অষ্টাধ্যায়ীকার পাণিনি (খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতক), মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি (খ্রীষ্টপূর্ব ৩য়-২য় শতক) থেকে আরম্ভ করে মহাভারত (খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০)-সংকলয়িতা ব্যাস পর্যন্ত সকলেই কংসের নিধনকারী শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করেছেন৷ পতঞ্জলি (যোগদর্শনকার পতঞ্জলি এবং মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি এক ব্যক্তি নন এটি অনেক পণ্ডিতের অভিমত)৷ তাঁর মহাভাষ্যে “কংসবধ” -নাটকের উল্লেখ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কংস ও কৃষ্ণের ভূমিকায় নটদের মুখে কিভাবে লালরঙ ও কালোরঙ মাখানো হোত তার বর্ণনা করেছেন৷ শ্রদ্ধেয় প্রবোধচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর ইংরাজী “পতঞ্জলি-নিবন্ধে লিখেছেন ঃ “Patanjali has clearly shown how the incidents of Kansha-badha and Bali-badha formed the subject of theatrical representations, and he particularly states how the actors, representing the sides of Kamsha and Krishna, besmeared their faces with black and reddish tinge respecting”৷ (Cf.The Indian Historical Quarterly. Vol. II. December, 1926. p. 751.) পাতঞ্জল-মহাভাষ্যে কংস ও কৃষ্ণের উল্লেখ থাকায় পতঞ্জলি যে কংসনিধনকারী কৃষ্ণের শৌর্য-বীর্য-মহিমা অবগত ছিলেন সেকথা বোঝা যায়৷ মোটকথা অভিনয়ে বাসুদেব বা কৃষ্ণ কংসরাজকে নিহত করলে বাসুদেবের অনুচরগণ উল্লসিত ও কংসরাজের অনুচরগণ মূহ্যমান হয়েছিল এই কথাই ভাষ্যে পতঞ্জলি বলতে চেয়েছেন৷ মৌর্য ও গুপ্তযুগে (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৭–খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতক) ও বিশেষ করে গুপ্তযুগের শিল্পে ও ভাস্কর্যে শ্রীকৃষ্ণের গোপীলীলা ও গোবর্ধনগিরি-ধারণকাহিনীর অভাব নাই ৷ পাল রাজাদের সময়ে পাহাড়পুর-মন্দিরের ভিত্তিচিত্রাবলীতে কৃষ্ণলীলাকাহিনীর সাক্ষ্য পাওয়া যায় এবং আরও পাওয়া যায় “রাধা”, “সত্যভামা”, “উৎকণ্ঠিত মাধব”-প্রভৃতি নামাবলীর৷ দক্ষিণ-ভারতে ভাগবতধর্মের প্রবর্তন হয় সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব ১ম শতকের গোড়ার দিকে৷ যজ্ঞ-শাতকর্ণির সময় চীনা -প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায়, খ্রীষ্টীয় ২য় শতকে ভাগবতধর্ম কৃষ্ণাজেলায় বিশেষভাবে প্রসার লাভ করেছিল৷ “শিলপ্পাধিকরম্‌” প্রভৃতি তামিল-নাটকে মাদুরা, কারিরিপর্দ্দিনম্‌ ও অন্যান্য শহরে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভ্রাতাদের উদ্দেশ্যে উৎসৃষ্ট মন্দিরের নিদর্শন বিরল নয় ৷ দক্ষিণ-ভারতে ভাগবতধর্ম-বিস্তারের