আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে, মালব, মালবগৌড়, গুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী, বা রামক্রী, কর্ণাট, দেশাখ বা দেবশাখ, দেশ-বরাড়ী, গোণ্ডকিরী ভৈরবী, বিভাস ও বরাড়ী বা বরাটী রাগগুলি “গীতগোবিন্দ”-পদগানের সঙ্গে সম্পর্কিত ৷ পূজারী গোস্বামী ও অন্যান্য অধিকাংশ টীকা ও ভাষ্যকাররা এই রাগগুলিরই উল্লেখ করেছেন এবং একথাও আলোচনা করেছি যে, রাণা কুম্ভ (রাণা কুম্ভ নামটি “রাণা কুম্ভা” নামে পরিচিত–যদিও রাণা কুম্ভা বলে অনেকে ব্যবহার করেন) ৷ “রসিকপ্রিয়া”-টীকায় বহু অন্যান্য রাগের নামোল্লেখ করেছেন৷ এই থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, গীতগোবিন্দে রাগসম্পর্কে গুণীসমাজে মতভেদেরও প্রয়োজন হয়েছিল৷ মূলপদগানে ও রাণা কুম্ভার টীকায় রাগ-সমাবেশের রীতির তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যায়,
১। (ক) প্রথম অষ্টপদীপ্রসঙ্গে কবি জয়দেব বলেছেন ঃ “মালবগৌড়রাগেণ রূপকতালেন গীয়তে।”
(খ) পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, রাণা কুম্ভা “রসিকপ্রিয়া”-র সূচনায় ( উপোদ্‌ঘাতে) চতুর্থ শ্লোকে বলেছেন ঃ “নত্বা মতরঙ্গভরতপ্রমুখান্‌ সুগীতসংগীতশাস্ত্রনিপুণাঞ্জয়দেববাচাম্‌।।” অর্থাৎ রাণা কুম্ভা গীতগোবিন্দের পদ-সম্পর্কিত সংগীত বিষয়ে আলোচনা করেছেন পূর্বগ বিদগ্ধ সংগীতবিদ্বান্‌ ভরত, মতঙ্গ প্রভৃতি-রচিত সংগীতশাস্ত্রকে অনুসরণ করে৷ তাছাড়া রাণা কুম্ভা ছিলেন যথার্থ অভিজাত ও সংগীতধারায় বিজ্ঞানী এবং তাঁর রচিত “সংগীতমীমাংসা” ও “সংগীতরাজ” গ্রন্থ-দুটি সেকথা প্রমাণ করে৷ টীকায় উপোদঘাতের উনিশ সংখ্যক শ্লোকের শেষে তিনি বলেছেন : “গমকালাপপেশলতয়া মধ্যমগ্রামে ষাড়বের মধ্যমগ্রহেণ মধ্যমাদিরাগেণ গীয়তে৷” প্রথম অষ্টাপদীসম্পর্কিত টীকায় বারো সংখ্যক শ্লোকে তিনি পুনরায় বলেছেন : “* * ধবলোঽযংপ্রবন্ধবাট৷ রাগোঽত্র মধ্যমাদিঃ স্যাদাদিতালো বিলম্বিতঃ ৷৷ লয়ঃ স্যান্মাগধীবীতিঃ শৃঙ্গাবোঽত্র রসঃ স্মৃতঃ৷” সুতরাং এখানে পাই মধ্যমাদি তথা মধুমাধবী রাগের উল্লেখ ৷ এই সকল রাগরূপ-সম্বন্ধে পূর্বে আলোচনা করেছি ৷
