শ্রীচৈতন্যচন্দ্রের আবির্ভাবের পূর্বেই অমারাত্রির অবসানে অরুণোদয়ের শুভ মুহূর্তে যে পুণ্যশ্লোক পরমভাগবত উচ্চকণ্ঠে হরিনাম-কীর্তনে দেশের কলুষরাশি অপসারিত করিয়াছিলেন, তাঁহারই অতি স্মরণীয় নাম ব্রহ্ম হরিদাস ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর দিব্যপ্রকাশের অব্যবহিত মাহেন্দ্রক্ষণে যাঁহার নয়নাসার মাটীর পৃথিবীকে মালিন্যমুক্ত করিয়াছিল,যাঁহার অঙ্গস্পর্শে বাঙ্গালার আকাশ-বাতাস পবিত্র হইয়াছিল, বৈষ্ণব-সাহিত্যে তিনিই ব্রহ্ম হরিদাস নামে সুপরিচিত ৷
ইঁহারই অন্যতর আখ্যা যবন হরিদাস ৷ প্রচলিত বিশ্বাস, এই মহাত্মা যবন কুলেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু স্বর্গগত ঐতিহাসিক বন্ধুবর সতীশচন্দ্র মিত্র আমাকে বলিয়াছিলেন, হরিদাস ব্রাহ্মণ-সন্তান ৷ যশোর-খুলনার ইতিহাস ১ম খণ্ডের ২য় সংস্করণে তিনি এই কথা লিখিয়াও গিয়াছেন ৷ আমি আজ সেই বিরলপ্রচারিত অধুনালুপ্ত গ্রন্থখানি হইতে সংক্ষেপে ব্রহ্ম হরিদাসের কথা বিবৃত করিতেছি৷
ব্যাসাবতার শ্রীল বৃন্দাবন দাস শ্রীচৈতন্যভাগবতে লিখিয়াছেন —
বুঢ়ণে হইলা অবতীর্ণ হরিদাস ৷
সে ভাগ্যে সে সব দেশে কীর্তন প্রকাশ ৷৷
যশোর-খুলনার ইতিহাসে বুঢ়ণের পরিচয় এইরূপ ৷ … “সাতক্ষীরা ও খুলনা সদর উপরিভাগের অধিকাংশ এই বৃদ্ধ দ্বীপের অন্তর্গত ৷ এখনও সাতক্ষীরা শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশে যমুনা-ইছামতী হইতে কপোতাক্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত প্রকাণ্ড বুঢ়ণ পরগণা পূর্বতন দ্বীপের স্থান নির্দেশ করিতেছে৷”
জয়ানন্দ স্বপ্রণীত চৈতন্যমঙ্গলে লিখিয়াছেন —
স্বর্ণ নদীতীরে ভাট কলাগাছি গ্রামে ৷
হীনকুলে জন্ম হয় উপরি পূর্ব নামে ৷৷
বুঢ়ণ পরগণায় সোনাই নামে নদী আছে ৷ নদীতীরে ভাট এবং কলাগাছি গ্রামও আছে ৷ কলাগাছি গ্রামই হরিদাসের জন্মস্থান ৷ জয়ানন্দ বলিয়াছেন, হরিদাসের
উজ্জ্বলা মাতার নাম পিতা মনোহর
অপর কাহারো মতে হরিদাসের মাতার নাম গৌরী দেবী, পিতার নাম সুমতি শর্মণা ৷ সতীশ মিত্র মহাশয় বলেন — প্রায় আড়াইশত বৎসর পূর্বে রাজা সীতারাম রায়ের সমসাময়িক গোঁসাই গোরাচাঁদ স্ব-রচিত শ্রীশ্রীসঙ্কীর্তন বন্দনায় লিখিয়াছেন —
মনোহর চক্রবর্তী সুমতি ব্রাহ্মণ ৷