কাহিনী ভাগবতপুরাণেও উল্লেখ আছে। বৈষ্ণবধর্মের বাহক ও ধারক-রূপে আল্‌বারের (আড্‌বার বা আলোয়ার) নাম দক্ষিণ ভারতে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ৷ ভাগবতধর্মের সাধক বা ভগবদ্‌প্রেমিকদের বলা হোত “আল্‌বার” বা আড়্‌বার ৷ সেই সাধকদের মধ্যে জাতি ও বর্ণের কোন বিচার ছিল না৷ স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই ভক্তিপথের সাধক ও সাধিকা হতে পারতেন৷ এরা “দিব্যপ্রবন্ধ” বা কৃষ্ণ-ভগবানের কীর্তিগাথাযুক্ত অংসখ্য পদগীতি বা কীর্তন রচনা করেছেন ৷ খ্রীষ্টীয় ১১শ শতকে আচার্য নাথমুনি সে সকল পদগান বা কীর্তন সংকলন করে সর্বসাধারণের সমাজে প্রচার করেন৷ কাঞ্চী, মহাবলীপুরম্‌, ও ময়লাপুর-অঞ্চলেও আল্‌বারদের প্রাচীন তিনজন সাধক ও প্রচারক নাকি বাস করতেন৷ এঁরা নারায়ণকেই আদি ও পরম দেবতা বলে গণ্য করতেন এবং বিশেষ করে শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপ ত্রিবিক্রমকে শ্রদ্ধা ও পূজা করতেন৷
ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত “রাধার ক্রমবিকাশ–দর্শন ও সাহিত্য”–গ্রন্থে আল্‌বারদের প্রসঙ্গে লিখেছেন ঃ “এই আল্‌বারগণ কখন আবির্ভূত হইয়াছেন এই বিষয়ে নানা মতানৈক্য রহিয়াছে, কিন্তু মোটামুটিভাবে এই রাগমার্গে ভজনশীল বৈষ্ণবগণ খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতক হইতে নবম শতকের ভিতরে বিভিন্নকালে আবির্ভূত হইয়াছিলেন বলিয়া গ্রহণ করা হইয়া থাকে৷ এই আল্‌বারগণ নিজদিগকে নায়িকা এবং বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে নায়ক মনে করিয়া রাগমার্গে ভজনা করিতেন৷ তাঁহাদের এই ভজন-সংগীতগুলির চারি সহস্র সংগীতযুক্ত “দিব্যপ্রবন্ধ” নামে প্রসিদ্ধ ৷ আল্‌বারগণ দিব্যভাবাবেশে আবিষ্ট হইয়া বিষ্ণুর যে-সকল বর্ণনা করিয়াছেন তাহা ভারতের বহুস্থানেই বিষ্ণুর কৃষ্ণ-অবতারে বৃন্দাবনলীলায় নানাভাবে উল্লেখ রহিয়াছে ৷ অন্যান্য বহু বহু লীলার সহিত গোপীগণের সহিত কৃষ্ণের প্রেমলীলারও অনেক স্থানে নানাভাবে উল্লেখ রহিয়াছে৷” (পৃঃ ১১১৷ তাছাড়া গোবিন্দাচার্য-কৃত (I) The Divine Wisdom of the Dravida Saints, (2) The Holy Lives of the Alvars (3) গোপীনাথজিউ -কৃত(4) এস. কে. আয়েঙ্গার-কৃত Early History of Vasnavismin South India, (5) J.S.M. Hooper-কৃত Hymns of the Alvars গ্রন্থগুলির দ্রষ্টব্য ৷ )
আল্‌বারদের পরেই দক্ষিণ-ভারতে বৈষ্ণবধর্মের প্রচারক-রূপে বিভিন্ন আচার্যদের নাম উল্লেখযোগ্য৷ তামিলীয় বৈষ্ণবধর্মে তত্ত্ববিচারও জ্ঞানের দিকটাই ভক্ত সাধকেরা বিশেষভাবে গ্রহণ করেছিলেন৷ নাথমুনি বা রঙ্গনাথাচার্য এই আচার্যদের প্রধান ও প্রথম গুরু৷ সম্ভবত ১১শ শতকে ত্রিচিনপল্লীর কাছে শ্রীরঙ্গমে তিনি বাস করতেন৷ নাথমুনি তাঁর ” ন্যায়তত্ত্ব”-গ্রন্থে যে