২৷ (ক) দ্বিতীয় অষ্টপদীসম্পর্কে কবি উল্লেখ করেছেন ঃ “গুর্জরীরাগা-নিঃসারতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা প্রারম্ভে বলেছেন ঃ “ইদানীং বর্ণ্যমানং শ্রীকৃষ্ণংস্বরূপনিরূপণদ্বারা মঙ্গলগীতেন স্তৌতি৷ তত্রেদমাদ্যং পদং ললিতরাগেণ লখ্বাদিতাল ইতি আদিতালে গীয়তে”, অর্থাৎ ললিতরাগে ও লঘু-আদিতালে গীত হবে দ্বিতীয় প্রবন্ধ৷
৩৷(ক) তৃতীয় অষ্টপদী সম্পর্কে মূলে আছে ঃ “বসন্তরাগ যতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা এ প্রসঙ্গে টীকার নবম শ্লোকে বলেছেন ঃ “মধ্যা নায়িকা ৷ গুর্জরীরাগেণ ঋষভাদিনা” –যদিও “বিপ্রলম্ভাখ্যঃ শৃঙ্গারো রসঃ”-ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “* * বসন্তরাগে ঝম্পাথ্যতালে মধ্যলয়াঞ্চিতে৷” সুতরাং তৃতীয় অষ্টপদী বা প্রবন্ধ-প্রসঙ্গে গুজরী রাগে ও মধ্যলয়ে গীত হবে তৃতীয় প্রবন্ধ৷
৪৷ (ক) চতুর্থ অষ্টপদীপ্রসঙ্গের মূলে আছে ঃ “রামকরীরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) “রাজ্ঞা কুম্ভেন তেন” প্রভৃতি বলে রাণা কুম্ভ রাগসম্পর্কে বলেছেন ঃ “যত্র স্যাদ্‌গুর্জরীরাগস্তালো ঝম্পেতি ভাগশঃ * * ৷”
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, চতুর্থ প্রবন্ধের তৃতীয় শ্লোক “গোপবধুরনুগায়তি * * পঞ্চমরাগম্‌”–এই পঞ্চমরাগ-সম্পর্কে পূজারী গোস্বামী অর্থ করেছেন ঃ “* * উন্মীতঃ পঞ্চমস্বরো যত্র তং রাগামনুগায়তি”৷ রসমঞ্জরী ব্যাখ্যায় শংকরমিত্র বলেছেন ঃ “পঞ্চমাখ্যো রাগো যত্র”৷ রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “পঞ্চমরাগো যেন বা, * * পঞ্চমস্বরোপলক্ষিতো রাগো যেন বা৷”
৫৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “গুর্জরীরাগেণ যতিতালেন গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা নবম শ্লোকের ব্যাখ্যার পর “গণগ্রামং”-পদপ্রসঙ্গে বলেছেন ঃ (১) “ইদানীং রাধা তদেব রহস্যং ভঙ্গ্যন্তরেণাহ — “রাগো ধন্যাসিকো যত্র তালো বর্ণয়তিঃ স্মৃতঃ * *৷ স চায়ং মধুরিপুরত্নকণ্ঠিকা নাম পঞ্চমঃ প্রবন্ধো ভৈরবরাগেণ গীয়তে গণয়তীতি৷” অর্থাৎ পঞ্চম প্রবন্ধ ধন্যাসিক বা ধানসী এবং ভৈরবরাগে ও যতিতালে গেয়৷
৬৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “মালবগৌড়রাগেণ একতালেন চ গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে — গীতৌ ভৈরবরাগেণ তালে বর্ণযতৌ যথা৷ আভোগান্তস্থিতৈঃ পাটৈঃ স্বরৈঃ পদ্যাঞ্চিতস্ততঃ ৷৷” অর্থাৎ ষষ্ঠ প্রবন্ধ ভৈরবরাগে ও যতিতালে গীত হবে৷