জপা তপা যাহাল ব্রাহ্মণের আচরণ ৷৷
সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় লিখিতেছেন — “মনোহর চক্রবর্তী সুব্রাহ্মণ ও সুপণ্ডিত ছিলেন ৷ তাঁহার চতুষ্পাঠী ছিল ৷ মনোহরের পূজিত শ্রীবিগ্রহদ্বয়ের নাম শ্রীনন্দকিশোর ও শ্রীবাসুদেব ৷ মনোহরের বাসুদেব বিগ্রহ নিকটবর্তী বিথারী গ্রামে শ্রীশীতলচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়ের বাসুদেব বিগ্রহ নিকটবর্তী বিথারী গ্রামে শ্রীশতীলচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়ের গৃহে অধিষ্ঠিত আছেন ৷ কলাগাছি গ্রামে এখনও লোকে মনোহরের ভিটা দেখাইয়া দেয় ৷ আমরা সে গ্রামে গিয়া সে ভিটা দেখিয়াছি ৷ চক্রবর্তী-বংশীয়েরা ১৭৷১৮ পুরুষ কলাগাছিতে বাস করিতেছেন ৷” মিত্র মহাশয় অনুমান করেন, হরিদাসের জন্মের দুই-তিন বৎসর পরে মনোহর স্বর্গারোগণ করিলে উজ্জ্বলা দেবী পতির চিতায় সহমৃতা হন ৷ এই সময় পিরালীদের অত্যাচারে গ্রামের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠে ৷ পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক মুসলমান সেই দুর্দিনে হরিদাসকে নিজ গৃহে লইয়া গিয়া লালন-পালন করেন ৷ এই মুসলমানের নিবাস হকিমপুর, নাম হবিবুল্লা ৷ সতীশ মিত্র একটি কবিতাংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন —
হবুল্লা কাজীর বেটা ব্রহ্ম হরিদাস৷
প্রেমবিলাসের ২২ বিলাসে আছে — হরিদাসের —
বুঢ়ণে হইল জন্ম ব্রাহ্মণের বংশে ৷
যবনত্ব প্রাপ্তি তার যবনান্ন দোষে ৷৷
হরিদাসের বোধ হয় পিতৃ-মাতৃদত্ত নাম একটা ছিল ৷ অনেকে অনুমান করেন হরিনামে অভূতপূর্ব নিষ্ঠার জন্য উত্তরকাল তিনি হরিদাস নামেই বিখ্যাত হন ৷ প্রথম যৌবনেই হরিদাস গৃহত্যাগ করেন এবং যশোহর জেলার বেনাপোল গ্রামের প্রান্তে কুটীর বাঁধিয়া সেখানেই নির্জনে নাম-সাধনায় সিদ্ধ হন ৷ নিকটেই কাগজ পুকুরিয়া গ্রাম ৷ এই গ্রামে রামচন্দ্র খাঁ নামে এক জমিদার বাস করিতেন ৷ হরিদাসের নিষ্ঠা ও তজ্জনিত প্রতিষ্ঠা তাঁহাকে অসিহিষ্ণু করিয়া তোলে ৷ তিনি স্বীয় অনুগৃহীতা এক পতিতাকে হরিদাসের নিকট পাঠাইয়া দেন ৷ উদ্দেশ্য সুন্দরী যুবতী হরিদাসকে ছলাকলায় ভুলাইয়া অধঃপতিত করিবে ৷ কিন্তু ফল বিপরীত হইয়াছিল ৷ হরিদাসের পুণ্য প্রভাব এই বারবনিতাকে সৎপথে পরিচালিত করে; তিনি আপনার সর্বস্ব বিলাইয়া দিয়া হরিপরায়ণা হইয়া জন্ম সার্থক করেন ৷