ভাগবতপ্রপত্তিধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন তা গীতা ও পঞ্চরাত্রতন্ত্রের মূলতত্ত্ব থেকে মোটেই পৃথক নয়৷ মোটকথা তিনি তামিল-ভারতে বৈষ্ণবধর্মের এক নবচেতনার উদ্বোধন করেছিলেন৷ (Cf. An Outline of the Religious Literature of India (Oxford,1926).p. 232.) তাঁর প্রতিষ্ঠিত শ্রীবৈষ্ণব-সম্প্রদায় দক্ষিণ ভারতে এখনো বর্তমান আছে৷ তাছাড়া আচার্য পুণ্ডরীকাক্ষ, রামমিশ্র, যমুনাচার্য প্রভৃতি দক্ষিণ-ভারতের বৈষ্ণবাচার্যদের নাম উল্লেখযোগ্য ৷ যমুনাচার্য-কৃত “সিদ্ধিত্রয়” বা “আত্মসিদ্ধি”, “ঈশ্বরসিদ্ধি” “সম্বিৎসিদ্ধি” সাধক রঙ্গ-রামানুজকে প্রেরণা যুগিয়েছিল ৷ নাথমুনি “আগমপ্রামাণ্য”–গ্রন্থে ভাগবত বা পাঞ্চরাত্র-সম্প্রদায়ের মতবাদের সাহায্যে আচার্য শঙ্করের অদ্বৈতবাদকেও খণ্ডন করেছেন৷ দক্ষিণী বৈষ্ণবাচার্য বেদান্তদেশিকও যমুনাচার্যের মতবাদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন৷
ঐতিহাসিক ফার্‌কুহার বলেন, শ্রীমদ্ভাগবতের সৃষ্টিই নাকি দ্রাবিড়দেশে তথা দক্ষিণ-ভারতে, আর তারি জন্য ভাগবতধর্মে বিশেষভাবে প্রেরণা লাভ করেছিলেন যমুনাচার্য, রঙ্গ-রামানুজ প্রভৃতি বিদগ্ধ বৈষ্ণবাচার্য এবং পরবর্তীকালে উত্তর-ভারতেও সংক্রমিত হয়েছিল সেই ভাগবতধর্মের প্রভাব ৷
এই মতের কোন কোন সমর্থক বলেন, চেদীরাজ কর্ণদেবই দক্ষিণদেশ থেকে শ্রীমদ্ভাগবতের ধর্ম বিশেষভাবে বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন — যার ফলে সেন রাজারাও বৈষ্ণবধর্মের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন এবং তার প্রমাণও ভিন্ন ভিন্ন তাম্রলিপিতে পাওয়া যায়৷ ঐতিহাসিক ফার্‌কুহার ও তাঁর অনুবর্তীরা এই অভিমত পোষণ করেন৷ তবে তাঁদের এই মতের প্রামাণিকতা কতটুকু তা বিচারের বিষয়৷ কেননা শ্রীচৈতন্যদেবের অভ্যূদয়ের (১৪৫৬-১৫৩৩) বহুপূর্বেই উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতের অধিকাংশ স্থানে ভাগবতধর্মের সমধিক প্রচার ও প্রসার ছিল এবং সেই ভাগবতধর্মের ক্রমপ্রসারণের ফলে বেদের বিষ্ণুদেবতা ও খ্রীষ্টীয় শতকের গোড়ার দিকে কৃষ্ণ-বাসুদেবই পরবর্তী যুগে নন্দগোপসুত চিরকিশোর বৃন্দাবনবিহারী শ্রীকৃষ্ণে পরিণত বা রূপান্তরিত হয়েছিলেন মনে হয়৷ তাছাড়া দক্ষিণদেশে ভ্রমণকালে শ্রীচৈতন্যদেব ভাগবতভাববিদগ্ধ “ব্রহ্মসংহিতা” ও লীলাশুকের “শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত” ভক্তি গ্রন্থদুটির কিছু কিছু অংশ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে(পুরীতে) এনেছিলেন৷
