ভক্তিকল্পতরুর প্রথম অঙ্কুর, পঞ্চম পুরুষার্থের প্রথম সূত্রধার শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরী ৷ বাঙ্গালার প্রথম কীর্তনীয়া, শ্রীহরি-কীর্তনের প্রথম গায়ক শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরী ৷ তাঁহার নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ পূর্বক যাঁহারা লোককল্যাণব্রতে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিলেন তাঁহাদের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ হইলেন শ্রীঅদ্বৈত আচার্য ৷ বৈষ্ণবের নাম-গণনায় শ্রীমন্‌, মহাপ্রভু শঙ্কর-চতুরানন হইতেও যাঁহাকে অধিক সম্নান দান করিতেন, সেই শান্তিপুর-পুরন্দরের পুণ্যচরিত সংক্ষেপে বিবৃত করিতেছি ৷
প্রেমবিলাসের মতে গৌতম ত্রিবেদী ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ ৷ তাঁহার পৌত্র ভাস্কর হইতেই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের গণনা শুরু ৷ ভাস্কর-বংশধর নরসিংহ নাড়িয়াল রাজা গণেশের মন্ত্রী ছিলেন ৷ তিনি শান্তিপুরে বাস করিতেন, পরে শ্রীহট্টের লাউড়ে চলিয়া যান ৷ ইঁহার সাত পুত্রের মধ্যে একজনের নাম বিদ্যাধর ৷ বিদ্যাধরের পৌত্র কুবের ও নীলাম্বর ৷ কুবেরের পুত্র অদ্বৈত আচার্য, আর-নীলাম্বরের কন্যা শচী দেবী ৷
এই বংশ-তালিকায় বিশ্বাস করা চলে না ৷ একই পিতার পুত্র কিরূপে একজন বারেন্দ্র ও অপরজন বৈদিক হইলেন বুঝা গেল না ৷ জগন্নাথ মিশ্র বৈদিক ছিলেন ৷ নীলাম্বর চক্রবর্তী বারেন্দ্র-সন্তান হইলে কখনই বৈদিক জগন্নাথ মিশ্রকে কন্যা সম্প্রদান করিতেন না ৷ নরসিংহ নাড়িয়াল রাজা গণেশের মন্ত্রী ছিলেন — প্রেমবিলাসের এই উক্তিও সত্য নহে ৷ স্বর্গগত খ্যাতনামা ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর ১৩৩২ সালের ‘ভারতবর্ষ’ পত্রে লিখিত একটি প্রবন্ধ হইতে জানা যায়, অরিরাজ দনুজ মাধব ১২৫৩ হইতে ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বর্তমান ছিলেন ৷ নরসিংহ নাড়িয়াল এই দনুজ মাধবেরই মন্ত্রী ছিলেন ৷ নরসিংহ শ্রীহট্ট লাউড়েই বাস করিতেন ৷ কুবেরের পত্নীর নাম নাভা দেবী ৷ কাহারো কাহারো মতে অদ্বৈতচার্যের পিতৃদত্ত নাম কমলাক্ষ এবং তিনি শ্রীহট্টের অন্তর্গত লাউড়ের নবগ্রামে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন ৷ মাঘ মাসের শুক্লা সপ্তমী । অদ্বৈতাচার্য্যের আবির্ভাব-তিথি ৷ লাউড়ের রাজার নাম দিব্যসিংহ ৷ কুবের পণ্ডিত নাকি তাঁহার সভাপণ্ডিত ছিলেন ৷ কোন্ সময়ে কমলাক্ষকে লইয়া তাঁহার