প্রেমবিলাসের মতে শ্রীবাসের পিতার নাম জলধর পণ্ডিত ৷ জলধরের পাঁচটি পুত্র — নলিন, শ্রীবাস,শ্রীরাম, শ্রীপতি ও শ্রীনিধি ৷ নলিন পণ্ডিতের কন্যা নারায়ণী ৷ সুবিখ্যাত শ্রীবৃন্দাবন দাস নারায়ণীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন ৷ বৃন্দাবনের পিতার নাম বৈকুণ্ঠনাথ ৷ শ্রীবাসের পূর্ব নিবাস শ্রীহট্ট ৷ শ্রীবাসের গৃহই শ্রীগৌরাঙ্গের প্রথম লীলাক্ষেত্র ৷ শ্রীবাস গৃহেই তাঁহার প্রথম প্রকাশ ৷
গয়া প্রত্যাগত প্রেমোন্মত্ত নিমাই পণ্ডিতের কথা শুনিয়া শ্রীবাস পণ্ডিতই প্রথম বলিয়াছিলেন ‘গোত্রং নো বর্ধতাম্‌’ ‘গোত্র বাঢ়াউক কৃষ্ণ আমা সভাকার’৷ নিমাই-এর প্রেমোন্মাদনা দেখিয়া লোকে শচীদেবীকে বলিতে লাগিল —
লোকে বোলে তূমিত অবোধ ঠাকুরাণী ৷
আর বা ইহার বার্ত্তা জিজ্ঞাসহ কেনি ৷৷
পূর্ব্বকার বায়ু আসি জন্মিল শরীরে ৷
দুই পায়ে বন্ধন করিয়া রাখ ঘরে ৷৷
খাইবারে দেহ ডাবু নারিকেল জল ৷
যাবত উন্মাদ বায়ূ নাহি করে বল ৷৷
কেহো বলে ইথে অল্প ঔষধে কি করে ৷
শিবাঘৃত প্রয়োগে সে এক বায়ু নিস্তারে ৷৷
পাক তৈল শিরে দিয়া করাইবা স্নান ৷
যাবত প্রবল নাহি হইয়াছে জান ৷৷
এই হৈ-হট্টগোলের দিনে সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে শ্রীবাস পণ্ডিতই নিমাই পণ্ডিতকে উদ্বোধিত করিয়াছিলেন ৷ লীলাচ্ছলে সংশয়াকুল নিমাই-এর জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে —
হাসি বোলে শ্রীবাস পণ্ডিত ভাল বাই ৷
তোমার যেমত বাই তাহা আমি চাই ৷৷
মহাভক্তি যোগ দেখি তোমার শরীরে ৷
শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ হইল তোমারে ৷৷
নিমাই পণ্ডিত শ্রীবাসকে কিরূপ শ্রদ্ধা করিতেন তাহার পরিচয় পাইলাম নিমাই-এর উক্তিতে—
এতেক শুনিল যবে শ্রীবাসের মুখে ৷
শ্রীবাসেরে আলিঙ্গন কৈল বড় সুখে ৷৷
সভে বোলে বায়ু সবে আশংসিলে তুমি ৷
আজি বড় কৃতকৃত্য হইলাঙ আমি ৷৷
যদি তুমি বায়ু হেন বলিতা আমারে ৷
প্রবেশিতোঁ আজি আমি গঙ্গার ভিতরে ৷৷
শ্রীবাস উত্তর দিলেন —
শ্রীবাস বোলেন যে তোমার ভক্তি যোগ ৷
ব্রহ্মা শিব শুকাদি বাঞ্ছয়ে এই ভোগ ৷৷
সভে মিলি এক ঠাঞি করিব কীর্তন ৷
যে তে কেনে না বোলে পাষণ্ডি পাপিগণ ৷৷
শচী প্রতি শ্রীনিবাস বলিলা বচন ৷
চিত্তের যতেক দুঃখ করহ খণ্ডন ৷৷
বায়ু নহে কৃষ্ণ ভক্তি বলিল তোমারে ৷
ইহা কভু অন্য জনে বুঝিবারে নারে ৷৷
ভিন্ন লোক স্থানে ইহা কিছু না কহিবা ৷
