জ বেষ্টিত নানা বৃক্ষ শোভে মনোরম।
প্রতি মূল রত্নে বান্ধা বেদি সর্ব্বোত্তম।।
রাধাকৃষ্ণ সেই রত্ন বেদির উপরে।
সখিগণ আছে তাহা আনন্দে বিহরে।।
মাণিক কুটির আছে প্রতি বৃক্ষ মূলে।
রাধাকৃষ্ণ বসি তাহা চারিদিগ ভালে (?)।।
গলা সম উচ্চ কেহো নাভি প্রমাণ।
কোন কোন বেদি হয় বুক সমান।।
আর কোন বেদি হয় জানু প্রমাণ।
অতি বিলক্ষণ বেদি দেখিতে সুঠান।।
কুণ্ড চারিকোণে শোভে মাধবীর কুঞ্জ।
চতুঃশালা বেষ্টিত রাসমণ্ডপ বহু পুঞ্জ।।
অশোক কেশরাদি করিয়া অনেক।
লিখিতে না পারি পুষ্প আছয়ে যতেক।।
তাহা বই কদলি বৃক্ষ কুঞ্জ বেষ্টিত।
থরে থরে শোভে পাকা কাঁচা ফল সহিত।
তাহার বাহিরে আছে বেষ্টিত পুষ্পবন।
দেখিতে সুন্দর অতি সব উপবন।।
কুণ্ডের উপরে রত্ন মন্দির আছএ।
কুণ্ড বনে ছয় ঋতু মূর্ত্তিবন্ত সেবএ।।
বৃন্দা দেবী শ্রীকুণ্ড সেবা করে সর্ব্বক্ষণ।
অতি সুগন্ধিত জলে করে সম্মার্জন।
হিল্লোলাদি পদ্ম মণ্ডপাদি করিঞা ।
সংস্কার করিল বৃন্দা আনিন্দিত হঞা।।
উড়েত ফুল গুচ্ছ পতাকা সহিত।
অপূর্ব্ব ফুলের ঝারা তাহাতে শোভিত।।
তার মধ্যে লীলাকুঞ্জ অতি বিলক্ষণ।
অত্যন্ত সুগন্ধ কুঞ্জ গন্ধে হরে মন।।
বাসিত সুগন্ধি পুষ্প শয্যা তার মাঝে।
নীল পীত শ্যাম শ্বেত পুষ্প তাহাঁ সাজে।।
মধু তাম্বুল পাত্র আদি অনেক আছয়।
কুঞ্জ দাসী শত শত চরণ সেবয়।।
পুষ্প তুলি সেবাযোগ্য সামগ্রী করণ।
যেই আজ্ঞা হয় তাহা আনি শীঘ্র দেন।।
কুঞ্জবেষ্টিত পুষ্প বাটি বহুত আছয়।
লখিতে না পারি সব চিদানন্দ ময়।।
আর যত উপবনে সামগ্রীরমূল।
যখন যে চাহি তাহা আছয়ে সকল।।
সেইখানে বৃন্দা দেবী নিজগণ লঞা ।
শ্রীরাধাকৃষ্ণ সেবা করে আনন্দিত হঞা।।
সেই কুণ্ডের জলে আছে কহলর রক্তোৎপল।
পুণ্ডরীক পদ্ম সুগন্ধি কেসরাদি সকল।।
তাহাতে কুণ্ডের জল সদা সুগন্ধিত।
নানা বর্ণ ডাহুকি হংস তাহাতে শোভিত।।
সারসের শব্দে আর কোকিলের গানে।
সুললিত শব্দ শুনি জুড়ায় শ্রবণে।।
বৃক্ষে শুক শারী সব আনন্দিত হঞা ।
রাধাকৃষ্ণ গুণ গায় পুলকে পুরিঞা।।
ময়ূর ময়ূরী কৃষ্ণ কান্তি দেখিঞা।
তারা সব নৃত্য করে আনন্দিত হঞা।।
পত্রের লহরি কিবা ডাল সুশোভিত।
চাতকাদি পক্ষি শব্দ করে সুললিত।।