পিতামাতা শান্তিপুরে আসেন জানিবার উপায় নাই ৷ শান্তিপুরে আসিয়া ফুল্লবাটীর শান্তনু ভট্টাচার্যের নিকট শিক্ষালাভ করিয়া কমলাক্ষ মহাপণ্ডিতরূপ খ্যাতিমান হইয়া উঠেন ৷ সপ্তগ্রামের ধনী জমিদার হিরণ্যদাস গোবর্ধন দাসের অর্থানুকূল্যে তিনি সপ্তগ্রামের নিকটবর্তী নারায়ণপুরের নৃসিংহ ভাদুড়ীর কন্যা সীতা ও শ্রীদেবীর পাণিগ্রহণ করেন ৷
সময় সময় দেশে এক-একজন সমাজ-সচেতন মানুষ আবির্ভূত হন, ব্যক্তি তথা জাতি, তথা সমাজের দুঃখ-দুর্দশা যাঁহাকে বিচলিত করে ৷ অন্তরের ব্যাকুলতা তাঁহাকে আহার-নিদ্রা ভুলাইয়া দেয় ৷ এই অতন্দ্রনয়ন মানুষের তখন একমাত্র চিন্তনীয় বিষয় হইয়া উঠে সমাজের দুঃখ-দুর্দশা দুরীকরণ ৷ তাঁহার সঙ্কল্পসুদৃঢ় চেতনা সংক্রামিত হয় একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে ৷ এই গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করিয়াই ইতিহাসের প্রবাহ আবর্তিত হয় ৷ এই গোষ্ঠীই ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত করিয়া দেয় ৷ এই গোষ্ঠীই ইতিহাসের যাত্রাপথে পথপরিচায়ক আলোকস্তম্ভ ৷ কখন কখন এই গোষ্ঠীর চিন্তাধারাই বিদ্রোহের আকার পরিগ্রহ করে এবং গোষ্ঠীর সঙ্কল্পকে সাফল্যমণ্ডিত করে ৷ আচার্য অদ্বৈত এমনই একজন সমাজ-সচেতন মানুষ এবং ইতিহাসপ্রসিদ্ধ গোষ্ঠীপতি ৷
মানবের দুঃখ-দুর্দশা অদ্বৈতের চিত্তকে ব্যথিত করিয়াছিল ৷ শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রের নিকট দীক্ষা-গ্রহণের পর এই বেদনা তীব্রতর হইয়া উঠিল ৷ তিনি বুঝিতে পারিলেন কোন লোকাত্তর পুরুষের আবির্ভাব ভিন্ন এই দুঃখ দূরীকরণ তাহাদের সাধ্যাতীত ৷ তিনি একাগ্রচিত্তে ভগবদাবির্ভাব কামনায় শ্রীভগবানের আরাধনাতেই প্রবৃত্ত হইলেন ৷ এই সময়ে ব্রহ্ম হরিদাস আসিয়া আচার্যের সঙ্গে মিলিত হন ৷ অদ্বৈতাচার্য হরিদাসের স্বতঃস্ফূর্ত কৃষ্ণভক্তি ও নামানুরাগ দর্শনে অভিভূত হইয়া পড়েন ৷ হরিদাসের প্রতি তিনি এমনই আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, একদিন পিতৃশ্রাদ্ধ-দিবসে যে শ্রাদ্ধান্ন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে নিবেদন করা কর্তব্য, সেই শ্রাদ্ধান্ন হরিদাসকে অর্পণ করেন ৷ অদ্বৈত যেন একটা নূতন পথের সন্ধান পাইলেন ৷ বুঝিতে পারিলেন এই ভক্তিযোগ ও হরিনামের বহুল প্রচার প্রয়োজন ৷ এই দুই অপার্থিব বস্তু আচণ্ডালে বিতরণ করিতে হইবে ৷ তিনি গোষ্ঠী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শ্রীধাম নবদ্বীপে শুভাগমন করিলেন ৷ অল্পদিনের