আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে ভারতীয় সাহিত্য সর্বপ্রথম সঙ্গীতেই অভিব্যক্ত হইয়াছিল ৷ ইঁহারা উদাহরণস্বরূপ পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন সাহিত্য বেদমন্ত্রের উল্লেখ করেন ৷ ঋষিগণ বেদমন্ত্র গান করিতেন ৷ যে ‘সহিত’ হইতে সাহিত্য শব্দটি নিষ্পন্ন হইয়াছে, সঙ্গীতেই সেই সহমিলনকে নিকটবর্তী করিয়া আনিয়াছিল ৷ কণ্ঠ-সঙ্গীতেই সাহিত্যের প্রথম প্রকাশ ৷ সুর পরিমার্জিত ও শ্রেণীবদ্ধ হইলে পরে তালের সৃষ্টি হইয়াছিল ৷ যন্ত্র-সঙ্গীতের সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহারও পূর্বে ৷
অসম্ভব নহে গৃহবাসী অরণ্যচারী মানব কীচক-কুঞ্জে একের সঙ্গে অন্যের সংঘর্ষজনিত শব্দে আকৃষ্ট হইয়াছিল ৷ কবিরাজ কৃষ্ণদাস ইহাকেই পরস্পর ‘বেণুগীত’ বলিয়াছেন ৷ কৃষ্ণপ্রাণ শ্রীরাধার তন্ময়তার কথা বলিতে গিয়া তিনি বলিয়াছেন, পরস্পর বেণুগীতে হরয়ে চেতনা ৷ বেণুগীতে শ্রীরাধার অন্তরে শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনির স্মৃতি উত্তাল হয়ে উঠে ৷ জানি না আদিম মানব ঐ বেণুগীতে মজিয়াই বংশী নির্মাণ করিতে এবং বাঁশী বাজাতে শিখিয়াছিল কিনা ৷ অসম্ভব নহে, সাগরতীরবর্তী মানব দিগন্তবিস্তৃত বালুবেলায় আপতিত শঙ্খ কঙ্কালের অভ্যন্তরে প্রবাহিত পবনোত্থিত আরাবে উৎকর্ণ হইয়াছিল ৷ তাহারা কম্বু-মুখে অধর ফুৎকার দিয়া মন্দ্রিত করিয়াছিল দিক্‌ হইতে দিগন্তর ৷ সে ধ্বনি তরঙ্গায়িত হইয়াছিল অন্তহীন নীলাম্বু-বিস্তারের লহরীমালায় ৷ এইবাবে মানব যন্ত্রসংগীতের দ্বিতীয় সোপান অতিক্রম করিয়াছিল ৷
মানুষ কবে লিখিতে শিখিয়াছিল ? গিরিগাত্রে না ভূর্জপত্রে, বৃক্ষবল্কলে না অর্ধ-শুষ্ক কদমাক্ত সমতলে সে প্রথম লিখিয়াছিল আপনার মর্মমথিত উল্লাস আবেগে, সুখ-দুঃখ, ব্যথা ও বেদনা, হাসি ও অশ্রুর পংক্তি-প্রচয়— তাহা কেহ জানে না ৷ কেহ কেহ বলেন, সঙ্গীত হইতেই কবিতা, আবার কবিতার ক্রমবিবর্তনে গদ্য উদ্ভূত হইয়াছে ৷ আমার আলোচ্য গীতি-কবিতা ৷ যে গান কবিতারূপে আবৃত্তি করিলে অথবা যে কবিতা সুর-সংযোগ গীত হইলে চিত্ত চমৎকৃতি ও শ্রুতি -সুখের প্রায় ইতরবিশেষ হয় না, তাহাকেই আমি গীতিকবিতা বলিতেছি ৷ অবশ্য শব্দটি বিদেশাগত ‘লিরিকের’ প্রতিশব্দ ৷
কবিকে আমরা নানা দেশে নানা বেশে প্রত্যক্ষ করিয়াছি ৷ কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের পর প্রথম শোকসভায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মন্দিরে আমি বলিয়াছিলাম, তোমারে দেখিয়াছিলাম পুণ্যতোয়া তমসার তীরে ক্রৌঞ্চমিথুনের একতরের বিয়োগে শোককাতর ৷ দেখিয়াছিলাম, অশ্রান্ত পাদচারণে মুখরিত তমসার তীর দেশে ৷ তোমারে দেখিয়াছিলাম উজ্জয়িনীর রাজসভা-মাঝে—উত্তুঙ্গ প্রাসাদ সৌধের মণিমণ্ডিত কক্ষকুট্টিমে ৷