৭৷(ক) মূলে আছে ঃ “গুর্জরীরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “রাগো গৌড়াকৃতির্যত্র প্রতিমণ্ঠপুরস্কৃতঃ ৷ আভোগান্তে তথা পাটস্বরৈঃ পদ্যগণাঞ্চিতঃ ৷৷ শৃঙ্গাররসসংপূর্ণ * *৷ ” অর্থাৎ ষষ্ঠ প্রবন্ধ গৌড় বা গৌড়াকৃতি রাগে ও প্রতিমণ্ঠতালে গেয়৷
৮৷ (ক) গীতিগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “কর্ণাটরাগৈকতালীতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) এই প্রসঙ্গে রাণা কুম্ভা বলেছেন —
প্রতিমণ্ঠকতালেন রাগে দেশাঙ্কসংজ্ঞিতে৷
পদাত্তূর্যাক্ষরৈর্যুক্তঃ পদাৎ সংগমতস্তথা৷৷
আকারোপচিতালাপগমককাকুবিগ্রহঃ ৷
আভোগাত্তেনকৈঃ পাটৈঃ প্রচুরৈরতিপেশনঃ ৷৷
মোটকথা সপ্তম প্রবন্ধ দেশাক বা দেবশাখ-রাগে ও প্রতিমণ্ঠতালে গান করা কর্তব্য৷
৯৷(ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “দেশাখরাগৈকতালীতালাভ্যং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন —
” মালবশ্রীঃ স্মৃতো রাগস্তালো নিঃসারসংজ্ঞকঃ ৷
রাগ্‌গেয়কারনামাঙ্কপদতস্তেন সন্ততিঃ ৷৷
ততঃ পাটাঃ পদানি স্যুঃ পঞ্চমানি রসোঽত্র যঃ ৷
শৃঙ্গারো বাসুদেববস্য ক্রীডনং বাসকাদিভিঃ ৷৷”
অর্থাৎ অষ্টম প্রবন্ধ মালবশ্রী রাগে ও নিঃসারতালে গেয়৷
১০৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “দেশীবডীরাগেণ রূপকতালেন গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “সংগীতরাজে —
নিঃসাবতালবচিতো রাগে কেদারসংজ্ঞকে৷
কবিনামাঙ্কিতপদাৎ পাটৈঃ স্বল্পতবৈশ্চিতঃ ৷৷
অর্থাৎ নবম প্রবন্ধ কেদাররাগে নিঃসারতালে গেয়৷
১১৷ (ক) মূলে আছে ঃ “গুর্জরীরাগেণ একতালীতালেন গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা এই প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ ” গীত্যাদি পূর্বোক্তমেব৷” “পূর্ববৎ” বলতে দশম প্রবন্ধ যে কেদাররাগ ও নিঃসারতালের প্রয়োগ আছে, এখানে সে প্রয়োগই বুঝতে হবে ৷
১২৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “গুণকরীরাগেণ রূপকতালেণ গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে —
মালবীয়ঃ স্মৃতো গৌডো রাগস্তালোহড্ডতালকঃ ৷
শৃঙ্গারো বিপ্রলম্ভাখ্যো বসো দেবাদিবর্ণনম৷
পদসন্ততিস্তেনাঃ পাটাঃ স্বরসমুচ্চয়ঃ ৷৷