মধ্যেই তাঁহার চতুষ্পাঠী কৃষ্ণানুরাগী ছাত্রে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল ৷ নবদ্বীপের প্রধান ভক্ত শ্রীবাস তাঁহার সঙ্গে সম্মিলিত হইলেন ৷ ধীরে ধীরে একটি অন্তরঙ্গ গোষ্ঠী গড়িয়া উঠিল ৷ দিনে অধ্যাপনা এবং রাত্রে তাঁহাদিগকে লইয়া ইষ্টগোষ্ঠী চলিল ৷ ইঁহাদের মধ্যে লোকনাথ, মুকুন্দ দত্ত ও শুক্লাম্বর ব্রহ্মাচারী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য ৷ অধিষ্ঠানভূমি নির্মিত হইল ৷ অদ্বৈতের আকুল আহ্বান মর্ত্যের সীমা অতিক্রমপূর্বক গোলোকে গিয়া প্রতিধ্বনি তুলিল ৷ গোলোকের সম্পদ্‌ অবনীতে অবতীর্ণ হইলেন ৷ শ্রীভগবানের পাদস্পর্শে ধরণীর ধূলি ধন্য হইয়া গেল ৷
ফাল্গুনের রাকা রজনী, পূর্ণচন্দ্রের উদয় হইয়াছে ৷ সায়াহ্নেই রাহু আসিয়া চন্দ্রকে গ্রাস করিল ৷ সুরধুনী-সলিলে স্নানরত নর-নারীর মিলিত কণ্ঠের হরিধ্বনি গগনাঙ্গনে ছন্দিত হইল ৷ নবদ্বীপের গৃহে গৃহে শঙ্খধ্বনি, পথে পথে হরিকীর্তন ৷ জগন্নাথ মিশ্রের কুটীর দিব্যালোকে উদ্ভাসিত করিয়া হরিনামমূর্তি নদীয়ার চাঁদ উদিত হইলেন— অদ্বৈতাচার্যের প্রার্থিত মহামানব ৷
আচার্য তাঁহাকে নানাভাবে পরীক্ষা করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু বিষ্ণুখট্টায় উপবিষ্ট নিমাই পণ্ডিত যেদিন অদ্বৈতশিরে চরণার্পণ করেন, সেই দিনই আচার্যের সর্বসংশয় তিরোহিত হইয়াছিল ৷ এই দিন মহাপ্রভু তাঁহাকে বলিয়াছিলেন—
তোমার সংকল্প লাগি অবতীর্ণ আমি ৷
বিস্তর আমার আরাধনা কৈলে তুমি ৷৷
শুতিয়া আছিলুঁ ক্ষীর সাগর ভিতরে ৷
নিদ্রা ভঙ্গ মোর তোর প্রেমের হুঙ্কারে ৷৷
দেখিয়া জীবের দুঃখ না পারি সহিতে ৷
আমারে আনিলে সর্ব্বজীব উদ্ধারিতে ৷৷
যতেক দেখিলে চতুর্দ্দিকে মোর গণ ৷
সভার হইল জন্ম তোমার কারণ ৷৷
যে বৈষ্ণব দেখিতে ব্রহ্মাদি ভাবে মনে ৷
তোমা হইতে তাহা দেখিবেক সর্ব্বজনে ৷৷
আচার্য অদ্বৈত কান্দিতে কান্দিতে বলিতে লাগিলেন —
আজি সে সফল মোর দিন পরকাশ ৷
আজি সে সফল কৈলুঁ যত অভিলাষ ৷৷
আজি মোর জন্ম দেহ সকল সফল ৷
সাক্ষাতে দেখিলুঁ তোর চরণ যুগল ৷৷
ঘোষে মাত্র চারি বেদ যারে নাহি দেখে ৷
হেন তুমি মোর লাগি হৈলা পরতেখে ৷৷
মোর কিছু শক্তি নাহি তোমার করুণা ৷
তোমা বই জীব উদ্ধারিব কোন জনা ৷৷
