গীতগোবিন্দে ক্রমিক পদগান বা অষ্টপদীর রীতি অনুসারে রাগ ও তালের নাম ও রূপের পরিচয় দেবার চেষ্টা করবো৷ যে কটি অভিজাত শাস্ত্রীয় রাগ ও তালের সন্নিবেশ আছে গীতগোবিন্দের পদগানগুলিতে, সেগুলির সঙ্গে অন্যান্য বিচিত্র রাগ ও তালকে সম্পর্কিত করা হয়েছে পরবর্তী কৃষ্ণকীর্তন অপেক্ষা ও মহাজন পদাবলীকীর্তনে ৷ সুতরাং পদাবলী কীর্তনের রাগ ও তালের বিশেষ অনুশীলন করার প্রসঙ্গে গীতগোবিন্দ-পদগানের রাগ ও তাল-সম্বন্ধে আমাদের সম্যকজ্ঞান থাকা প্রয়োজন ৷
গীতগোবিন্দে (রাণা কুম্ভা বলেছেন “অষ্টপদী”) মোট চব্বিশটি গানের সমাবেশ আছে এবং সে চব্বিশটি গান বা অষ্টপদী দ্বাদশ সর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত ৷ দ্বাদশ সর্গের মধ্যে —
(১) প্রথম সর্গে চারটি গান মালব বা মালবগৌড় , গুর্জরী, বসন্ত ও রামক্রী বা রামকীরি এই চারটি রাগে এবং রূপক, দিঃসার ও যতি (৩য় ও ৪র্থ গানই যতি) তালে৷
(২) দ্বিতীয় সর্গে দুটি গান গুর্জরী ও মালব বা মালবগৌড় রাগে এবং যতি ও একতালী তালে৷
(৩) তৃতীয় সর্গে একটি গান গুর্জরী রাগে ও যতি তালে৷
(৪) চতুর্থ সর্গে দুটি গান কর্ণাট ও দেশাগ রাগে এবং যতি ও একতালী তালে৷
(৫) পঞ্চম সর্গে দুটি গান দেশ-বরাড়ী ও গুর্জরী রাগে এবং রূপক ও একতালী তালে৷
(৬) ষষ্ঠ সর্গে একটি গান গোণ্ডকিরী রাগে ও রূপক তালে৷
(৭) সপ্তম সর্গে চারটি গান মালব বা মালবগৌড়, বসন্ত, গুর্জরী ও দেশ-বরাড়ী রাগে এবং যতি (দুটি গান যতি তালে) একতালী ও রূপক তালে৷
(৮) অষ্টম সর্গে একটি গান ভৈরবী রাগে ও যতি তালে৷
(৯) নবম সর্গে একটি গান রামকিরী রাগে ও যতি তালে৷
(১০) দশম সর্গে একটি গান দেশ-বরাড়ী রাগে ও অষ্টতালী তালে৷
(১১) একাদশ সর্গে তিনটি গান বসন্ত, দেশ বরাড়ী ও বরাড়ী রাগে এবং যতি ও রূপক (রূপক দুটি গানে) তালে৷
(১২) দ্বাদশ সর্গে দুটি গান বিভাষ রামকিরী রাগে এবং একতালী ও যতি তালে৷
এখানে বারোটি সর্গে ও চব্বিশটি গানে বা অষ্টপদীতে মালব, মালবগৌড় গুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী বা রামক্রী, কর্ণাট, দেশাগ বা দেশাখ, দেশ-বরাড়ী, গোণ্ডকিরী বা গোণ্ডক্রী, ভৈরবী, বরাড়ী বা বরাটী, বিভাষ বা বিভাস এই বারোটি রাগ (ও রাগিণী) এবং যতি, রূপক, নিঃসার একতালী, অষ্টতালী বা অষ্টতাল এই পাঁচটি তাল৷ পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, রাণা কুম্ভা “রসিকপ্রিয়া”-টীকায় গীতগোবিন্দের মূলপাঠে কবি জয়দেব-কর্তৃক উল্লিখিত রাগ ও তালগুলির উল্লেখ করলেও টীকায় ভিন্ন ভিন্ন রাগ ও তালের সন্নিবেশ করেছেন সম্ভবত তৎকালীন সমাজে প্রচলিত রাগনাম ও তালনাম অনুসারে৷
গীতগোবিন্দের মূলপাঠে রাগ-রাগিণীগুলির নামোল্লেখ আছে, কিন্তু তাদের রূপ বা স্বরূপের কোন উল্লেখ নাই৷ জয়দেব ১২শ শতকের প্রায় শেষের দিকের কবি, সুতরাং দ্বাদশ -ত্রয়োদশ শতকের এবং তৎপূর্বের সংগীত-শাস্ত্রোক্ত রাগরূপকে লক্ষ্য করে কবি রাগগুলির নির্দেশ দিয়েছেন৷ সুতরাং জয়দেবপূর্ব সংগীতগ্রন্থরূপে আমরা মোটামুটিভাবে পার্শ্বদেবের (৯ম-১১শ শতক) “সংগীতসময়সার”, অভিনবগুপ্তের (১০ম শতকের শেষার্ধ) ভরতভাষ্য “অভিনবভারতী”, নান্যদেব বা নান্যভূপালের (১১০৭-১১২৩ খ্রীঃ) ভরতভাষ্য “সরস্বতীহৃদয়লঙ্কার”, সোমেশ্বরদেবের -২য় (১১৩১ খ্রীঃ) “মানসোল্লাস” বা ” অভিলাষার্থচিন্তামণি”, মম্মটের (১০৫০-১১৫০ খ্রীঃ) “সংগীতরত্নমালা”,শার্ঙ্গদেবের (১২১০-১২৪৭ খ্রীঃ) “সংগীত-রত্নাকর” সোমেশ্বরের -৩য় (১১৭৪-১১৭৭ খ্রীঃ) “সংগীত-রত্নাবলী”, শারদাতনয়ের (১২০০ খ্রীঃ) “ভাবপ্রকাশন” বা “ভাবপ্রকাশ”, হরিপালের (১৩০৯ -১৩১২ খ্রীঃ) “সংগীত -সুধাকর” সুধাকলসের (১৩*৩ – ১৩৪৯ খ্রীঃ) “সংগীত-উপদিষৎ”, সিংহভূপালের (১৩৩০ খ্রীঃ) “সংগীতসার”, বেমভূপালের (১৫শ শতকের প্রারম্ভে) “সংগীত-চিন্তামণি”, রাণা কুম্ভার (১৪৩৩-১৪৬৮ খ্রী, কারু কারু মতে ১৪৫০ খ্রীঃ) “সংগীত-মীমাংসা” ও “সংগীতরাজ”, কল্লিনাথের (১৪শ শতকের মধ্যভাগ) সংগীত-রত্নাকরের টীকা “কালানিধি” প্রভৃতি৷ এইসকল সংগীতগ্রন্থে ও টীকায় রাগ ও স্বরসজ্জা বা স্বরসমাবেশের যে পরিচয় দেওয়া আছে, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের ভারতীয় (এবং বাংলার) সংগীত-সমাজেও সেই ধরনের রাগরূপের ও তাদের প্রকাশভঙ্গীর প্রচলন ছিল মনে করা যায়, সুতরাং গীতগোবিন্দে উল্লিখিত রাগ-রাগিণীদের স্বররূপ ও স্বরবিকাশভঙ্গীর আলোচনা করতে গেলে আমাদের নাট্যশাস্ত্রের সময় থেকে সংগীত-রত্নাকর ও তৎপরবর্তী কালের রাগরূপ সম্বন্ধে কিছুটা অনুশীলন করা উচিত৷
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, গীতগোবিন্দের চব্বিশটি পদগানে মালব, মালবগৌড় , গুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী, কর্ণাট, দেশাখ, দেশবরাড়ী, গোণ্ডকিরী, ভৈরবী, বরাড়ী ও বিভাষ বা বিভাস এই বারোটি রাগনামের উল্লেখ পাই৷ কবি জয়দেব রাগের স্বররূপ ও ধ্যানশ্লোকের কোন উল্লেখ করেন নি৷ পরবর্তীকালে পূজারী গোস্বামী, রাণা কুম্ভা ও অন্যান্য টীকা ও ভাষ্যকাররা রাগগুলির ধ্যানরূপের সঙ্গে সঙ্গে তালগুলির শাস্ত্রীয় রূপের পরিচয় দিয়েছেন৷ এ প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত যে, বর্তমান কালের উত্তর ভারতীয় ও দক্ষিণ ভারতীয় রাগের রূপগুলি প্রাচীন ভারতে প্রচলিত রাগরূপ থেকে বেশ কিছুটা পৃথক এবং সে পার্থক্যের কারণ রাগগুলির নিয়ামক রাগ বা থাটের (Standard Scale) রূপ-পরিবর্তন ৷ প্রাচীন ভারতে (নাট্যশাস্ত্রকার ভারতের সময়ে থেকেই ) রাগ-নিয়ামক থাট বা মূলরাগের রূপ ছিল বর্তমান কালের অনেকটা কাফীর মতো৷ “সংগীতসার”-গ্রন্থকার মাধব-বিদ্যারণ্য তদানীন্তন কালে নিয়ামক থাট বা “স্ট্যাণ্ডার্ড স্কেল”-এর নাম দিয়েছেন “মুথারী–যার স্বরসজ্জা বা স্বররূপ ছিল বর্তমান কালের উত্তর-ভারতীয় সংগীতপদ্ধতির “কাফী” রাগেরই প্রায় অনুরূপ৷ গীতগোবিন্দের পদগানে ব্যবহৃত রাগগুলির প্রাচীন ও আধুনিক স্বররূপগুলির আলোচনা করলে তা থেকে গীতগোবিন্দের রাগগুলির রূপ ও বিকাশভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করি৷
প্রথমেই গীতগোবিন্দের অষ্টম সর্গে প্রথম গানে বা অষ্টাপদীতে “ভৈরবী-যতিতালাভ্যাং গীয়তে” এই ভৈরবী রাগ বা রাগিণীর আলোচনা করা যাক্‌৷ খ্রীষ্টীয় ৯ম ১১শ শতকের সংগীতগুণী পার্শ্বদের “সংগীতসময়সার”-গ্রন্থ ভৈরবীর পরিচয় দিয়েছেন —
ভিন্নষড্‌জসমুদ্ভুতা বাংশন্যাসগ্রহান্বিতা ৷
সমশেষস্বরা পূর্ণা গান্বিতা তাব-মন্দ্রয়োঃ৷
দেবাদিপ্রার্থনাযাঃ তু ভৈরবী বিনিযুজ্যতে৷৷
ধৈরতস্বর ভৈরবীর অংশ (বা বাদী) এবং গ্রহ (আরম্ভ স্বর) ও ন্যাস (বিরাম বা শেষ-স্বর) এবং সম্পূর্ণজাতি অর্থে সাত স্বরবিশিষ্ট৷ মন্দ্র ও তার (নিম্ম ও উচ্চ) এই উভয় সপ্তকের গান্ধার পর্যন্ত ভৈরবীর স্বরগুলি লীলায়িত৷
শার্ঙ্গদেব (ত্রয়োদশ শতক) “সংগীত-রত্নাকর”-গ্রন্থে ভৈরবীর প্রসঙ্গে পার্শ্বদেবকেই অনুসরণ করেছেন, অর্থাৎ ভৈরবী সাতস্বরবিশিষ্ট, তার বৈবর্তবাদী, গ্রহ ও ন্যাস স্বর৷ এখানে কোন্‌ স্বর কোমল বা বিকৃত তার কোন পরিচয় দেননি পার্শ্বদেব ও শার্ঙ্গদেবও ৷ কিন্তু পণ্ডিত অহোবল (১৭শ শতক) “সংগীত-পারিজাত”-গ্রন্থে ভৈরবীর পূর্ণরূপের পরিচয় দিয়েছেন, আর দিয়েছেন ১৭শ শতকের গুণী সোমনাথ, দামোদর, লোচন-কবি ও অন্যান্য পরবর্তী সংগীতগ্রন্থকাররা৷ পণ্ডিত অহোবল ভৈরবীর স্বররূপের ও অন্যান্য বিষয়ের পরিচয় দিয়ে বলেছেন,
