সমস্ত ভারতীয় সংগীতে তালের প্রাধান্য বিশেষ লক্ষ্য করিবার বস্তু৷ সংগীতকারেরা বলেন যে, তাল বিনা সংগীতের প্রতিষ্ঠা নাই৷ তাহার কারণ এই যে, সুর সহজেই ছন্দকে অবলম্বন করিয়া সার্থক হয়৷ শোকাতুরা রমণীরা যে বিনাইয়া বিনাইয়া রোদন করেন, তাহারও মধ্যে ছন্দ আছে৷ এই ছন্দ নানাভাবে মুকুলিত হইয়া উঠে৷ ছন্দেরও যেমন নির্দিষ্ট সংখ্যা নাই, তালও তেমনি অসংখ্য৷
ন রাগানাং ন তালানাং ন বাদ্যানাং বিশেষতঃ
নাপি প্রবন্ধগীতানামস্তো জগতি বিদ্যতে৷৷

সুতরাং ছন্দের বৈচিত্র্য অনুসারে তালের বৈচিত্র্য কল্পিত হইয়াছে৷ ভারতীয় সংগীত এই তালের দিকে যেরূপ মনোযোগ দিয়াছেন, অন্য কোথায়ও তাহার দৃষ্টান্ত দেখা যায় না৷ সংগীতের উৎকর্ষ যেমন যেমন বাড়িয়াছে,তালেরও তেমনি সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম বিভাগ পরিকল্পিত হইয়া এক বিরাট সৌধ নির্মিত হইয়াছে৷ বৈঠকী গানের সঙ্গে মৃদঙ্গে বা তবলা-বাঁয়ায় যাঁহারা সংগত করিতে অভিলাষী তাঁহারা জানেন যে, অগণিত তালের বোল তাঁহাদিগকে যত্নে অভ্যাস করিতে হয়৷ সংগীতরত্নাকরের সময় (ত্রয়োদশ শতাব্দী) বা তাহারও পূর্ব হইতে সংগীতশাস্ত্রে এইসকল বাদ্যের বোল গ্রথিত হইয়া সংগীতশাস্ত্রকারেরও প্রতিপাদ্য হইয়োছে৷
কীর্তনে তালের সংখ্যা ১০৮ প্রকার কথিত হয়৷ ইহাদের মধ্যে নিম্মলিখিত তালগুলি সমধিত সুপরিচিত : একতালী, দশকুশী, সমতাল, পাকছটা, শ্রুতি, পোট, ধরন, গঞ্জল, রূপক, বিষমপঞ্চ, পঞ্চমশোয়ারি, ছুটা, তেওট, তেওরা, তিউটি, ধড়া, ডাশপাহিড়া, জপতল, যৎ, ঝাঁপতাল,দুঠুকী, বীরবিক্রম, আড়তাল, নন্দন, চঞ্চুপুট, মণ্ঠক, ধামালি, ব্রহ্মতাল, রুদ্রতাল, ঝুজ্‌ঝুটি, শশিশেখর, চন্দ্রশেখর, নটশেখর, লোফা —ইত্যাদি৷
এই সকল তাল আবার ছোট, মধ্যম, ও বড় ভেদে নানাপ্রকার হয়, যথা— বড় দশকুশী, মধ্যম দশকুশী, ছোট দশকুশী ইত্যাদি৷ দ্রুত ও বিলম্বিত ভেদই এই প্রকারভেদের হেতু৷ মাত্রারও তারতম্য লক্ষণীয়৷ বড় দশকুশী গুরু ও লঘু ধরিয়া ৫৬ মাত্রা (২৮ + ২৮), মধ্যম দশকুশী (১৪ + ১৪) ২৮ মাত্রা; ছোট দশকুশী ১৪ মাত্রা, তেওট ১৪ মাত্রা,জপতাল ১২ মাত্রা, একতালা ১২, ঝাঁপতাল ১০, লোফা ৮, যৎ ৭ মাত্রায় নিষ্পন্ন হয়৷
কীর্তনগানের বিশেষতঃ উচ্চাঙ্গের কীর্তনে অনেক সময়ে বিলম্বিত লয়ের ব্যবহার হয়৷ ইহার কারণ আর কিছুই নহে — শ্রোতাকে ভাবিবার সময় দেওয়া৷ অর্থাৎ গায়ক যে চিত্রটি অঙ্কিত করিতেছেন, শ্রোতাকে ভাবিবার সময় দেওয়া৷ অর্থাৎ গায়ক যে চিত্রটি অঙ্কিত করিতেছেন, শ্রোতাকেও আপনার চিত্তে সে চিত্রের উদ্দীপনায় অবসর প্রদান করা৷ অনেক বড় বড় ওস্তাদও কীর্তনের এই বিলম্বিত লয়ের বিন্যাস দেখিয়া চমৎকৃত হন৷
