মনে রাখতে হবে যে, সার্থক কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দ”-পদগান রাধাকৃষ্ণ-লীলাবিষয়ক ও রসাস্বাদনপ্রধান ৷ শ্রীচৈতন্যপরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণবগোস্বামীগণ-প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম পরবর্তীকালে আরও অধিক তত্ত্বপ্রধান ও রসসাধনাত্মক হলেও কবি জয়দেবের সময়েই বৈষ্ণবধর্মের নবজাগরণচেতনা সমগ্র বাংলাদেশকে প্রবুদ্ধ করেছিল৷ খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতকেই আমরা শ্রী, ব্রহ্ম, রুদ্র ও সনকাদি এই চারপ্রকার বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণ লক্ষ্য করি এবং এই সম্প্রদায়গুলি রামানুজ, মধ্ব, বল্লভ ও নিম্বার্ক প্রভৃতি ধর্মাচার্যদের কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল৷ এই চারটি বৈষ্ণবধর্মসম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান হয় আসলে আচার্য শঙ্কর-প্রবর্তিত অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে ৷ আচার্য শঙ্কর যেমন ভাষ্য রচনা করেছিলেন ব্যাস-রচিত বেদান্তসূত্রের উপর, রামানুজ, মধ্ব-বল্লভ ও নিম্বার্কও তেমনি বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈত, শুদ্ধাদ্বৈত ও দ্বৈতাদ্বৈত মতবাদমূলক ভাষ্য রচনা করেছিলেন ঐ একই সূত্রগুলিকে অবলম্বন করে ৷ তবে এইচারটি ভাষ্যেরই প্রাণকেন্দ্র ছিল শ্রীবিষ্ণু-ভগবান, এবং ভক্তি, আত্মনিবেদন বা প্রপত্তি ও আরাধনাদি ছিল শ্রীকৃষ্ণ-নারায়ণের প্রসাদ বা অনুগ্রহ লাভের উপায়স্বরূপ ৷ (ডঃ সুশীলকুমার দে ঃ Early History of the Vaisnava Faith and Movement in Bengal (1942), pp.2-3 দ্রষ্টব্য ৷ ) কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই চারজন আচার্য কিংবা তাঁদের তত্ত্বপ্রধান বৈষ্ণবধর্ম ও বিষ্ণু-উপাসনাও কবি জয়দেবের উপর বিশেষ কোন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় নি৷ কবি জয়দেবও ছিলেন বৈষ্ণবধর্মাশ্রয়ী পরমভাগবত এবং তাঁর ভক্তিসাধনা ছিল সহজ সরল শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলাগান ও লীলা-আস্বাদনকে নিয়ে সার্থক ও কেন্দ্রায়িত৷ তবে মূখ্যত কবি জয়দেব ছিলেন কাব্যরসপিপাসু কবি ও সংগীতশিল্পী ৷
অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত যে, পঞ্চরাত্রসংহিতা, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিত ও লীলাবৈচিত্র্য যেভাবে ভারতবর্ষীয় সমাজে বা বৈষ্ণবসমাজে প্রকাশিত ও প্রচারিত ছিল, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ-কর্তৃক পরিকল্পিত, প্রতিপাদিত ও প্রচারিত শ্রীকৃষ্ণলীলা ও শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বের রূপে ও বিকাশে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল৷ বিশেষ করে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে, পঞ্চরাত্রসহিতাগুলিতে