বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনে নায়ক-নায়িকাভেদ, তার রসবিকাশ ও ভাবতত্ত্বই প্রধান৷ তাছাড়া অপার্থিব রাধাকৃষ্ণলীলাতত্ত্বই শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার বিচিত্র লীলাকাহিনীর আকারে পদাবলীকীর্তনের প্রধান বিষয়বস্তু৷ পদাবলীকীর্তনে মাথুর, বাস, কলহান্তরিত, দান, নৌকাবিলাস, খণ্ডিতা প্রভৃতি পালা শ্রীরাধা-কৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেমলীলাকাহিনীকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে ৷ শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ সকল পালা বা কীর্তনকাহিনীরই প্রাণবস্তু৷ কিন্তু পদাবলীকীর্তনে সমগ্র রাধাকৃষ্ণলীলাকাহিনীর উৎস গীতগোবিন্দকাব্য বা গীতগোবিন্দপদগান৷
গীতগোবিন্দের প্রথম সর্গের প্রথম শ্লোকেই দেখি, কবি জয়দেব যমুনা -কুলবিহারী শ্রীরাধা-কৃষ্ণের জয়গান করেছেন — “রাধামাধবযোর্জয়ন্তি যমুনা -কূলে বহঃ কেলয়ঃ”৷ শৃঙ্গাররসপ্রধান শ্রীরাধা কৃষ্ণের যমুনাকূলে বিজনকেলি এবং রাধাকৃষ্ণলীলামুখরিত এই গীতগোবিন্দকাব্য শৃঙ্গারপ্রধান –শৃঙ্গাররস-প্রধানং হি কাব্যম”৷ গীতগোবিন্দে শ্রীরাধা-কৃষ্ণ সম্পর্কিত পদাংশ, যথা —
(ক) বসন্তে বাসন্তীকুসুমসুকুমাবৈববয়বৈ –
র্ভ্রমন্তীং কান্তারে বহুবিহিতকৃষ্ণানুসারণাম ৷
* * *
বলদ্‌রাধাং রাধাং সবসমিদমূচে সহচরী ৷ (১.২৭)
মাধবীকুসুমতুল্য কোমলাঙ্গী শ্রীরাধা নিভৃত প্রদেশে শ্রীকৃষ্ণের অন্বেষণে ব্যাকুলা৷

(খ) চন্দনচর্চিতনীলকলেবরপীতবসনবনমালী৷
* * *
হরিবিহ মুগ্ধবধূনিকরে বিলাসিনি
বিলসতি কেলিপরে৷ (১.৪০)
পীতবসনপরিহিত বনমালী শ্রীকৃষ্ণ বিলাসমত্তা মুগ্ধা গোপবধূগণকে নিয়ে কেলিবিলাসে রত৷

(গ) রাসোল্লাসভরণে বিভ্রমভৃতামাভীযবামভ্রুবাম
অভ্যর্ণে পরিবভ্য নির্ভরমুরঃ প্রেমান্ধয়া রাধয়া৷ (১.৪৯)
রাসোল্লাসে বিহ্বলচিত্ত গোপিগণের সম্মুখেই শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণকে দৃঢ়ভাবে প্রেমালিঙ্গন দান করলেন ৷

(ঘ) বিঽবতি বনে রাধা সাধারণপ্রণয়ে হরৌ৷ (২.১)
শ্রীরাধা নির্বিচারে সকল গোপীর সঙ্গে মিলিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করছেন৷

(ঙ) গোবিন্দং ব্রজসুন্দরীগণবৃতং পশ্যামি হ্যষ্যামি চ ৷ (২.১৯)
ব্রজসুন্দরীগণরিবৃত গোবিন্দ শ্রীকৃষ্ণকে নিরীক্ষণ করে সকলে আনন্দিত৷

(চ) কংসাবিরপি * * রাধামাধায় হৃদয়ে তত্ত্যাজ
ব্রজসুন্দরী ৷ (৩.১)
কংসারী শ্রীকৃষ্ণ * * রাধার পূর্ণ-অনুধ্যানে ব্রজাঙ্গনাগণের সঙ্গ পরিত্যাগ করলেন৷

(ছ) ইতস্ততষ্টামনুসৃত্য বাধিকামনঙ্গবাণব্রণখিণ্ণমানসঃ, * * বিষসাদ মাধবঃ ৷ (৩.২)
অনঙ্গবাণে ব্যথিতচিত্ত মাধব শ্রীকৃষ্ণ * * রাধিকার দর্শন না পেয়ে অনুতাপ করতে লাগলেন৷

(জ) যমুনাতীর-বাণীবনিকুঞ্জে মন্দমাস্থিতম্‌৷
প্রাহ প্রেমভবোদভ্রান্তং মাধবং রাধিকাসখী৷৷ (৪.১)
যমুনাতটবর্তী বেতসকুঞ্জে * * মাধব শ্রীকৃষ্ণকে রাধিকার সখী এসে বল্লেন৷

(ঝ) স্তনবিনিহিতমপি হারমুদারম্‌ ৷
* *
রাধিকা তব বিরহে কেশব৷৷ (৪.১১)

হে শ্রীকৃষ্ণ, তোমার বিরহে শ্রীরাধা গৃহকে অরণ্যপ্রায় জ্ঞান করছেন৷ এভাবে ৪৷১০, ৫৷১, ৫৷২১, ৫৷২, ৬৷১২, ৭৷৪২, ১০৷১৭, ১১৷১, ১১৷২, ১১৷২৪, ১১৷৩২, ১২৷১, ১২৷২, ১২৷১৬ শ্লোকগুলিতে শ্রীরাধা-কৃষ্ণের নামের উল্লেখ পাই এবং গীতগোবিন্দপদ-রচয়িতা কবিশেখর জয়দেব যে একান্তভাবে শ্রীরাধাকৃষ্ণের অনুগত ছিলেন তা “তৎ সর্বৎ জয়দেব পণ্ডিতকরেঃ কৃষ্ণৈকতানাত্মনঃ” (১২৷২৭) (“শ্রীকৃষ্ণে একতানঃ একাগ্রোঽনন্যবৃত্তিরাত্মা মনো যস্য তস্য শ্রীকৃষ্ণৈকান্তভক্তস্যৈব সর্বগুণাশ্রয়ত্বাদিত্যর্থঃ” – পূজারী গোস্বমী৷) শ্লোকই প্রমাণ করে এবং তারি জন্য তাঁর গীতগোবিন্দকাব্য “হরি চরণস্মরণামৃত নির্মিতকলিকালুষজ্বরখণ্ডনে” সমর্থ৷