শ্রীরাধাকৃষ্ণের মুখ কোটি চন্দ্র শোভা।
চকোর চকোরী তাহে অতি মনলোভা।।
শ্রীগুরু বৈষ্ণব পাদ পদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল শ্রীকুণ্ডের আখ্যান ।।
শ্রীকুণ্ড বেষ্টিত অপূর্ব্ব কুণ্ড শোভয়।
অষ্ট দিগে অষ্ট সখীর কুঞ্জ আছয়।।
মদন সুখদা কুঞ্জ কুণ্ড ঈশানে।
বিশাখা নন্দদা কুঞ্জ তার নামে।।
বিশাখার শিষ্য এক নাম মঞ্জুমুখী।
কুঞ্জ সংস্কার করে হঞা বড় সুখী।।
কুঞ্জে নানা বৃক্ষ আছে পুষ্প সুসার।
তাহার সৌরভে অলি করয়ে ঝংকার।।
আনন্দিত হঞা ভৃঙ্গ করে মধুপানে।
শ্রবণ প্রফুল্ল হয় কোকিলের গানে।।
নানা মত কুটির তার দ্বার সুন্দর।
দিব্য শয্যা রচন আছে তাহার উপর।।
অতি সে সুন্দর কুঞ্জ শোভে মেঘবর্ণ ।
সে কুঞ্জে বিহরে রাধা মদনমোহন।।
আনন্দে লহরি সব বরিখএ পুঞ্জে।
শ্রীবিশাখার নিজ মন্দির সেই কুঞ্জে।।
বিশাখার যত সখী তার করি লেখা।
মাধবী মালতী আর গন্ধ রেখিকা।।
কস্তুরী হরিণী বলি আর যে চপলা।
সুরভি শোচনাদি এই যূথ মেলা।।
কুণ্ডের পুর্ব্ব দিগে কুঞ্জ আছে চিত্র নাম।
শ্রীচিত্রাঠাকুরাণী কুঞ্জ বৈচিত্র নাম।।
চিত্রবর্ণ দেখি সব ভ্রমরের গণ।
চিত্র কুটির চতুঃশালা চিত্র প্রাঙ্গণ।।
চিত্র মণ্ডপ চিত্র হিল্লোলাদি করিঞা ।
সকল আছয়ে তাতে আবৃত হইঞা।
অপূর্ব্ব সে কুঞ্জ দেখি হয় চমৎকার।
নানা বর্ণে একত্র হইলে চিত্রবর্ণ নাম তার।।
চিত্রার যূথ কিবা বর্ণিবারে জানি।
রসালিকা তিলোকনী আর সৌরসেনী।।
সুগন্ধিকা বাসিনী আর কামনাগরী।
নাগরী নাগবেণী এই অষ্ট লেখা করি।।
মনোহর কুঞ্জ আছে কুণ্ডের অগ্নিকোণে।
ইন্দুরেখার সুখদা কুঞ্জ আছে সেই স্থানে।।
চন্দ্র কান্তি কুঞ্জের নাম ফটিক স্তম্ভিত।
ফটিক চৌথর সব দেখিতে শোভিত।।
শ্বেত পদ্ম মল্লিকা কুন্দ কিরণ আদি।
লতা পত্র কোকিল শুক শারি ভ্রমরাদি।।
সে স্থানে যাহার স্থিতি সেই শ্বেতবর্ণ।
পক্ষ পরিজ্ঞান (?) নিজ শব্দ হয় পূর্ণ।।
পূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণ শুক্ল বর্ণ ধরিঞা।
নানা লীলা রস করে সখিগণ লঞা।।
ক্রীড়া কালে যদি কেহ যায় সেই স্থানে।
অনুগা বিহীনে কেহ না পায় দর্শনে।।
শুভ্র কেলি শয্যা তথা দেখিতে মনোরম।
পূর্ণতা তাহে আছে ইন্দুরেখার নাম।।