এক শ্রেণীর মানুষ থাকে যাহারা অপরের অভ্যুদয় সহ্য করিতে পারে না ৷ মাৎসর্যের প্রতিমূর্তি ইহারা; কিন্তু ইহাদের প্রতিঘাতই মানুষের উৎকর্ষ শিখরে অধিরোহণের সহায়ক হয় ৷ আমার অনুমান রামচন্দ্র খাঁর প্রতিহিংসা সহজে প্রতিনিবৃত্ত হয় নাই ৷ প্রতিহত হইয়া তাহা লেলিহান শিখায় জ্বলিয়া উঠিয়াছিল ৷ মনে হয় রামচন্দ্র খাঁর প্ররোচনাতেই হরিদাস মুলুকপতির রোষদৃষ্টিতে পতিত হইয়াছিলেন ৷ হরিনাম কীর্তনের অপরাধে কাজীর আদালতে হরিদাসের বিচার হইয়াছিল ৷ মুসলমান সমাজ হরিদাসকে মুসলমান বলিয়াই জানিতেন ৷ মুসলমান হইয়া উচ্চকণ্ঠে হরিকীর্তন গুরুতর অপরাধ ! শত অনুরোধেও হরিদাস যখন হরিনাম ত্যাগ করিতে অস্বীকৃত হইলেন, তখন সর্বজনসমক্ষে তাঁহাকে বেত্রাঘাতের আদেশ দেওয়া হয় ৷ পৈশাচিক উল্লাসের নির্মম হস্ত হরিদাসকে কঠোর প্রহারে জর্জরিত করিয়াছে, কিন্তু মৃতকল্প হরিদাসের নামমাধুর্য-প্রমত্ত অমৃতসিক্ত রসনা তিলেকের তরেও হরিনাম উচ্চারণে বিরত হয় নাই ৷ হরিদাস বলিয়াছিলেন —
খণ্ড খণ্ড হয় দেহ যায় যদি প্রাণ ৷
তবু আমি বদনে না ছাড়ি হরিনাম ৷৷
কাহার প্রভাবে কাহার শিক্ষাগুণে তাঁহার নিষ্ঠায় এই রতি হইয়াছিল, ইতিহাসে সে-বিষয়ে কোন উল্লেখ নাই ৷ সম্মুখে তো কোন আদর্শই ছিল না ৷ ব্রাহ্মণকুলজাতই হউন, আর যবনকুলজাতই হউন, হরিদাস যে কর্ণেক সহজাত কবচ কুণ্ডলের মত এই নিষ্ঠা এই প্রেম লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, সে-সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই৷ প্রহারে প্রহারে প্রপীড়িত হইয়াও নিজের জন্য কোন ক্লেশবোধ নাই ৷

সবে যে সকল পাপীগণ তাঁরে মারে ৷
তার লাগি দুঃখ মাত্র ভাবেন অন্তরে ৷৷
এ সব জীবের কৃষ্ণ করহ প্রসাদ ৷
মোর দ্রোহে নহ এ সভার অপরাধ ৷৷

জগতের ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত দুর্লভ ৷ অপরাধীকে ক্ষমা করিয়াও তৃপ্তি নাই, তাহাদের জন্য শ্রীকৃষ্ণের কৃপা প্রার্থনা, এ এক অভাবনীয় উদাহরণ ৷ এ এক অদ্ভুত চরিত্র ৷ মানুষের ভাষায় ইহার কোন ব্যাখ্যা হয় না ৷ শ্রীমদ্ভাগবতোক্ত ভক্তরাজ প্রহ্লাদের সাধনার মূর্তপ্রতীক এই ব্রহ্ম হরিদাস ৷