তত পদ্যানি যত স্যুর্লমধ্যমমানতঃ৷
রাণা কুম্ভার অভিমতে দ্বাদশ প্রবন্ধ মালবরাগে ও অড্ডতালে গেয়৷
১৩৷(ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “মালবরাগ-যতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে —
রাগঃ স্যাৎ স্থানগৌড়াখ্যস্তালো –বর্ণযতি -রসঃ৷
শৃঙ্গারো বিপ্রলম্ভাখ্যাঃ প্রমদা মদনাকুল৷ ৷৷”
অর্থাৎ ত্রয়োদশ প্রবন্ধ স্নানগৌড় তথা গৌড়রাগে এবং যতিতালে গীত হবে৷
১৪৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “বসন্তরাগ-যতিতালাভ্যাং গীয়তে ।”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথাত্র সংগীতরাজে —
শ্রীরাগো যত্র রাগঃ স্যাত্তালস্তু দ্রুতমণ্ঠকঃ৷
বর্ণনং বাসুদেবস্য হরিস্তদ্ব্যত্যয়ে স্ত্রিয়াঃ ৷৷
পদেভ্যঃ পাটসন্তানং স্বরান্তেনাস্তথৈব চ৷
অর্থাৎ চতুর্দশ প্রবন্ধে শ্রীরাগ ও দ্রুত মণ্ঠকতালের ব্যবহার হবে৷
১৫৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে অছে ঃ “গুর্জরীরাগৈকতালীতালেন গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে —
দ্রুতমণ্ঠেন তালেন দ্রুতেনৈব লয়েন চ৷
মহ্লারে রসরাজে স্যাৎ পদানাং সংততে পুনঃ ৷৷
স্বরগ্রামস্তথা পাঠাস্তেনা অপি যথাক্রমম্‌৷”
অর্থাৎ পঞ্চদশ প্রবন্ধ মহলার বা মল্লাররাগে ও দ্রুতমণ্ঠতালে গীত হবে৷
১৬৷(ক) মূলে আছে ঃ “দেশবরাড়ীরাগেণ রূপকতালেন গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন —
“তথা চ সংগীতরাজে —
রাগো বরাটিকা যত্র তালো বর্ণ-যতিস্তথা৷
পদানি স্বেচ্ছয়ালাপ ভূষিতানি যথাদ্যুতি৷৷
ততঃ স্বরাশ্চ পাটাশ্চ ততঃ পদ্যানি কানিচিৎ৷৷”
অর্থাৎ ষোড়শ প্রবন্ধ বরাটিকা বা বরাটি রাগে ও যতিতালে গেয়৷
১৭৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “ভৈরবীরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে —
তালো বর্ণযতির্মেঘরাগো দেবাদিবর্ণনম্‌৷
বিপ্রলম্ভাথ্যশৃঙ্গারো রসঃ করুণবেদনম্‌৷
কবিনামাঙ্কিতপদপ্রান্তে পাটস্বরাবলিঃ ৷৷”
অর্থাৎ সপ্তদশ মেঘরাগে ও যতিতালে গীত হবে৷
১৮৷(ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “গুর্জরীরাগ-যতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে —
নট্টরাগস্তৃতীয়াখ্যস্তালো মধ্যে ক্বচিৎ ক্বচিৎ ৷
পদানাং শোভয়ালাপগুম্ফানাং নানাহেতুকম৷৷