শ্রীইন্দুরেখার যূথ কহিতে না আঁটি।
তুঙ্গভদ্রা রসতুঙ্গা আর রঙ্গবাটি।।
সুসঙ্গতা চিত্ররেখা আর সুচিত্রাঙ্গী।
মদনী মদনালসা এই সব সঙ্গী।।
চম্পকানন্দদা কুঞ্জ শ্রীকুণ্ড দক্ষিণে।
চম্পকলতার সুখস্থল হেমকুঞ্জ নামে।।
পাকশালা আছে মধ্যাহ্ন তাহাঁ হয়।
ভোজন বেদিকা এক তাহাতে আছয়।।
নিজ সখি সঙ্গে তেহোঁ করেন গমন।
কদাচিত কোনদিন করেন ভোজন।।
শ্রীরাধিকা নিজসখিগণ লঞা সঙ্গে।
আশ্চর্য্য কুঞ্জের শোভা দেখে নানা রঙ্গে।।
স্থান হেম বৃক্ষলতা হেমের আকার।
হেমবর্ণ শুক শারী কোকিল ভ্রমর।।
মণ্ডপাদি কুটির চত্বর প্রাঙ্গণ।
হেম পার্ষদ সব দেখিতে হেমবর্ণ।।
বস্ত্রভূষা হেম বর্ণ কুঙ্কুম বিলেপনে।
গৌরাঙ্গ বেশ ধরেন শ্রীকৃষ্ণ আপনে।।
প্রেম আলাপন শুনেন আনন্দিত হঞা ।
রাধাকৃষ্ণ তাহা একাসনেত বসিঞা।।
ইহা দেখি চন্দ্রাবলীর প্রিয় সখি সখা।
ঈর্ষা করি জটিলা স্থানে কহে গিয়া কথা।।
আমরা কহিলে তুমি মান মিথ্যা করি।
আইস দেখাব তোমার বধুর চাতুরী।।
আপনে আসিয়া তবে দেখ দুই জনে।
দুই জনে বসিয়াছে এক সিংহাসনে।।
এত শুনি জটিলা অতি ত্বরায় আসিঞা ।
দেখেন শ্রীরাধা আছেন একলে বসিঞা।।
গৌরবর্ণ দেখি পদ্মাকে কুটিল জানিঞা।
শ্রীমতীকে আশীর্ব্বাদ যায়েন করিঞা।।
চম্পকলতার শুন কহি যূথ মেলা।
কুরঞ্জাক্ষি সুচরিতা আর মণি কুন্তলা।।
মণ্ডলী চন্দ্রিকা আদি চন্দ্র তিলকা।
কুরঞ্জাক্ষি সুমন্দিরা এই অষ্ট লেখা।।
কুণ্ডের নৈঋতে রঙ্গদেবীর কুঞ্জ শ্যামল।
রাধাকৃষ্ণের সেই কুঞ্জ অতি প্রিয় স্থল।।
তরুলতা বর্ণ সব শ্যামল আকৃতি।
সুন্দর শোভয়ে লতা শ্যামল আকৃতি।
শ্যামবর্ণ কুটির কুঞ্জ শ্যাম চৌথর।
ইন্দ্রনীল মণি প্রায় নব নিদকর (?)।।
প্রত্যেক পত্র পুষ্পে মধু শ্রবে অনুক্ষণ।
এইমত এই কুঞ্জের অপূর্ব্ব কথন।।
ইন্দ্রনীল পক্ষ লতা ভ্রমরাদি গণ।
অন্তঃপুর কুটির ভূমি চত্বর প্রাঙ্গণ।।
প্রবেশমাত্র রাধাকৃষ্ণ যুগল ভাব হয়।
সকল শোভয় তায় শ্যাম বর্ণ ময়।।
ইথে মধ্যে কার্ত্তিকা আইসে দেখিতে।
দেখিয়া যায়েন মাত্র না পারে লখিতে।।
কেবল সে শ্রীকৃষ্ণকে একলা দেখিল।
শ্রীমতী কৃষ্ণের সঙ্গে লখিতে নারিল।।
লখিতে না পারে যবে কৃষ্ণের সহিতে।