নারদভক্তিসূত্র ও শাণ্ডিল্যসূত্রের ভক্তিবাদই খ্রীষ্টীয় ৮ম শতকের শেষ পর্যন্ত যে সমানভাবে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত ছিল সেকথা পূর্বেও আলোচিত হয়েছে৷ হরিবংশে এবং বিষ্ণু, পদ্ম,ব্রহ্মবৈবর্ত প্রভৃতি পুরাণে গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের যে লীলাবিলাস অঙ্কুরাকারে নিহিত ছিল, শ্রীমদ্ভাগবতে সে বিলাসই ফুল-ফল-সুশোভিত বৃক্ষে পরিণত হয়ে প্রকাশ পায়৷ তাছাড়া মহাভারত, হরিবংশ ও পুরাণগুলিতে শ্রীকৃষ্ণের সমগ্র লীলামাধুর্যের আভাস পাওয়া যায়৷ কিন্তু বিশেষভাবে শ্রীমদ্ভাগবতে দেখি শ্রীকৃষ্ণ-ভগবানের অপ্রাকৃত বাল্য ও যৌবনলীলার বিলাস৷ গীতার শ্রীকৃষ্ণলীলা থেকে শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণলীলা বেশ কিছুটা পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করেছিল, কেননা শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণলীলায় যেখানে শৈশব-কারুণ্যের সরল মাধুর্য প্রকাশিত, গীতার শ্রীকৃষ্ণে সেখানে ক্ষাত্রবীর্য ও পুরুষত্বের সঙ্গে সঙ্গে কোমল-কঠোর ভাবের প্রকাশই সমধিক৷ স্বামী অভেদানন্দ মহারাজ এই অভিমত পোষণ করেন৷
এই অভিমত ডঃ সুশীলকুমার দে এবং ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের অভিমতের অনুরূপ ডঃ দে বলেছেন ঃ “The Srimad-bhagavata is indeed the one great Purana which appears to have exercised an enormous influence on the development of Bhakti ideas in mediaeval times. No satisfactory theory of its date and origin has yet been advanced, but there can be no doubt that its emergence marks a turning point in the history of the Vaisnava faith, and that a whole series of sects, who take it as their leading scripture, appears in a sense to have been born out of this remarkable work. Contrasted with the Harivamsa and the Visnu-purana,the Bhagavata scarcely deals with the whole life of Krishna, but concentrates all its strength upon his boyhood and youth. With the youthful Krishna at the centre,it weaves its peculiar theory and practice of intensely personal and passonate Bhakti, which is somewhat deferent from the speculation Bhakti of the Bhagavad-Gata.” (Cf. Dr. Dey: Early History of the Vaisnava Faith and Movement in Bengal (Calcutta. 1942) p. 5.Cf. also Dr.B.N.Dutta : Rise of Gaudiya Vaishnavism in Bengal, Prachyavani, vol. II. July-October, 1945, pp.161-171)৷
পরবর্তী (খ্রীষ্টীয় ১৫শ -১৬শ শতক) বৈষ্ণবধর্মে বৃন্দাবনলীলায় কিশোর শ্রীকৃষ্ণ ও কিশোরী শ্রীরাধার অপ্রাকৃত প্রেমের মাধুর্যময়ী লীলাকাহিনী বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে৷ শ্রীমদ্ভাগবতে যে “রাধা” প্রচ্ছন্নভাবে থেকেও শ্রীকৃষ্ণের একান্ত সোহাগিনী গোপীর স্থান অধিকার করেছিলেন, শ্রীচৈতন্যের সময়ে ও চৈতন্যোত্তরকালে বৈষ্ণব-সাধকসমাজে