কবিকে যেমন দেখিয়াছি রাজ-সন্নিধানে, তেমনই দেখিয়াছি উটজপ্রাঙ্গণে কুশাসনে ৷ ইঁহারা রামায়ণ-মহাভারত রচনা করিয়াছেন ৷ মেঘদূত, শ্রীগীতগোবিন্দ ইঁহাদেরই রচনা ৷ আবার ইঁহাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত একান্তই দীন সামর্থ্য কেহ কেহ পল্লীগীতি গাথা রচনা করিয়া গিয়াছেন ৷ এই অজ্ঞাতনামা স্বল্পখ্যাত কবিদের পরিচয় কেহ স্মরণ করিয়া রাখে নাই ৷ আমি ইঁহাদিগকেও কবি বলিয়া সম্মান করি ৷ ইঁহারা জনসাধারণের কবি ৷ আশ্চর্যের বিষয়, ইঁহাদের রচিত কবিতা সাহিত্য হইত এবং সর্বসাধারণে তাহা বুঝিতে পারিত ৷ বাঙ্গালার জনসাধারণের মধ্য হইতে আবির্ভূত কবিগণ দুইবার সার্থক সাহিত্য রচনা করিয়াছেন এবং সেই সাহিত্য জনসাধারণকে প্রভাবিত করিয়াছে, হাসাইয়াছে, কাঁদাইয়াছে, মাতাইয়াছে ৷ প্রথমে যাঁহাদের কথা বলিয়াছি তাঁহারা জনচিত্তের পরিবর্তনও ঘটাইয়াছেন ৷ ইঁহাদেরই একদল — প্রথম দল অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের কবিত্বশক্তিসম্পন্ন, দৈবী প্রতিভায় সমলঙ্কৃত, লোকোত্তর চমৎকারিতার চিত্রকর ৷ ইঁহারাই বৈষ্ণব কবি নামে পরিচিত ৷ ইঁহারা কালজয়ী, ইঁহারা অমর ৷ অপর দলের নাম কবিওয়ালা ৷ বৈষ্ণব কবিগণের লৌকিক সংস্করণ, অতি অল্প শক্তির অধিকারী এই কবিগণ যুগ-প্রয়োজনেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ প্রকৃতই কবি ছিলেন ৷ ক্ষণিকের খদ্যোত বলিয়া ইঁহাদিগকে অবমানিত করিলে চলিবে না ৷ আজ বৈষ্ণব কবিগণের কথাই আলোচনা করিতেছি ৷
বাঙ্গালার বৈষ্ণব কবিতার উৎস অনুসন্ধানে আমাদিগকে সম্রাট সভাতেই উপস্থিত হইতে হয়, উপস্থিত হইতে হয় কবি জয়দেবের পদপ্রান্তে ৷ আকস্মিক নিদারুণ ভূ-কম্পনে বাঙ্গালার রাজধানী বিধ্বস্ত হইয়া গেল ৷ সমৃদ্ধ নগরী পরিণত হইল ধ্বংসস্তূপে ৷ কিন্তু এই রাষ্ট্রবিপ্লবের দুর্যোগ মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য হইতে উৎসারিত হইল এক মৃতসঞ্জীবনীর অমৃত প্রস্রবণ ৷ সংবাদপত্র নাই, রেলপথ নাই, বেতার-বার্তা নাই, শ্রীগীতগোবিন্দের গীতধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলিল সারা ভারতবর্ষে ৷ কিন্তু বাঙ্গালায় তাহা অন্যরূপে কল্যাণপ্রসূ হইল ৷ শ্রীগীতগোবিন্দের অমৃত মন্দাকিনী দুইটি প্রবাহে বিভক্ত হইয়া গেল ৷ এই দুইটি ধারার নাম চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির গীতি স্রোতস্বিনী ৷ এই ত্রিধারারই মিলিত বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, বাঙ্গালার শ্রীগৌরাঙ্গদেব ,নিমাই পণ্ডিত৷