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে, কবি জয়দেব শ্রীকৃষ্ণেরই পদ বন্দনা করেছেন, শ্রীকৃষ্ণেরই তিনি শরণাগত, কিন্তু সেখানে শ্রীরাধিকার বা শ্রীরাধার নামের কোন উল্লেখ নাই৷ তাছাড়া এটাও লক্ষ্য করার বিষয় যে, গীতগোবিন্দের সর্গবন্ধে তথা প্রতিটি সর্গের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নামই সম্পর্কিত , যেমন ১ম সর্গের নাম “সামোদ-দামোদর” ২য় সর্গের নাম “অক্লেশ-কেশব” তয়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম সর্গের নাম “মুগ্ধমধুসূদন”, “স্নিগ্ধমধুসূদন” “সাকাঙ্ক্ষা-পুণ্ডরীকাক্ষ” “ধৃষ্টবৈকুণ্ঠ”, “নাগর-নারায়ণ” প্রভৃতি৷ এই সম্বন্ধে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি৷ তাছাড়া কবি জয়দেবের শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ ও মহিমা-বর্ণনাভঙ্গী ও একটু ভিন্ন ধরনের, কেননা শ্রীমদ্ভাগবতে বৈষ্ণবভক্তিনিষ্ণাত ও মধুররস -সমুজ্জ্বল শ্রীকৃষ্ণলীলার বর্ণনার সঙ্গে গীতগোবিন্দে জয়দেব-বর্ণিত মধুরোজ্জ্বল শ্রীকৃষ্ণলীলাবর্ণনার ঠিক ঐক্য ও সামঞ্জস্য নাই, বরং গীতগোবিন্দের শ্রীকৃষ্ণলীলা বর্ণনার সাদৃশ্য পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণকারের শ্রীকৃষ্ণলীলাবর্ণনার সঙ্গে৷ গীতগোবিন্দে বর্ণিত শ্রীরাধিকা বা শ্রীরাধার যে “উজ্জ্বলরসের নায়িকা”-রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সাদৃশ্যও ঠিক শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায় না৷ মোটকথা “ভগবদুপাসনার ঐশ্বর্য ও মাধুর্য এ দুটি দিক গীতগোবিন্দে ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সমানভাবে প্রতিপাদিত হইয়াছে৷” (ডঃ শ্রীসুশীলকুমার দে- প্রণীত “নানা-নিবন্ধ” (১ম সংস্করণ ১৯৫০)-গ্রন্থে “জয়দেব ও গীতগোবিন্দ”, পৃঃ ৪৬)। শ্রদ্ধেয় ডঃ সুশীল কুমার দে এই সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন ঃ “বাংলাদেশে রাধাকৃষ্ণের রসোপাসনা কি ভাবে বা কাহার দ্বারা প্রথম প্রবর্তিত হইয়াছিল তাহা নিঃসন্দেহে নির্ণয় করা দুরূহ,কারণ তদানীন্তন বৈষ্ণবধর্মের ইতিহাসের সুস্পষ্ট পরিচয় এখনও পাওয়া য৷য় নাই৷ যতটুকু জানা যায়, তাহা হইতে এরূপ অনুমান করিলে ভুল হইবে না যে, জয়দেব, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণকার ও নিম্বার্ক এই তিনজনই আপন-আপন অনুভবের দ্বারা কোন অধুনালুপ্ত বৈষ্ণবভাবের কোন একটি ধারা অনুসরণ করিয়াছেন ৷ এই ধারা বোধ হয় পরবর্তী শ্রীমদ্ভাবত-প্রবর্তিত ধারা হইতে স্বতন্ত্র এবং ইহাদিগকে পরস্পরের নিকট ……. বলিয়া গ্রহণ করিবার কোন প্রমাণ নাই৷” (ডঃ এস. কে. দে. ঃ “নানা-নিবন্ধ” (জয়দেব ও গীতগোবিন্দ), পৃঃ ৪৭)৷
ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে, কবি জয়দেব শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত শৃঙ্গাররসবহুল শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলাবিলাসতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গীতগোবিন্দপদগান রচনা করেন নি, কেননা শ্রীমদ্ভাগবতে রাধাকৃষ্ণলীলামাধুর্য রসতত্ত্বে পরিণত এবং অপ্রাকৃত সেই তত্ত্ব ও তত্ত্বের আস্বাদন৷ কিন্তু কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ-রচনার রসমাধুর্য একেবারে শুদ্ধ অপ্রাকৃত তত্ত্বের রূপ গ্রহণ করে নি৷ “বরং তাঁহার রচনায় অপ্রাকৃতের সহিত প্রাকৃত, ভক্তির সহিত প্রীতি, কল্পনার সহিত বাস্তব অনুভূতি একাকারে মিশিয়া গিয়াছে”৷ কবি জয়দেব শ্রীরাধা-কৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমলীলাই বর্ণনা করেছেন৷ তার পদগানে সেই প্রেমলীলা