মুর্শিদাবাদ জেলায় তালিবপুর গ্রামে (ইস্টার্ন রেলপথের সালার স্টেশনের নিকট) প্রাণকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় নামে একজন ব্রাহ্মণ বাস করিতেন ৷ তাঁহার মামার বাড়ি ছিল বেলডাঙ্গা গ্রাম (ইস্টার্ন রেলপথের নিকট)৷ মাতুলের সন্তানাদি ছিল না ৷ প্রাণকৃষ্ণ মাতুলের উত্তরাধিকারীস্বরূপ বেলডাঙ্গায় আসিয়া বাস করেন এবং তাঁহার সম্পত্তি-সহ -দেবসেবা ও বহুশিষ্য প্রাপ্ত হন ৷ গুরুগিরি করিতেন, তাই লোকে তাঁহাকে অধিকারী বলিত ৷ শেষে তিনি প্রাণকৃষ্ণ অধিকারী রূপেই পরিচিত হন ৷ প্রাণকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম রূপচাঁদ ৷ স্বরূপচাঁদ নামেও তাঁহার অপর এক পুত্র ছিল ৷ ১১২৯ সালে বেলডাঙ্গায় রূপচাঁদের জন্ম হয় ৷
পাঠশালায় কিছুদূর লেখাপড়া শিখিয়া রূপচাঁদ এক চতুষ্পাঠীতে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেন ৷ অতঃপর তিনি নিজেদের শিষ্যবাড়িতে এবং নিকটবর্তী গ্রামে শ্রীমদ্‌ভাগবতের কথকতা করিতে থাকেন ৷ রূপচাঁদের কণ্ঠ মধুর ছিল ৷ শৈশব হইতেই তিনি গান শুনিতে ও গান গাহিতে ভালবাসিতেন ৷ কথকতা করিতে গিয়া সঙ্গীতের উপর তাঁহার প্রবল অনুরাগে জন্মে ৷ তিনি সঙ্গীতশিক্ষার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠেন ৷ এই সময়ে সালারের নিকট শিমুলিয়া গ্রামে এক সন্ন্যাসীর সহিত তাঁহার পরিচয় ঘটে ৷ সন্ন্যাসী অতি যত্নে রূপচাঁদকে শিক্ষাদান করেন ৷ শিক্ষা সমাপ্ত হইলে সন্ন্যাসীর নিকট আশীর্বাদস্বরূপ একটি ‘ডুবকী’ প্রাপ্ত হন ৷ ডুবকী যেন মন্ত্রসিদ্ধ ছিল, ডুবকী বাজাইয়া সুগায়ক রূপচাঁদ যখন মধুর কণ্ঠে গান গাহিতেন, তখন নরনারী তন্ময় হইয়া শুনিত ৷ অতঃপর কথকতা ত্যাগ করিয়া রূপচাঁদ কীর্তনের দল করেন ৷ দলে মৃদঙ্গবাদক থাকিলেও সন্ন্যাসীদত্ত ডুবকীটি তিনি ত্যাগ করেন নাই ৷ মূল গায়করূপে তিনি ডুবকী বাজাইয়া গান করিতেন ৷
মনোহরসাহী কীর্তনের সুর ভাঙ্গিয়া রূপচাঁদ হাল্কা সুরের সৃষ্টি করেন ৷ রূপচাঁদের কীর্তনই ‘ঢপ’ নামে পরিচিত ৷ প্রবাদ আছে, কীর্তন গাহিয়া ফিরিবার পথে সদলে রূপচাঁদ একদিন দস্যুহস্তে পতিত হইয়াছিল ৷ মৃত্যুর পূর্বে শ্রীভগবানের নাম গাহিবার জন্য তিনি দস্যু-দলপতির নিকট অনুমতি ভিক্ষা করেন ৷ দলপতি অনুমতি দিলে তিনি ডুবকী বাজাইয়া স্বরচিত পদ গাহিয়াছিলেন ৷ গান শুনিয়া দস্যুসর্দার রূপচাঁদের পদে পতিত হইয়া মার্জনা চাহিয়াছিলেন এবং সদলে রূপের শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন ৷ পরবর্তীকালের ঢপ-গায়কগণের মধ্যে অঘোর দাস, দ্বারিক দাস, শ্যম বাউল, মোহন দাস ও মধুসূদন কিন্নরের নাম উল্লেখযোগ্য ৷৷ আমরা বহু কষ্টে রূপের কয়েকটি গান সংগ্রহ করিয়াছি ; ১১৯৯ সালে ৭০ বৎসর বয়সে তাঁহার তিরোধান হয় ৷