ও শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের মথুরা-বৃন্দাবন-দ্বারকালীলার রূপ ও বিকাশ পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রভাবিত ও পরিকল্লিত শ্রীকৃষ্ণের বালগোপাললীলা ও কৌমারকৃতি থেকে বেশ ভিন্ন ছিল বলে মনে হয়৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যেরা শ্রীকৃষ্ণের আপ্রাকৃত লীলার তত্ত্বাংশই বিশেষভাবে প্রচার করেছিলেন ভক্তিসাধনা ও ভক্তিদর্শনের মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের ও শ্রীরাধার অপার্থিব লীলাকে নব রসে ও বিচিত্র ভাবে উপলব্ধি করার জন্য এবং সেই উপলব্ধির রূপ আরও নিবিড় ও ঘনীভূত হয়েছিল শ্রীচৈতন্যের মধ্যে যখন পরবর্তীকালে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির আবেশ শ্রীচৈতন্যে আরোপিত হয়েছিল৷ পদাবলী-কীর্তনের গৌরচন্দ্রিকার পরিকল্পনা ও প্রবর্তন প্রচেষ্টাই অবশ্য সেকথা প্রমাণ করে৷ এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও যে অন্য মতবাদের প্রচলন নাই — তা নয়, তবে পঞ্চরাত্রসংহিতা, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও শ্রীমদ্ভাগবতের ভক্তিধর্ম ও শ্রীকৃষ্ণলীলার রূপ ও তত্ত্ব পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজে রূপায়িত ভক্তিধর্ম ও শ্রীকৃষ্ণ তত্ত্বেরও বিকাশ যে কিছুটা ভিন্ন ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই৷ বাংলার বৈষ্ণবধর্ম-সম্পর্কে অলোচনাকালে ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন৷
তারপর কবি জয়দেব যে তত্ত্বাশ্রয়ী বৈষ্ণবরসতত্ত্বের অনুসরণ করে তাঁর অপূর্ব গীতিকাব্য গীতগোবিন্দ -পদগান রচনা করেন নি, বাংলার ইতিহাসই আমাদের সেকথা নিঃসংশয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়৷ ডঃ সুশীলকুমার দে এই প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “কিন্তু ইহা মনে রাখা প্রয়োজন যে, জয়দেবের অন্তত তিনশত বৎসর পরে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব হইয়াছিল, এবং তৎসম্প্রদায়-প্রবর্তিত রসশাস্ত্র বৃন্দাবন-গোস্বামীগণ-কর্তৃক আরও পরে রচিত হইয়াছিল৷ সুতরাং গোস্বামীমতের প্রচার জয়দেবের এত পরবর্তী সময়ে হইয়াছিল যে, তাঁহাকে গোস্বামীমতের প্রচারিত বৈষ্ণবমত বলিয়া গ্রহণ করা যায় না৷ কবি হিসাবে বৃন্দাবনলীলার মাধুর্য তাঁহাকে মুগ্ধ ও বিভোর করিয়াছিল, কিন্তু তিনি রূপগোস্বামীর মতো রসশাস্ত্রের উদাহরণস্বরূপ অথবা সেই শাস্ত্রের আদর্শ অনুযায়ী কাব্য রচনা করিয়াছিলেন একথা বলিলে শুধু ইতিহাসের অপলাপ নয়, তাঁহার (জয়দেবের) কবি-প্রতিভাও অসম্মান করা হয়৷ * * কিন্তু তিনি তত্ত্বন্বেষী ছিলেন না৷ তাঁহার কল্পনা-প্রবৃত্তির স্বরূপ ছিল মুখ্যত কবিধর্মী৷” ((ক) “নানা-নিবন্ধ” (জয়দেব ও গীতগোবিন্দ), পৃঃ ৪৮)৷ ডঃ দে