বাস্তব বিরহবেদনা, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার অতীত হয়ে ধ্যানগম্য নিত্যবৃন্দাবনের সৃষ্টি করেনি, বরং “প্রাকৃত প্রেমলীলার প্রতিচ্ছবি-রূপে অপ্রাকৃতিক বৃন্দাবনলীলা, মানবোচিত ভাব ও আশার উজ্জ্বল ও গীতিময় শব্দচিত্রপরম্পরায় সর্বসাধারণের অধিগ্যম হইয়াছে৷ এই বাস্তব ও কল্পনার সংযোগ অতীন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়গত ভাবের মিশ্রণ, –ইহাই গীতগোবিন্দের অন্তর্গত কাব্যবস্তু”৷ (ডঃ এস, কে. দে : “নানা-নিবন্ধ” (জয়দেব ও গীতগোবিন্দ), পৃঃ ৫২) সুতরাং এই গীতগোবিন্দকাব্য সবিশেষ থেকে পরিশেষে নির্বিশেষে রসোপলব্ধির আনন্দরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যায়৷
শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন ঃ “শ্রীমদ্ভাগবতে যে রহস্য গুপ্ত ছিল, গীতগোবিন্দে তাহা প্রকাশিত হইয়াছে” (কবি জয়দেব ও শ্রীগীতগোবিন্দ (৩য় সংস্করণ ১৩৬২), পৃঃ ১২৫) এবং এই মতের পরিপোষণে তিনি পুনরায় বলেছেন ঃ “কবি জয়দেব যে শ্রীমদ্ভাগবতের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন,উভয় গ্রন্থের শ্রীশ্রীরাসলীলার বর্ণনাতেও তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়৷” (ডঃ এস, কে. দে : “নানা-নিবন্ধ” (জয়দেব ও গীতগোবিন্দ), পৃঃ ১৪১) কিন্তু শ্রীদ্ভাগবতের রাসপঞ্চাধ্যায়ের “কাচিং সমং মুকুন্দে * * তসৈ মামঞ্চ বহ্বদাৎ” (৯-১০ শ্লোক) এবং গীতগোবিন্দের “পীনপয়োধরভারভবেণ * * কাচিদুদঞ্চতপঞ্চমরাগম্‌” ( ১৷৪১) শ্লোকদুটির অর্থ ও ভাবের যথার্থ কোন সাদৃশ্য নাই, কেননা ষড্‌জাদি সাত লৌকিক স্বর এবং রামায়ণোক্ত (৪র্থ কাণ্ড) ও নাট্যশাস্ত্রোক্ত (২৮শ অধ্যায়) ষাড়্‌জী, আর্যভী প্রভৃতি সাতটি শুদ্ধজাতি, জাতিরাগ বা জাতিগানের সঙ্গে পঞ্চম-উপলক্ষিত পঞ্চমরাগের কিংবা গীতগোবিন্দের “বাগ্‌দেবতাচরিত * * করোতি জয়দেব-কবিঃ প্রবন্ধম” (১৷২) এবং শ্রীমদ্ভাগবতের “তদ্বাগ বিসর্গো * * শৃণন্তি সাধবঃ (১ম স্কন্ধ, ৫ম অধ্যায়) শ্লোকদুটির ভাববস্তুর মধ্যেও কোন প্রাসঙ্গিক ঐক্য নাই ৷ (কেননা স্বর, তাল, রাগ, তাল, পাট, ধাতু প্রভৃতি ষড়্‌ঙ্গযুক্ত প্রবন্ধগান গীতগোবিন্দ এবং সাধুজনগণের শ্রুতি, গীত ও গৃহীত শব্দালঙ্‌কারযুক্ত শ্লোকবাক্য এক পর্যায়ভুক্ত নয় ৷) তাই “গীতগোবিন্দ”-পদগান শ্রীমন্মহাপ্রভু চৈতন্যদেব, শ্রীচৈতন্যপরিকরগণ এবং পরবর্তী বৈষ্ণবসমাজ ও বৈষ্ণবশাস্ত্রের একান্ত উপজীব্য ও পরমশ্রদ্ধার বস্তুরূপে পরিগণিত হলেও (পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ও বলেছেন ঃ “গৌড়ীয় বৈষ্ণবসম্প্রদায় শ্রীগীতগোবিন্দ গ্রন্থখানিকে শ্রীমন্‌ মহাপ্রভু প্রেমধর্মের অন্যতম সূত্রগ্রন্থরূপে-শ্রীমদ্ভাগবতের কবিত্বময় ভাষ্যরূপেই গ্রহণ করিয়াছেন” ৷ (“কবি জয়দেবও শ্রীগীতগোবিন্দ”, ৩য় সংস্করণ,পৃঃ ১৩৯)৷ তাছাড়া রায় রামানন্দ নাকি স্বীকার করতেন যে, কবি জয়দেব শ্রীমদ্ভাগবত অপেক্ষা গীতগোবিন্দ রাধাপ্রেমের উৎকর্ষ দেখিয়েছেন৷ গীতগোবিন্দ ৩৷২ শ্লোক দ্রষ্টব্য৷) শ্রীমদ্ভাগবতের কোন প্রভাব অধিকাংশ পণ্ডিত গীতগোবিন্দকাব্যে বা গীতগোবিন্দপদগানে লক্ষ্য করেন নি৷ এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় ডঃ সুশীলকুমার দে-র সুচিন্তিত অভিমত উল্লেখ করে বলি ঃ “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ব্রহ্মবৈবর্তপূরাণের শৃঙ্গাররসবহুল রাধাকৃষ্ণের লীলাবিলাসই জয়দেবের কবি-কল্পনাকে অনুপ্রাণিত করিয়াছে৷ গীতগোবিন্দের —
আকাশ মেদুর মেঘে, দ্রুমে শ্যাম-বনভূমি,
রাত্রি এখন ভীরু এরে রাধে, গৃহে লয়ে যাও তুমি, —
নন্দের এই আদেশে চলিত আধারকুঞ্জনীড়ে
রাধামাধবের নির্জন-কেলি জয়তু যমুনাতীরে !