তাহাতে আনন্দ রাধা ডবিলা রসেতে।।
রঙ্গদেবীর কুঞ্জ ক্রীড়া রসের মহিমা।
নানা সুখে ভোর কৃষ্ণ পাসরে আপনা।।
শ্রীরঙ্গদেবীর কহি যত যূথ মেলা।
কলকঞ্চি শশিকলা আর যে কমলা ।।
মধুরিমা ইন্দিরাদি কন্দর্প মঞ্জরী।
কামলতিকা আর প্রেমমঞ্জরী।।
শ্রীকুণ্ড পশ্চিমে আছে আনন্দের পুঞ্জে।
অনঙ্গাম্বুজ শ্রী তুঙ্গবিদ্যার কুঞ্জে।
অরুণানন্দ কুঞ্জ অরুণ সকলি।
বৃক্ষলতা পত্র অরুণ পুষ্পাবলি।।
পক্ষ ভৃঙ্গ মৃগ আদি সকলি অরুণ।
মণ্ডপ হিল্লোলা কুটির চত্বর প্রাঙ্গণ।।
অরুণ বর্ণ ধরে সভে কুঞ্জ প্রবেশিতে।
অরুণ কান্তি ধরে রাধা কৃষ্ণের সহিতে।।
আপনার যূথ সঙ্গে থাকেন তুঙ্গবিদ্যা।
মঞ্জুমেধা সুমধুরা আর সুমধ্যা।।
মধুরেখা তনুমধ্যাদি মধুষ্টদা।
গূণচূড়াদি যূথ আর বরাঙ্গদা।।
শ্রীকুণ্ডের বায়ু কোণে সুদেবীর ধাম।
অত্যন্ত সুখদস্থল হরিত কুঞ্জ নাম।।
হরিত পুষ্প লতাবৃক্ষ তরুর সহিত।
পক্ষ ভৃঙ্গ মৃগ আদি সকল হরিত।।
কুটির আভা রার্য্য (?) চত্বর জগত মোহন।
শ্রীরাধাকৃষ্ণের পাসা খেলার সেই স্থান।।
সুদেবীর যূথ হয়েন মঞ্জুবেশী।
… … আর যে সুকেশী।।
মঞ্জুকেশী হারহিরা আর মহানিরি।
হারকঞ্চি মনোহরা অষ্ট সহচরি।।
শ্রীকুঞ্জ উত্তরে কুঞ্জ ললিতানন্দদা।
অনঙ্গাম্বুজ নাম ধরেন তেহোঁ যে সর্ব্বদা।।
কিবা সে আশ্চর্য্য কুঞ্জ কন্দর্প জিনি আভা।
শ্রীকুণ্ডের যেমতি তার শোভা।।
শ্রীরাধাকৃষ্ণের যত লীলা হয় সেই স্থানে।
বিশেষিয়া সে সব লীলা না যায় লিখনে।।
সেই কুঞ্জ স্থান হয় কণিকা আকার।
ইহারে বেষ্টিত অষ্ট কুঞ্জ আছে আর।।
তাহার বাহিরে অষ্টদিগে আছে কুঞ্জ।
অপূর্ব্ব সুঠান আছে চৌরাশি কুঞ্জ পুঞ্জ।।
পদ্ম মন্দির শোভে তার নৈঋত কোণে।
অগ্নি কোণে অষ্ট দল হিল্লোলাদি লিখি ক্রমে।।
শ্রীললিতার কুঞ্জ আগে করিব বর্ণন।
যেমত যে কুঞ্জ তার যথা যথা ক্রম।।
শ্রীকুঞ্জ হইতে অন্য কুঞ্জ যাইতে।
কিম্বা অন্য কুঞ্জ যাইতে অন্য কুঞ্জ হইতে।।
ভিতরে আছয়ে পথ অন্য কুঞ্জ যাইতে।
অন্যান্য লোক কেহ না পারে লখিতে।।
তার মধ্যে আছে নানা বৃক্ষ সকল।
মণি মরকত বান্ধা যত পথস্থল।।
ফটিক মানিক দুই পাতে দেয়ালের ক্রম।
অন্যোহন্য লোক যাইতে পথ হয় ভ্রম।।
এই ক্রমে ক্রমে স্থান দ্বার আছয়।