স-স্ববাংশগ্রহন্যাস ভৈরবী স্যাদ ধ-কোমলা ৷
বি-নাবোহে তু প-ন্যাসা পঞ্চমেনোভয়োবপি৷
ষড়্‌জেনাথাবরোহে তু সর্বদা সুখদায়িনী৷৷
ভৈরবীর অংশ বা বাদীস্বর ষড়্‌জ (সা) এবং সংবাদী পঞ্চম (পা), গ্রহ ও ন্যাস তথা আরম্ভ স্বর এবং শেষ-স্বরও ষড়্‌জ এবং ধৈরত কোমল বা বিকৃত (এখানে কোমল স্বরের উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেই কোমলস্বর ধৈরত)৷ পণ্ডিত সোমনাথ মনে হয় পারিজাতকারকে অনুসরণ করেছেন৷ কিন্তু পণ্ডিত দামোদর ও লোচন কবির পরিচয়দানের মধ্যে একটু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়৷ লোচন-কবি (১৭শ শতকের প্রথম বা মধ্যভাগ) “রাগতরঙ্গিণী”-গ্রন্থে ভৈরবীর পরিচয়প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “শুদ্ধা সপ্তস্বর রম্যা বাদনীয়াঃ প্রযত্নতঃ”, অর্থাৎ ভৈরবীর সাত স্বরই শুদ্ধ৷ কিন্তু এখানে মনে করতে হবে যে, লোচনের সময়েও নিয়ামক রাগ বা থাট ( Standard Scale)ছিল বর্তমানের কাফীরাগ বা কাফীথাটের অনুরূপ, সেজন্য লোচন-কবি বর্তমান কালের কাফীকেই শুদ্ধমেল বা শুদ্ধথাট রূপে গ্রহণ করেছেন এবং সে হিসাবে তখনকার (১৭শ শতকের) ভৈরবীর স্বরূপ ছিল — সা রি গ (কোমল) ম প ধ নি (কোমল )৷ কোন কোন গুণী সেই সময়ে ঋষভকে কোমল -স্বর-রূপে ভৈরবীতে ব্যবহার করতেন (এখানে লক্ষণীয় যে, সকল সময়ই রাগরূপ নিয়ে মতভেদের অন্ত ছিল না)৷ সেজন্য লোচন-কবি বলেছেন ঃ “তদ্‌শুদ্ধং যতস্তাদৃক্‌ নায়ং রাগাঽনুরঞ্জকম্‌”–অর্থাৎ কোমল -ঋষভযুক্ত ভৈরব ব্যবহৃত হোলে তা শ্রুতিমধুর হয় না৷ হৃদয়নারায়ণদেব “হৃদয়কৌতুক” ও “হৃদয়প্রকাশ” গ্রন্থ-দুটিতে লোচন-কবিকে এই বিষয়ে হুবহু অনুকরণ করেছেন৷ পণ্ডিত দামোদর (১৬২৫ খ্রীঃ) “সংগীতদর্পণ”-গ্রন্থে ভৈরবী সম্বন্ধে বলেছেন ঃ “সম্পূর্ণা ভৈরবী জ্ঞেয়া গ্রহাংশন্যাসমধ্যমা”, অর্থাৎ ষড়্‌জের পরিবর্তে মধ্যমস্বর ভৈরবীর বাদী, গ্রহ ও ন্যাস স্বর৷ দামোদর সোবীরীমূর্ছনার মাধ্যমে ভৈরবীর স্বররূপের পরিচয় দিয়েছেন৷ বর্তমান হিন্দুস্তানী পদ্ধতির ভৈরবীতে ও বাদীস্বর মধ্যম ও সংবাদী ষড়্‌জ (অবশ্য কারু কারু মতে ধৈরত বাদী ও গান্ধার সংবাদী)৷ অনেকে ভৈরবীকে সন্ধি প্রকাশরাগের অন্তর্ভুক্ত করেন, কিন্তু তা কতদূর সমীচীন তা অনুধাবনযোগ্য কারণ রাত্রির অন্তর্ধানে দিবালোকের প্রকাশমুহূর্তকে “সন্ধি” (meeting period of night and day)বলে এবং সে সময়ে প্রভাতসূর্যকে আরতি জানানোর জন্য ভৈরবরাগের ব্যবহার হয়, সুতরাং ভৈরবকেই সেদিক থেকে সন্ধিপ্রকাশ-রাগ বলা সমীচীন৷ বর্তমান সময়ে ভৈরবী সম্পূর্ণ জাতি, অর্থাৎ তাতে সাত স্বরের ব্যবহার হয়৷ ঋষভ, গান্ধার, ধৈরত ও নিষাদ কোমলস্বর-রূপে ব্যবহার হয় বর্তমান পদ্ধতির ভৈরবীতে ৷ সুতরাং ভৈরবীতে প্রাচীন ও নবীন (আধুনিক) স্বররূপের মধ্যে পার্থক্য অনেক৷
অন্যান্য রাগসম্বন্ধেও ঠিক এককথা,অর্থাৎ প্রাচীন রূপের সঙ্গে আধুনিকের পার্থক্য অনেক তার নিয়ামক মেল বা থাটরূপের পরিবর্তনের জন্য৷ সেভাবে বরাড়ী বা বরাটী, কর্ণাট বা কানাড়া, বসন্ত, মালব, গুর্জরী প্রভৃতি রাগের প্রাচীন ও আধুনিক রূপের মধ্যে কিছু কিছু (কিংবা অনেক) পার্থক্য দেখা যায়৷ যেমন, ৯ম-১১শ শতকের গুণী পার্শ্বদেব বসন্তকে বলেছেন ঋষভ-ধৈরতবর্জিত ঔড়ব তথা পাঁচস্বরের রাগ৷ পণ্ডিত রামামত্য (১৫৫০ খ্রীঃ) “স্বরমেলকলানিধি” -গ্রন্থে বসন্তকে “শুদ্ধবসন্ত” বলেছেন এবং তার স্বরূপ ষাড়ব-সম্পূর্ণ-জাতির (৬ স্বর-৭ স্বরযুক্ত), কেননা আরোহণে পঞ্চমবর্জিত৷ এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে, রামামত্য মুখারীকে নিয়ামক শুদ্ধমেল (Standard