অন্যত্র পুনরায় বলেছেন ঃ “It should not be forgotten that Jayadeva flourished at least three centuries before the promulgation of the Rasa-shastra of Rupa Goswamin, and the Krisnaism, which emerges in a finished literary form in his poem, as in the Maithili songs of Vidyapati, should not be equalished with that, presented by the dogmas and docyrines of later scholastic theologians. * * If he selected the love-story of Radha and Krishna, fascinating to mediaeval India, the divine love that he depicts, is considerably humanised in an atmosphere of passionate poetic appeal”.(Sanskrit Lieerature, published in Indian Studies : Past & Present,Vol.1, No.4. p.646 ৷ এখানে শ্রীকৃষ্ণের প্রাকৃত লীলার কথাই বলা হয়েছে ৷)
একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, কী গীতগোবিন্দ -পদগানে, এবং কী কৃষ্ণকীর্তন ও পদাবলীকীর্তন –সকলেরই উপজীব্য শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার প্রাকৃত কিংবা অপ্রাকৃত লীলামাধুর্যের বর্ণনা ও তার রসাস্বাদন এবং সকলেরই প্রাণকেন্দ্র ছিল বিচিত্র লীলাবিহারী শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা৷ তাছাড়া ভক্তিকেন্দ্রিক বৈষ্ণবধর্মকে অবলম্বন করেই এই সকল পদগান বা পদাবলীগানের প্রবর্তন ও সম্প্রসারণ হয়েছিল৷ বৈষ্ণবধর্মের পরমপ্রতিষ্ঠা বিষ্ণুদেবতা–যিনি বিচিত্র বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নারায়ণ, বাসুদেব, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ-বাসুদেব প্রভৃতি নামে ও রূপে বিকাশ লাভ করেছিলেন৷ বৈদিক সাহিত্যে “বিষ্ণু” শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ যেমন, কখনো বিষ্ণু শব্দে সূর্য, কখনো অগ্নি, কখনো যজ্ঞ, আবার কখন বা সকল দেবতার উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়েছে৷ যেমন — “যো বৈ বিষ্ণুঃ স যজ্ঞঃ” (শতপথ ব্রাঃ ৫৷২৷৩৬), “বিষ্ণুর্যজ্ঞঃ” (গোপথ ব্রাঃ৷ উত্তরভাগ ১৷১২ ; তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণ ৩৷৩৷৭৷৬, যজুর্বেদ (২২৷২০),”স যঃস যজ্ঞোঽসৌ স আদিত্যঃ” (১৪৷১৷১৷৬), “বিষ্ণুঃ সর্বা দেবতাঃ (ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ ১৷১), “বৈষ্ণবো হি যুপঃ” (শতপথ ব্রাঃ ৩৷৮৷৪৷১)৷ শতপথব্রাহ্মণে বিষ্ণুর অভিন্ন রূপ “হরি”-শব্দের অর্থও আদিত্য বা সূর্য — “এষ বৈ বৃষা হরির্য এষ (আদিত্য) তপতি” (১৪৷৩৷১৷২৬)৷ পুরাণে নারায়ণের সঙ্গে প্রকৃতি বা শক্তিরূপ লক্ষ্মীর উল্লেখ আছে, যেমন নারায়ণ কারণসলিলে শায়িত ও লক্ষ্মী তাঁর পদপ্রান্তে আসীনা সৃষ্টির কারণ পুরুষ-প্রকৃতি বা শিব-শক্তিরই প্রতিচ্ছবি –লক্ষ্মী-নারায়ণ৷ পঞ্চরাত্রসংহিতাগুলিতে বিষ্ণু (ব্যাপনশীল) বাসুদেব পরমদেবতা ঃ “সমস্তভূতবাসিত্বাদ্বাসুদেবঃ প্রকীর্তিতঃ” (অহির্বুধ্ন্যসংহিতা ২৷২৮) ৷ ব্রাহ্মণসাহিত্যেও “বাসুদেব” নামের উল্লেখ আছে ৷ সেখানে বসুদেবপুত্র” বাসুদেব এই অর্থ-সার্থকতাকে আরো ব্যাপক ও প্রবৃদ্ধ করেছে৷