সপ্তগ্রামের ধনকুবের গোবর্ধন দাস হরিদাসকে শ্রদ্ধা করিতেন ৷ গোবর্ধন পুত্র শ্রীরঘুনাথ দাস প্রথম জীবনে হরিদাসের সঙ্গলাভ করিয়াছিলেন ৷ তাহারই সুফল রঘুনাথের শ্রীচৈতন্য-সঙ্গলাভ, কৃপাপ্রাপ্তি ৷ পাঁচ শত বৎসর পূর্বে শান্তিপুরের মত ব্রাহ্মণপ্রধান স্থানের অন্যতম নেতা আচার্য শ্রীঅদ্বৈত পিতৃশ্রাদ্ধ দিনে ব্রহ্ম হরিদাসকে শ্রাদ্ধান্ন নিবেদন করিয়াছিলেন, যাহা ছিল ব্রহ্মনিষ্ঠ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের ভোজ্য ৷ হরিদাস একটি মূর্তিমন্ত বিপ্লব ৷ বেনাপোল হইতে গৌড় রাজধানী, তথা হইতে ফুলিয়া, সপ্তগ্রাম, শান্তিপুর — এক কথায় সারা বাঙ্গালা তিনি এক অজ্ঞাতপূর্ব আলোড়নে আন্দোলিত করিয়াছিলেন ৷ প্রেমোদ্দাম, অক্রোধ , পরমানন্দ নিত্যানন্দের করুণার সঙ্গে সর্বংসহা ধরিত্রীর সহিষ্ণুতা-জেতা হরিদাসের সুদিব্য দৃঢ় ভক্তির এবং অদৃষ্টপূর্ব নিষ্ঠার শুভ সম্মেলনে যে গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গমের উদ্ভব ঘটিয়াছিল তাহাতে অবগাহনের সুযোগ না পাইলে দুর্ধর্ষ জগাই মাধাই—দুরাচার জগাই মাধাই — ‘সাধুরেব স মন্তব্যঃ’ গীতার এই মহাবাক্যের দৃষ্টান্তস্থলে পরিগণিত হইতেন না, এ-কথা একেবারে ধ্রুব সত্য ৷ উপযুক্ত পাত্র বলিয়াই শ্রীমন্‌ মহাপ্রভু এই দুইজনকেই নাম-প্রেম প্রচারের আদেশ দান করিয়াছিলেন ৷
কি সর্বজন-অনুসরণীয় মর্যদাবুদ্ধি ! জগন্নাথক্ষেত্রে আসিয়াছেন, মহাপ্রভু পুনঃ পুনঃ তাঁহাকে আহ্বান করিতেছেন — কিন্তু কিছুতেই হরিদাস ভক্তগোষ্ঠীতে প্রবেশ করিবেন না ৷ অবশেষে স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব পথে বাহির হইয়া ধরণীর ধূলি হতে তাঁহাকে বক্ষে তুলিয়া লইলেন ৷ তিনি কোনদিন দারুব্রহ্ম জগন্নাথ দর্শনের আকাঙ্ক্ষা করেন নাই, তাই সচল ব্রহ্ম শ্রীশচীনন্দন তাঁহাকে নিত্য দর্শন দান করিতেন ৷ পুরীতে শ্রীরূপ আসিয়াছেন, শ্রীসনাতনও আসিয়াছেন, উভয়ে তাঁহার কুটীরেই অবস্থান করিয়াছেন ৷ কত আলোচনা, কত সিদ্ধান্ত, কত গূঢ় রহস্যের গোপনসঙ্কেত শুনিবার সৌভাগ্য হইয়াছে তাঁহার ৷ হরিদাসের সৌভাগ্যের তুলনা হয় না ৷ মহাপ্রভুর কি ভালবাসাই না পাইয়াছিলেন তিনি ৷ তাঁহার দেহাবসানও তেমনি অলৌকিক, সে সৌভাগ্যও কল্পনাতীত ৷