Scale)বলে গণ্য করেছেন, তাতে মূখাবীর বর্তমান হিন্দুস্তানীপদ্ধতির রূপ দাঁড়ায়–সা রি (কোমল) রি ম প ধ, (কোমল) ধ র্সা; অর্থাৎ বামামত্যের শুদ্ধঋষভ ও শুদ্ধধৈরত বর্তমান হিন্দুস্থানীপদ্ধতির কোমল-ঋষভ কোমল-ধৈরত এবং তাঁর শুদ্ধগান্ধার ও শুদ্ধনিষাদ বর্তমান হিন্দুস্তানীপদ্ধতির তীব্র-ঋষভ ও তীব্র-ধৈরত৷ পণ্ডিত সোমনাথ অনুরূপ অভিমত পোষণ করেন বসন্তের রূপ-সম্বন্ধে। বর্তমান পদ্ধতিতেও বসন্তের রূপ নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই ৷ শুদ্ধবসন্তের প্রচলিত রূপ উভয়-মধ্যম, পঞ্চম-বর্জিত ও ঋষভ-কোমল ৷ প্রাচীন ধ্রুবপদপদ্ধতির গানে এই রূপের প্রচলনই দেখা যায় এবং অনেকের মতে, কোমল-ধৈরতেরই ব্যবহার হয় বসন্তে; যেমন , সা গ ম (কড়ি) ধ (কোমল), ঋষভ (কোমল-তারস্থানে), র্সা ৷ এই বসন্তের রূপ পরজ-বসন্তের রূপের অনুরূপ ৷ সুতরাং বসন্তের রূপে বর্তমানকালেও মতভেদ দেখা যায়৷ লোচন-কবি “রাগতরঙ্গিণী” -গ্রন্থে এবং তাঁর মতানুবর্তী পণ্ডিত হৃদয়নারায়ণ বসন্তকে গৌরী সংস্থান বা গৌরীমেলার রাগ বলেছেন তখনকার গৌরীমেল বর্তমান ভৈরবমেলের অনুরূপ, সুতরাং তখনকার মেলনাম ও বর্তমানের মেলনাম এক নয়, যদিও স্বররূপে প্রায় এক৷
“গীতগোবিন্দে”-পদগানে ব্যবহৃত মালব, মালবগৌড়, গুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী, কর্ণাট, দেশখে, দেশবরাড়ী, গোণ্ডকিরী, ভৈরবী, বরীডী বা বরাটী ও বিভাষ বা বিভাস এই বারোটি প্রাচীন যুগের রূপানুশীলন করেছেন সংগীতশাস্ত্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী পণ্ডিত হৃদয়নারায়ণের “হৃদয়প্রকাশ” ও “হৃদয়কৌতুক” গ্রন্থি-দুটিতে উল্লিখিত স্বররূপকে অনুসরণ করে৷ (তাঁর প্রবন্ধ কয়েক বৎসর পূর্বে “বিশ্ববাণী”-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ ) রাগতরঙ্গিণীকার লোচন কবির অভিমতকে অনুসরণ করেই পণ্ডিত হৃদয়নারায়ণও প্রাচীন রাগগুলির স্বরবিন্যাস করেছেন৷ লোচন কবি কিংবা হৃদয়নারায়ণের ও অন্যান্য প্রাচীন সংগীতগ্রন্থকারদের রাগবিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি–
(১) মালব ও মালবগৌড় গৌরী-সংস্থান বা ভৈরবমেলের স্বরূপ সা রি(কোমল) গ ম প ধ (কোমল) নি৷ কিন্তু বর্তমান হিন্দুস্থানীপদ্ধতিতে কড়ি-মধ্যমের (হ্ম) ব্যবহার হয়, যদিও লোচন কবি সে সম্বন্ধে কোন কিছু বলেন নি৷
(২) গুর্জরীও লোচনের মতে, গৌরী-সংস্থান তথা ভৈরবমেলের রাগ, সুতরাং এতে ঋষভ ও ধৈরত কোমল বা বিকৃত ৷
(৩) বসন্তও লোচনের মতে, গৌরী-সংস্থানের রাগ৷ বসন্ত-সম্বন্ধে পূর্বে আলোচনা করেছি৷ কিন্তু লোচনের পূর্বগ-শাস্ত্রীদের মতের সঙ্গে লোচনের মতের মিল নাই৷ লোচন ও হৃদয়নারায়ণ বসন্তে ঋষভকে বাদ দিয়ে কোমল -ধৈরতের ব্যবহার করেছেন অবরোহণে৷ প্রাচীন ধ্রুবপদগানে যে শুদ্ধবসন্তের প্রচলন আছে, তাতে পঞ্চম-বর্জিত এবং ঋষভ-কোমল এবং উভয়-মধ্যমের (ম হ্ম) ব্যবহার৷
(৪) রামকিরি বা রামক্রী লোচনের মতে ভৈরবীমেলেব রাগ ৷ বর্তমান ভৈরবীমেলেব স্বররূপ — সা রি (কোমল) গ(কোমল) ম প ধ (কোমল)৷ লোচনের অনুবর্তী হৃদয়নারায়ণ রামকিরী-রাগিণীতে কোমল-ধৈরত ও কোমল -ঋষভের ব্যবহার করেছেন৷