অন্তে পাটাঃ স্বরাস্তেনাস্তদন্তে পদগুম্ফনম৷ ”
অর্থাৎ অষ্টাদশ প্রবন্ধ নটরাগে ও তৃতীয় তালে বা ত্রিতালে গীত হয় (বা কখনো কখনো গীত হয়)৷
১৯৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “দেশবরাডীরাগাষ্টতালী গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে —
তালো বর্ণযতী রাগাঃক্রমাদষ্টাদশ স্মৃতাঃ ৷
মধ্যমাদিশ্চ ললিতো বসন্তো গুর্জরী তথা৷৷
ধনাশ্রী ভৈরবী গৌণ্ডকৃতিদেশাঙ্কিতাপি চ ৷
মালবশ্রীশ্চ কেদার মালবীযাদিগৌণ্ডকৌ ৷৷
স্থানগৌণ্ডশ্চ শ্রীরাগো মহ্লাবশ্চ বরাটিকা৷
মেঘরাগশ্চ ভদ্রাবদঘোরনীনিয়তা ইমে।।
যাবদ্রাগং পদানি স্যুঃ প্রান্তে পাটস্বরাণি তু৷
ক্কচিৎক্কচিদগতালাপভূষিতাণি যথারুচি৷৷
* * *
যত্র স্যাৎ স প্রবন্ধোঽয়ং রাগরাজি-বিরাজিতঃ ৷৷”

এই উনবিংশ প্রবন্ধটি গীতিরূপে প্রকাশ করায় বৈচিত্র্য আছে৷ এতে যতিতালে এবং মধ্যমাদি বা মধুমাধবী, ললিত, বসন্ত, গুর্জরী, ধনাশ্রী, ভৈরবী, গৌণ্ডকৃতি, দেশাখ বা দেবশাখ, মালবশ্রী, কেদার, মালব, গৌণ্ডকী, স্থানগৌণ্ড বা স্থানগৌড়, শ্রীরাগ, মহলার বা মল্লার, বরাটিকা বা বরাটী, মেঘ এই আঠরোটি রাগের সমাবেশ দিয়ে গান করতে হয়৷ শ্লোক বা পদংখ্যা ১৬ কিম্বা ১৭, কিন্তু ১৮টি রাগের বিকাশ থাকে এই প্রবন্ধে৷ মোটকথা রাণা কুম্ভার মতে, ১৯শ সংখ্যক প্রবন্ধটি রাগমালা দিয়ে গান করতে হয়৷
২০৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “”বসন্তরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে৷””
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “তথা চ সংগীতরাজে —
আদিতালঃ প্রথমতঃ প্রতিমণ্ঠস্ততঃ পরম্‌৷
চর্তুমাত্রহ্বমণ্ঠশ্চ তুর্যঃ স্যাদড্ডতালকঃ ৷৷
তালো বর্ণ-যতিঃ পশ্চান্নবমাত্রিকমণ্ঠকঃ ৷
নিঃসারশ্চ তথা ঝম্পা দ্রুতমণ্ঠশ্চ রূপকঃ৷৷
প্রতিতালস্ত্রিপুটক একতালীতি সংজ্ঞয়া ৷
ত্রয়োদশ ক্রমাত্তালাঃ প্রতিতালং পদানি চ
* * *
প্রতিতালং প্রয়োগোঽপি রাগো নন্দো নিগদ্যতে ৷৷
অর্থাৎ বিংশ সংখ্যক প্রবন্ধে ১৩টি পদের সমাবেশ আছে, সুতরাং নন্দরাগে এবং ১৩টি তালে ১৩টি পদ গান করতে হবে৷ ১৩টি তাল –আদি, প্রতিমণ্ঠ ৪ মাত্রাবিশিষ্ট মণ্ঠ, অড্ড, যদি, ৯ মাত্রাবিশিষ্ট মণ্ঠ বা মণ্ঠক, নিঃসার, ঝম্প দ্রুতমণ্ঠ, রূপক, প্রতি ত্রিপুটক বা ত্রিপুট ও একতালী৷ এতগুলি তালের সমাবেশ থাকার জন্য হরিপ্রেমিক রাণা কুম্ভা এই প্রবন্ধের নাম দিয়েছেন “শ্রীহরিতালরাজিজলধরবিলসিতঃ” ৷ অন্যান্য টীকাকারগণ নাম দিয়েছেন “সানন্দ-গোবিন্দ” প্রবন্ধ ৷ এতে পটহ, মুরজ, করট, শৃঙ্গ, শঙ্‌খ, ডমরু, ঢক্কা, কাহলী, মর্দল, দুন্দুভি প্রভৃতি বাদ্যের সহযোগ থাকবে৷