এই দিন আচার্যদেব গঙ্গাজলে এবং চন্দনাক্ত তুলসীমঞ্জরী -সহ নানা উপচারে শ্রীগৌরাঙ্গদেবের চরণ পূজা করেন ৷ মহাপ্রভু পুনঃ পুনঃ তাঁহাকে বর প্রার্থনা করিতে বলিলে প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, ”সাক্ষাতে তোমাকে দেখিলাম, ইহার পর কি আমার অন্য কিছু প্রার্থনীয় থাকিতে পারে ? আর তুমি কি না জান? দিব্যদৃষ্টিতে কি না দেখিতে পাও?” তখন বিশ্বম্ভর বলিলেন, ”তোমার জন্যই আমি অবতীর্ণ হইয়াছি ৷ আমি ঘরে ঘরে কীর্তন প্রচার করিব, আমার গুণগান করিয়া যেন সমস্ত সংসার নৃত্য করে ৷ ব্রহ্মা শঙ্কর নারদাদি যে ভক্তির জন্য তপস্যা করেন, আমি সেই ভক্তিই সর্ব-সাধারণের মধ্যে বিলাইয়া দিব৷”
তখন —
অদ্বৈত বোলেন যদি ভক্তি বিলাইবা ৷
স্ত্রী শূদ্র আদি যত মূর্খেরে সে দিবা ৷৷
বিদ্যাধন কুল আদি তপস্যার মদে ৷
ভোর ভক্ত তোর ভক্তি যে যে জনে বাধে ৷৷
সে পাপষ্ঠি সব দেখি মরুক পুড়িয়া ৷
চণ্ডাল নাচুক তোর নাম গুণ গাড়া ৷৷
(শ্রীচৈতন্যভাগবত মধ্যখণ্ড ষষ্ঠ অধ্যায়)

আচার্য অদ্বৈতের প্রার্থনায় শ্রীমহাপ্রভু তাঁহাকে বিশ্বরূপ দর্শন করাইয়ছিলেন — সে রূপ কুরুক্ষেত্র-রণাঙ্গণে অর্জুন দেখিয়াছিলেন ৷ ইহার উদ্দেশ্য, জগতের জীবকে জানানো যে এই অবতারে লোকক্ষয়কৃৎ মহাকালের কোন স্থান নাই৷ অথচ পার্থসারথিই আসিয়া ভূদেবতারূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন ৷ কিন্তু গৌরাঙ্গ অবতারের উদ্দেশ্য, এই জন্মেই জীবের জন্মান্তর সংঘটন; পরশ মণির স্পর্শে লৌহে কাঞ্চনত্ব-প্রাপ্তিতে হৃদয়ের পরিবর্তন সাধন ৷
কাজী-বিজয়ের দিন মহাপ্রভু যে বিরাট কীর্তনমণ্ডলী লইয়া কাজী-ভবনের দিকে অগ্রসর হন তাহার সর্বাগ্রবর্তী মণ্ডলে ছিলেন আচার্য অদ্বৈত৷
শুনি সর্ব্ববৈষ্ণব আইলা ততক্ষণ ৷
সভারে করেন আজ্ঞা শচীর নন্দন ৷৷
আগে নৃত্য করিবেন আচার্য্য গোসাঞী ৷
এক সম্প্রদায় গাহিবেন তান ঠাঞি ৷৷
মধ্যে নৃত্য করি যাইবেন হরিদাস ৷
এক সম্প্রদায় গাহিবেন তান পাশ ৷৷
তবে নৃত্য করিবেন শ্রীবাস পণ্ডিত ৷
এক সম্প্রদায় গাহিবেন তান ভিত ৷৷
নিত্যানন্দ দিকে মাত্র চাহিলেন প্রভু ৷
নিত্যানন্দ বোলে তোমা না ছাড়িব কভু ৷৷
এই দিন যাঁহারা নগর-কীর্তনে বাহির হইয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে ইঁহারাও ছিলেন ৷
গদাধর বক্রেশ্বর মুরারি শ্রীবাস ৷
গোপীনাথ জগদীশ বিপ্র গঙ্গাদাস ৷৷
রামাই গোবিন্দানন্দ শ্রীচন্দ্রশেখর ৷
বাসুদেব শ্রীগর্ভ শ্রীমুকুন্দ শ্রীধর ৷৷
গোবিন্দ জগদানন্দ নন্দন আচার্য্য ৷
শুক্লাম্বর আদি যে যে জনে রহঃ কার্য্য ৷৷
শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি সঙ্কীর্তনে শ্রীচৈতন্যচন্দ্রের নামগানের প্রবর্তন ৷ তাঁহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াই বাসু ঘোষ প্রভৃতি কবিগণ গৌরলীলা লইয়া পদ রচনা করিয়াছিলেন ৷ শ্রীচৈতন্যভাগবত অন্ত্যখণ্ডের বর্ণনায় আছে — ঘটনাটি ঘটিয়াছিল নীলাচলে :