অনেক কৃষ্ণের যদি রহস্য দেখিবা ৷৷

মিশ্র পরিবারের সঙ্গে শ্রীবাস পণ্ডিতের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল ৷ পণ্ডিত পত্নী মালিনী দেবী শচী দেবীর সখীস্থানীয়া ছিলেন ৷ সুতরাং শ্রীবাসের বাক্যে শচী দেবী কথঞ্চিৎ আশ্বস্তা হইয়াছিলেন ৷
নিমাই পণ্ডিতকে শ্রীবাস -গৃহে মহাপ্রকাশের পূর্বেই আপনার প্রভু বলিয়া প্রথম চিনিয়াছিলেন আচার্য অদ্বৈত ৷ গয়া-প্রত্যাগত নিমাই একদিন প্রিয় বন্ধু গদাধরকে সঙ্গে লইয়া অদ্বৈত সন্দদর্শনে গিয়াছিলেন ৷ সেই দিন আচার্য নানা উপাচারে নিমাইএর চরণপূজা করিয়াছিলেন ৷ পূজাশেষে ‘ নমো ব্রহ্মণ্যদেবায়’ মন্ত্রে প্রণামপূর্বক অদ্বৈত যখন নিমাই-এর পদতলে জোড়হস্তে দণ্ডায়মান হইলেন তখন —
হাসি বোলে গদাধর জিহ্বা কামড়ায়ে ৷
বালকের গোসাঞী এমন না জুয়ায়ে ৷৷
অবশ্য সেদিন নিমাই পণ্ডিতেও অদ্বৈতের পদধূলি লইয়া তাঁহার স্তুতি করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু শ্রীবাস-গৃহে বিষ্ণুখট্টায় উপবেশনপূর্বক শ্রীবাসের প্রথম পূজা তিনি সানন্দেই গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ শ্রীবাসের সৌভাগ্যের তুলনা হয় না ৷
নিমাই পণ্ডিত প্রথমে নিজ গৃহেই সঙ্কীর্তন আরম্ভ করেন ৷ কীর্তনে লোকে বিরক্ত হইয়া উঠিল ৷ নানা জনে নানা কথা বলাবলি করিতে লাগিল ৷ কেহবা শ্রীবাস পণ্ডিতকে দোষী স্থির করিয়া নানারূপ ভীতিমূলক গুজব রটাইতে আরম্ভ করিল ৷ রাজভয়ের কথায় হয়তো শ্রীবাস পণ্ডিত কিছুটা চঞ্চল হইয়া পড়িলেন ৷ গৌরচন্দ্র দেখিলেন, আর উপেক্ষা করা উচিত নয়, কালক্ষেপও অকর্তব্য ৷
একদিন আপন বিষ্ণু-মন্দিরে বসিয়া শ্রীবাস নৃসিংহদেবের পূজা করিতেছিলেন ৷ অকস্মাৎ শ্রীগৌরাঙ্গ আসিয়া রুদ্ধদ্বারে লাথি মারিতে লাগিলেন; উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন—
কাহারে বা পূজিস্‌ করিস্‌ কার ধ্যান ৷
যাহারে পূজিস্‌ তারে দেখ বিদ্যমান ৷৷
জ্বলন্ত অনল যেন শ্রীবাস পণ্ডিত ৷
হইল সমাধি ভঙ্গ চাহে চারিভিত ৷৷
শ্রীবাস দেখিলেন বিশ্বম্ভর বীরাসনে বসিয়া আছেন ৷ তাঁহার চারি হস্তে শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম ৷ মত্ত সিংহের মত তাঁহার গর্জন, বাম কক্ষে তালি দিয়া হুঙ্কার করিতেছেন ৷ স্তব্ধ শ্রীবাসকে ডাকিয়া বলিলেন— এতদিনেও আমার প্রকাশ জানিতে পারিলি না ৷ তোর উচ্চ সঙ্কীর্তনে এবং নাড়ার হুঙ্কারে বৈকুণ্ঠ ত্যাগ করিয়া সর্বপরিবারে আবির্ভূত হইলাম ৷ আমাকে আনিয়া তোরা নিশ্চিন্তে বসিয়া আছিস? নাড়া আমাকে ত্যাগ করিয়া শান্তিপুরে চলিয়া গিয়াছে ৷ সাধুর উদ্ধার এবং দুষ্টের সংহারের জন্যই আমার অবতার গ্রহণ ৷ তোর কোন চিন্তা নাই—আমার স্তব পাঠ কর ৷
