বাঙ্গালায় শ্রীরাধাগোবিন্দের তথা শ্রীগৌরচন্দ্রের নাম, লীলা ও গুণকীর্তনের ধারা আজিও প্রবহমান ৷৷ স্রোত মন্দীভূত হইয়াছে, কিন্তু বিলুপ্ত হয় নাই ৷ খ্রীষ্টীয় ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ে— সম্ভবতঃ তৃতীয় পাদে, খেতরী গ্রামে একটি বিরাট্‌ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ৷ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের অভিপ্রায়-মত তাঁহার পরমাত্মীয় (রাজা) শ্রীমান্‌ সন্তোষ এই উৎসবের সমগ্র ব্যয়ভার বহন করেন ৷ উৎসবের নেত্রী ছিলেন প্রভু শ্রীনিত্যানন্দের সুযোগ্যা সহধর্মিণী জাহ্নবী দেবী ৷ এই উৎসবে বাঙ্গালার বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ভুক্ত বহু জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত গায়ক বাদক উপস্থিত ছিলেন ৷ সম্প্রদায় তখন প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে ৷ এই সম্প্রদায়ের প্রভাবে যোজনান্তর সংস্কৃতি-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হইতেছে ৷ বহুবিধ ইষ্টাপূর্তের অনুষ্ঠানে বাঙ্গলীর নবজাগ্রত যৌবন দেশকে অভিনব আদর্শে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে ৷ সমাজে নূতন চেতনা, নবীন উদ্যম ৷ সার্থক ও বাস্তব গণ-সংযোগের ফলে বাঙ্গালী নূতন জাতিরূপে অভ্যুদিত হইয়াছে ৷ এমনই দিনে খেতরীর ইতিহাস-প্রসিদ্ধ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ৷ বলা বাহুল্য, এই উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য বহু ব্যক্তিও দর্শকরূপে উপস্থিত ছিলেন ৷
শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর দিব্যাবদান সমাজের তথাকথিত নিম্মশ্রেণীর নর-নারীকেও মানবতার আদর্শে অনুপ্রাণিত করিয়াছিল ৷ তিনি অকপটে নিষ্ঠার চন্দ্রাতপতলে শৌচ সদাচরণের বৃহত্তর প্রাঙ্গণে সমাজের উচ্চাবচ স্তরকে প্রায় সমতলে সন্নিবেশিত করিয়াছিলেন; উচ্চ-নীচ একত্রে সম্মিলিত হইয়াছিল ৷ শ্রীচৈতন্যচন্দ্র সমাজগঠনের মূলমন্ত্র গণসংযোগের যে সর্বোত্তম সরণিতে চরণার্পণ করিয়াছিলেন, সেই চরণাঙ্কিত নরপতিপথে আসিয়া দাঁড়াইলেন শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর যোগ্য উত্তরাধিকারী চারিজন বিশ্রুতনামা জননায়ক— শ্রীনিত্যানন্দতনয় শ্রীবীরচন্দ্র প্রভু, আচার্য শ্রীনিবাস, ঠাকুর নরোত্তম এবং শ্রীল শ্যামানন্দ ৷ জনতার সঙ্গে একাত্মতা লাভের জন্য তাঁহারাও মহাপ্রভু প্রবর্তিত নাম-কীর্তন এবং লীলা-কীর্তনকেই বিতরণের উপায়নরূপ সঙ্গে লইলেন ৷ নাম-কীর্তনের ধারা নির্দিষ্ট আকার পরিগ্রহ করিয়াছিল মহাপ্রভুর সমকালেই ৷ খেতরীর মহোৎসবে লীলা-কীর্তনের পদ্ধতি বিধিবদ্ধ হইয়া গেল ৷ ইতিপূর্বে শ্রীপাদ রূপ গোস্বামী ভক্তিরসামৃত-সিন্ধু ও উজ্জ্বলনীলমণি প্রণয়ন করিয়াছিলেন ৷ সুতরাং রসপর্যায় স্থিরীকৃত হইয়াই ছিল ৷ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর নিয়ম করিলেন, শ্রীরাধা-কৃষ্ণের পূর্বরাগাদি যে লীলাগান অদ্যকার অভিপ্রেত, গায়ককে তাহার প্রথমে তদুচিত গৌরচন্দ্র গান করিয়া পালা আরম্ভ করিতে হইবে ৷ অর্থাৎ সেই প্রেম-বিগ্রহ আদর্শ সন্ন্যাসী এই অপ্রাকৃত লীলা যেভাব আস্বাদন করিয়াছিলেন— শ্রোতৃবৃন্দ যাহাতে তদ্‌বিষয়ে অবহিত হন, কীর্তনীয়া সর্বপ্রথম তাহারই সুযোগ করিয়া দিবেন ৷
চর্যাপদগুলির মাথায় রাগ লেখা আছে ৷ কবি জয়দেব শ্রীগীতগোবিন্দের স্বরচিত গানে আপনিই রাগ ও তালের নির্দেশ রাখিয়া গিয়াছেন ৷ বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণগানের প্রতি পদে রাগ ও তালের নাম পাইতেছি ৷ বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ে সুপ্রসিদ্ধ নরহরি চক্রবর্তী সঙ্গীতশাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন ৷ সঙ্গীত লইয়া লিখিত তাঁহার গ্রন্থ আছে ৷ নরহরির ভক্তিরত্নাকরেও সঙ্গীতের মূল্যবান্‌ অলোচনা পাওয়া যায় ৷ সুতরাং কীর্তনগান যে বিশুদ্ধ সুর ও তাল-সংযোগে গীত হইত এ-বিষয়ে কোন সংশয় নাই ৷ সেকালে স্বরলিপি ছিল না, গায়কগণ কর্মসিদ্ধ ছিলেন ৷ গুরুর মুখে শুনিয়া শুনিয়া, শ্রুতিপথে আয়ত্তে আনিয়া তাঁহারা কীর্তনের সুরকে আপন কণ্ঠে তুলিয়া লইয়াছিলেন ৷ ফলে যাহা ঘটিবার, তাহাই ঘটিয়াছে ৷ সুরের এদিক্‌ ওদিক্‌ হইয়া গিয়াছে ৷ তাল অপেক্ষা সুরের দিক্‌ দিয়া ক্ষতিটা কিছু বেশী হইয়াছে ৷
আমি তদানীন্তন বঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তন-গায়ক রসিক দাসের কীর্তন বহুবার শুনিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলাম ৷ তিনি ১৩২০ সালে মরজগৎ ত্যাগ করিয়াছেন ৷ এই স্বনামধন্য কীর্তনীয়া কীর্তনে নূতনত্ব আনিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন ৷ কীর্তনে কাটা-ধরা তাল তাঁহারই সৃ্ষ্টি ৷ ধরা তালের সঙ্গে ইহার বিশেষ পার্থক্য নাই ৷ ধরা তালের চারিটি মাত্র ৷ এই গান কেহবা সাত-ফের কেহবা আট-ফের ঘুরাইয়া আনেন ৷ এক-এক ফের বা ওয়ার্দায় চারিটি করিয়া ছুট বা তালের হিসাবে এই গানে কেহবা আঠাশ চাপড়, কেহবা বত্রিশ চাপড় ব্যবহার করেন৷ “আঁধল প্রেম পহিলে নাহি হেরনু সো বহু বল্লভ কান, ‘যাকর চরণ’ নখররুচি হেরইতে মুরছিত কত কোটি কাম, চরণে লাগি হরি হার পিঁধায়ল, প্রেমক অঙ্কুর , এই না মাধবীতলে”, প্রভৃতি ত্রিপদী ছন্দে রচিত গানগুলির প্রথম পংক্তি ধরা তালে গীত হয়৷