পাড়ার লোকে গোল করে মা
বলে গৌর কলঙ্কিনী ৷
যেদিন হয় মা কাজীর দলন
গউর করে নগর কীর্তন
আচণ্ডাল ব্রাহ্মণ যবন গউর সঙ্গেতে ৷
আবাল বৃদ্ধ যুব ছেলে
সবাই নাচে হরি বলে
দেখেছিলাম ঘুঙ্গুট খুলে
হয়ে গেলাম ক্ষ্যাপা পাগলিনী ৷
একদিন জাহ্নবীর ঘাটে
গোরাচাঁদ দাঁড়ায়ে তটে
চন্দ্র সূর্য উভয় ছোটে গৌর অঙ্গেতে ৷
হেরে গোরা রূপের ছবি
মাগো ভুলে গেলাম সবি
দৈবে গেল কলসী ডুবি
রূপকে দেখেছিলো পাপ ননদিনী ৷৷


আমায় দংশেছে গৌরাঙ্গ ভুজঙ্গ৷
বিষেতে জারিল জ্বলে গেল সর্ব অঙ্গ ৷
এ ভুজঙ্গ দংশেছে অন্তরে
বিষ যায় না মণি মন্তরে—
নাই তাগা বাঁধবার স্থান কিসে হবে ত্রাণ
শেষে যায় যে পরাণ আশার সঙ্গ ৷৷
কলঙ্কিনী হইলাম জাতিকুল মজাইলাম
সাধে সাধে সখী সকলি হারাইলাম
ভুলি আঁখির ছলনে কি জানি কি ক্ষণে
তার নয়নে নয়নে মিলাইলাম
সেই দেখা আমার বুঝি শেষ দেখা
না দেখিয়া তারে দায় হল প্রাণ রাখা
ছিলাম গৃহবাসী করিয় উদাসী
সব নাশি রূপের করলে বাসাভঙ্গ ৷৷


কি রূপ দেখিনু কদম্ব মূলে ৷
কলিন্দ নন্দিনীর কুলে ৷৷
জন্মাবধি এমন রূপ তো দেখি নাই
অপরূপ রূপের বলিহারি যাই
রূপ বলতে নারি মুখে দেখেছি এই সুখে
বুকের জ্বালা সয়ে আছি সুখ ভুলে ৷
দুখ ভুলি তারে ভুলতে পারি কই
সে কি জানে আমি কত জ্বালা সই
জানে না অচেনা সেইজনা বই
আমি অপর কারো নই
সব হারায়ে তারি পায়ে রূপ বিকালো বিনামূলে ৷৷


যদি নাহি দিবে দেখা কেন বারেক দেখা দিলে ৷
কহিবে না কথা তার আঁখিতে কি বাখানিলে ৷
বল দেখি একি লীলে নির্দ্দোষে বিষে জারিলে
সর্ব্বস্ব হরিলে যদি আমায় কেন নাহি নিলে
কেন মনে এসো নিরাবিলে (তুমি) সুখ পাও (কি)
আমি দুখ পাইলে ৷
একেবারে মারিলে না মারিতে চাও তিলে তিলে
বাহির হতে কেন আমার অন্তরেতে লুকাইলে
এ কি রকম লুকোচুরী দেখা পাই নয়ন মুদিলে
বাহিরে দেখা নাহি মিলে এ খেলা কোথায় শিখিলে
রূপচাঁদ বলে ভুলবে যদি তবে কেন ভুলাইলে ৷৷


বাঁকা শ্যাম গুণধাম নামটি তোমার প্রাণারাম ৷
আমি তো বামতা ছাড়ি তোমায় ডাকি অবিরাম ৷৷
তবে কেন তুমি বাম শুনেছি আমার গুণগ্রাম
যেমন রূপ তেমন নাম শুনি আমি অনুপাম
সকল দুখের বিরাম কেবল আনন্দ ধাম ৷৷
সারা জীবন ডাকিলাম তবু তো না পাইলাম
অন্তিম কালে আসিবে না অনুমানে জানিলাম
আপন করতে নারিলাম মনের কথা বুঝিলাম
রূপচাঁদ বলে রাধাশ্যাম পূর্ণ হবে নাকি মনস্কাম ৷৷