শ্রীবাসের সৌভাগ্যের সীমা নাই ৷ ইতিপূর্বে মহাপ্রভু এমনভাবে আর কাহারো নিকট আত্মপ্রকাশ করেন নাই ৷ এমনভাবে সাধিয়া যাচিয়া আর কাহারো নিকট আত্মপ্রকাশ করেন নাই৷ এমনভাবে সাধিয়া যাচিয়া আর কাহারো নিকট আত্মস্তুতি শুনিতে চাহেন নাই ৷ আজ্ঞাপ্রাপ্ত হইয়া শ্রীবাস শ্রীমদ্ভাগবত-বর্ণিত ব্রহ্মমোহাপনোদন অধ্যায়ের ব্রহ্মর স্তব পাঠ করিতে লাগিলেন ৷ যাঁহাকে শৈশবে কোলেপিঠে করিয়াছেন, যাঁহার প্রথম যৌবনের অজস্র ঔদ্ধত্য হাসিমুখে সহিয়াছেন — শচীদুলাল সেই নিমাই পণ্ডিতকে তিনি সাক্ষাৎ ভগবানরূপে বরণ করিয়া লইলেন ৷ কোন দ্বিধা নাই, কোন কুণ্ঠা নাই, কোনরূপ উপেক্ষা নাই, শ্রীবাস একাগ্র নিষ্ঠায় বিশ্বাস করিলেন বৈকুণ্ঠের অধিপতিই শচীনন্দনরূপে আবির্ভূত হইয়াছেন ৷ তিনি স্তব করিতে লাগিলেন—
বিশ্বম্ভর চরণে আমার নমস্কার ৷
নবঘন জিনি বর্ণ পীতবাস যাঁর ৷৷
শচীর নন্দন পায়ে মোর নমস্কার ৷
নব গুঞ্জা শিখিপুচ্ছ ভূষণ যাহার ৷৷
গঙ্গাদাস শিষ্যপায়ে মোর নমস্কার ৷
বনমালা করে দধি ওদন যাঁহার ৷৷
জগন্নাথ পুত্রপদে মোর নমস্কার ৷
কোটী চন্দ্র জিনি রূপ বদন যাঁহার ৷৷
শিঙ্গা বেত্র বেণু চিহ্ন ভূষণ যাঁহার ৷
সেই তুমি তোমার চরণে নমস্কার ৷৷
চারি বেদে যারে ঘোষে নন্দের কুমার ৷
সেই তুমি তোমার চরণে নমস্কার ৷৷

এই দিন মহাপ্রভুর আদেশমতই ভ্রাতা পত্নী দাসদাসীসহ শ্রীবাস সপরিবারেই তাঁহার অর্চনা করেন ৷ এই দিনই শ্রীবাসের ভ্রাতৃসুতা নারায়ণী মহাপ্রভুর আদেশে কৃষ্ণ বলিয়া কাঁদিয়াছিলেন ৷ মহাপ্রভু শ্রীবাসকে অভয় দান করিয়া গৃহে ফিরিয়া যান ৷ সেই দিন হইতে শ্রীবাস-গৃহই তাঁহার লীলাক্ষেত্রে পরিণত হইল ৷ সাতপ্রহরিয়া ভাবের মহাপ্রকাশে তিনি শ্রীবাস-গৃহেই প্রত্যক্ষীভূত হইয়াছিলেন ৷ রাত্রিতে একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হইয়াছে, কিন্তু পাছে মহাপ্রভুর নৃত্যকীর্তনে কোন বিঘ্ন ঘটে, তাই শ্রীবাসের অনুরোধে শ্রীবাসপত্নী প্রভৃতি রুদ্ধকণ্ঠে সে শোক সংবরণ করিয়াছিলেন ৷ শ্রীবাসও সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবেই নৃত্যকীর্তনে যোগ দিয়াছিলেন ৷ এই দৃষ্টান্তের দ্বিতীয় উদাহরণ কোথায়?