এই ভাবের উল্লেখ শ্রীমদ্ভাগবতাদি প্রাচীনতর পুরাণে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, বরং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায়ে বর্ণিত বিষয়ের সহিত ইহার যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়৷ জয়দেবের কাব্যে বসন্তকালীন বাসের বর্ণন রহিয়াছে, কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতের বাস শরৎকালীন৷ গোপীলীলার কথা আছে, কিন্তু শ্রীরাধার প্রত্যক্ষ উল্লেখ শ্রীমদ্ভাগবতের পাওয়া যায় না৷ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মতো জয়দেবের কাব্যে শ্রীরাধাকে রসস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের সকল বিলাসলীলার কেন্দ্ররূপে অঙ্কিত করা হইয়াছে৷ ইহা আরও উল্লেখযোগ্য, যে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণকার শ্রীকৃষ্ণ-রাধার নিয়মিত বিবাহের অনুষ্ঠান করিয়া পরকীয়াবাদের সমর্থন করেন নাই, গীতগোবিন্দ আলোচনা করিলেও “পরকীয়াভাবের পরিস্ফুট স্বরূপ উপলব্ধি হয় না” — এই কথা গীতগোবিন্দের সুযোগ্য বৈষ্ণবপ্রবর শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ও স্বীকার করিয়াছেন৷ ভগবদুপাসনার ঐশ্বর্য ও মাধুর্য এই দুইটি দিকই গীতগোবিন্দে ও ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণে সমানভাবে প্রতিপাদিত হইয়াছে ৷” (“নামা নিবন্ধ (জয়দেব ও গীতগোবিন্দ), পৃঃ ৪৫ – ৪৬৷) ডঃ সুশীলকুমার তাঁর Sanskrit Literature-গ্রন্থেও (Cf Indian Studies: Past & Present, vol-1, no.4,p.440)অনুরূপ মন্তব্য করে বলেছেন ঃ “There are parallellisms between the treatment by Jayadeva on the one hand and the Brahma-vaviarta-purana on the other, of the Radha-Krishna legend and its erotico-religious possibilities in a vivid background of sensuous charm; but there is no conclusive proof of Jayadeva”s indebtedness to the Purana. Nor is it probable that the source of Jayadeva”s inspiration was the Krishna-Gopi legend of the Srimad-bhagavgata, which avoids all direct mention of Radha and describes the autumnal and not the vernal (as in Jayadeva) Rasalila. There must have been other widespread tendencies of similar kind from which Jayadeva, like Vidyapati, derived his inspiration”৷ (Cf. Dr. S. K. De. Pre.Chaitanya,Vaisnivism in Bengal(Festschrift M. Winternitz, pp. 1969) and Early History of he Vaisnava Faith and Movement in Bengal(1942). pp.7-10.)
পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় “কবি জয়দেব ও গীতগোবিন্দ”-গ্রন্থের ভূমিকায় শ্রীমদ্ভাগবদোক্ত “শারদ-রাস” ও গীতগোবিন্দে-বর্ণিত “বাসন্ত-রাস”- বর্ণনা করে দুটির পার্থক্য সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন৷ তিনি লিখেছেন ঃ “শারদ-রাসে কাত্যায়ণীব্রতপরায়ণা কুমারীগণের কামনা পূর্ণ করাই শ্রীকৃষ্ণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল৷ এই ব্রতপরায়ণা কুমারীগণ — শ্রুতিচরী ও ঋষিচরী গোপীগণ –কাত্যায়ণীদেবীর নিকট নন্দগোপনন্দনকে পতিরূপে পাইবার কামনা করিয়াছিলেন৷ ইহাদের মধ্যে শ্রীরাধিকা অথবা তাঁহার যুথভুক্তা কোন গোপী ছিলেন না৷ * * কৃষ্ণপ্রাপ্তির সম্ভাবনায় তাঁহারা সকলেই আত্মবিস্মৃত হইয়াছিলেন৷ তাঁহাদের সৌভাগ্যকে সম্পূর্ণ করিবার জন্য কৃষ্ণ তাঁহাদিগকে ত্যাগ করিয়াছিলেন, এবং তাঁহাদের পথপ্রদর্শনের জন্যই সকলের মধ্য হইতে পৃথক করিয়া শ্রীমতী রাধাকে পথের মাঝখানে একাকী রাখিয়া গিয়াছিলেন৷ যুগল-পদাঙ্গ অনুসরণ করিতে করিতে গোপীগণ শ্রীমতীর সঙ্গ লাভ করেন এবং তাঁহারই কৃপায় শ্রীকৃষ্ণ-সঙ্গ প্রাপ্ত হন৷ রাসমণ্ডলে কৃষ্ণ সকলকেই সন্তুষ্ট করিয়াছিলেন৷ * * ইহাই শারদ-রাস৷ বাসন্ত-রাস কিন্তু অন্যরূপ৷ এই লীলার শ্রীরাধা সম্যক্‌ সচেতন রহিয়াছেন৷ * * শ্রীকৃষ্ণকে তিনি একা পাইতে চাহেন না৷ কিন্তু তিনি দান না করিলে শ্রীকৃষ্ণ কেন অন্যের হইবেন, কিরূপে তিনি অন্যের নিকট যাইবেন –এই কথা তিনি বুঝিতে পারেন না৷ এই অভিমানেই তিনি কৃষ্ণের প্রেয়সী শ্রেষ্ঠা ৷ * * শ্রীমতীর এই অভিমান ছিল বলিয়াই বাসন্ত রাসে তিনি রাসমণ্ডল ত্যাগ করিয়াছিলেন৷ বাসন্ত-রাসে শ্রীরাধাকে হারাইয়া শ্রীকৃষ্ণের বিরহ এক অপূর্ব বস্তু৷ কবি জয়দেব এই অভিমান — এই অপূর্বতার উজ্জ্বল আলেখ্য অঙ্কিত করিয়াছেন৷ এই আলেখ্যই বাসন্ত-রাস৷” (কবি জয়দেব ও শ্রীগীতগোবিন্দ (৩য় সংস্করণ, ১৩৬২), পৃঃ ১৩৯-১৪০)৷ সুতরাং কবি জয়দেবের বর্ণনা থেকে এই কথা সহজেই অনুমান করা যায় যে, শ্রীমদ্ভাগবতের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন নি, অথবা তত্ত্বপ্রধান শ্রীমদ্ভাগবতের ঠিক আপ্রকৃত রাধাকৃষ্ণমাধুর্যলীলা তিনি অনুসরণ করেন নি৷
এক্ষণে বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের পাদভূমি বা পটভূমিকা গীতগোবিন্দ-পাদগানের নায়ক-নায়িকা-সম্পর্কে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে পদাবলী কীর্তনের মাধুর্য ও লীলার নায়ক-নায়িকার কথাই বিশেষভাবে মনে পড়ে এবং পদাবলীকীর্তনের প্রসঙ্গে পরে এই সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করলেও এখানে নায়ক-নায়িকা সম্পর্কে এটুকু বলা যায় যে, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী-প্রণীত “সাহিত্যদর্পণ”, পীতাম্বরদাসের সংস্কৃত “রসমঞ্জরী”, ভানুদত্তের রসমঞ্জরীর পদ্যানুবাদ, শ্রীরূপ গোস্বামীর “উজ্জ্বলনীলমণি” প্রভৃতি অলঙ্কার ও রস-গ্রন্থের বিশেষভাবে অষ্টনায়িকার রসোজ্জ্বল বর্ণনা নিহিত থাকলেও ঐ অষ্ট নায়িকার প্রত্যেকের আট প্রকার ভেদ দর্শিত হয়নি৷ তবে পীতাম্বরদাসের “রসমঞ্জরী” কিংবা শশিশেখর তথা শেখর-ভ্রাতৃদ্বয়ের “নায়িকারত্নমালা”-য় অষ্টনায়িকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অষ্ট প্রকার ভেদের উল্লেখ দেখা যায়৷ অবশ্য প্রসিদ্ধ আলঙ্কারিকদের অনুসৃত তর্কশাস্ত্রের বিচারে বা তাদের দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষণে অষ্টনায়িকার কল্পিত ভেদগুলির স্বতন্ত্র বাস্তব সত্তা স্বীকৃত হয়নি, পরন্তু তাঁরা নায়ক-নায়িকার বিভিন্ন অনুভাব ও ব্যভিচারীভাব রূপেই স্বীকার করেছেন, তথাপি পীতাম্বরদাসের “রসমঞ্জরী”-গ্রন্থে ও বিশেষভাবে “নায়িকারত্নমালা” গ্রন্থে সঙ্কলয়িতা শশিশেখর ও চন্দ্রশেখরের ভনিতাযুক্ত পদাবলীতে তাদের সত্তার ও নিদর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ অষ্টনায়িকার প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পীতাম্বরদাসের “রস-মঞ্জরী”-গ্রন্থে “প্রোষ্যৎপতিকা” নাম্নী নবমী নায়িকারও উল্লেখ দেখা যায় এবং মুগ্ধা, মধ্যা, প্রগলভা, পরকীয়া ও গণিকাভেদ এবং অভিসারিকা প্রভৃতি নববিধ নায়িকার প্রত্যেকটির পাঁচটি করে কবিত্ব ও রসপূর্ণ পদের সন্ধান পাওয়া যায় (ভানুদত্ত-কৃত পদ্যানুবাদ ও দ্রষ্টব্য)৷ সুতরাং পরে পদাবলীকীর্তনের নায়ক-নায়িকাদের ভেদ, ভাব ও রসমাধুর্যের বিশদভাবে আলোচনা করলেও বর্তমানে প্রাচীন পদসাহিত্যে সুপণ্ডিত সতীশচন্দ্র রায়-সম্পাদিত “শ্রীশ্রীনায়িকারত্নমালা”-গ্রন্থে চৌষটি নায়িকা ও প্রাচীন পদকর্তা শশিশেখর ও চন্দ্রশেখরের ভনিতাযুক্ত পদাবলীর কিছু অংশ এখানে অলোচনা করার চেষ্টা করবো পরবর্তী আলোচনার পটভূমিকা (background) রচনা করার জন্য৷
“নায়িকারত্নমালা” গ্রন্থের (সন ১৩৩৫ সালে প্রকাশিত৷) প্রারম্ভে উদ্ধৃত দেখা যায়,
যথা শ্রীগীতাবল্যাম —
অথাভিসারিকা বাসকসজ্জাপ্যুৎকণ্ঠিতা তথা৷
বিপ্রলব্ধা খণ্ডিতা চ কলহান্তরিতাপরা৷৷
প্রোষিতপ্রেয়সী প্রোক্তা তথা স্বাধীনভর্ত্তৃকা৷
ইত্যষ্টৌ নায়িকাভেদা রসতন্ত্রে প্রকীর্তিতাঃ ৷৷
অভিসারিকা, বাসকসজ্জা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা,কলহান্তরিতা, প্রোষিতপ্রেয়সী বা প্রোষিতভর্ত্তৃকা ও স্বাধীনভর্ত্তৃকা এই আট প্রকার নায়িকাভেদ-সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এখানে বলা প্রয়োজন যে, “নায়িকাভেদ-সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এখানে বলা প্রয়োজন যে, “নায়িকারত্নামালা” বা শশিশেখর ও চন্দ্রশেখরের-ভণিতাযুক্ত পদাবলী সম্ভবত ১৫০ বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়, কেননা ১৫৮০ বৎসর লিখিত পীতাম্বদাসের “রসমঞ্জরী” গ্রন্থের পুঁথিতে (অন্যূন ২৬৯ বৎসর পূর্বে সঙ্কলিত) শশিশেখর