শ্রীগৌরাঙ্গের অভ্যুদয় বাঙ্গালায় যুগান্তর আনয়ন করিল ৷ পরাধীনতায় বন্দী বাঙ্গালী একটা জাতিরূপে সংহত হইয়া উঠিল ৷ ভাগবত প্রেম ও মানবপ্রেমের সমন্বয় মূর্তি শ্রীগৌরাঙ্গদেব ছিলেন বিশ্বাসের প্রাণবন্দ প্রতিভূ ৷ যেমন ভগবদ্‌ভক্তি, তেমনই লোককল্যাণে প্রবৃত্তি ৷ মানব-মঙ্গলব্রতী অগণিত ভক্ত সাধক তাঁহাকে কেন্দ্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া একত্রে আসিয়া মিলিত হইল ৷ ভালবাসা হইল তাঁহাদের মূলমন্ত্র ও প্রেমেই তাঁহাদের প্রাণ ৷ সঙ্কল্পে দুর্জয়, লক্ষ্যে অবিচলিত , চরিত্রে অম্লান, নিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিষ্ঠ এই বাঙ্গালী দল বাঙ্গালী সমাজের সর্বস্তরেরই মানুষ— তাহারা অকপট, অকুতোভয় ৷ ভালবাসার শাশ্বত নিকেতন শ্রীবৃন্দাবন আর কল্পনার কল্পলোকে রহিল না, ইঁহাদের চক্ষের সম্মুখে বাস্তবে আসিয়া ধরা দিল ৷ শ্রীকৃষ্ণ-রূপের দলিতাঞ্জন চক্ষে মাখিয়া বাঙ্গালার গগন-নীলিমায়, পল্লবী অমল শ্যামলিমায় ইঁহারা শ্রীকৃষ্ণকে প্রত্যক্ষ করিলেন ৷ প্রতনু- সলিলা প্রবাহিনীর কলতানে শুনিলেন শ্রীকৃষ্ণের চরণযুগলের নূপুর-শিঞ্জন। কোকিলের কুহু-গানে শুনিলেন মুরলীর আকুল আহ্বান ৷ বরষার ঘনঘটা, বসন্তের বনশোভা ইঁহাদিগকে নিত্য নতুন ভাবে বিভাবিত করিয়া তুলিল ৷ এই মানসপ্রকর্ষে পরিমার্জিত , প্রাণ-প্রাচুর্যে প্রফুল্ল জাতি ভালবাসার মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করিল ৷ দেশকে ভালবাস, জাতিকে ভালবাস, অকপট ভালবাসাই তোমাকে অমরত্ব দান করিবে ৷ দেশকে, জাতিকে অমৃত আস্বাদন করাইবে ৷ এই ভালবাসাই মরজগতের মৃতসঞ্জীবনী ৷ কিন্তু এই ভালবাসার আদর্শ কোথায়? মানুষ কাহাকে অনুসরণ করিবে ? কাহার চরণাঙ্কিত সরণি তাহাকে পথ দেখাইবে ? কাহার পণ্য-কথা তাহার অন্তরে প্রেরণা জাগাইবে, ভরসা আনিয়া দিবে, হৃদয়ে বল-সঞ্চারের প্রবল সহায়ক হইবে? শ্রীমহাপ্রভু এই আদর্শের সন্ধান প্রদান করিলেন ৷ ‘দুস্ত্যজ আর্য পথ নিজ পরিজন, স্বজন করয়ে যত তাড়ন ভর্ৎসন’ চিরাচরিত অনুসরণীয় ৷ আর্যপথ ও আপনার গৃহ ও পরিজনকে পরিত্যাগপূর্বক, শত গঞ্জনা সহিয়া, সহস্র বাধা পায়ে দলিয়া যিনি ভালবাসিবার জন্য ভালবাসিয়াছিলেন, স্বার্থগন্ধহীন ভালবাসার প্রমূর্ত বিগ্রহ সেই শ্রীরাধাকে আনিয়া লোকচক্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত করিলেন ৷ আপনি আচরি ধর্ম সকলকে শিক্ষাদানের জন্য শ্রীরাধার ভাব ও ইচ্ছাকে নিজ জীবনেই প্রতিফলিত করিয়া তুলিলেন ৷ তাঁহার সর্বত্যাগ সমাজে সর্বতো ভদ্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিল ৷ লোকে রাধাভাবদ্যুতি-সুবলিততনু শ্রীগৌরসুন্দরকে হৃদয়ে বরণ করিয়া লইল ৷ সেকালে এই ভালবাসার কথা প্রচারের প্রয়োজনীয়তা ছিল ৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলধারা কেমন করিয়া সুরধুনীধারায় আত্মসমর্পণপূর্বক মানবজীবনের চরম ও পরম কাম্য সাগর সঙ্গমে গিয়া উল্লসিত হয়, শ্রীরাধাকে আনিয়া তিনি মানুষকে এই উদাহরণের প্রতি আকৃষ্ট করিয়া তুলিলেন৷ তাঁহার প্রচেষ্টা সার্থকতা প্রাপ্ত হইল ৷