ঋগ্বেদের ১৷১৫৫৷৪-৬ এবং ১৷১৫৬৷১-৫ মন্ত্রগুলি বিষ্ণুদেবতার উদ্দেশ্যে লেখা৷ ১৷১৫৫৷৭ ঋক্‌মন্ত্রটি হোলঃ “”চতুর্ভিঃ সাকং নবতিং * * বৃহচ্ছশরীরো বিমিমান ঋক্কভির্যুবাকুমারঃ প্রত্যেত্যাহবম্‌” ৷ এই “ঋক্কভিং যুবা অকুমার প্রতি এতি আহবম্‌” মন্ত্রের অর্থ করতে গিয়ে আচার্য সায়ণ বলেছেন ঃ “ঋক্বভিঃ স্তুতিমভির্মন্ত্রবদ্ভির্বাবিমানঃ যদ্যপিবিভুঃ তথাপি ভক্ত্যধীনত্বাৎ স্তুত্যামীয়তে যুবা সর্বত্রমিশ্রণশীলঃ নিত্যতরুণোবা অতএবাকুমারঃ অনল্পঃ এবংভুতো মহাবিষ্ণুরাহবমাহ্বানংপ্রতি এতি গর্চ্ছতি যজ্ঞদেশম্‌৷” ঋগ্বেদের ১৷১৫৬৷১ মন্ত্রেও “অথাতেবিষ্ণোর্বিদুষা * * ” — বিষ্ণুর উল্লেখ আছে ৷ঋগ্বেদের ১৷৫৬৷৩ মন্ত্রে আছে ঃ “বিষ্ণোসুমতিং ভজামহে” ৷ এই স্তুতিযোগ্য বিষ্ণুদেবতা যজ্ঞের সঙ্গে সর্বদাই সম্পর্কিত ৷ পুনরায় ঋগ্বেদের ১৷১৫৪৷১ মন্ত্রে পাই — “বিষ্ণোঃ নু কং বীর্ষাণি প্রবোচং” প্রভৃতি৷ ১৷১৫৪৷২ মন্ত্রে — “প্র তদ্বিষ্ণুঃ স্তবতে বীর্ষেণ মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ, যস্যোরুষু ত্রিষু বিক্রমণেষ্বধি ক্ষিয়ংতি ভুবনানি বিশ্বা”৷ ঋগ্বেদের ১৷১৫৪৷৩ থেকে ১৷১৫৪৷৬ মন্ত্রগুলি হোল–
প্র বিষ্ণবে শূষমেতু মন্ম গিরিক্ষিত উরুগায়ায় বৃষ্ণে৷
য ইদং দীর্ঘং প্রযতং সধস্থমেকো বিমমে ত্রিভিরিৎপদেভিঃ ৷৷
যস্য ত্রী পূর্ণা মধূনা পদান্যক্ষীয়মাণা স্বধয়া মদংতি ৷
য উ ত্রিধাতু পৃথিবীমুত দ্যামেকো দাধার ভুবানানি বিশ্বা ৷৷
তদস্য প্রিয়মভি পাথো অশ্যাং নরো যত্র দেবযবো মদংতি৷
উরুক্রমস্য স হি বংধুরিত্থা বিষ্ণোঃ পদে পরমে মধ্ব উৎসঃ৷৷
তা বাং বাস্তূন্যুশ্মসি গমধ্যৈ যত্র গাবো ভরিশৃংগা অয়াসঃ ৷
অত্রাহ তদুরুগায়স্য বৃষ্ণঃ পরমং পদমব ভাতি ভূরি ৷৷
এই মন্ত্রগুলিও বিষ্ণুর বা বিষ্ণু-ভগবানের উদ্দেশ্যে রচিত৷ এখানে বিষ্ণু ব্যাপনশীল বা সর্বব্যাপী৷ সায়ণ তাঁর ভাষ্যে লিখেছেন ঃ “হে নরাঃ বিষ্ণোর্ব্যাপনশীলস্য দেবস্য বীর্যাণি-বীরকর্মাণি” (২৷১৫৪৷৪)৷ “ত্রিধাতু পৃথিবীম্‌ উত দ্যাম্‌ এক দাধার ভূবনানি বিশ্বা” মন্ত্রের ভাষ্যে সায়ণ বলেছেন ঃ “ত্রিধাতু পৃথিব্যপ্তেজোরূপধাতুত্রয়বিশিষ্টং যথা ভবতি তথাদাধার ধৃতবান * * ত্রিবৃৎকরণসৃষ্টিরূপপাদিতা যদ্বা ত্রিধাতু কালত্রয়ং গুণত্রং বা দাধারেত্যন্বয়ঃ ৷” ১৷১৫৪৷৫ ঋক্‌মন্ত্রে “উরুক্রমস্য” শব্দের ব্যাখ্যায় সায়ণ “সর্বজগদ্বীজরূপী ব্যাপক বিষ্ণুর” কথা বলেছেন এবং তিদি “বৃষ্ণঃ পরমং পদম্‌” ! সায়ণের বক্তব্য যে, এই পরমপদ ত্রিগুণাত্মক ত্রিবিক্রম বিষ্ণুই বামন-রূপ (ত্রিপাদে) বলি রাজার নিকট সর্গ-মর্ত্য-পাতাল এই তিন লোকের অধিকার গ্রহণ বা হরণ করেছিলেন৷ এই “ত্রিপাদ-যুক্ত বিষ্ণুই সর্বব্যাপক পরমদেবতা৷ ত্রিপাদ = অ + উ + ম এবং এই ত্রিদেবতা বা ভু, ভুবঃ, স্বঃ তিন লোকের অতীত কলা ও বিন্দু বা নির্গুণ ব্রহ্মচৈতন্য৷ ঈশোপনিষদে “ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ” মন্ত্র সর্বব্যাপক বিষ্ণুরই বোধক, সুতরাং বিষ্ণু বিশ্বপ্রাণময় ও সর্বব্যাপক বৃহদ্‌ চৈতন্য –ব্রহ্ম৷