হরিদাস মহাপ্রভু অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন ৷ একমাত্র আচার্য অদ্বৈত ভিন্ন মহাপ্রভুর সম্প্রদায়ে তাঁহার অধিক বয়স্ক কেহ ছিলেন না ৷ একদিন মহাপ্রভুর একান্ত সেবক শ্রীগোবিন্দ মহাপ্রসাদ লইয়া আসিয়া দেখিলেন হরিদাস শয়ন করিয়া আছেন ৷ গোবিন্দ জানাইলেন, মহাপ্রসাদ আনিয়াছি ৷ হরিদাস উত্তর করিলেন, ‘নামসংখ্যা সম্পূর্ণ হয় নাই,অথচ মহাপ্রসাদকেও উপেক্ষা করিতে পারি না ৷’ এই বলিয়া তিনি প্রসাদের কণিকামাত্র গ্রহণ করিলেন ৷ পরদিন মহাপ্রভু আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন আছ হরিদাস ? হরিদাস বলিলেন, দেহ সুস্থ আছে কিন্তু মন-বুদ্ধি অসুস্থ ৷

প্রভু কহে কোন ব্যাধি কহতো নিশ্চয় ৷
তিঁহো কহে সংখ্যা সঙ্কীর্তন না পূরয় ৷৷
প্রভু কহে বৃদ্ধ হইলা সংখ্যা অল্প কর ৷
সিদ্ধদেহ তূমি সাধনে আগ্রহ কেন ধর ৷৷
লোক নিস্তারিতে তোমার এই অবতার ৷
নামের মহিমা লোকে করিলে প্রচার ৷৷
এবে অল্প সংখ্যা করি করহ কীর্তন ৷
হরিদাস কহে শুন মোর নিবেদন ৷৷
হীন জাতিতে জন্ম মোর নিন্দ্য কলেবর ৷
হীন কর্মে রত মুঞি অধম পামর ৷৷
অদৃশ্য অস্পৃশ্য মোরে অঙ্গীকার কৈলে ৷
রৌরব হইতে কাড়ি বৈকুণ্ঠে চড়াইলে ৷৷
স্বতন্ত্র ঈশ্বর তুমি হও ইচ্ছাময় ৷
জগৎ নাচাও যারে যৈছে ইচ্ছা হয় ৷৷
অনেক নাচাইলে মোরে প্রসাদ করিয়া ৷
বিপ্রের শ্রাদ্ধ পাত্র খাইনু ম্লেচ্ছ হইয়া ৷৷
এক বাঞ্ছা হয় মোর বহুদিন হইতে ৷৷
লীলা সম্বরিবে মোর লয় এই চিতে ৷৷
সেই লীলা প্রভু মোরে কভু না দেখাইবা ৷
আপনার আগে মোর শরীর পাড়িবা ৷৷
হৃদয়ে ধরিব তোমার কমল চরণ ৷
নয়নে দেখিব তোমার ও চাঁদ বদন ৷৷
জিহ্বায় উচ্চারিব তোমার কৃষ্ণ চৈতন্য নাম ৷
এই মত মোর ইচ্ছা ছাড়িব পরাণ ৷৷
তুমি কৃপাময়, আমার ইচ্ছা পূর্ণ কর ৷ মহাপ্রভু বলিলেন, তুমি যাহা চাহিবে শ্রীকৃষ্ণ তোমার সেই ইচ্ছা পূর্ণ করিবেন ৷ কিন্তু আমার য৷হা কিছু আনন্দ তো তোমাদিগকে লইয়া ৷ আমাকে ছাড়িয়া যাওয়া কি তোমার পক্ষে উচিত হইবে ৷ হরিদাস নিবেদন করিলেন,অধমকে দয়া কর, আমার শিরোমণিস্বরূপ তোমার কত কোটি ভক্ত তোমার লীলার সহায়ক রহিয়াছেন ৷ আমার মত পিপীলিকা মরিলে পৃথিবীর কি ক্ষতি হইবে?