আশ্চর্য্য কুঞ্জের কথা কহিল না হয়।।
অনঙ্গাম্বুজ কুঞ্জ এই করিল বর্ণনা।
সুন্দর চত্বর তার অষ্ট দল তুল্য ঘনা (?) ।।
সুবর্ণ রম্ভা তুল্য প্রায় তাহার কেশর।
অষ্ট দলে অষ্ট কুঞ্জ পশ্চাত বর্ণিব সকল।।
একত্রে লিখিলে ইহা বুঝিতে না পারি।
অতএব কর্ণিকার আগে বর্ণনা করি।।
সুন্দর কুটির তাহে শোভে কর্ণিকায়।
পুষ্পকুটির ষষ্ট দল পদ্ম প্রায়।।
রাধাকৃষ্ণ সমুচিত লীলা করএ যখন।
লঘু বিস্তারিত তেহোঁ হএন তখন।
ললিতার শিষ্য তিহোঁ নাম কলাবতী।
এ কুঞ্জ সংস্কার তেহোঁ করে নিতি ।।
শ্রীললিতার যূথ যত কহিয়ে বিবরি।
রত্নসুভদা রত্নপ্রভা রতিকলা আদি করি।।
সুভদ্রা সৌর প্রভা অরা সুভগা সুমুখী।
কলহংসী কলাপিনী এই যূথ লেখি।।
ছয় পূর্ণ ধাতু সর্ব্ব কেলি ঘন স্থল।
মাণিক্য কেজুর (?) সর্ব্বকান্তি অত্যন্ত শীতল।।
সর্ব্বগুণ যুক্ত অতি মাধুর্য্য নির্ম্মল।
তার বাহ্যে প্রবাল বান্ধা আছয়ে মণ্ডল।।
দেব মনুষ্য পক্ষ আছয়ে লিখন।
স্ত্রী পুরুষ ক্রীড়া যুত … কারণ।।
শ্রীগুরু বৈষ্ণব পাদপদ্ম করি ধ্যান।
অনঙ্গাম্বুজ কুঞ্জ এই করিল বর্ণন।।
ললিতানন্দদা কুঞ্জের বায়ুকোণে।
আর এক কুঞ্জ আছে বসন্ত সুখদা নামে।।
আর অষ্ট কুঞ্জ তার হয় আবরণ।
মধ্যে আছয়ে কুঞ্জ কর্ণিকার সম।।
অলিকুল ভ্রমে পুষ্প মধুপান লোভে ।
নানা পক্ষগণ কত থরে থরে শোভে।।
অষ্ট দলে অষ্ট পদ্ম বর্ণ পদ্ম প্রমাণ ।
ডাহুকাদি হংস সারস ডাক এ সুতান।।
ময়ূরাদি শুকশারী গায় দোহাঁর গুণ ।
রাধাকৃষ্ণ শুনি তাহা অতি সুখ পান।।
পূর্ব্বে কহিয়াছি পদ্ম মন্দির করিএ বর্ণনে।
ললিতানন্দদা কুঞ্জের নৈঋত কোণে।।
বিলক্ষণ পদ্ম মন্দির তাহাই শোভিত ।
ষোলপত্র পদ্ম তুল্য মণিতে রচিত।।
চারিদিগে দেয়াল আছে চারি পাট।
চারিদ্বার চারিদিগে দেখিতে সুঠাট।।
তাহাতে ঝরোকা আছে অতি বিলক্ষণ ।
তাহার নিগূঢ় লীলা দেখে সখীগণ।।
সে মন্দিরের দেয়ালে চিত্র লেখা আছে কত।
পূর্ব্ব রাগের চেষ্টা বিলাসাদি যত।।
পুতনাদি অসুর কৃষ্ণ যতেক বধিল।
দিয়ালের ভিত্তে চিত্র লেখিয়াছে সকল।।
রতুমন্দির মধ্যে অট্টালিকা অতি উচ্চ ঘর।
রত্ন স্তম্ভ পাতি উপরে দেয়ালের থর।।
ফটিক প্রবাল স্তম্ভ আছে সারি সারি।
চালের উপরে আছে মণিরত্ন ভরি।।
রত্ন স্তম্ভ আদি করি তাহার উপরে।
কোটি সূর্য্য জিনি সেই অতি শোভা করে।।
দূরবন দেখি সেই মন্দিরে চড়িঞা ।
তার তলে ছোট ছোট কুটির বেড়িয়া।।
চারিদিগে রত্ন উচ্চ গলা সম।
বৃক্ষগণ শোভে তাহা অট্টালি সমান।।
পুষ্প যুক্ত তরুগণ অতি মনোরম।
নানা কেলি করি সে স্থানে নিরন্তর।।
এ কুঞ্জ হইতে যান করিবারে লীলা।
ললিতানন্দদা কুঞ্জের অগ্নি কোণেতে হিন্দোলা।।
রত্ন কুটির তাহা আছয়ে প্রত্যক্ষে।
পশ্চিমে আছয়ে তাঁহা বকুলের বৃক্ষে।।
অতি উচ্চ বৃক্ষ পূর্ণ পুষ্প শাখাময়।
মিলিঞা আছয়ে মণি মণ্ডপের প্রায়।।
তার মাঝে হিল্লোলিকা ডালের গোড়াতে।
পট্ট বস্ত্রে খুরা বান্ধা সুন্দর দেখিতে।।
মণ্ডপ কুটির যত আছএ প্রমাণ।
এই হিল্লোলিকা উচ্চ নাভি সমান।।
পদ্মরাগ হিল্লোলিকা প্রাচীর আটপাট।
একহাত উচ্চ প্রবালের লাল পাট।।
আশ্চর্য্য হিল্লোলা ষোল পত্র পদ্মাকার।
রত্ন সমূহ চিত্র কর্ণিকা আকার।।
দুই খুরা কাছে এক এক দল প্রায়।
অষ্ট দিগে অষ্ট দ্বার অতি শোভা পায়।।
দক্ষিণ দিগে দুই দ্বার আছে করিতে আরোহণ।
ছোট ছোট স্তম্ভ আছে পিঠে দিবারে হেলন।।
তার মধ্যে বসিতে আসন আছয়ে পট্টলি ।
উপরে চান্দয়া গাঁথা মুকুতার ঝুরি।।
অষ্ট কুঞ্জ মাঝে অষ্ট সখী সুশোভন।
শ্রীরাধা সট কোন মধ্যে বিলক্ষণ।।
ইহা পূর্ব্ব দলের কথা কি কহিতে জানি।
শ্রীঅনঙ্গমঞ্জরি যাতে সর্ব্ব সিদ্ধ শিরোমণি।।
যে জন যে সেবা চান তারে দেন করি কৃপা।
সভার আরাধ্য তেহোঁ হরে গুরুরূপা।।
তাঁর সখিগণ করে আনন্দে দোলনা।
শ্রীরাধাকৃষ্ণ আনন্দে তাহাঁ খেলেন ঝুলনা।।
সেখানে অদ্ভুত এক হয় লীলা সার।
সব সখি জানে দুহাঁ সমুখে আমার।।
কিবা সে স্থানের সুখ মদন দোল নামে।
রাধাকৃষ্ণ দোলে সদা খেলে সেই স্থানে।।
যুগল সেই রাধাকৃষ্ণ বিহার কারণ।
শ্রীবলরাম দোসর তাহাঁ নাম ধারণ।।
ললিতানন্দদা কুঞ্জ তাহার ঈশানে।
আর এক কুঞ্জ আছে অতি মনোরমে।।
মাধবী কুঞ্জশালা অষ্ট দল প্রায়।
গঠন দেখিতে মন মজি রহু তায়।।
অষ্ট পত্রে অষ্ট কুঞ্জ মধ্যে কর্ণিকা আছয়।
এই কুঞ্জে নয় কুঞ্জ আবরণ হয়।।
মূল হৈতে তাহা সর্ব্ব আছে বৃক্ষ লতা।
অগ্নি কোণ মধ্যে এক কর্ণিকা আছে তথা।।
মাধবানন্দ হয় সেই কুঞ্জের নামে।