এই সকল তাল ও দ্রুত, মধ্যম, বিলম্বিত লয়ের বাদ্য অভ্যাস করিতে অনেক সময় ও সহিষ্ণুতার প্রয়োজন হয়৷ বর্তমানকালে উপযুক্ত উৎসাহের অভাবে এইরূপ গান ও বাদ্যের অভাব ঘটিবার সম্ভাবনা হইয়াছে৷ পূর্বে যে সময়ে কীর্তনের প্রসার ও উন্নতি ছিল সে সময়ে গরানহাটী, মনোহরসাহী রেনেটি ও মন্দারিণী এই চারি ঘরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকার বাদ্যে অভিজ্ঞ অনেক ব্যক্তি ছিলেন৷ এখনও কীর্তনবিদেরা তাঁহাদের নাম জানেন৷ ভারত দাস, ময়নাডালের নিকুঞ্জ মিত্র, বৃন্দাবনধামের গৌরদাস প্রভৃতি খোলবাদ্যে প্রভুত যশঃ লাভ করিয়াছিলেন৷
কীর্তনে গায়কের ন্যায় বাদকেরও অনুভূতি প্রবল হওয়া আবশ্যক৷ ভাবের সহিত গান না হইলে যেমন রসসঞ্চারে বাধা হয়, তেমনি ভাবের সহিত বাদ্য না হইলেও রসপুষ্টিতে বাধা হয়৷ বর্তমানকালে শ্রীযুক্ত নবদ্বীপ ব্রজবাসী প্রভৃতির ন্যায় প্রসিদ্ধ খোলবাদকের বাদ্য শুনিলেই ইহা বুঝিতে পারা যায়৷ মনে করুন, গায়ক ভাবকে ফুটাইয়া তুলিবার জন্য আখর ধরিয়াছেন, এই আখর যেমন স্তরে স্তরে বিস্তৃত হইবে, বাদ্যও তেমিন স্তরে স্তরে বিস্তৃত হইয়া গীতের পারিপাট্য বিধান করিবে৷ বাজনার এই ভঙ্গীকে বলে ‘কাটান’৷ আখরকেও কাটান বলা হয়৷ সুতরাং গায়ক ও বাদকের পূর্ণ সহযোগিতা না থাকিলে গান সফল হয় না৷ গায়ক পদ ও সুরের দ্বারা যেরূপ রসমাধুরী সৃষ্টি করিতে চাহেন, বা কাটানের উপর কাটান দিয়া যে অনুভূতি জাগ্রত করিতে চেষ্টা করেন, বাদক যদি তাহা অনুভব করিয়া বাদ্যের তরঙ্গে সেই সেই ভার বিস্তার করিতে সহায়তা করেন, তরে সে গীত অপূর্ব হয়৷ ইহাই কীর্তনের ‘টেক্‌নিক্‌’ ৷
কীর্তনের টেক্‌নিক্‌ এক সময়ে এরূপ উন্নতি লাভ করিয়াছিল যে, কীর্তনকে পল্লীসংগীত বা অন্তর্ভুক্ত কার চলে না৷ অনেকে এই টেক্‌নিক্‌ অবগত নহেন বলিয়া কীর্তনের প্রতি সুবিচার করিতে পারেন না৷ একদিক দিয়া গানে সুরের যে টেক্‌নিক্‌ গড়িয়া উঠিয়াছিল, অন্য দিকে বাদ্যেও তাহা প্রতিফলিত হইয়া কীর্তনের উন্নতির যুগকে সংগীতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় যুগ করিয়া তুলিয়াছিল৷
বর্তমান কালে যাঁহারা বৈঠকী গানের টেক্‌নিক্‌ আয়ত্ত করিয়াছেন, তাঁহারা কীর্তনের টেক্‌নিক্‌কে দুর্বোধ্য বলিয়া উপেক্ষা করেন৷ তাঁহারা সুর সম্বন্ধে বৈচিত্র্য দেখিয়া মনে করেন, কীর্তনের সুরের অবনতি ঘটিয়াছে, তেমনি তাল-সম্বন্ধে মাত্রা গণিয়া হতাশ হইয়া ভাবেন যে কীর্তনে বিশুদ্ধ তাল নাই৷ বস্তুতঃ সূক্ষ্ম মাত্রাবিভাগের উপরই কীর্তনের তাল প্রতিষ্ঠিত৷ কীর্তনের সুর ও তাল সম্বন্ধে বিচার করিতে হইলে উভয়ই আয়াস স্বীকার করিয়া অভ্যাস করিতে হয়৷
আবার যদি কখনও বাঙালী কীর্তন-গানের মর্যাদা উপলব্ধি করে এবং সুরজ্ঞ গায়কেরা ইহার টেক্‌নিক্‌ অভ্যাস করিবার কষ্ট স্বীকার করিতে উদ্যম করেন, তবেই কীর্তনের উন্নতি হইতে পারে৷