ও চন্দ্রশেখরের কোন পদের উল্লেখ দেখা যায় না৷ তাছাড়া মহারাজ নন্দকুমারের আচার্যদেব বৈষ্ণবাচার্য ও পদকর্তা রাধামোহন ঠাকুরের (পদকর্তা রাধামোহন ঠাকুরের পদাবলী ও সাঙ্গীতিক অন্যান্য বিষয়ের আলোচনা এই গ্রন্থের পরবর্তী ভাগে করবো)৷ পরবর্তী পদকর্তা বা পদসঙ্কলয়িতা বৈষ্ণবদাসের বিরাট “পদকল্পতরু”-গ্রন্থেও শশিশেখর ও চন্দ্রশেখর এবং নায়িকারত্নমালার বিশেষ কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না৷ এজন্য অনেকে শশিশেখর ও চন্দ্রশেখর ভাতৃদ্বয়ের সঙ্কলিত পদগুলিকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন৷ কিন্তু পণ্ডিত সতীশচন্দ্র রায় “নায়িকারত্নমালা”-গ্রন্থে পদাবলী-কীর্তনের অন্যতম উপাদান-রূপে শশিশেখর ও চন্দ্রশেখরের পদগুলির প্রামাণ্য ও সার্থকতা স্বীকার করেছেন৷ তাছাড়া এই পদগুলি অনেক কারণে দুষ্প্রাপ্যও ছিল, এজন্য বর্তমানে আমাদের অলোচনায় পূর্বাভাস-রূপে “নায়িকারত্নমালা”-র ভিত্তিতে শশিশেখর ও চন্দ্রশেখরের পদের পরিপ্রেক্ষিতে “নায়িক-নায়িকা ও বৈষ্ণব-পদাবলীতে রস ও ভাব-বিকাশের কথঞ্চিৎ আলোচনা করতে এখানে চেষ্টা করেছি৷
“নায়িকারত্নমালা”-গ্রন্থে অষ্টনায়িকার উল্লেখের পরেই প্রথম নায়িকা “অভিসারিকা”-র অষ্টবিধ লক্ষণ “গীতাবলী” থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে —
যা পর্য্যুৎসুকচিত্তাতিমদেন মদনেন চ ৷
আত্মনাভিসরেৎ কান্তং সা ভবেদভিসারিকা ৷৷
অর্থাৎ যে নায়িকা অতিশয় যৌবন-মদ ও মদন-বিকার দ্বারা উৎকণ্ঠিত চিত্ত হয়ে নিজ কান্ত বা নায়কের নিকট অভিসার করেন তাঁকেই “অভিসারিকা” বলা হয়৷ এই অভিসারিকা আট প্রকার —
জ্যোৎস্নী চ তামসী চৈব বর্ষাস্বথ দিবা মতা৷
কুজ্ঝটিকা তীর্থযাত্রা চোন্মত্তা সঞ্চরাপি চ ৷৷
অর্থাৎ অভিসারিকা জ্যোৎস্নী, তামসী, বর্ষাভিসারিকা, দিবাভিসারিকা, কুজ্ঝটিকাভিসারিকা, তীর্থযাত্রাভিসারিকা, উন্মত্তা ও সঞ্চবা-ভেদে অভিসারিকা আট প্রকার৷
এরপর জ্যোৎস্নী প্রভৃতি আট প্রকার অভিসারিকার পরিচয় দিয়েছেন পদরচয়িতারা সুললিত সংস্কৃত পদের মাধ্যমে৷ যেমন —
কূচ-কলসভরার্তা কেশাবি-ক্ষণ-মধ্যা;
বিপুলতর-নিতম্বা পক্ব-বিম্বাধবৌষ্ঠী ৷
ধবল-বসন-বেশা, মালতী-বদ্ধ-কেশা
নিধুবন-রস-পুঞ্জং যাতি রাধ নিকুঞ্জম্‌৷৷
পদগুলির ছন্দসজ্জা, রচনা ও সাহিত্য সুললিত ও রসপূর্ণ৷ অনেকে এই বৈষ্ণবপদ-সাহিত্যে শৃঙ্গাররসাত্মক বর্ণনায় মধ্যে কামগন্ধের সন্ধান পান, কিন্তু এ্ই শৃঙ্গাররস বিশ্বসৃষ্টির আদিরস ও অপূর্ব কল্পনা — যে রস ও কল্পনাকে নিয়ে বিশ্বরচয়িতা ঈশ্বর বিরাট সৃষ্টি রচনা করেছেন অগণিত মানুষের শান্তি ও মুক্তির জন্য৷ পরবর্তী প্রস্তরমন্দির বা গুহামন্দিরগুলিতে শৃঙ্গাররসাত্মক মূর্তির লীলাবিলাসের পিছনেও অপার্থিব ভাবমাধুর্যের বিকাশ বা প্রলেপ দেখা যায় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্রষ্টা ভগবানের সন্নিধানে রসপিপাসু মানুষকে উপনীতি হবার জন্য৷
শশিশেখর ও চন্দ্রশেখর-রচিত পদগুলির সঙ্গে শাস্ত্রীয় ধানশী (ধানেশ্রী), মল্লার বা মল্লারিকা, ভূপালিকা বা ভূপালী, মঙ্গল-ধানশী, বরাডী, সৌরঠী (সৌরাষ্ট্রী), মায়ুরী৷ কল্যাণ বা কল্যাণী প্রভৃতি রাগেরও সমাবেশ দেখা যায়, যেমন দেখা যায়, অষ্টনায়িকার প্রতিটি রূপভেদের প্রারম্ভে গীতাবলী কিংবা শ্রীমদ্ভাগবত থেকে সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে৷ যেমন, অনুকূলার বর্ণনার প্রারম্ভে দেখা যায় —
শ্রীমদ্ভাগবতে যথা —
অনয়ারাধিতো ন্যূনঃ ভগবান্‌ হরিবীশ্বরঃ ৷
নন্নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনযদ্রহঃ ৷৷

অর্থাৎ অকুকূলা স্বাধীনভর্ত্তৃকার বর্ণনা শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায় যে, এই নায়িকা-কর্তৃক নিশ্চয়ই ভগবান শ্রীহরি আবাধিত হয়েছেন, যে জন্য গোবিন্দ প্রসন্ন হয়ে ও আমাদের পরিত্যাগ করে এই অনুকূলা নায়িকাকে সঙ্গে নিয়েই নির্জনে গমন করেছেন৷ শশিশেখর করুণাশ্রী-রাগে (?) বসায়িত ব্রজবুলি ভাষায় বর্ণনা করেছেন —
এই যে নাগরী আরাধিল হরি
নিশ্চয় কহিলুঁ তোরে৷
প্রাণের গোবিন্দ পাইয়া আনন্দ
সঙ্গতি লইল যারে ৷৷
আমা সবাকারে পরিহরি দূরে
তারে লৈয়া সঙ্গোপনে ৷
মদন-বিলাস করে পরকাশ
বুঝিলাম অনুমানে৷৷
রমনী-রমন দুঁহুঁ পদচিহ্ন