এই ভালবাসার মন্ত্র প্রচার করিবার জন্যই কবিগণের প্রয়োজন ৷ তাঁহারা বাঙ্গালার জনসাধারণের মানসক্ষেত্র হইতেই অভ্যুদিত হইলেন ৷ সমাজের সকল শ্রেণীরই মানুষ ছিলেন ইঁহাদের মধ্যে ৷ জনপ্রতিনিধিরূপে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার উদ্গাতারূপে এই কবিগণের আবির্ভাব বাঙ্গালার ইতিহাসে এক অভাবনীয় ঘটনা ৷ বাঙ্গালায় সে সময় এমনই সব শক্তিধর কবি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যাঁহাদের কবিতা আজ চারি শত বৎসর ধরিয়া বাঙ্গালার সাহিত্য-ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে— যাঁহাদের কবিতা বঙ্কিম, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথকে মোহিত করিয়াছে, আনন্দ দান করিয়াছে, পরিতৃপ্ত করিয়াছে ৷ এই কবিতায় ব্যক্তিগত আবেগ ছিল, সুখ-দুঃখ ছিল, আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল ৷ আত্মগত ভাবতন্ময়তার সেই প্রাণচাঞ্চল্য কখন যে গোপীভাব-প্রবাহিণীতে বিলীন হইয়া গিয়াছিল, কবি তাহা জানিতে পারেন নাই ৷ জনমনও তাহাতে ব্যক্তিকে আবিষ্কার করিতে পারে নাই ৷ সে কবিতা তাই গোলোকের সঙ্গীতে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে ৷
আশ্চর্যের বিষয়, এই কবিতা জনসাধারণ — সেকালের শতকে প্রায় পাঁচ জন লোক বুঝিতে পারিত ৷ তাহারা এই কবিতা হইতেই হৃদয়ের ভোজ্য সংগ্রহ করিত, এই কবিতা উপভোগ করিয়া আনন্দিত হইত ৷ কবি আসিয়াছেন — কবিতা বুঝিয়াছেন জনসাধারণের সর্ব শ্রেণীর সাক্ষর নিরক্ষর সর্বশ্রেণীর মানুষ— অন্তত সহস্রে তাহাদের সংখ্যা ছিল অর্ধশত ৷ বুঝিবার ও বুঝাইবার এই রহস্যের সন্ধান জানা নাই বলিয়াই পঁচিশে বৈশাখ প্রায় গ্রামে গ্রামে সভা করিয়াও রবীন্দ্রনাথকে আজিও হাজারে একজন মানুষের বোধগম্য করিতে পারা যায় নাই ৷ বৈষ্ণব কবিগণ সেকালের জনসাধারণের কবি, একটি বিশিষ্ট ধার্মিক সম্প্রদায়ের কবি, একটা গোষ্ঠীগত চেতনার কবি ৷ বৈষ্ণব কবিতা ধর্মমূলক কবিতা ৷ অনেক কবির একই বিষয়বস্তু লইয়া লেখা কবিতা আছে ৷ তাহা হইলেও এই সমস্ত কবিতার কিছু অংশ প্রকৃত কবিতার সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছে ৷ সেকালের মানুষ সকলেই বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে নাই ৷ তথাপি এই কবিতা অবৈষ্ণব রসিক মানুষকে আকর্ষণ করিয়াছে ৷ ভালবাসা মানবের সহজাত— মানবের জন্মের সঙ্গেই তাহার অন্তরে সঞ্জাত হইয়াছিল, বৈষ্ণব কবিতা সেই ভালবাসার চরম ও পরমতম প্রকাশে উজ্জ্বল বলিয়া জনমনকে উদ্বুদ্ধ করিত ৷