এ প্রসঙ্গে “পঞ্চোপাসনা” গ্রন্থে ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোকপাত উল্লেখযোগ্য৷ ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় “বিষ্ণু –বৈষ্ণব”-প্রসঙ্গে লিখেছেন ঃ “ঋগ্বেদে এবং অন্যান্য বেদে বিষ্ণু “ত্রিবিক্রম”, “উরুগায়” ইত্যাদি নামে খ্যাত ৷ শেষোক্ত দুইটি শব্দের অর্থ এই যে, “যিনি বিস্তৃতভাবে বিচরণশীল”৷ কিন্তু “ত্রিবিক্রম” শব্দের একটি বিশেষ অর্থ আছে৷ এই অর্থ বিষ্ণুদেবতা-সম্বন্ধে প্রযুক্ত একটি বৈদিক বাক্য হইতে উদ্ভুত, উহা এইরূপ — “ত্রেধা নিদধে পদম্‌”, অর্থাৎ (তিনি) তিনবার পদক্ষেপে করেছিলেন৷ (পঞ্চোপাসনা (১৯৬০) পৃঃ ৩৪) ৷ প্রকৃতপক্ষে “ত্রিবিক্রম”-শব্দটি বিষ্ণু-সূর্যের ত্রিপাদ তথা আকাশে ত্রিভাগ -বিচরণ বা সঞ্চরণেরই দ্যোতক৷ ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ও “সূর্যের নভোমণ্ডলে পরিভ্রমণের তিনটি পর্যায়” বলে উল্লেখ করেছেন৷ মোটকথা “ত্রিপাদ” “প্রাতঃকালীন সূর্যের পূর্বাকাশে স্থিত রূপ যেন তাঁর প্রথম পাদ, মধ্যাহ্নের গগনমধ্যস্থ সূর্য দ্বিতীয় এবং সায়াহ্নে পশ্চিম দিকচক্রবালে বিলীয়মান সূর্যদেবতার শেষ তৃতীয় পাদ সূচিত করে৷ দেবতা এরূপে তিনটি পদক্ষেপের দ্বারা যেন সমগ্র অন্তরীক্ষমণ্ডল অতিক্রম করেন”৷ (পঞ্চোপাসনা (১৯৬০), পৃঃ ৩৪) শ্রদ্ধেয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমরাও একমত যে, ব্রাহ্মণ-আরণ্যকে বর্ণিত কাহিনী থেকেই বামন-অবতারের পৌরাণিক বলি-ছলনা-উপাখ্যানের সৃষ্টি ৷ সূর্য-নারায়ণের ত্রিপাদ-সংক্রমণকে কেন্দ্র করেই পৌরাণিক দেবতা, দুর্গা, সরস্বতীও লক্ষ্মী এই তিন রূপের ও কল্পনা করা হয়েছে৷ দেবী দুর্গা স্বয়ং সূর্যদেবতার মধ্যাহ্নকালীন প্রকাশ, দেবী সরস্বতী সূর্যের প্রাতঃকালীন এবং দেবী লক্ষ্মী সূর্যের সায়ংকালীন প্রকাশ৷ সূর্যরূপী বা সূর্যসম্ভুত দেবী দুর্গা যে সর্বদিক ও সর্বদেশব্যাপিণী বিরাট ও বিস্তৃত, দেবীর তিন রূপ সে তত্ত্বের প্রকাশক ৷ (স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ-রচিত “শ্রীদুর্গা” গ্রন্থে এই বিষয় আলোচিত হয়েছে ৷) বেদের সর্বব্যাপকত্বের প্রতীক সূর্যরূপী বিষ্ণুদেবতার ত্রিবিক্রম রূপ তার প্রমাণ৷