পড়িয়া আছয়ে পথে৷
মাফবী পতাকা ধ্বজ উর্ধরেখা
বজর অঙ্কুশ তাতে ৷৷
আমরা গোপিনী সবে ভাগিহীনী
ভাগ্যবর্তী এই নাবি ৷
শশি (শশী) কহে সতি বরজ-যুবতি
তারে অনুকূল হরি৷৷
পিতাম্বরদাসের “রসমঞ্জরী” গ্রন্থটি বিদগ্ধ বৈষ্ণব-সাধকগণের সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত ৷ অষ্টনায়িকার প্রসঙ্গে “শ্রীশ্রীনায়িকারত্নমালা”-র মতো পীতাম্বরদাস-রচিত এবং ভানুদত্তের পদ্যানুবাদ “রসমঞ্জরী” থেকে সামান্য-কিছু রস-ভাব তত্ত্ব নিয়ে এখানে আলোচনা করছি ৷ শ্রদ্ধেয় নগেন্দ্রনাথ বসু “রসমঞ্জরী” (গীতাম্বরদাসের “রসমঞ্জরী” ত্রৈমাসিক সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় বঙ্গাব্দ ১৩০৬ শতকে প্রকাশিত হয় ৷) গ্রন্থের সম্পাদকীয় মন্তব্য করেছেন৷ শ্রদ্ধেয় নগেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন, মিথিলাবাসী গণপতিনাথের পুত্র ভানুদত্ত পীতাম্বরদাসের “রসমঞ্জরী” গ্রন্থটির পদ্যানুবাদ করেন৷ “রসমঞ্জরী” গ্রন্থের উপর অনন্ত পণ্ডিতরচিত “ব্যঙ্গার্থকৌমুদী”, আনন্দশর্মা-রচিত “ব্যঙ্গার্থদীপিকা”, নাগেশভট্ট-রচিত “রসমঞ্জরীপ্রকাশ”, হরিবংশভট্ট-রচিত “রসমঞ্জরীটীকা”, হরিবংশভট্টের পুত্র গোপালভট্ট-রচিত “রসিকরঙ্গিনী”, নৃসিংহাত্মজ বোপদেব-কৃত “রসমঞ্জরী বিকাশ”, লক্ষ্মীধরাত্মজ বিশ্বেশ্বর-রচিত “সমঞ্জসা”, শেষনৃসিংহাত্মজ শেষচিন্তামণি-রচিত “রসমঞ্জরীপরিমল”, ব্রজরাজ দীক্ষিতের “রসিকরঞ্জন” প্রভৃতি টীকা ও ভাষ্য প্রসিদ্ধ৷
বাংলাভাষায় সম্ভবত মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রই প্রথমে “রসমঞ্জরী” গ্রন্থের প্রচারক৷ অবশ্য তিনি সংস্কৃত “চোরপঞ্চাশৎ”কাব্যের যে পদ্যানুবাদ ও শিখরিণী ছন্দে “নাগাষ্টক” রচনা করেন তাদের ভাব ও ভাষা “রসমঞ্জরী”-গ্রন্থের ভাবের উদ্বোধক৷ তাছাড়া পীতাম্বরদাসের সংস্কৃত “রসমঞ্জরী” ও ভানুদত্তের পদ্যানুবাদযুক্ত রসমঞ্জরীর আদর্শে ভারতচন্দ্র একখানি “রসমঞ্জরী” গ্রন্থও রচনা করেন৷ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতচন্দ্রের রসমঞ্জরীর বিশেষ সমাদর দিয়েছেন৷ “জয়দেব ও বিদ্যাপতি” নিবন্ধে শ্রদ্ধেয় বঙ্কিমচন্দ্র ভারতচন্দ্রের “রসমঞ্জরী”-গ্রন্থকে শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য বলে প্রশংসা করেছেন৷ শ্রদ্ধেয় সতীশচন্দ্র রায় ভানুদত্ত-কৃত “রসমঞ্জরী” গ্রন্থের বাংলা -পদ্যানুবাদের (বসন্তকুমার চক্রবর্তী-কর্তৃক কলিকাতা মডেল লাইব্রেরী থেকে ১৩২০ সালে প্রকাশিত ৷) ভূমিকায় করেছেন ঃ “ভানুদত্ত প্রোষিতভর্তৃকা প্রভৃতি অষ্টনায়িকার প্রত্যেকের মুগ্ধা, মধ্যা, প্রগল্‌ভা পরকীয়া ও গণিকা-ভেদে যে স্বতন্ত্র উদাহরণ দিয়াছেন, সেস্থলে ভারতচন্দ্র প্রোষিতভর্তৃকা ইত্যাদির মুগ্ধা প্রভৃতি নায়িকা-নির্বিশেষে কেবল একটি করিয়া উদাহরণ দেখাইয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন এবং সংস্কৃত রসমঞ্জরীর বিচারাত্মক অধিকাংশ স্থলই বাহুল্য-ভয়ে পরিত্যাগ করিয়াছেন৷” তাহলেও ভানুদত্তের রসমঞ্জরীর বাংলা-পদ্যানুবাদের মতো ভারতচন্দ্রে রসমঞ্জরীও রস-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আদরণীয় বলে গণ্য ৷
শ্রদ্ধেয় সতীশচন্দ্র রায় লিখেছেন, সংস্কৃত ভাষায় ভরত মুনি-প্রণীত “নাট্যশাস্ত্র” সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও প্রামাণিক গ্রন্থ নির্বাচিত হইলেও রুদ্রভট্ট-প্রণীত “শৃঙ্গারতিলক” ভানুদত্ত-প্রণীত – “রসমঞ্জরী” পদ্যানুবাদ ও বিশ্বনাথ চক্রবর্তী প্রণীত “সাহিত্যদর্পণ” গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত নায়ক-নায়িকার যে বিস্তৃত বিভাগ ও পরিচয় আছে, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে ঠিক সে রকম নাই !” পুনরায় “শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবে মধুরভাবাত্মক বৈষ্ণবধর্মের প্রভুত উৎকর্ষ সাধিত হওয়ায় পরবর্তী বৈষ্ণবাচার্য ও বৈষ্ণব-কবিদিগের দ্বারা এই বিষয়টি যেইরূপ উৎকৃষ্টরূপে আলোচিত ও পল্লবিত হইয়াছে সেইরূপ আর কোথাও হয় নাই৷ সুপ্রসিদ্ধ রূপ গোস্বামী-প্রণীত “উজ্জ্বলনীলমণি” নামক অপূর্ব গ্রন্থ রসশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ যুক্তিপূর্ণ দর্শন ও প্রায় সার্ধশত বৈষ্ণব-কবির সুললিত