রসিক দাসের পুত্র সুগায়ক রাধাশ্যাম দাসের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল ৷ একবার দক্ষিণখণ্ডে গিয়া তাঁহার বাড়িতে আমি প্রায় সপ্তাহকাল কাটাইয়া অসিয়াছিলাম ৷ সেই সময় রাধাশ্যাম আমাকে বলেন— পিতাঠাকুর একদিন ভোরে উঠিয়া গ্রামের বাহিরে প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনে যাইতেছিলেন ৷ পথের মাঝে থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন ৷ এক পুত্রহারা বিধবা ক্রন্দন করিতেছেন ৷ প্রভাতের বাতাসে ক্রন্দনের সেই করুণ সুর ভাসিয়া আসিতেছে ৷ গৃহে ফিরিয়া তিনি — “কদম্বের বন হইতে কিবা শব্দ আচম্বিতে আসিয়া পশিল মোর কানে”, “হরি করচিহ্ন পদম্বুজে যাবক”, প্রভৃতি কয়েকটি গানকে সেই ক্রন্দনের সুরের অনুসরণে রূপায়িত করেন ৷ গানগুলি আজও রসিক দাসের সুরেই গীত হয় ৷ ধরা তালের চারি মাত্রার প্রথম দুইটি ছুটকে বাদ দিয়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছুটের মধ্যবর্তী স্থান হইতে ইহার আরম্ভ ৷ ইহা দুই ওয়ার্দা বা আট চাপড়ের গান ৷ রসিক দাস প্রায় বড় তালের গানই গাহিতেন ৷ রসিক ছিলেন খণ্ডিতা, কুঞ্জভঙ্গের সিদ্ধ গায়ক ৷ দুইটি পালা প্রাতঃকালেরই গান ৷ পালা দুইটির অনেক গান তিনি প্রভাতী সুরেই গাহিতেন ৷ স্বরলিপি ছিল না ৷ পিতার নিকটেই শুনিয়া শিখিয়াছিলেন ৷ স্বরগ্রামও তাঁহার জানা ছিল না ৷ কিন্তু সঙ্গীতজ্ঞগণের নিকট শুনিয়াছি তিনি প্রায় বিশুদ্ধ সুরেই কীর্তন গান করিতেন ৷ তালেও যেমন, সুরেও তেমনই তিনি কিছু কিছু নূতন পরিবর্তন আনিয়াছিলেন ৷ এরূপ প্রতিভাধর কীর্তনীয়া তাঁহার সময়ে মাত্র দুই-একজনই ছিলেন ৷ সৃষ্টির ক্ষমতা সকলের থাকে না ৷
যাঁহারা বহু কীর্তনীয়ার কীর্তন শুনিয়াছেন — তাঁহারাই ইহার বৈচিত্র্যের কথা অবগত আছেন ৷ ধনী ঠমকি ঠমকি চলি যায় ৷ যায় যায় বঁধুপানে ফিরে ফিরে চায় ৷ কলিকাতার কোন শ্রোতা এই গান শুনিলে তাঁহার ঠুংরী বলিয়া ভ্রম হইবে ৷ কীর্তনীয়া ফটিক চৌধুরী প্রথম জীবনে ধ্রুপদী খেয়াল শিক্ষা করিয়াছিলেন ৷ পরে কীর্তনের প্রতি আকৃষ্ট হন ৷ তিনি কোন কোন পদ গাহিবার পূর্বে গেয় পদগুলি যে যে রাগের সেই সেই রাগ আলাপ করিতেন ৷ শ্রীখণ্ডের ঠাকুরবাড়িতে তাঁহার বাঁধা আসর ছিল ৷ কীর্তনের বৈচিত্র্য বিষয়ে আরো একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি ৷
শ্রীল নরহরি সরকার ঠাকুরের তিরোভাব-তিথিতে, অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা একাদশীতে শ্রীখণ্ড গ্রামের বড়ডাঙ্গায় একটি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয় ৷ নামকীর্তনের সিদ্ধ গায়ক শ্রীল রামদাস বাবাজীর প্রিয় শিষ্য ত্রিভঙ্গ দাস বাবাজী বীরভূম একচক্রায় শ্রীপাদ নিত্যানন্দ প্রভুর আবির্ভাবস্থানে দেব-সেবাদির তত্ত্বাবধান করিতেন ৷ ক্ষেত্রটির সংস্কার-সাধনপূর্বক রামদাস