তিনিই হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার কেবলই প্রধানা সহচরী নন, শ্রীকৃষ্ণের অপেক্ষাও লাভ করেছিলেন তিনি শ্রদ্ধার আসন ৷ ডক্টর শ্রীসুকুমার সেন বলেছেন ঃ আমরা জানি যে, শ্রীচৈতন্য রাধা-কৃষ্ণকাহিনীতে একটু বিশেষ তাৎপর্য আরোপ করেছিলেন, রাধাকে কৃষ্ণের চেয়ে বড় করে ধরেছিলেন, মথুরা ও দ্বারকালীলার অনেক উধ্বে বৃন্দাবনলীলা–এই তত্ত্ব তিনি (বা তাঁর মুখ্য ভক্তেরা) প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ৷”
ডঃ সেন তাঁর বক্তব্য আরো পরিষ্কার করে বলেছেন “বলরামদাসের পদাবলী”-গ্রন্থের (ব্রহ্মচারী অমরচৈতন্য-সম্পাদিত ৷) ভূমিকায় ঃ “গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের বিলাস, মনে হয়, বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল প্রথমে মেয়েলি ও পরে সাধারণ লোকগীতে৷ লোকগীতের মধ্যে দিয়েই কৃষ্ণের প্রেয়সী গোপী “রাধা” নামে চিহ্নিত হন৷ “রাধা”–শব্দটি আসলে সাধারণ বিশেষ্য-শব্দ ব্যক্তিবিশেষের নাম হয়৷ আবাধ্য অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষিত প্রেয়সী নারী — ইহাই “রাধা”-শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ৷ এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ রক্ষিত আছে রাধাচক্রের রাধায়৷ যে চক্র ভেদ করলে রাধা অর্থাৎ ইষ্টনারী পাওয়া যায় তাহাই “রাধাচক্র”৷ এবং পুংলিঙ্গ-রূপ “রাধা” সংস্কৃতে পাওয়া যায় নি, পাওয়া গেছে আবেস্তীয় ৷ সেখানে অর্থ আবাধ্য অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় বা পতি ৷ ক্লীবলিঙ্গে এর রূপ ছিল “বাধস্‌”, — অর্থ অবাধ্য অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষিত বস্তু বা উপহার৷ ক্লীবলিঙ্গে এর রূপ ছিল “বাধস্‌”, –অর্থ আবাধ্য অর্থাৎ আকাঙ্কিত বস্তু বা উপহার ৷ প্রথমে কৃষ্ণের প্রেয়সী বাধা বলতে কোন নির্দিষ্ট একটি গোপীকে বোঝাতো না, যখন সে কৃষ্ণের প্রিয়া তখন সেইই রাধা৷ (পঞ্চরাত্রে “রাধা-শব্দের ব্যুৎপত্তি এভাবে দেওয়া হয়েছে —
রা-শব্দোচ্চাবনাদ ভক্তো ভক্তিং মুক্তিঞ্চ বাতি সঃ ৷
ধা-শব্দোচ্চারণেনৈব ধাবত্যেব হরেঃ পদম্‌ ৷৷২৷৩৷৩৮
“রা”-শব্দ উচ্চারণ করলে “ভক্ত” পদবাচ্য হয় এবং সে ভক্তি ও মুক্তি লাভ করে এবং “ধা”-শব্দ উচ্চারণ করলে হরির পদে ধাবিত হয়৷ অবশ্য এই ব্যুৎপত্তি -নির্ধারণের রীতি প্রাচীন কিনা সন্দেহ৷ “রাধা-শব্দের একটি আধুনিক ব্যাখ্যায় দেখি, “রা”শব্দ দ্বিবচনান্ত, সুতরাং রাধা ও কৃষ্ণ এবং “ধা” শব্দে “ধাবিত”, সুতরাং “রাধা” একটি শব্দেই রাধা-কৃষ্ণের সান্নিধ্য সার্থক হয় ৷ ) কৃষ্ণলীলার বিবর্তনের পরে যখন দেখা গেল যে, কৃষ্ণের বিশেষ পছন্দে বিশেষ একটি গোপীকেই –যাকে নিয়ে তিনি রাসমণ্ডলী থেকে অন্তগত হয়েছিলেন, তাকেই রাধা বলা হল৷ ভাগবতে গোপীরা খেদ করে বলেছে —