২১ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “বরাড়ীরাগ-রূপকতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা একবিংশ ও দ্বাবিংশ প্রবন্ধের রাগ ও তাল বর্ণনা একসঙ্গে করেছেন, কারণ বরাড়ীরাগের সমাবেশ উভয় প্রবন্ধেরই আছে৷ তবে দ্বাবিংশ প্রবন্ধের তাল যতি৷
২২৷ (ক) মূলে আছে ঃ “বরাড়ীরাগ-যতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা (একবিংশ ও দ্বাবিংশ এই উভয়-প্রবন্ধ সম্বন্ধে) বলেছেন ঃ
ক্রমেণ নট্টকেদারশ্রীরাগস্থানগৌড়কাঃ ৷
ঘোরণী মালবীয়শ্চ বরাটী মেঘরাগকঃ ৷৷
মালবশ্রীর্দেবশাখো গৌণ্ডকৃচ্চাথ ভৈরবী৷
ধন্নাসিকা বসন্তশ্চ গুর্জরী চ মহ্লারকঃ ৷৷
ললিতঃ সপ্তদশমো বাগাস্তাবন্তি চ ক্রবাৎ৷
পদানি যেষু তালাঃ স্যুরিতস্তন্নাম কীর্ত্যতে৷৷
আদ্যত্রিসপ্তদশমদ্বাদশে দ্রুতমণ্ঠকাঃ৷
দ্বিতীয়ে নবমে চৈকাদশে চৈব ত্রয়োদশে ৷৷
পদে পঞ্চদশে সপ্তদশে রূপক ইবিতঃ ৷
চতুর্থে প্রতিপালব্যা দ্রুততালঃ পঞ্চাম স্মৃতঃ৷৷
ত্রিপুট ষষ্ঠাষ্টময়োঃ স্যাদ্রুতপ্রতিমণ্ঠকঃ৷
চতুর্দশে ষোড়শে চ ভদ্রঃ স্যাৎপ্রতিতালকম্‌৷৷
মধ্যমাদৌ পুনর্মুক্তিঃ শৃঙ্গাবঃ সাভিলাষয়োঃ ৷
* * *
স রাগশ্রেণীনামায়ং প্রীতিকৃৎ কমলাপতেঃ৷৷
এই প্রবন্ধ-দুটিতেও রাগমাত্রার সমাবেশ আছে৷ নট, কেদার, শ্রী, স্থানগৌড়,ঘেরণী (?), মালব বা মালবী, বরাটী, মেঘ, মালবশ্রী, দেবশাখ,গৌড়কৃতি, ভৈরবী, ধন্নাসিকা বা ধনাসি, বসন্ত, গুর্জরী, মহ্লার বা মল্লার ও ললিত –এই ১৭টি রাগ৷ ১ম, ৩য়, ৭ম, ১০ম ও ১৮শ পদে দ্রুতমণ্ঠক; ২য়, ৯ম,১১শ, ১৩শ, ১৫শ, ১৭শ পদে রূপক ৪র্থ ও ৫ম পদে প্রতিতাল, ৬ষ্ঠ পদে ত্রিপুট ও ৮ম পদে দ্রুতমণ্ঠ ৷ ১৪শ ও১৬শ পদে প্রতি তালের ব্যবহার হবে৷
২৩৷(ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে ঃ “বিভাসরাগৈকতালীতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন —
পদানাং দশকং যত্র তালে বর্ণ-যতৌ ভবেৎ৷
ধ্রুবঃ প্রতিপদং গেয়ঃ কবিনামাঙ্কিতাৎ পদাৎ ৷৷
গীতালাপান্‌ যথাশব্দং প্রতিতালে ততঃপবম্‌ ৷
পাটাস্তেনাঃ স্বরাশ্বৈব শৃঙ্গারো রস-উত্তম ৷৷