বৈষ্ণব কবিতা মূলত সঙ্গীত, গাহিবার জন্যই তাহা প্রণীত হইয়াছিল ৷ কিন্তু কয়জনের কবিতা কীর্তনীয়াগণ গাহিতেন? খেতরী মহোৎসবে বিধিবদ্ধভাবে কীর্তন গানের প্রথা প্রবর্তিত হয় ৷ তাহার পর সঙ্কলিত হয় পদসংগ্রহের গ্রন্থ ৷ আমি বাল্যকাল হইতেই কীর্তন-গান শুনিয়া আসিতেছি ৷ বড় বড় কীর্তনীয়াগণ, নানা পালায় খুব বেশী হইলেও পনের-কুড়ি জনের অধিক কবির পদ গাহিতেন না ৷ বর্তমানে কীর্তনীয়া দল এখনো দশ-পনের জনের কবিতাই গান করেন ৷ যত সঙ্কলন-গ্রন্থ দেখিয়াছি, শতাধিক কবির পদ মাত্র সঙ্কলিত পাইয়াছি ৷ অথচ পদ-রচয়িতার সংখ্যা চারি শতের কম হইবে না ৷ বহু পদ লুপ্ত হইয়া গিয়াছে ৷ তথাপি এখনো খুঁজিয়া পাতিয়া সংগ্রহ করিলে ছয় হাজার পদ পাওয়া যাইবে ৷ শ্রীসরস্বতী প্রেসে মুদ্রিত সাহিত্য সংসদ-প্রকাশিত আমার সম্পাদিত ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ গ্রন্থের জন্য আমি প্রায় সাড়ে চারি হাজার পদ সংগ্রহ করিয়াছিলাম ৷ কিছু কম চারি হাজার ছাপা হইয়াছে ৷ আমার অনবধানতায় বাকী পদগুলি কোথায় হারাইয়া গিয়াছে ৷ আমি প্রায় দুই শত কবির পদ সংগ্রহ করিয়াছিলাম ৷
যে কথা বলিতেছিলাম— গায়কের গানে বৈষ্ণব কবিতার প্রচার ঘটিয়াছে ইহা আংশিক সত্য ৷ কারণ, গানের একটা আকর্ষণী শক্তি আছে ৷ তাহার সুরের মধ্যেও মোহকার যাদু রহিয়াছে ৷ ধর্মমূলক বলিয়াও অবশ্যপাঠ্য হইয়াছে একটা সম্প্রদায়ের নিকট এই বৈষ্ণব কবিতা ৷ বৈষ্ণব জানেন, বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যেই তাঁহার উপাসনার মন্ত্র রহিয়াছে ৷ পদাবলীর বহুল প্রচারের ইহাও অন্যতম কারণ ৷ কিন্তু এই দুইটি কারণই বৈষ্ণব পদাবলীকে সর্বজন গ্রহণীয় করে নাই ৷ বৈষ্ণব পদাবলী সর্বজনগ্রাহ্য হইয়াছে তাহার রসের আবেদনে ৷ এই আবেদনে সাড়া দিবার লোকের সংখ্যা ছিল সেকালে প্রচুর এবং এই সংখ্যা বৃদ্ধির হেতু হইয়াছিল শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর দিব্যাবদান ৷
বৈষ্ণবগণের মধ্যে কাহারো কাহারো রচিত এমন দুই-চারিটি কবিতা আছে, কবিতার মধ্যে এমন দুই-একটি পংক্তি আছে, জরা যাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না ৷ তথাপি মানবদেহের মত সাহিত্য-দেহেরও যৌবন ও বার্ধক্য আছে ৷ প্রায় দুই শত বৎসর অখণ্ড রাজ্য পরিচালনপূর্বক বৈষ্ণব কবিগণ অন্তর্হিত হইলেন ৷ তাহার পরও বৈষ্ণব কবির কোন প্রতিস্পর্ধীর দেখা মিলিল না ৷ আসরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন মঙ্গলকাব্যের কবিগণ ৷ চণ্ডীমঙ্গল,ধর্মমঙ্গল মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গল— দেবতা পৃথক্‌ হইলেও বিষয়বস্তু প্রায় এক এবং রচনাশৈলীতেও বিশেষ কোন পার্থক্য পাওয়া গেল না ৷ মঙ্গল-কাব্যে ৷ ইঁহারাই পল্লীগ্রামের অন্তিম গ্রামীণ কবি, জনসাধারণের কবি৷ ইহার পরই কবিওয়ালাদের আবির্ভাব ৷