(৫) কর্ণাট লোচনের মতে, খাম্বাজমেলের অনুরূপ ও ঐ মেলের অন্তর্গত৷ খাম্বাজ মেলে কোমলনিষাদের, ব্যবহার এবং অন্যান্য স্বর অবিকৃত বা শুদ্ধ৷ ইতিহাসের পাতায় কর্ণাটের পরবর্তী রূপ হিসাবে আমরা কানড়া রাগকে পাই৷ “সংগীত-রত্নাকর”-গ্রন্থে শার্ঙ্গদেব কর্ণাট বা কানাড়ার পরিবর্তে কর্ণাট-বঙ্‌গাল-রাগের পরিচয় দিয়েছেন এবং তা পঞ্চম-বর্জিত ষাড়বজাতির রাগ বা রাগিণী৷ পণ্ডিত রামামত্য (১৫৫০ খ্রীঃ) পৃথকভাবে কর্ণাট বা কানাড়ার নামোল্লেখ করেন নি, তবে “কন্নড়্‌”-শব্দ ব্যবহার করেছেন সম্ভবত কর্ণাটকে লক্ষ্য করে৷ পণ্ডিত পুণ্ডরীকে বিট্‌ঠল সম্রাট আকবরের সময়কার শাস্ত্রী৷ তিনি কর্ণাটের নামোল্লেখ করে “রি-ধ-বর্জিত বা পূর্ণস্তু কর্ণাট ইনাস্তশোভী” বলেছেন৷ অর্থাৎ তাঁর মতে, কর্ণাট ঋষভ ও ধৈরত-বর্জিত ঔড়ব বা পাঁচ স্বরের রাগ, আবার সমস্ত স্বরকে নিয়ে সম্পূর্ণ জাতির৷ পণ্ডিত সোমনাথের রাগবিরোধে (১৬০৯ খ্রীঃ) “কর্ণাটঃ কর্ণাচগৌড়ঃ” শব্দগুলির উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তা থেকে কর্ণাট ও কর্ণাটগৌডকে যেন একই রাগ বলে প্রতীত হয়(?) ; খ্রীষ্টীয় ১৭শ শতকে লোচন-কবি “রাগতরঙ্গিণী”-গ্রন্থে কর্ণাট ও কানড়া বা কানাড়া শব্দ-দুটি পৃথকভাবে ব্যবহার করেছেন৷ যেমন ,
বাগেশ্বরী কানবশ্চ খম্‌ভাইচী তু রাগিণী ৷
* * *
কর্ণাটসংস্থিতাবেতে রাগাঃ সন্থীতি নিশ্চিতম্‌৷৷
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আনুমানিক ১৪শ শতকের “পঞ্চমসারসংহিতা” -গ্রন্থে রাগ মল্লারের রাগিণী-রূপে “কানড়া”-র উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ১৭শ শতকের দক্ষিণী সংগীতশাস্ত্রী বেঙ্কটমখী চতুদণ্ডী প্রকাশিকায় শ্রীরাগের জন্যরাগ-রূপে কন্নড়গৌল বা কন্নড় বা কানাড়ার পরিচয় দিয়েছেন৷ তাছাড়া ভাবভট্টের “অনূপসংগীতাংকুশ” ও অনূপসংগীতরত্নাকর” এবং পুরুষোত্তম মিশ্রের “সংগীত-নারায়ণ” গ্রন্থগুলিতে “কর্ণাটী-শব্দের উল্লেখ দেখি৷ আহোবলের “সংগীত-পরিজাত”-গ্রন্থে কানাড়া আবার “কানডী” নামে উল্লিখিত৷ সেখানে কানডী বা কানাড়া তীব্র-গান্ধারযুক্ত৷ মোটকথা কর্ণাট ও কানাড়াকে যদি এক ও অভিন্ন রাগরূপে পাই, তবে সংগীতদর্পণকার দামোদরের মতে, কর্ণাট বা কানাড়া সম্পূর্ণ তথা সাত স্বরের রাগ এবং নিষাদ বিকৃত বা কোমল৷ কিন্তু বর্তমান হিন্দুস্তানীপদ্ধতির কানডা তথা কর্ণাটরাগে গান্ধার, ধৈরত ও নিষাদ বিকৃত বা কোমল (জ্ঞ দ ণ) ৷
(৬) দেশাখ, দেশাখ্য বা দেবশাখ লোচনকবির মতে মেঘ-সংস্থানের রাগ৷ দেশাখ দেশাঘ্য রাগ বা রাগিণীরই ভিন্ন নাম৷ হনুমন্মতে দেশাখ্য বা দেশাখ হিন্দোলরাগের তৃতীয় রাগিণী৷ দেশাক্ষী দেবশাখ, দেওশাখ নামেরও ভিন্ন ভিন্ন সংগীতগ্রন্থে উল্লিখিত৷ পার্শ্বদেব “সংগীতসময়সার”-গ্রন্থে দেশাখ ও দেশাখ্য এই দুই রকম শব্দ ব্যবহার করেছেন৷ দেশাখ বা দেশাখ্য পার্শ্বদেবের মতে, ঋষভ-বর্জিত ষাড়ব, অর্থাৎ ছয়স্বরের রাগ৷ এতে সমস্ত স্বরই শুদ্ধ৷ সংগীতরত্নাকরে শার্ঙ্গদেব “দেশাখ্য” নামেরই উল্লেখ করেছেন৷ “কলানিধি”-টীকায় কল্লিনাথ দেশাখ্য বা দেশাখকে পঞ্চম-বর্জিত ষাডবরাগ বলেছেন৷ কিন্তু পার্শ্বদেবের মতে, দেশাখ্য ঋষভ -বর্জিত ষাড়বরাগ৷ পণ্ডিত রামামত্যের মতে, দেশাখ বা দেশাখ্য বা দেশাক্ষী আরোহণে সম্পূর্ণ ও অবরোহণে মধ্যম ও নিষাদ-বর্জিত ঔড়বজাতি৷ পণ্ডিত সোমনাথ দেশাখ বা দেশাক্ষীকে ঔড়ব-সম্পূর্ণ বলেছেন৷ সুতরাং দেশাখ, দেশাখ্য বা দেশাক্ষীকে নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই৷ বর্তমানে দেশাখ বা দেবশাখ কাফীমেলের ধৈরত-বর্জিত ষাড়বজাতি রাগ৷ কবি জয়দেবের সময় (১২ শতকের শেষভাগ) দেশাখ বা দেশাখ্য বা দেবশাখ সম্ভবত কল্লিনাথ -সমর্থিত পঞ্চম-বর্জিত ষাড়ব-ষাড়ব-জাতির রাগ ছিল৷