নবজলধর কুসুম কাপড় জিনিয়া তার তনু কাঁতি ৷
নীলরতন দলিতাঞ্জনে তুচ্ছ করে দেহের ভাতি ৷৷
অঙ্গগন্ধে নানা ছন্দে অলি গুঞ্জে পাঁতি পাঁতি ৷৷
বাজায় বাঁশী যোগী তপস্বী শুনে আমি শ্রবণ পাতি ৷৷
চরণ নূপুর মধুর মধুর মনে বাজে দিবা রাতি ৷
রূপচাঁদ ভণে ধ্বনি শুনে কাঙ্গাল হৃদয় ওঠে মাতি ৷৷

মধু-কান
ঢপ-গানের অপর একজন সুবিখ্যাত গায়ক মধুসূদন কিন্নর, চলিত নাম মধু-কান ৷ ১২২৫ সালে যশোহরের অন্তর্গত বনগ্রাম মহকুমার অধীন উলুশিয়াই গ্রামে জন্ম ৷ পিতার নাম তিলকচন্দ্র কিন্নর ৷ মধুর আরো তিনটি সহোদর ভাই ছিল ৷ লেখাপড়া শিখিবার সুযোগ হয় নাই, তিনি মুদ্রিত পুস্তক পড়িতে পারিতেন, কিন্তু লিখিতে জানিতেন না ৷ যৌবনে ঢাকার প্রসিদ্ধ গায়ক ছোটে খাঁর নিকট সঙ্গীত শিক্ষা করেন ৷ যশোহর রাঢ় খাদিয়ার মোহন বাউল তাঁহাকে ঢপ-কীর্তন শিক্ষা দেন ৷ মধু নিজে মান, অক্রূর -সংবাদ, মাথুর, কুরুক্ষেত্র-মিলন প্রভৃতি কয়েকটি পালা রচনা করিয়াছিলেন ৷ তাঁহার গানের সুর ‘মধু-কানের সুর’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে ৷ মধু গানে ‘সূদন’ ভণিতা দিতেন ৷ কোন বন্ধু তাঁহাকে এ-বিষয়ে প্রশ্ন করায় বলিয়াছিলেন — মধু পাছে বিষ হয়, তাই মধু ভণিতা দিতে সাহস হয় না ৷ ১২৭৫ সালে নদীয়া কৃষ্ণনগরে গান গাহিতে গাহিতে হঠাৎ যকৃৎ ও বুকে বেদনা অনুভব করেন ৷ সঙ্গে সঙ্গে প্রবল জ্বর দেখা দেয় ৷ এই জ্বরেই কৃষ্ণনগরে তিনি দেহত্যাগ করেন ৷
মধুসূদনের কয়েকটি গান এখানে তুলিয়া দিলাম ৷

শ্রীরাধার পূর্বরাগ
সুরট, কাওয়ালী
কি জানি কি হল আমার মনে ৷
কি শয়নে কি স্বপনে কৃষ্ণরূপ হেরি দুনয়নে ৷৷
যদি না ভাবি অন্তরে তবু না রহে অন্তরে ৷
কি আছে যে তার অন্তরে অন্তরে বুঝিতে পারি নে ৷৷
যদি থাকি আপন মনে না করি মনে
সে কেমনে মনে মনে উদয় হয় মনে
মনে পাইলে মনের কথা তাইতে সদাই মনে ব্যথা
কারো বা কই মনের কথা মন দিয়ে তা কেবা শোনে ৷৷
যেদিকে যাই যেদিকে চাই শুধু কুষ্ণ দেখিতে পাই
কৃষ্ণ ভেবে কৃষ্ণ বর্ণ শেষে বা বুঝি কৃষ্ণ পাই
কালরূপ চিনিলে কে সে নাম বুঝি তার হৃষীকেশে
ধরিলে আমার কেশে সূদন শেষে জানবে মনে ৷৷