অনয়া বাধিতো নূনং ভগবান হরিবীশ্বরঃ ৷
যন্নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনযদ্‌ বহঃ ৷৷
তারপরে এটি তাঁর নামে হোয়ে দাঁড়াল,যদিও পুরানো অর্থ একেবারে লুপ্ত হোল না ৷”
কোন সৌভাগ্যবতী রমণী-কর্তৃক ভগবান ঈশ্বর হরি আবাধিত বা পূজিত হয়েছেন এবং এজন্য শ্রীগোবিন্দ গোপীগণকে পরিত্যাগ করে সেই রমণীকে নিভৃত স্থানে আনয়ন করেছেন৷ গোস্বামী-মহাজনগণ “অনয়া বাধিতঃ” শব্দটির মধ্যে শ্রীরাধার সন্ধান লাভ করেছেন৷ বিষ্ণুপুরাণে ও ভাগবতপুরাণে রাসলীলা-বর্ণনায় অনুরূপ একটি শ্লোকের সন্ধান পাওয়া যায়৷ শ্লোকটি হোল — অত্রোপবিশ্য যা তেন বাপি পুষ্পৈরলঙ্কৃতা ৷
অন্মজন্মনি সর্বত্মা বিঞ্চুরভ্যর্চিতো ময়া ৷৷ ১৩৷৩৪
“এখানে উপবিষ্ট সেই রমণী শ্রীকৃষ্ণ-কর্তৃক কোন পুষ্পের দ্বারা অলঙ্কৃতা হয়েছে, কেননা সেই রমণী দ্বারা অন্য জন্মে সর্বাত্মা বিষ্ণু অভ্যর্থিত বা পূজিত হয়েছেন ৷” এখানে পাই “রাধিত” বা “আরাধিত” শব্দের পরিবর্তে “অভ্যর্থিত” শব্দ৷ (ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত ঃ শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ-দর্শন ও সাহিত্য” (১৩৫৯), পৃঃ ১০১) শ্রদ্ধেয় সনাতন গোস্বামী ও জীব গোস্বামীকে অনুসরণ করে গোস্বামী কৃষ্ণদাস কবিরাজও লিখেছেন,
কৃষ্ণবাঞ্ছাপূর্তিরূপ করে আরাধনে ৷
অতএব রাধিকা নাম পুরাণে বাখানে ৷ — আদিলীলা ৷ ৪
আসলে শ্রদ্ধেয় সনাতন, জীব, কৃষ্ণদাস প্রভৃতি গোস্বামীগণ পদ্মপুরাণের “যথা রাধা পিয়া (প্রিয়া ?) বিষ্ণোঃ” প্রভৃতি শ্লোক থেকে “রাধা”-সংগ্রহ করেছেন৷ তাছাড়া পদ্মপুরাণের বহু স্থানেও “রাধা” -নামের উল্লেখ দেখা যায়৷ কিন্তু ডঃ শশিভূষণ দাসগুপ্ত “রাধার ক্রমবিকাশ”–“দর্শন ও সাহিত্য”-গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন ঃ “পদ্মপুরাণে গোপীগণসহ বৃন্দাবনলীলার কোন বর্ণনাপ্রসঙ্গে এই রাধার উল্লেখ পাইতেছি না; প্রায় উল্লেখই এখানে সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে পাইতেছি৷ পদ্মপুরাণের স্বর্গখণ্ডে জয়ন্তীব্রতমাহাত্ম্যখ্যাপনপ্রসঙ্গে একবার রাধাষ্টমীব্রতের উল্লেখ পাই৷ (বঙ্গবাসী সংস্করণ ৩৭।২৮,৪৪)৷ তৎপরে চত্বারিংশ সর্গে রাধাষ্টমীব্রতের মাহাত্মাই আখ্যাত হইয়াছে৷ * * পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডে রাধার বহুভাবে উল্লেখ পাই ৷ ” পদ্মপুরাণের ৩৯শ অধ্যায়ে বৃন্দাবনে বালকৃষ্ণের উল্লেখও আছে ৷ পদ্মপুরাণের রচনাবলী ( (ক) শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ –দর্শন ও সাহিত্য” পৃঃ ১০১)৷ (খ) ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার ঃ “ষোড়শ-শতাব্দীর পদাবলী-সাহিত্য” ১৯৬১), পৃঃ ১৭১-১৭৭)৷ অনেকের মতে, আনুমানিক ৬ষ্ঠ-৮ম শতক, সুতরাং পদ্মপুরাণে বৃন্দাবনে বাল-কৃষ্ণের উল্লেখ অনেকের মতে বেশ সন্দেহজনক৷
কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দ”–পদগানে “রাধা” ও “রাধিকা” শব্দের উল্লেখ যথেষ্ট পরিমাণে আছে৷ জয়দেবের সমসাময়িক কবি গোবর্ধনাচার্যও শ্রীরাধার পূর্বরাগ-সম্পর্কে একটি শ্লোক লিখেছেন এবং শ্রীরূপ গোস্বামী “পদাবলী” গ্রন্থে সেই শ্লোকটির উল্লেখ করেছেন৷ তাছাড়া জয়দেবের সমসাময়িক কবি উমাপতিধরের “রাধা”-সম্পর্কীয় একটি শ্লোকও শ্রীরূপ গোস্বামী “পদ্যাবলী” ও “উজ্জ্বলনীলমণি”-গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন এবং দেখা যায় যে, সেই শ্লোকে লক্ষ্মীদেবী, রুক্মিণীদেবী ও সত্যভামা অপেক্ষা শ্রীরাধাকে শ্রীকৃষ্ণের “অধিক প্রিয়” বলে বর্ণনা করা হয়েছে ৷ শ্রীধরদাসও “সদুক্তিকর্ণামৃত”-গ্রন্থে রাধার নামোল্লেখ করেছেন৷ বৈষ্ণবশাস্ত্রপারগ ডঃ বিমানবিহারী মজুমাদার এই প্রসঙ্গে লিখেছেন ঃ “সদুক্তিকর্ণামৃতে ধৃত রূপদেব নামে একজন কবির একটি শ্লোকে আছে ঃ “এই জলবেতসের নিকুঞ্জের মাঝামাঝি স্থানে কোন রমণীর জন্য কচিপল্লব দিয়া বিজনে শয্যা রচিত হইয়াছে ? বৃন্দা অন্যান্য স্ত্রীগণকে এই কথা বলিলে রাধা ও মাধবের স্মিতহাস্যের দ্বারা বিচিত্রিত সে অবলোকন তাহা তোমাদিগকে রক্ষা করুক”(১।৫৫।১)৷ বৃন্দাদেবীর সহিত রাধা-কৃষ্ণলীলার সম্বন্ধ যে অন্তত দ্বাদশ শতাব্দী হইতে তাহা ইহার দ্বারা প্রমাণিত বেতসকুঞ্জে রাধাকৃষ্ণের মিলনের কথা প্রাচীন কিম্বদন্তীতে ছিল ৷ জয়দেবের বহুস্থানে (১।৪৪,৪।১, ৭।১১) বেতসকুঞ্জের উল্লেখ আছে ৷ তাই শ্রীচৈতন্যদেব “যঃ কৌমারহরঃ” শ্লোকের “বেবারোধসি বেতসীতরুতলে বেতঃসমুৎকণ্ঠতে” শুনিয়া পরমানন্দে মগ্ন হইয়াছিলেন (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ৩৷১) ৷ ষোড়শ শতাব্দীতে ও তাহার পরবর্তীকালে অবশ্য পদকর্তারা কেহ বেতসকুঞ্জেও রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটান নাই, তাঁহারা মাধবীকুঞ্জই নির্বাচন করিয়াছেন ৷” (ডঃ মজুমদার ঃ “ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী-সাহিত্য” (১৯৬১), পৃঃ ১৬৯)
মধ্যযুগে বল্লভচারী ও নিম্বার্ক-সম্প্রদায় “রাধা”-শব্দের অর্থ করেছেন শ্রীকৃষ্ণশক্তি ; অর্থাৎ শ্রীরাধা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের দিব্যলীলার চিরসঙ্গিনী ৷ আচার্য নিম্বার্ক “বেদান্তপারিজাতসৌরভ”-ভাষ্যগ্রন্থে শ্রীরাধা বা শ্রীরাধিকাকে পরমব্রহ্ম শ্রীকৃ্ষ্ণের বিচিত্র অচিন্ত্য শক্তি বলে বর্ণনা করেছেন ৷ তাছাড়া তিনি “প্রাতঃস্মরণ”, “রাধাষ্টক”, প্রভৃতি স্তোত্রে বা রচনায় শ্রীরাধা-কৃষ্ণের মহিমা বর্ণনা করেছেন৷ কিন্তু বিচারবিলাসী মাধ্ব-সম্প্রদায় শ্রীমদ্ভাগবতের রাসপঞ্চাধ্যায়ের বিরোধী ছিলেন, সেজন্য শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণলীলাকে তাঁরা গৌণ এবং তার