(৭) দেশ-বরাড়ী সম্ভবত দেশ ও বরাটী-রাগ দুটির সংমিশ্রণে সৃষ্ট৷ “বরাড়ী” রাগ বৈরাটী, বিরাটী, বরাটিকা প্রভৃতি নামেও পরিচিত৷ শার্ঙ্গদেব একে “বটুকী” নামেও অভিহিত করেছেন ঃ “তজ্জা বরাটিকা সৈব বটুকী ধ-নিপাধিকা”৷ ধৈরত, নিষাদ ও পঞ্চম স্বর-তিনটির এতে অধিক ব্যবহার৷ দেশ, দেশী ও দেশাখ্য ভিন্ন ভিন্ন রাগ৷ কিন্তু দেশ ও দেশকার সমশ্রেণীভুক্ত বা একই রাগ৷ দেশ বা দেশকার মোটেই প্রাচীন রাগ নয়, কেননা নান্যদেব মম্মটাচার্য, সোমেশ্বরদেব এবং এমনকি ১৩শ শার্ঙ্গদেব “সংগীতরত্নাকর”-গ্রন্থে দেশ ও দেশকার -রাগের কোন পরিচয় দেন নি৷ পণ্ডিত সোমনাথ (১৬০৯ খ্রীঃ) দেশ বা দেশকারকে “দেশকৃৎ” তথা “দেশকৃদ্দেশকারঃ” বলেছেন৷ তিনি বলেছেন , দেশ বা দেশকার সংপূর্ণজাতির রাগ : “সাংশাদ্যন্তোঽহ্নোঽন্তকম্প্রমনির্দেশকৃৎ পূর্ণঃ”৷ পূর্বেই বলেছি যে, জয়দেব-বর্ণিত দেশ-বড়ারী সম্ভবত দেশ ও বরাটী বা বরাড়ী রাগ-দুটির মিশ্রণে সৃষ্ট ৷ লোচন-কবি ও হৃদয়নারায়ণদেব এই রাগের কোন পরিচয় দেন নি৷ কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ কবি জয়দেব ১২শ-১৩শ শতকে তাঁর গানের সঙ্গে দেশ-বরাড়ী রাগের সম্পর্ক ঘটিয়েছেন, অথচ ঠিক সেই সময়ে দেশ-বরাড়ী অথবা দেশ-বরাটী নামে নির্দিষ্ট কোন রাগের নাম কোন প্রাচীন সংগীতগ্রন্থে পাওয়া যায় না৷ পাওয়া যায় না ৫ম-৭ম শতকের সংগীতগ্রন্থ মতঙ্গের বহদ্দেশীতে, পার্শ্বদেবের সংগীতসময়সারে এবং নাট্যলোচনেও ৷” অথচ পরবর্তীকালে দেশ-বরাড়ীরাগের শিল্পী-অংকিত চিত্র পাওয়া যায়৷ মনে হয়, দেশ-বরাড়ী রাগ বা রাগিণী পরবর্তীকালের সৃষ্ট এবং ১২শ শতকের গীতগোবিন্দে তার উল্লেখ ঐতিহাসিকদের মনে একটু সংশয়ের উদ্রেক করে৷
(৮) গোণ্ডকিরি –গুণকেলী, গুণ্ডক্রী, গুণক্রী, গুণক্রিয়া, গুণকিরী প্রভৃতি নামে পরিচিত৷ “গুণ্ডকী” নামও প্রাচীন গ্রন্থ সংগীতসময়সারে পাওয়া যায়৷ ১৩শ শতকের গুণী শার্ঙ্গদেব গুণক্রীরাগের পরিচয় দেননি কেন –তা বলা যায় না৷ পণ্ডিত রামামত্য একে ধৈরত-বর্জিত ষাড়ব-ষাড়বজাতির রাগ বলেছেন৷ পুণ্ডরীক বিট্‌ঠল (১৫৯০ খ্রীঃ) একে “গৌণ্ডকৃতি” বলেছেন এবং তাঁর মতে, ধৈরত-বর্জিত ষাড়ব-ষাড়বজাতির রাগ গোণ্ডকিরী৷ কিন্তু ১৭শ শতকের প্রথম পাদের সংগীতশাস্ত্রী পণ্ডিত সোমনাথ তাঁর গ্রন্থে “গোণ্ডক্রিয়া” তথা গোণ্ডকিরীকে কোমল-ঋষভ ও ধৈরতযুক্ত গান্ধার ও নিষাদ-বর্জিত ঔড়বজাতির রাগ বলেছেন৷ গৌরী-সংস্থান বর্তমানে ভৈরবমেলের অনুরূপ এবং ভৈরবরাগের জন্যরাগ, সুতরাং প্রাতঃকালে গেয়৷ গোণ্ডকিরী বা গোণ্ডক্রীর ঋষভ ও ধৈরত কোমল বা বিকৃত৷
(৯) ভৈরবী৷ তখনকার সময়ে ভৈরবীর রূপ ছিল বর্তমানের কাফীমেলের অনুরূপ , সুতরাং ভৈরবীর রূপ পাই –সা রি গ (কোমল) ম প ধ নি (কোমল)৷ পণ্ডিত সোমনাথ বলেছেন ঃ “অন্যে তু ভৈরবীরাগে ধৈরতং কোমলং বিদুঃ”, অর্থাৎ অনেকে ভৈরবীতে কোমল-ঋষভ ব্যবহার করেন৷ বর্তমানে হিন্দুস্তানীপদ্ধতির ভৈরবীতে কোমল-ঋষভ, গান্ধার, ধৈরত ও নিষাদ ব্যবহৃত হয় (ঋ জ্ঞ দ ণ)৷ লোচন-কবি ভৈরবীতে কোমল-ধৈরতের ব্যবহারকে অসুন্দর বলেছেন৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, লোচন কবি ১৬শ শতকের শেষার্ধের কিংবা ১৭শ শতকের প্রথম বা মধ্যম পাদের কবি৷ সুতরাং ১২শ শতকের শেষপাদের “গীতগোবিন্দ”-পদগানের রাগ নিরূপণ যে লোচনের রাগতরঙ্গিণীর মাধ্যমে করণীয় একথা স্বীকার করা সঙ্গত হবে না, কারণ ১২শ শতকের পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাগরূপে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল৷ পণ্ডিত অহোবল প্রভৃতি ভৈরবীতে কোমল-ধৈরতের ব্যবহার বলেছেন ঃ “ভৈরবী স্যাদ্‌ ধ কোমল”৷
(১০) বরাড়ী বা বরাটী -সম্বন্ধে আমরা দেশ-বড়ারী প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনা করেছি৷ বরাড়ী বা বরাটীর প্রকারভেদ, যেমন সৈন্ধববরাটী, কুন্তলবরাটী, দ্রাবিড়বরাটী, প্রতাপবরাটী, নাগবরাটি, শোকবরাটী প্রভৃতি৷ বর্তমান পদ্ধতির বরাড়ী তথা বরাটীতে কোমল-ঋষভ ও কড়ি-মাধ্যমের ব্যবহার হয়৷ শার্ঙ্গদেব বরাড়ীতে কোন কোমল স্বরের উল্লেখ করেন নি, বলেছেন — ধৈরত, নিষাদ ও পঞ্চমের অধিক প্রয়োগ৷ পণ্ডিত অহোবল বরাড়ীতে কোমল-ঋষভ ও ধৈরতের ব্যবহারের কথাই বলেছেন৷ লোচন কবি বরাড়ীর কোন পরিচয় দেন নি৷
