উপসংহারে বক্তব্য এই যে, বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে ভারতবর্ষের নানাস্থানে রাধাকৃষ্ণলীলা প্রচারিত হয় এবং ঐ লীলা অবলম্বনে বহু পদাবলী রচিত হইয়াছিল৷ বাংলা দেশে প্রচলিত পদাবলীর সহিত ঐ সকল পদাবলীর ভাব, কবিত্ব ও মাধুর্য তুলনা করিলে বাংলার কীর্তনের বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করিবার পক্ষে সুবিধা হইবে৷ কিন্তু সারাভারতের এই অতুলনীয় সম্পদ এখনও সম্যকরূপে আলোচিত ও আস্বাদিত হয় নাই৷ মিথিলার বিদ্যাপতি যে পদাবলী রচনা করিয়াছিলেন, বাংলার বৈষ্ণবসমাজ আনন্দের সহিত তাহা তাঁহাদের কীর্তনের সঙ্গে গাঁথিয়া লইয়াছিলেন৷ বিদ্যাপতিকে আমরা বাঙালী বলিয়াই মনে করিয়া আসিয়াছি এবং কীর্তনে তাঁহাকে উচ্চাসন দিয়াছি৷ উত্তর পশ্চিমের হিন্দী কবি সুরদাসের পদাবলীও কিছু কিছু আমরা আত্মসাৎ করিয়াছি৷ পদকল্পতরুতে ইঁহার একটি পদ উদ্‌ধৃত হইয়াছে৷ রাজপুতনার মূর্তিমতী ভক্তিস্বরূপিণী মীরাবাইয়ের অপূর্ব পদাবলী বাংলার মহাজনী কীর্তনের অঙ্গীভূত হইতে পারে নাই বটে, কিন্তু মীরার সংগীত কীর্তনেরই ছন্দে বাংলার অনেকস্থলে গীত হইতে শুনা যায়৷ শিখদের গ্রন্থসাহেবে যে পদাবলী আছে, তাহাও অনেকটা কীর্তনের ভঙ্গীতে লেখা৷ নানক জির এই সকল ভজন শিখদের সংগতে একান্ত নিষ্ঠার সহিত গীত হইয়া থাকে৷ এই সকল পদাবলীও গীতের উদ্দেশ্যেই রচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় এবং ইহার মধ্যে যে ভক্তিভাবের নির্মলধারা প্রবাহিত হইয়াছে, তাহা বঙ্গদেশের পদাবলী অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহে৷ উত্তর পশ্চিম ভারতেরও সে সময়ে অর্থাৎ পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীতে এইরূপ এক ভাবের বন্যা বহিয়া গিয়াছিল৷ বল্লভাচার্য ও তাঁহার ভক্তদের মধ্যে কবিত্বের যে উচ্ছ্বাস দেখিতে পাওয়া যায় তাহা বঙ্গদেশের কীর্তন-সম্পদের সহিত তুলনীয়৷ তুলসীদাস, নন্দদাস প্রভৃতি কবিগণ ভক্তিধর্মের যে প্রবাহ ছুটাইয়াছিলেন তাহাও অত্যন্ত উপভোগ্য৷ তুলসীদাস তাঁহার রামায়ণে যে দোহা, চৌপাই প্রভৃতি দিয়াছেন; ভারতের বহু স্থানে তাহা গীত হইয়া থাকে৷ সুরদাস, নন্দদাস প্রভৃতি রাধাকৃষ্ণের লীলা সম্বন্ধে বহু পদ রচনা করিয়া গিয়াছেন৷ ভাবের গাম্ভীর্যে ও ভাষার মাধুর্যে এখনও তাহা পরম আস্বাদ্য৷ উত্তরপশ্চিম ভারতের কয়েকজন মুসলমান কবি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যাঁহারা রাধাকৃষ্ণলীলা সম্বন্ধে পদ রচনা করিয়া যশস্বী হইয়া গিয়াছেন৷ ইহাঁদের মধ্যে রসখান্‌ ও খান্‌খানান্‌ আবদার রহিম খানের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ রসখান ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত পাঠান৷ তিনি হিন্দীতে যে পদাবলী রচনা করিয়াছেন, তাহার কবিত্বমাধুর্য অবর্ণনীয়৷ আবদর রহিম ছিলেন বৈরাম খানের ভ্রাতা৷ ইনি আকবরের সেনাপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন৷ কিন্তু রাধাকৃষ্ণলীলা-বর্ণনায় তিনি তাঁহার ভক্তিপ্রবণতার যে পরিচয় দিয়াছেন, তাহা চিরদিন রসিকসমাজে আদৃত হইবে৷ দক্ষিণ ভারতে আলবারদের সংগীতও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য৷ তামিল ভাষায় ইঁহাদের পদাবলী ‘তামিলবেদ’ নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছিল৷
সুতরাং পদাবলীর দিক দিয়া দেখিলে এই ভাবধারা শুধু বাংলার নয় সমগ্র ভারতের সাংস্কৃতিক সম্পদ্‌৷ ভারতবর্ষকে জানিতে হইলে এই ভাবধারার সহিত বিশেষ পরিচয় থাকা বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে হয়৷ ইহার মধ্যে আবার বাংলার উচ্চাঙ্গের কীর্তন সুর তালও ব্যঞ্জনায় একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে৷