দেবাশাখাভিধৌ রাগঃ প্রবন্ধে সংপদৃশ্যতে৷
দেবশাখে বা দেশাক রাগে ত্রয়বিংশ প্রবন্ধ গান করতে হবে৷ পদের দশক যতিতালের থাকবে৷ পুনরায় “দোভ্যা সংযমিতঃ পয়োধরভরেণাপীডিতম্‌” প্রভৃতি পদ-প্রসঙ্গে রাণা কুম্ভা বলেছেন —
বিজয়ানন্দতালেন গৌডীরাগে বিরচ্যতে৷
পদ্যং পাটাঃ স্বরাস্তেনা লীলা নায়কসংভবাঃ ৷
* * *
রাগে কর্পটবঙ্গালে স পৌরুষরসাৎপবঃ৷৷”
সেভাবে “তস্যাঃ পাটালাপনিজাঙ্কিতমুরো” প্রভৃতি চতুর্থ পদটি মরুকৃতি (মারু) রাগে ও যতিতালে গান করতে হবে —
যতিতালেন তালেন পদ্যং পাটস্বরাস্তথা ৷
* * *
রাগো মরুতকৃতির্যত্র দ প্রবন্ধে নিগদ্যতে ৷৷
২৪৷ (ক) গীতগোবিন্দের মূলে আছে : “রামকরীরাগষতিতালাভ্যাং গীয়তে৷”
(খ) রাণা কুম্ভা বলেছেন —
আদিতালস্তথা পঞ্চ হরবক্ত্রসমুদ্ভবাঃ ৷
প্রতিমণ্ঠশ্চতুর্মাত্রো মণ্ঠশ্চৈবাড্ডতালকঃ ৷৷
তালো বর্ণযতিশ্চৈব জয়মঙ্গলসংজ্ঞিতঃ ৷
বিজয়ানন্দনামা চ জয়শ্রীসংজ্ঞকঃ পরঃ ৷৷
প্রতিতালং পদানি স্যুঃ পাটাস্তদুভয়ং তথা৷
মধ্যে মধ্যে যথাশোভালপ্তিযুক্তির্বিশেষবৎ ৷৷
বিশেষতো বর্ণযতৌ যদা শ্রীসংজ্ঞিকোঽপি চ ৷
তেনকাঃ স্যুঃ পদস্থানে প্রতিতালেন বেশ্যতে ৷৷
মুক্তিপাদদাক্ষরৈর্ষু ক্তৈরালাপেন পুরস্কৃতৈঃ ৷৷
পদান্যেবং ষোড়শ বৈ তালা একোনবিংতিঃ ৷
গৌডঃ স্যাদ্দেশতালাদিরাগাঃ সর্বপদাশ্রয়ঃ ৷৷

অর্থাৎ আদি, প্রতিমণ্ঠ (৪ মাত্রাবিশিষ্ট), মণ্ঠ, অড্ড, যতি, জয়মঙ্গল, বিজয়ানন্দ ও জয়শ্রী প্রভৃতি তালের এবং গৌড়রাগের সমাবেশ থাকবে চতুবিংশ প্রবন্ধে৷
এভাবে রাণা কুম্ভা “গীতগোবিন্দ” -পদগানে রাগ, তাল এবং রাগমালা ও তালশ্রেণীর সমাবেশ ঘটিয়েছেন নতুন ভাবে৷ মনে হয়, রাণা কুম্ভার সময়ে (১৫শ শতক) গীতগোবিন্দে নূতন রাগ-সমাবেশের প্রয়োজন হয়েছিল তদানীন্তন রুচি ও ধারা অনুযায়ী ৷ ভারতের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে গীতগোবিন্দ গানে রাগপ্রকাশে ও গায়কীপদ্ধতিতে অনেক রকম মতভেদ দেথা যায়৷ যেমন বাংলাদেশের গীতরীতির ও মহারাষ্ট্রের কিংবা দক্ষিণ-ভারতের বিশেষ করে তাঞ্জোরের গীতিপদ্ধতির মধ্যে অনেকাংশে মিল নাই৷ মনে হয়, ১২শ শতকের শেষার্ধে কবি জয়দেব ও জয়দেব-অনুসারীরা গীতগোবিন্দপদ যেভাবে গান করতেন রাগের যে প্রকাশভঙ্গীকে অনুসরণ করে, পরবর্তীকালে সে ধারা বা পদ্ধতি নানান্‌ কারণে লুপ্ত হয়ে যায়৷