(১১) বিভাসরাগ লোচনের মতে ভৈরবমেলের অনুরূপ সুতরাং বিভাসে ঋষভ ও ধৈরত কোমল৷ বিভাসের রূপ প্রধানত দুইর কম ঃ একটি প্রাতঃকালে ও অপরটি রাত্রে গেয়৷ বিভাসের প্রাচীনরূপেও নিষাদ ও মধ্যমবর্জিত দেখা যায়৷
(১২) মালব বা মালগৌড়রাগের প্রকারান্তরে আমরা পরিচয় দিয়েছি৷ লেখকের “রাগ ও রূপ” -গ্রন্থের ১ম ভাগে এই মালবরাগ-সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা দ্রষ্টব্য৷
(দুই)

মেবারের রাণা কুম্ভা (বা কুম্ভকর্ণ) গীতগোবিন্দের উপর “রসিকপ্রিয়া” নামক টীকা রচনা করেছেন –যাতে দেশীরাগগুলির স্বররূপ বা স্বর-সমাবেশের মধ্যে মতঙ্গ, শার্ঙ্গদেব প্রভৃতি নির্দেশিত রাগসজ্জার বিকাশ থেকে কিছু কিছু পার্থক্য বা প্রভেদ দেখি৷ গীতগোবিন্দে যে রাগগুলির উল্লেখ আছে পদগুলি সুরে প্রকাশ করার জন্য, তাদের রূপের পার্থক্যের কথা আলোচনাপ্রসঙ্গে পূর্বে উল্লেখ করেছি৷ “সংগীতরাজ” রাণা কুম্ভার একটি অবিস্মণীয় অক্ষয় অবদান৷ ডক্টর কুঞ্জন রাজা “সংগীতরাজ”-গ্রন্থের স্বরাধ্যায়মাত্র সম্পাদনা করে বিকানীর থেকে প্রকাশ করেছেন৷ পরে বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (Banaras Hindu University) থেকে ডক্টর প্রেমলতা শর্মা “সংগীতরাজ” বিশেষভাবে সম্পাদনা করে ইংরাজী ১৯৬৩ খ্রীষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে (প্রথম ভাগ) প্রকাশ করেছেন৷ সম্পাদিকা ডক্টর প্রেমলতা শর্মা মেবারের রাণা কুম্ভার অবির্ভাব-কাল-সম্পর্কে লিখেছেন ঃ “The date of Kumbha presents no difficulty. He ascended the throne of Mewar in Chittorgard in 1433 A.D. after the assassination of his father Mokal and had a glorious reign of thirty-five years.(vide Sanskrit verse). The above verse : “শ্রীমদ্বিক্রমকালতঃ পরিগতে নন্দাভ্রভূতক্ষিতা * *” mentions the year in which S. Raj was completed as V.S. 1509 Saka year 1374 corresponding to 1456 A.D.The Kirttistambha inscription which was installed in 1460 A.D. clearly refers to the composition of S.Raj by Kumbha”৷ রাণা কুম্ভার তিরোভাব ঘটে ১৪৬৮ খ্রীষ্টাব্দে৷ “সংগীতরাজ” গ্রন্থে সাঙ্গীতিক উপাদানের ও বিশেষ করে রাগ-রাগিণীদের পরিচয়প্রসঙ্গে রাণা কুম্ভার একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় সেকথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি৷ বিদগ্ধ সম্পাদিকা সংগীতরাজে অলোচিত ও অনুসৃত ধারা-প্রসঙ্গে লিখেছেন : “The author”s theories and concepts are traditional though he evenices a special partiality for the more ancient authorities,who do not seem to possess the same degree of appeal for contemporary writers” (vide Intoduction, p.151). Traditional বা ঐতিহ্যবাহী ধারাপারম্পর্য-সম্পর্কে তিনি রাণা কুম্ভার নিজের স্বীকারোক্তির উল্লেখ করেছেন৷ স্বীকারোক্তিটি হল —
অধ্যাসিতায়া নিজপূর্বপুঙ্‌ভিঃ
পদং সবীসর্তি ন যঃ কদাচিৎ ৷
বিশুদ্ধিমত্যাঃ সরণে স রাজা
পদং চবীকর্তি বিচারবর্তী৷৷