শ্রীরাধার মান
বিভাস, কাওয়ালী
মোহন চূড়া লাগে পায় আমাদের প্রাণে ব্যথা পায় ৷
রাজার নন্দিনী হয়ে প্যারী যা করিস তাই শোভা পায় ৷৷
যে হরি ধরেছে ত্রিপায় তার চূড়া ভাঙ্গিলি বাঁ পায় ৷
তবু তারে চাইলি নে কৃপায় যার পায় ধরেও কেউ না পায় ৷
যা হতে তুই নারীর চূড়া ভাঙ্গিলি তার মাথার চূড়া
শুনিস কি ভেঙ্গে চূড়া কে কোথায় হয়েছে চূড়া
যার চূড়া তুই দলিলি পায় ত্রিজগৎ তার লুটায় পায়
সুরধনী জন্মে যে পায় তার অপরাধ কি পায় পায় ৷
ঐ কৃষ্ণধন যে পায় সে পায় সেটা তুমি জানতো প্রায়
প্রাণ ধরে তার ধরালি পায় সূদন বলে ধরি দুপায়
তায় তুমি ঠেল না দু পায়৷৷


দেবকীর বিলাপ
বিভাস, ঢিমে তেতালা
বলো তারে কারাগারে আর কত দিন রইতে হবে ৷
সে দিনের আর বাকী ক দিন চিরদিন কি কেঁদে যাবে ৷৷
এমনি কপাল পাথর চাপা বুকের মাঝে পাথর চাপা
নয়ন জলে নয়ন ঝাঁপা শ্রীকৃষ্ণের পুণ্য প্রভাবে ৷
পুণ্য ফলে পুত্র কোলে পেয়ে যে ছিলাম ৷
তেমনি সুখে বন্দীশালে জনম গোঁয়ালাম ৷৷
যে সুখেতে হেথায় আছি একবার কৃষ্ণ দেখলে বাঁচি
কিম্বা কৃষ্ণ পেলে বাঁচি এ বাঁচায় আর কি ফল হবে ৷৷
অসিত অষ্টমী রাতে এই কারাগারে
ব্রহ্মমূর্তি দেখাইল করুণা কোরে
কোন্‌ পুণ্যে এল উদরে কোন পাপে বা কারাগারে
সূদন বলে বোলো তারে এ বন্ধন ঘুচিবে কবে ৷৷


মথুরায় দ্বারীর প্রতি
দেওগিরি, ঢিমে কাওয়ালী
আহূত এসেছি মোরা রবাহূত কও কারে ৷
আবাহন করেছে রাজা তাই এসেছি তোদের দ্বারে ৷৷
যেতে যেতে যদি দেওরে বাধা ধর এই দেখাও গে বাধা
দেখলে আর মানবে না বাধা আনবে বাধা মাথায় কোরে ৷৷
আমরা নইতো তত্র মানী তোদের রাজার পত্রে জানি ৷
জানতে পারি শুনতে পারি আগে হৌক রে জানাজানি ৷৷
তোদের রাজা যে যদুরায় রাধার নোকর গোকুলে গায়
কোরতে চাও কাঙালী বিদায় গোকুল তোরা চিনিস নারে ৷৷
তোদের রাজার নীলমণি নামে ছিল মোদের বৃন্দাবনে
লয়ে তোদের সকল ধেনু চরাইতে বলে বনে
সূদন বলে শোনরে দ্বারী কেন করিস তেরি মেরি
দুঃখ ভুলি তারে হেরি একবার এনে দেখা তারে ৷৷


মথুরায় দূতী
শ্যাম শুক নামে প্রিয় পাখী
এদেশে এসেছে উড়ে শ্রীরাধারে দিয়ে ফাঁকি ৷
এসেচি তার অন্বেষণে দেখা হলে বাঁচি প্রাণে
জানে না সে রাধা বিনে রাধা নামে সদা সুখী ৷৷
পাখা যদি দিত পাখী হয়ে উড়ে যেতাম
যে বনে প্রাণ পাখী আছে সে বনে তায় খুঁজে নিতাম
পেয়ে থাকিস দেখা দেখা পাখীর মাথায় পাখীর পাখা
তাতে রাধার নামটী লেখা দেখা নাই তাই ঝুরে আঁখি ৷৷