দার্শনিক তত্ত্বই মুখ্য বা প্রধান বলেছেন৷ কিন্তু শ্রীচৈতন্যের সময়ে বৃন্দাবনলীলাই প্রাধান্য পেয়েছিল বিশেষভাবে এবং শ্রীরাধা হয়েছিলেন তখন পরমারাধ্যা ও উপাস্যতত্ত্ব এবং শ্রীরাধা-কৃষ্ণের যুগলরূপই পরিগণিত হয়েছিল ভক্তিসাধনদৃষ্টির পরাকাষ্ঠা-রূপে৷ খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতকে বৃন্দাবনে গৌড়ীয় -বৈষ্ণব গোস্বামীরা শ্রীরাধা-কৃষ্ণকে পুনরায় তত্ত্বরূপেই প্রচার করেছিলেন৷ পরমভাগবত জীব-গোস্বামী “তত্ত্বসন্দর্ভ”, “প্রীতসন্দর্ভ” প্রভৃতি দর্শনগ্রন্থেও বিশেষ করে শ্রীরাধাকে পরমতত্ত্বরূপে বর্ণনা করেছেন৷ ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত “রাধার ক্রমবিকাশ–দর্শন ও সাহিত্য”-গ্রন্থে এই সম্পর্কে বলেছেন ঃ জীব-গোস্বামী-কৃত “তত্ত্বসন্দর্ভ”, “ভগবৎসন্দর্ভ”, “পরমসন্দর্ভ”, “কৃষ্ণসন্দর্ভ” ও “প্রীতিসন্দর্ভ” এই ছয়খানি সন্দর্ভের ভিতর দিয়াই গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের সকল মতবাদ — রাধাবাদের দার্শনিক প্রতিষ্ঠা৷” (ডঃ মজুমদার ঃ “ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী-সাহিত্য” (১৯৬১), পৃঃ ১৮০) ৷ বৈষ্ণব -গোস্বামীদের এই রাধাতত্ত্ব শক্তিতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত এবং এই শক্তিতত্ত্ব ও পূর্ব-পূব” বিদগ্ধ আচার্য ও শ্রীমদ্ভাগবত- বর্ণিত পরমাত্মতত্ত্ব — ভাগবত্তত্ত্ব—ব্রহ্মতত্ত্বের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে,
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তুং ত্বং যজ্‌ জ্ঞানমদ্বযম্‌ ৷
ব্রহ্মেতি পরামাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে ৷৷
এই পরমতত্ত্বই গৌড়ীয়-বৈষ্ণবগণের অদ্বয়তত্ত্ব এবং শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা সেখানে শক্তিতন্ত্রের মিথুনাত্মক শিবশক্তিসামরস্যেরই প্রতিচ্ছবি ৷ ডঃ শ্রীসুশীল কুমার দে এই সম্পর্কে বলেছেন ঃ “The Vaisnava Sakti-tattva, the acceptance of Kama-gayatri, and the idea of Radha as the Sakti or Energy of Krishna, point probably to Tantric Influence, both romote and direct. Quotations from tantra works are scattered throughout the standard Vaisnava treatises of Rupa,Jiva and other authoritative theorists of the Bengal School. It is not surpising, therefore, that Radha figures in a Tantric light in such later Vaisnava Tantras as the Narada-Panchatra, and Rupa Gosvamin in his Ujjala-Nilamani declares that Radha is already established in the Tantra(“tantra pratisthita”) as the Hladim Mahasakti of Krishna” (Cf. Early History of the Vaisnava Eaith and Movement (1942).pp.21-22.)৷