পদাবলীকে ইহার কবিত্বপূর্ণ উদাহরণ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে৷ * * বাংলাভাষায় বৈষ্ণব-কবি কৃষ্ণদাস -প্রণীত “ভক্তমাল” গ্রন্থের অন্তর্গত রস-পরিচ্ছেদে ও ভারতচন্দ্র রায়ের প্রণীত “রসমঞ্জরী” প্রভৃতি ২৷৩ খানা গ্রন্থ ব্যতীত যদিও এই বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হয় নাই, তথাপি বৈষ্ণব-কবি ও কীর্তন-গায়কদিগের প্রসাদে পরকীয়া, মুগ্ধা, মধ্যা, বাসকসজ্জা, অভিসারিকা, কলহান্তরিতা প্রভৃতি রসশাস্ত্রের পারিভাষিক শব্দগুলি আমাদিগের অধিকাংশের নিকটেই অপরিচিত নহে৷ “পদকল্পতরু” নামক সুরহৎ পদাবলী-সংগ্রহের সঙ্কলয়িতা বৈষ্ণবদাস ঐ গ্রন্থে উজ্জ্বলনীলমণির বর্ণিত ক্রম অনুসারে বৈষ্ণব-কবিদিগের পদাবলী বিন্যস্ত করিয়াছেন এবং কোন কোন স্থলে পারিভাষিক শব্দগুলির লক্ষণ দেওযার জন্য “উজ্জ্বল নীলমণি” হইতে সংস্কৃত কারিকাতে সংস্কৃত উদাহরণ শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন৷”
পীতাম্বরদাসের সংস্কৃত “রসমঞ্জরী” গ্রন্থে অভিসারিকা-সম্পর্কে দেখি —
কান্তার্থিনী তু যা যাতি —
সঙ্কেতং সাভিসারিকা ৷
পদ্যানুবাদে দেখি —
সেই অভিসার হয় পুন অষ্ট প্রকার৷
জোৎস্নী তামসী বর্ষা দিবা-অভিসার ৷৷
কুজ্ঝটিকা তীর্থযাত্রা উন্মত্তা সঞ্চরা৷
গীতপদ্যরসশাস্ত্রে সর্বজনোৎকরা ৷৷
এরপর গ্রন্থকার সঙ্গীত-দামোদর (১৬শ শতক) থেকে এর নিদর্শন দিয়েছেন (সুতরাং রসমঞ্জরী ১৬শ শতকের পরবর্তী রসগ্রন্থ) —
“শ্রীসঙ্গীত-দামোদরে —
স্ফারিকুজ্‌ঝটিহেমন্তরজনীধ্বান্তসঞ্চরা৷
গ্রীষ্মমধ্যাহ্নবাতাদি-কোলাহলবিধূদয়াৎ ৷৷
রাষ্ট্রভঙ্গনিরাতঙ্ক —
পুবদারমহোৎসবঃ ৷
প্রদোষশ্চেতি কথিতা
দ্বাদশৈবেদৃশাঃ ক্রমাৎ ৷৷
পীতাম্বরদাসের সংস্কৃত “রসমঞ্জরী” গ্রন্থে অভিসারিকার প্রসঙ্গচ্ছলে জ্যোৎস্নী, তামসী, দিবা, কুজ্ঝটিকা, তীর্থযাত্রা, উন্মত্তা, সঞ্চার , বাসকসজ্জা, মোহিনী, জাগর্তিকা, মধ্যোক্তিকা, প্রগল্‌ভা, সুপ্তিকা, সুবসা, উদ্দেশা, উৎকণ্ঠিতা, বিকলা, স্তব্ধা, চকিতা, অচেতনা, উৎকণ্ঠিতা-মধ্যা প্রভৃতির পরিচয় আছে এবং সঙ্গে সঙ্গে অভিসারিকাগুলিতে সংযোজিত -ভূপালি, আসোআরি বা আসাবরী, ধানসী, কেদারিকা, মঙ্গল-গুর্জরী, গান্ধার প্রভৃতি রাগগুলির উল্লেখ আছে৷ রসমঞ্জরীতে গীতাবলী, পদ্যাবলী, রসকদম্ব, কৃষ্ণমঙ্গল, গীতগোবিন্দ প্রভৃতি গ্রন্থের উদ্ধৃতি আছে৷ সংস্কৃত রসমঞ্জরীর সমাপ্তিভাগে উল্লিখিত দেখি —
খণ্ডিতাদি অষ্ট রস আট আট করি৷
চৌষট্টি প্রকার করি গ্রন্থ রসমঞ্জরী৷৷
গদ্য পদ্য সঙ্গীত ইহার প্রমাণে ৷
অবোধ না বুঝে ইহা রসিক সে জানে৷
শ্রীশচীনন্দন প্রভু ঠাকুর আমার ৷
পীতাম্বরদাস কহে রসের বিস্তার ৷৷
“রসকল্পবল্লি”-গ্রন্থে যে অবশিষ্ট ছিল৷
তাহা বিবরিঞা ইহা বর্ণনা করিল ৷৷
পীতাম্বরদাসের গুরুর নাম শচীনন্দন ঠাকুর, বর্ধমানের অন্তর্গত শ্রীখণ্ড নামক স্থানে তাঁর বাসস্থান ৷ শ্রদ্ধেয় নগেন্দ্রনাথ বসু রসমঞ্জরীর ভূমিকায় লিখেছেন ঃ “মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব যে সময়ে নীলাচলে ছিলেন, সেই সময়ে চক্রপাণি ও মহানন্দ নামে দুই ভাই তথায় গিয়া মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীরঘুনন্দনের শিষ্য বলিয়া পরিচয় দেন৷ (রামগোপাল-দাস স্বরচিত “রসকল্পবল্লী” গ্রন্থের মধ্যে এরূপে পরিচয় দিয়েছেন –“চক্রপাণি মহানন্দ দুই মহাশয়৷ নীলাচলে দুই ভাই প্রভুকে মিলয় ৷৷”) এই চক্রপাণি চৌধুরীর পুত্র নিত্যানন্দ, তৎপুত্র গঙ্গারাম,গঙ্গারামের পুত্র শ্যামরায়, তাঁহার দুই পুত্র ঃ জ্যেষ্ঠ “গোবিন্দলীলামৃত”-রচয়িতা মদনরায় চৌধুরী ও কনিষ্ঠ “রসকল্পবল্লী”-প্রণেতা রামগোপাল৷ এই রামগোপালের পুত্র পীতাম্বর বা পীতাম্বরদাস৷” সুতরাং পীতাম্বরদাস শ্রীচৈতন্যের পরবর্তী বৈষ্ণব-কবি বা গ্রন্থকার৷ অনুবাদক ভানুদত্ত পরে সংস্কৃত “রসমঞ্জরী” গ্রন্থের পদ্যানুবাদ রচনা ও প্রকাশ করেন৷ সুতরাং “শ্রীশ্রীনায়িকারত্নমালা”-র মতো “রসমঞ্জরী” (১৬শ শতকের) পরবর্তী কালের রসগ্রন্থ হলেও এবং এই “পদাবলীকীর্তনের ইতিহাস” গ্রন্থের পরবর্তী ভাগে নায়ক-নায়িকাভেদ ও রসপর্যায় বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার ইচ্ছা থাকলেও পূর্বসূচনারূপে সামান্যভাবে রস ও ভাব এবং নায়ক-নায়িকার এখানে আলোচনা করলাম মাত্র ৷