রাণা কুম্ভার যে নিজস্ব একটি স্বাধীন বৃত্তি ও দৃষ্টি ছিল সংগীতমীমাংসার বেলায় গীতগোবিন্দের “রসিকপ্রিয়া” টীকা রাগরূপের আলোচনার সময়ে কিছুটা তার উল্লেখ করেছি৷ এখানে গীতগোবিন্দে রাগরূপের পরিচয় প্রসঙ্গে খ্রীষ্টীয় ১৭ শতকের প্রথমে বা মধ্যকালে লোচন-কবি-রচিত “রাগতরঙ্গিণী” গ্রন্থের মতানুযায়ী যে ভৈরবাদি রাগগুলির (যে রাগগুলি গীতগোবিন্দে উল্লিখিত হয়েছে) স্বররূপের উল্লেখ করেছি, এখানে রাণা কুম্ভা-রচিত সংগীতরাজ” থেকে সেই সেই রাগের কতকগুলির পরিচয়ের উল্লেখ করি তুলনামূলক দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষণে সেকাল ও একালের রাগগুলির স্বরসমাবেশের পরিচয় লাভ করার জন্য৷ যেমন গীতগোবিন্দে মালব, মালবগৌড়, গুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী, কর্ণাট, দেশাখ, দেশ-বরাড়ী, গোণ্ডকিরী, ভৈরবী, বরাড়ী ও বিভাস বা বিভাষ এই ১২টি রাগের উল্লেখ পাই৷ রাণা কুম্ভা সংগীতরাজে বসন্তরাগের পরিচয় দিয়েছেন —
সাংশন্যাসগ্রহঃ পূর্ণো মন্দ্রানিঃ সকম্পিতঃ ৷
ভূযিষ্ঠরিনিসো দৈনে পশ্চিমে প্রহরে বুধৈঃ ৷৷ ১৷৭৭
হিন্দোলাঙ্গ বসন্তোঽযং বসন্তে গীয়তে শুচৌ ৷
বিদ্রুমাভং দশভুজং ষডাস্যং কোকিলাগতিম ৷৷ ১৷৭৮

* * *
রী রী রি গা ম নি ধ পা ম গ রী স রী রী
গা মং রি গা ম প স সা স রি গা রি সা রী৷
প মং রি সা ম প ধ নী নি স নী ধ পা মং
পা ধা নি ধা রি নি ধ ধা প ধ মা ম সা রী ৷৷ ১।৮০
এটি বসন্তরাগের (স্বর)-করণ৷ তাছাড়া আলাপ–সা রী গ সা গ গ ধা ম গ মা গ রী সা প্রভৃতি৷
কর্ণাটী বা কর্ণাট-রাগ সম্বন্ধে রাণা কুম্ভা বলেছেন —
ধান্তা ষড্‌জগ্রহন্যাসা তারণা মন্দ্রমধ্যমা৷
সমশেষস্বরা পূর্ণা কর্ণাটী কর্ণবক্তিদা ৷৷ ১৷১১৩
ইমাং ভাষাং সমাচষ্ট মতঙ্গাদিবিদাং গণঃ ৷
রাগাঙ্গমাহ নিঃশঙ্কো গ্রামরাগানুসারতঃ ৷৷
কৃষ্ণবস্ত্রা নীলবর্ণা গজেন্দ্রবরবাহ না৷৷ ১৷১১৪

অবশ্য কর্ণাটী-সম্পর্কে রাণা কুম্ভা কর্ণাটীর দ্বিতীয় রপের পরিচয় দিয়েছেন — “গান্ধারতারা মৃদুমা ধৈরতাংশগ্রহান্তিমা” প্রভৃতি এবং “পূর্ণা কর্ণাটী বর্ণিতা” (১.১০৮) বলেছেন৷
ভৈরবী সম্পর্কে রাণা কুম্ভা সংগীতরাজে বলেছেন —
ভৈরবী-ভৈরবোপাঙ্গং ধ-গ্রহাংশাবসানিকা৷
মন্দ্রতাব-গান্ধারা সমশেষস্বরা ভবেৎ৷৷১৷১৪৮)
ধ নী স গ ম ধা নী গ স গ রী ম গ ধ নি ধা৷
ধ প মা ধ ধ পা মা গ ম ধ নী স রি গা নি ধা ৷৷ ১৷১৪৯
মালবরাগ-সম্পর্কে রাণা কুম্ভা বলেছেন —
টক্বকৈশিকভবা তু মালবা যা
তদঙ্গমিহ মালবা মতা ৷
সংগতাবিহ রিপৌ সধৌ তথা
নিগ্রহাংশবিবতির্নিযোজিতা ৷৷ ২৷৭৯
বাসবান্তিমদলে শুচৌ বসে
বস্যতে চ করুণে পুরাতনৈঃ ৷
ধৈরতাংশবিবতির্ভয়ানকে
কেশ্চিদেব নিপুণং বিভাষ্যতে ৷ ২৷৮০

তেমনি সংগীতরাজে রামকৃতি বা রামক্রী বা রামকিরী-সম্পর্কে রাণা কুম্ভা বলেছেন —
কোলাহলা টক্কভরাত্র ভাষা
পূর্বোদিতা রামকৃতিস্তদঙ্গম্‌৷
সান্তা গ্রহাংশীকৃতমধ্যমা চ
বিবর্জিতা পঞ্চমনিস্বনেন৷৷ ২৷১৪৪
রামকৃতি বা রামক্রী রাগ বা রাগিণী হোল — “দোলারূঢ়া চ গৌরাঙ্গী বীণাদণ্ডবিভূষিতা”৷ তাছাড়া ক্রিয়াঙ্গরাগ-রূপে পূর্বরামক্রিয়া, রামক্রিয়া, গৌণ্ডকৃতি, দেবকৃতি প্রভৃতির পরিচয়ও দিয়েছেন রাণা কুম্ভা৷ রামকৃতি (২৷১১৪) ও রামক্রিয়া (৩৷২) রাগকে পৃথক দৃষ্টিতেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন রাণা কুম্ভা৷ রামক্রিয়ার রূপ —
আপঞ্চমং তাবমৃদুপ্রচারা
সাংশগ্রহান্তা রিসভূরিনাদা ৷
স্যাদ্বিপ্রলম্ভে করুণে রসে চ
রামক্রিয়া বাসরপশ্চিমার্ধে৷৷ ৩৷৪

মোটকথা রাগতরঙ্গিণীকার লোচন-কবি রাণা কুম্ভার বহু পরবর্তী গ্রন্থকার বা শাস্ত্রকার৷ ঐতিহাসিক পটভূমিকায় বিচার-দৃষ্টিতে দেখা যায়, ১২শ – ১৩শ শতকের কবি জয়দেবের নির্দেশিত রাগরূপকে ১৫শ শতকের শাস্ত্রকার ও সংগীতজ্ঞানী রাণা কুম্ভা -রচিত “সংগীতরাজ”- গ্রন্থে উল্লিখিত রাগগুলির স্বরসমাবেশপদ্ধতির দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের বিচার করা উচিত৷ বর্তমান উত্তর-ভারতীয় রাগরূপের মধ্যে রাণা কুম্ভা-নির্দিষ্ট রাগরূপগুলি ঐক্য-অনৈক্য লক্ষ্য করা যায়৷