রাধাকৃষ্ণের সেই কুঞ্জ অতি প্রিয় স্থানে।।
কুঞ্জলীলা করে কৃষ্ণ সখিগণ সঙ্গে।
আনন্দে বিহার করেন নানা ক্রীড়া রঙ্গে।।
ললিতানন্দদা কুঞ্জ তাহার উত্তরে।
শ্বেত পদ্ম অষ্টকুঞ্জ আছে মনোহরে।।
মধ্যে কর্ণিকা এক সুবর্ণ আকার।
তাহা বেড়ি অষ্ট কুঞ্জ শ্বেত পদ্মাকার।।
শ্বেত বর্ণে শোভে তাহা সব তরুবর।
শ্বেত লতা শাখা পুষ্প সকলি সুন্দর।।
চন্দ্রকান্তি সম আছে তাহার ভিতরে।
প্রদীপের অপেক্ষা তাহা কেহ নাহি করে।।
নানা বিলাস রাধাকৃষ্ণের হয় সেই কুঞ্জে।
মধ্যে কর্ণিকা আকার হয় সেই পুঞ্জে।।
পূর্ব্বে করিয়াছি আমি এ সব উক্তি।
এই নব কুঞ্জ অতি শোভাকার যুক্তি।।
নানা মণি মরকতে ভিতর সুগঠন।
তমালের বৃক্ষ বেড়া অতি সুগঠন।।
অতি সুগন্ধিত স্বর্ণ পুষ্প তায় শোভা।
তাহাতে ভ্রময়ে ভৃঙ্গ মধুপানে লোভা।।
উপকুঞ্জ এক নীল পদ্ম দলাকার।
আর এক কুঞ্জ স্বর্ণ কর্ণিকার।।
এই নয় কুঞ্জের হইল এ গণন।
রাধাকৃষ্ণ ক্রীড়া করেন যখন যেমন।।
যখন যেমন কৃষ্ণ সময় বুঝিয়া ।
রাধাকৃষ্ণ ক্রীড়া করেন রাজ কুঞ্জে গিয়া।।
ললিতাত্তদদা নাম কুঞ্জের দক্ষিণে।
রত্ন পদ্ম প্রায় স্থল অতি বিলক্ষণে।।
অষ্টদিগে অষ্ট কুঞ্জ মধ্যে কর্ণিকা হয়।
অত্যন্ত অদ্ভুত কুঞ্জ পদ্মরাগ প্রায়।
লবঙ্গ লতায় বেড়া অতি মনোরমে।
সুগন্ধি কুসুমে কুঞ্জ পূর্ণ সর্ব্বক্ষণে।।
মধুপানে মত্ত প্রায় ফিরে ভৃঙ্গগণ।
রাধাকৃষ্ণ প্রত্যহ তাহা করেন ক্রীড়ন।।
ললিতানন্দদা নাম কুঞ্জের পশ্চিমে।
আশ্চর্য আছয়ে কুঞ্জ হেমাম্বুজ নামে।।
তাহা অষ্ট দল বর্ণ আছে পদ্মাকার।
(উপ) কুঞ্জ অষ্ট মধ্যে এক কুঞ্জ কর্ণিকার।।
স্বর্ণ পদ্ম প্রায় অতি হয় সুশোভন।
… … … বেষ্টিত চারিকোণ।।
পুষ্প যুক্ত হঞা (আচ্ছাদিত) বৃক্ষগণ।
শাখা পত্রে বেষ্টিত মণ্ডপ … আছন।।
শুকশারী পক্ষ আদি ভ্রমরের গীত।
মৃগ আদি শব্দ করে অতি সুললিত।।
তাহার ভিতরে দিব্য হয় সুরচনা।
নানা রত্নে বিচিত্র তাহাঁ অষ্টাদি রচনা।।
এইত মুঞি কহিল কুঞ্জের গণন।
সখি বিনে ইহা নাহি জানে অন্য জন।।
শ্রীলোকনাথ গোসাঞির পাদ পদ্ম আশ।
কুঞ্জবর্ণন গাহে নরোত্তম দাস।।

ইতি কুঞ্জবর্ণন সমাপ্ত।।

(ক. বি. ১১৫0 পুথি হইতে আদর্শ পাঠ গৃহীত)