শ্রীবাস পুরীধামে গেলে মহাপ্রভু আনন্দিত হইতেন ৷ পত্নী মালিনী অতি আদরেই তাঁহাদের শচীদুলালকে ভিক্ষাদান করিতেন ৷ শ্রীরাধিকা ও শ্রীকমলার ঐশ্বর্য-সম্পদের ব্যাখ্যায় স্বরূপ দামোদরের সঙ্গে শ্রীবাসের প্রণয়-কলহ মহাপ্রভুকে পরমানন্দ দান করিত ৷ মহাপ্রভুর সন্ন্যাসগ্রহণের পর শ্রীবাস কুমারহট্টে চলিয়া যান ৷ মহাপ্রভুর রামকেলি যাইবার সময় এবং তথা হইতে প্রত্যাবর্তন পথে শ্রীবাস-গৃহে ভিক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ সেই সময় তিনি শ্রীবাসকে বর দান করেন— জরা তোমাকে আক্রমণ করিবে না? লক্ষ্মীকেও যদি ভিক্ষা করিতে হয়, তথাপি তোমার গৃহে দারিদ্র্য প্রবেপথ পাইবে না ৷
শ্রীবাস নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণভক্ত ৷ প্রথম যৌবনে একদিন গঙ্গাস্নানের পথে দেবানন্দ পণ্ডিতের ভাগবত শুনিয়া ভাবাবিষ্ট হন ৷ যদিও ব্যাখ্যায় ভক্তির প্রসঙ্গ ছিল না, তথাপি তিনি কৃষ্ণকথা শ্রবণে হাসিয়া কাঁদিয়া আকুল হইয়াছিলেন ৷ দেবানন্দের চেলারা বিরক্ত হইয়া শ্রীবাসকে সেখানে হইতে টানিয়া তুলিয়া পথে বসাইয়া দেন ৷ পরে বক্রেশ্বর পণ্ডিত কয়েকদিন দেবানন্দের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করিলে তাঁহার অহৈতুকী কৃপায় দেবানন্দ নিজ ভ্রম বুঝিতে পারেন ৷ মহাপ্রভুর উপদেশে দেবানন্দ শ্রীবাসের শরণ গ্রহণ করিলে শ্রীবাস দেবানন্দের অপরাধ মার্জনা করেন ৷ মহাপ্রভু যখন শ্রীবাস-গৃহে প্রতি রাত্রিতে কীর্তন করিতেন, সেই সময় চাপাল গোপাল নামে একজন দুষ্টবুদ্ধি ব্রাহ্মণ শ্রীবাসের গৃহের দুয়ারে গভীর রাত্রে একটি কলাপাতায় সিন্দূর, রক্তচন্দন, হলুদের গুঁড়া , কিছু চাউল, জবা ফুল ও একটি মদের ভাঁড় রাখিয়া পালাইয়া যায় ৷ শ্রীবাস প্রভাতে উঠিয়া সেইসমস্ত জিনিস একজন হাড়িকে ডাকিয়া তাহার দ্বারা দূরে সরাইয়া ফেলেন ৷ বোধ হয় এইরূপ নির্যাতন তাঁহাকে আরো অনেক সহিতে হইয়াছিল ৷ কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত চাপাল গোপাল তাঁহার নিকট মার্জনা ভিক্ষা করিলে তিনি তাহাকেও ক্ষমা করেন ৷ শ্রীবাসের শাশুড়ী এক রাত্রিতে মহাপ্রভুর কীর্তনের আসরে লুকাইয়া ছিলেন ৷ মহাপ্রভুর ভাবাবেশে বিঘ্ন উপস্থিত হওয়ায় শ্রীবাস শাশুড়ীকেও ক্ষমা করেন নাই, সেখান হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিলেন ৷ আচার্য অদ্বৈতের গৌরগুণকীর্তনে তাঁহার পূর্ণ সমর্থন ছিল ৷ এমন কি মহাপ্রভু ক্ষোভ প্রকাশ করিলে শ্রীবাসই অগ্রবর্তী হইয়া নানা প্রকারে বুঝাইয়া তাঁহাকে শান্ত করেন ৷
মহাপ্রভুর সম্প্রদায়ে শ্রীবাস প্রভূত মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন ৷ এমন কি মহারাজ প্রতাপরুদ্রেরও সে সংবাদ অজ্ঞাত ছিল না ৷ তাই একদিন রথাগ্রে মহাপ্রভুর নৃত্য দর্শনরত প্রতাপরুদ্রের অমাত্য হরিচন্দনকে ভাবাবিষ্ট শ্রীবাস চড় মারিলে আপনি প্রতাপরুদ্র হরিচন্দনের ভাগ্যের প্রশংসাপূর্বক তাঁহার ক্রোধ প্রশমিত করেন ৷