বাবাজী মহারাজই তাঁহাকে তথায় পাঠাইয়া দেন ৷ ত্রিভঙ্গ দাস সুগায়ক ছিলেন ৷ বড়ডাঙ্গার উৎসবে রামদাস বাবাজী মহারাজ আসিতেন ৷ আরো কয়েকজন কীর্তনীয়াও আসিতেন ৷ চৈতন্যমঙ্গল গায়ক অবধৌত দাস আসিতেন ৷ ত্রিভঙ্গ দাসও আসিতেন ৷ শ্রীখণ্ডের শ্রীগৌর গুণানন্দ ঠাকুর একজন বিখ্যাত কীর্তনাচার্য ৷ বহু ছাত্র তাঁহার নিকট কীর্তন শিক্ষা করিয়া পরে দল গঠন করিয়াছেন ৷ আমি বহুদিন পূর্বে পর পর কয়েক বৎসরই বড়ডাঙ্গার উৎসবে গিয়াছিলাম ৷ এক বৎসর গিয়াছি, সেবার কীর্তনীয়াগণের মধ্যে ছিলেন সুবিখ্যাত অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায়, আখরিয়া হরিদাসের পুত্র গোপাল দাস, শ্রীগৌরগুণানন্দের ছাত্র স্বর্ণহাটির শচীনন্দন ৷ ইঁহাদের সঙ্গে অবধৌত দাস এবং ত্রিভঙ্গ দাসও ছিলেন ৷ উৎসব-শেষের পূর্ব রাত্রে রাসলীলা গান করিয়া পরদিন প্রভাতে কুঞ্জভঙ্গ গান করিতে হয় ৷ আমি দেখিলাম ত্রিভঙ্গ দাস বাবাজীকে রাস গাহিবার জন্য আহ্বান করা হইয়াছে৷ স্বয়ং গৌরগুণানন্দ ঠাকুর দোহার ৷ শ্রোতৃগণের মধ্যে শ্রীখণ্ডের রাখালানন্দ ঠাকুর শাস্ত্রী-সহ বহু গোস্বামী-সন্তান ও কীর্তন-গায়ক দুই-একজন উপস্থিত আছেন ৷ রাস গান শেষ হইল ৷ শ্রীরাধাকৃষ্ণ লীলাশেষে নিদ্রামগ্ন হইলেন ৷ ত্রিভঙ্গ দাস বাবাজী গান ধরিলেন— “ধীরে ধীরে কও গো কথা রাই যেন জাগে না ৷” ঈষৎ বিলম্বিত লয়ে একতালাতে আমি এই গান বহুবার শুনিয়াছি ৷ কিন্তু ত্রিভঙ্গ দাস বাবাজীর মুখে এ গান পৃথক সুরে শুনিলাম ৷ সুরটি খ্যামটার সুর বলিয়া ভ্রম হইল ৷ পরে গৌরগুণানন্দ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছিলাম এ সুরটিও পুরানো সুর এবং কীর্তনীয়া সমাজের অনুমোদিত সুর ৷ রাখালানন্দ ঠাকুর মহাশয়ও এ কথা সমর্থন করিয়াছিলেন ৷
প্রায় চারিশত বৎসর ধরিয়া প্রবহমান এই ধারায় বহু পরিবর্তন ঘটিয়াছে ৷ সে ইতিহাস কেহ লিখিয়া রাখে নাই ৷ পুরাতন কিছুটা লোপ পাইয়াছে, কিছু নূতন আসিয়া সে স্থান গ্রহণ করিয়াছে ৷ সুতরাং কীর্তনের কাঠামোটি বজায় থাকিলেও বিবর্তন যে ঘটিয়াছে, সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই ৷ রসিক দাস কিছুটা সংস্কার-সাধন করিয়াছিলেন ৷ ফটিক চৌধুরী সামান্যরূপে হইলেও নূতনকে আহ্বান করিয়া আনিয়াছিলেন ৷ আমার মনে হয় কীর্তনীয়াগণ যেমন তালের দিকে লক্ষ্য রাখেন, তেমনই তাঁহাদের সুরের বিশুদ্ধতার দিকেও লক্ষ্য রাখা আবশ্যক ৷ বদ্ধ জলা ভয়াবহ, কিন্তু যে স্রোতে বহিয়া চলে, তাহার মধ্যে প্রাণের ছন্দ স্পন্দিত হয় ইহা সুনিশ্চিত ৷ তাহা নূতনকে পরিহার করিয়া চলে না ৷ এইজন্যই আমি শ্রীমান্‌ রথীন্দ্রনাথ ঘোষের বিশুদ্ধ সুরে তালে কীর্তনগানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমর্থন করিয়াছি ৷