পরদিন সদলবলে মহাপ্রভু হরিদাসের কুটীরে শুভাগমন করিলেন ৷ অঙ্গনে হরিনাম-সঙ্কীর্তন আরম্ভ হইল ৷ বক্রেশ্বর পণ্ডিত নৃত্য করিতে লাগিলেন ৷ হরিদাস যেমন মহাপ্রভু এবং তাঁহার সঙ্গীগণকে বন্দনা করিলেন, তেমনই সর্বভক্ত বন্দে হরিদাসের চরণ ৷ মহাপ্রভুর মুখে হরিদাসের গুণগান শুনিয়া সকলেই মুগ্ধ হইলেন ৷ চতুর্দিকে হরিবোল হরিবোল ধ্বনি উঠিল ৷ হরিদাস আপনার অগ্রে মহাপ্রভুকে বসাইয়া বক্ষে তাঁহার পদদ্বয় ধারণ করিলেন, হরিদাসের চক্ষু দুটি সুস্থির হইল গিয়া মহাপ্রভুর মুখারবিন্দে ৷
স্বহৃদয়ে আনি ধরিল প্রভুর চরণ ৷
সর্বভক্ত পদরেণু মস্তক ভূষণ ৷৷
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম বলে বারবার ৷
প্রভু মুখ মাধুরী পিয়ে নেত্রে জলধার ৷৷
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম করি উচ্চারণ ৷
নামের সহিত প্রাণ কৈল উৎক্রামণ ৷৷
হরিদাসের দেহ কোলে তুলিয়া সঙ্কীর্তনের মাঝে প্রেমবিহ্বল মহাপ্রভু বহুক্ষণ নৃত্য করিয়াছিলেন ৷ অতঃপর শ্রীপাদ স্বরূপ দামোদর মহাপ্রভুকে প্রতিনিবৃত্ত করিলে, হরিদাসের দেহ বিমানে স্থাপিত হইল, এবং সকলে মিলিয়া নামসঙ্কীর্তন করিতে করিতে হরিদাসের দেহ লইয়া সমুদ্রতীরে উপস্থিত হইলেন ৷ হরিদাসের দেহকে সমুদ্রজলে স্নান করাইয়া ভক্তগণ তাঁহার পাদোদক পান করিয়াছিলেন ৷ শ্রীজগন্নাথদেবের প্রসাদী চন্দন এবং প্রসাদ বস্ত্র অঙ্গে দিয়া হরিদাসকে সমুদ্রতীরে সমাধিস্থ করা হয় ৷ সেই সমাধিতে স্বয়ং মহাপ্রভুও হরিদাসের অঙ্গে বালুকা-মুষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন ৷ সমাধির উপর ইষ্টক বেদী নির্মিত হইল ৷ সঙ্কীর্তনরত মহাপ্রভু বেদী প্রদক্ষিণপূর্বক সমুদ্রে স্নানান্তে জগন্নাথ-মন্দিরের সিংহদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ৷ মহাপ্রভু
সিংহদ্বারে আসি পসারির ঠাঞি ৷
আঁচল পাতিয়া প্রসাদ মাগিল তথাই ৷৷
হরিদাস ঠাকুরের মহোৎসব তরে ৷
প্রসাদ মাগিয়ে ভিক্ষা দেহত আমারে ৷৷
হরিদাস ঠাকুরের শ্রাদ্ধোৎসবের জন্য স্বয়ং মহাপ্রভু পাতিয়া ভিক্ষা করিতেছেন, মহাকালের বক্ষে সেই আলেখ্য অনপনেয় বর্ণসমারোহে চিরকালের জন্য অঙ্কিত হইয়া আছে ৷ মহাপ্রভুকে ভিক্ষা করিতে দেখিয়া সুপ্রচুর দ্রব্যসম্ভার লইয়া পসারিরা ছুটিয়া আসিলেন ৷ স্বরূপ তাঁহাদিগকে বাধা দিয়া মহাপ্রভুকে গম্ভীরায় পাঠাইয়া দিলেন ৷ পরে প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত বহুবিধ মহাপ্রসাদ লইয়া তিনি গম্ভীরায় ফিরিলেন ৷ উপযুক্ত সমারোহেই ব্রহ্ম হরিদাসের তিরোধানোৎসব সমাধা হইল ৷
কবিরাজ গোস্বামী অতি বিনয়ে রূপ-সমাতনকেও নীচ জাতি নীচ সঙ্গী বলিয়াছিলেন ৷ হরিদাস ঠাকুর দীনতাবশতঃ মহাপ্রভুকে যাহা বলিয়াছিলেন, হয়তো কবিরাজ গোস্বামী তাহারই পুনরুক্তি করিয়াছেন ৷ নানা কারণে ব্রহ্ম হরিদাসের আবির্ভাব-বৃত্তান্ত রহস্যাবৃতই রহিয়া গিয়াছে ৷