পুনরায় ১৷১৫৫৷৬ ঋক্‌মন্ত্রে “বিষ্ণু” বা বিষ্ণুদেবতা-সম্বন্ধে বলা হয়েছে ঃ “যুবা অকুমারঃ” এবং ১৷২২৷১৮ ঋক্‌মন্ত্রে বলা হয়েছে — গোপা”৷ “যুবা অকুমারঃ” অর্থে যে বিষ্ণুদেবতা চিরকিশোর বা চিরনবীন এবং “গোপা” অর্থে গাভীগণের রক্ষক — রাখাল বা গোপাল৷ সুতরাং ঋগ্বেদেই কৃষ্ণদেবতাকে একবার চিরযুবা (ever young),আর একবার গাভীগণের রক্ষক বা রাখাল তথা “protector of cows” ও “herdsman”বলা হয়েছে ৷ এই প্রসঙ্গে ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী Materials for the Standy of the Early History of the Vaishnava Sect (2nd ed.) গ্রন্থে বলেছেন ঃ The epithets Gopa and Yuva-akumarah of the Vedic Vishu might have been suggestive of he Pauanic tale of the three strides of the same god, suggested the legend of the Dwarf Avatara৷” অর্থাৎ ডঃ চৌধুরীর অভিমতে, ত্রিবিক্রম বামন-অবতারই বেদের বিষ্ণু ৷ ঐতিহাসিক ডঃ জয়সোয়াল বলেছেন, বৌধায়ণধর্মসূত্রের পূর্বে বিষ্ণুকে “দামোদর” ও “গোবিন্দ” নামেও অভিহিত করা হোত৷ খ্রীষ্ট্রীয় ২০০ থেকে ৪৫০ শতকের মধ্যে রচিত সাতবাহনরাজ হালের (১ম-২য় শতক) “গাহা-সত্তসঈ” বা গাথা-সপ্তসতীর ২৷১২ শ্লোকে “দামোদর” শ্রীকৃষ্ণবিগ্রহে রূপান্তরিত ঃ “অজ্জিবি কালো দামোঅরো ত্তি ইঅ জমিপএ জসোআত্র, কহ্নমূহপেসিঅচ্ছং নিহুঅং * * ৷” এখানে দামোদর বালক শ্রীকৃষ্ণ এবং যশোদা ও ব্রজবধূগণের মতো হালের সপ্তসতীতে রাধিকার উল্লেখও বাদ পড়েনি — “বহিআত্রঁ অরণেন্তো” (১৷৮৯)৷ খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এলাহাবাদ-স্তম্ভলিপিতে “বিষ্ণু গোপ”-শব্দের উল্লেখ আছে এবং পণ্ডিত হপকিন্স্‌ এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য মনীষীদের অভিমতে “বিষ্ণু-গোপ” শব্দ গোপাল-বিষ্ণু বা গোপাল-কৃষ্ণের পূজারই বোধক৷ রাজপুতনায় ঘোসূণ্ডী-লিপিমালার ব্রাহ্মী-অক্ষর কৃষ্ণবাসুদেবের দেবভাব ও দেব-মহিমার সাক্ষ্য দান করে খ্রীষ্টপূর্ব ২০০-১৫০ শতকে৷ ঘোসূণ্ডীলিপিতে সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবকে “সর্বেশ্বর” এবং দিযবপুত্র হেলিওডোরাস প্রতিষ্ঠিত খ্রীষ্টপূব ১০০ শতকে বেসনগবলিপিতে বাসুদেবকে “দেবদেব” বলা হয়েছে৷ খীষ্টপূর্ব ১০০ শতকে নানাঘাট – লিপিমালায় বাসুদেব ও সঙ্কর্ষণের নাম পাওয়া যায়৷ অধ্যাপক এ. বি. কিথ বলেন, খ্রীষ্টপূর্ব ৩য় শতকের সমাজে পাঞ্চবাত্রতন্ত্র -কথিত ভাগবতসম্প্রদায়েরও প্রচলন ছিল৷ একথাও আবার সত্য যে, নারায়ণ-বিষ্ণু ঠিক কবে থেকে কৃষ্ণ-বাসুদেবে রূপান্তরিত হয়েছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না৷ তবে তৈত্তিরীয়-অরণ্যকে (১০৷১৷১৬) এই তাদাত্ম্য-ধারণায় একটা নিদর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু তৈত্তিরীয়-অরণ্যকের রচনাকাল সঠিকভাবে নির্ণীত না হওয়ায় ঐ ধারণায় নির্দিষ্ট সময়ও জানা যায় না৷ তৈত্তিরীয়-আরণ্যকের ভূমিকায় ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র লিখেছেন, এই আরণ্যকটি খ্রীষ্টীয় শতকের গোড়ার দিকে রচিত ঃ “At least in the beginnign of the Christian era” ৷ কিন্তু ডঃ কিথের অভিমতে তৈত্তিরীয়-অরণ্যক রচিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৩য় শতকে,কেননা নারায়ণ-বিষ্ণুর নামের পরিবর্তে “বাসুদেব”-শব্দটি যে ব্রাহ্মণসাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে, তার রচনাকাল (কিথের মতে) খ্রীষ্টীয় ৩য় শতক৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতকে ভাগবত-সম্পর্কীয় কোন প্রস্তরলিপিতেই বাসুদেবের অভিন্নতাসূচক “নারায়ণ-বিষ্ণু” নামের উল্লেখ নাই, বরং তার পরিবর্তে দেখা যায় বাসুদেব ও সঙ্কর্ষণের নামোল্লেখ৷ মহাভারতের (খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০) ভীষ্মপর্বে ও অহির্বুধ্ন সংহিতায় সাত্ত্ব তথা পাঞ্চরাত্রসংহিতার বক্তা ও নিয়ামক-রূপে বাসুদেবের মতো সঙ্কর্ষণের নামও পাওয়া যায়৷ মহাভারতের ২য় পর্বে (২।৭৯।২৩) সঙ্কর্ষণকে কৃষ্ণ-বাসুদেবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ও (২।১৪।৬৪) কৃষ্ণ-কংস-সংগ্রামে কৃষ্ণের সহায়ক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে৷ পুনরায় মহাভারতের শান্তিপর্বের নারায়ণীয়ভাগে (১২।৩৩৯।২৫ এবং ১২।৩৩৯।৪০) বাসুদেবকে “পরমাত্মা” ও সঙ্কর্ষণকে “জীবাত্মা” নামে অভিহিত করা হয়েছে ঃ “যে বাসুদেবো বিজ্ঞেয় পরমাত্মা সনাতনঃ০” এবং “জ্ঞেয়ঃ স এ এব রাজেন্দ্র জীবঃ সঙ্কর্ষণঃ প্রভুঃ” ৷
আসলে বাসুদেব ও সঙ্কর্ষণ-পূজার বীজ আমরা পাই পাঞ্চরাত্রদর্শনের ব্যুহতত্ত্বের মধ্যে৷ ঘোসুণ্ডীলিপিতেও বাসুদেব-সংকর্ষণের নাম উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু মহাভারতের (২।৭৯।২৩) মতে সঙ্কর্ষণকে বাসুদেব বা কৃষ্ণ-বাসুদেবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা কিংবা বাসুদেব থেকে সৃষ্ট দেবতা বলা হয় নি, বরং সঙ্কর্ষণ সেখানে বাসুদেবের মতো সমান আসনে অধিষ্ঠিত৷ ভাগবত ও পাঞ্চরাত্রধর্মে ব্যুহতত্ত্বটির সারমর্ম এই যে, বাসুদেব তাঁর শিষ্যের মধ্য থেকে প্রথমে প্রকৃতি বা মহাপ্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কর্ষণচৈতন্যও সৃষ্টি করেছিলেন৷ প্রকৃতি ও সঙ্কর্ষণের সংমিশ্রণে মন বা সাংখ্যীয় বুদ্ধি ও প্রদ্যুন্মচৈতন্যের সৃষ্টি৷ এটি তৃতীয় ব্যূহ ৷ ভাগবতদর্শনে একেই সৃষ্টিতত্ত্ব বলা হয়েছে এবং এই সৃষ্টিতত্ত্বের কেন্দ্র বা মূল-উৎস বাসুদেব বা কৃষ্ণ-বাসুদেব৷ উল্লেখযোগ্য যে, এই চতুর্ব্যূহই পরবর্তীকালে বিংশতি ব্যূহে , তত্ত্বে বা মূর্তিতে পরিণত হয়েছিল৷ বিংশতি মূর্তি যেমন –উপেন্দ্র, হরি, অনন্ত, কেশব, নারায়ণ, ত্রিবিক্রম, জনার্দন, পদ্মনাভ, দামোদর, অচ্যুত, মাধব, গোবিন্দ, মধুসূদন, অধোক্ষজ, শ্রীধর, বিষ্ণু, বামন, হৃষীকেশ, পুরুষোত্তম ও নৃসিংহ ৷ (ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ “পঞ্চোপাসনা”, পৃঃ ৬৬) পাঞ্চরাত্রীয় ব্যূহবাদের সৃষ্টি গুপ্তযুগের পূর্বে এবং গুপ্তযুগের তা বিশেষভাবে পরিপুষ্ট ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে৷