একদিন অদ্বৈত সকল ভক্ত প্রতি ৷
বলিলা পরমানন্দে মত্ত হই অতি ৷৷
শুন ভাই সব এক কর সমবায় ৷
মুখ ভরি গাই আজ শ্রীচৈতন্য রায় ৷৷
আজি আর কোন্‌ অবতার গাওয়া নাই ৷
সর্ব্ব অবতারময় চৈতন্য গোসাঞী ৷৷
যে প্রভু করিল সর্ব্ব জগৎ উদ্ধার ৷
আমা সবা লাগি যে গৌরাঙ্গ অবতার ৷৷
সর্ব্বত্র আমরা যাঁর প্রসাদে পূজিত ৷
সঙ্কীর্তন হেন ধন যে কৈল বিদিত ৷৷
নাচি আমি তোমরা চৈতন্য যশ গাও ৷
সিংহ হই গাই পাছে মনে ভয় পাও ৷৷
প্রভু যে আপনা লুকায়েন নিরন্তর ৷
ক্রুদ্ধ পাছে হয়েন সবার এই ডর ৷৷
তথাপি অদ্বৈতবাক্য অলঙ্ঘ্য সবার ৷
গাইতে লাগিল চৈতন্য অবতার ৷৷
নাচেন অদ্বৈত সিংহ পরম বিহ্বল ৷
চতুর্দ্দিকে গায় সবে চৈতন্য মঙ্গল ৷
নব অবতারের শুনিয়া নাম যশ ৷
সকল বৈষ্ণব হৈলা আনন্দে বিবশ ৷৷
আপনে অদ্বৈত চৈতন্যের গীত করি ৷
বলিয়া নাচেন প্রভু জগৎ নিস্তারি ৷৷
শ্রীচৈতন্য নারায়ণ করুণা সাগর ৷
দুঃখিতের বন্ধু প্রভু মোরে দয়া কর ৷৷

শেষের দুইটি পংক্তি আমি শ্রীচৈতন্য-সম্বন্ধের প্রথম পদ বলিয়া মনে করি ৷

কাটোয়ার সন্ন্যাস গ্রহণপূর্বক নবানুরাগিণী ব্রজবধূর মত কৃষ্ণ-প্রেমোন্মাদে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী তিন দিন রাঢ়দেশে ভ্রমণ করিয়াছিলেন ৷ এক কৌপীন, এক বহির্বাস; কোথায় ভিক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন, কোথায় রাত্রিযাপন করিয়াছিলেন কেহ জানে না ৷ শ্রীপাদ নিত্যানন্দ তাঁহাকে ভুলাইয়া শান্তিপুরে লইয়া আসেন ৷ আচার্য অদ্বৈতের গৃহেই তাঁহার প্রথম ভিক্ষাগ্রহণ, আচার্যের গৃহেই তাঁহার সন্ন্যাসজীবনের প্রথম নান্দীপাঠ ৷ সকলের সম্মুখে সর্বপ্রথম আচার্যই তাঁহার স্বরূপ প্রকাশ করিয়া দিয়াছিলেন এই গান গাহিয়া —
কি কহিব সে সখি আনন্দ ওর ৷
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর ৷৷
মহাপ্রভু আদর করিয়া আচার্যকে নাঢ়া বলিয়া ডাকিতেন ৷ নাঢ়া আদরের সম্বোধন ৷ বিষ্ণুদাসের মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগর ডাকিতেছেন—
কোথা গেলি ওরে মোর নাড়ারে নফর ৷

পূর্বে রাজভৃত্যগণের মস্তক মুণ্ডিত থাকিত ৷ নাড়া হইতে নাঢ়া হওয়া বিচিত্র নহে৷ নাড়িয়াল-বংশজ বলিয়াও নাড়া বা নাঢ়া হইতে পারে ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর অন্তর্নিহিত শ্রদ্ধার একাতপত্রী অধিকারী ছিলেন আচার্য অদ্বৈত ৷ মহাপ্রভু তাঁহাকে শুক -প্রহ্লাদ হইতেও যোগ্য পাত্র বলিয়া প্রচার করিতে কুণ্ঠিত হন নাই ৷