এক

উল্লেখযোগ্য যে, কবি জয়দেব গীতগোবিন্দে “রাধামাধয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃ কেলয়ঃ”(১।১), “রাসবসে-সহনৃত্যপরা হরিনা”(১।৪৫) প্রভৃতি কৃষ্ণের দিব্যসহচারিণী বা “লীলাসঙ্গিনী-রূপে নির্বিচারে “রাধা” বা “রাধিকা” শব্দ ব্যবহার করেছেন প্রধানা গোপীর পরিবর্তে ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও অন্যান্য প্রাচীন বাংলা-সাহিত্যেও “রাই”, “রাহী”, “রাধা” এবং “কিশোরী” প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, কিন্তু বিকাশধারার দিক থেকে রাধা ও রাধিকা শব্দদুটির মধ্যে বেশ পূর্বাপর ভাবের সামঞ্জস্য আছে ৷ যেমন , চণ্ডীদাসের পদাবলীতে পাই —
(১) রাই , তুমি যে আমার গতি ৷
তোমার কারণে রসতত্ত্ব লাগি
গোকুলে আমার স্থিতি ৷
(২) প্রেমেতে রাধিকা স্নেহেতে রাধিকা
রাধিকা আরতি পাশে ৷
রাধারে ভজিয়া রাধাকান্ত নাম
পেয়েছি অনেক আশে ৷
(৩) উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী
কিশোরী গলার হার ৷
কিশোরী ভজন কিশোরী পূজন
কিশোরী চরণ সার ৷ (নীলরতন মুখোপাধ্যায়-প্রকাশিত “চণ্ডীদাসের পদাবলী” দ্রষ্টব্য)
এক্ষণে “রাধা”-শব্দের অর্থ-সার্থকতা কতটুকু তা দেখার বিষয় ৷ ডঃ শ্রীসুকুমার সেন ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে এই সম্বন্ধে বলেছেন ঃ “রাধা”-শব্দটি অর্থ ও ব্যবহার দুই দিক দিয়েই প্রাচীনতর ৷ যাকে রাধন করা হয়, খাওয়া হয় — সে রাধা ৷ “রাধিকা” –শব্দটি অর্বাচীন, সংস্কৃতে বোধকরি দ্বাদশ শতাব্দীর আগে পাই না; প্রাকৃতে আরও তিন চারশো বছর আগে মিলছে ৷ শব্দটি যদি প্রাকৃত থেকে সংস্কৃতে এসে থাকে তবে এটি রাধা-শব্দেরই রূপান্তর ক্ষুদ্রার্থক সা স্নেহদ্যোতক “ইক্‌” বিভক্তি যোগে৷ আর যদি সংস্কৃতে সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে এটি হবে রাধক-শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ, আর অর্থ হবে, যে নারী রাধনা করে –যে চায় ৷ এই ব্যুৎপত্তি স্বীকার করলে রাধা ও রাধিকার পার্থক্য স্পষ্ট করে বোঝা যাবে কালিদাসের এই উক্তি থেকে –“ন রত্নমন্বিষ্যতি মৃগ্যতে হি তৎ” ৷ রাধিকা অন্বেষণ করে, রাধা অনিষ্ট হয়৷ * * একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী কিংবা তার কিছু আগে থেকে কৃষ্ণের প্রেমলীলা একটু নতুন দৃষ্টিতে দেখা হতে লাগল৷ আগেকার সাহিত্যে গোপীদের প্রেমে কৃষ্ণ চতুর নায়ক, পথভ্রান্ত মধুকর মাত্র, সময় হলেই তিনি উড়ে পালালেন, আর কোন সম্বন্ধ রইল না তাঁর ব্রজের সঙ্গে ৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর সাহিত্যে দেখা গেল যে, দ্বারকায় ঐশ্বর্যবিলাসের মধ্যে থেকে কৃষ্ণের চিত্ত থেকে থেকে উন্মনা হয় কৈশোরের সেই দিনগুলির জন্যে, রাধার জন্যে৷”
“রাধা”-শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের নির্ণয় করে ডঃ শ্রীসেন Indian Linguistics, (Vol. VIII)”The Etymology of the Name “Radha” নামে যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন তা উল্লেখযোগ্য৷ বিবৃতিতে তিনি বলেছেন ঃ “The name Radha, the chief beloved Gopi of Krishna, does not occur in the older Puranas, e.g. in the Harivamsha, the Vayupurana, and the Bhagavata-purana, where the Krishna legend has been elaboratary described. In secular literature, however, it occurs as early as seventh or the eighth century : it occurs in Gatha-Saptasati (I 89), and in Ananda-vardhana”s Dhvanyaloka (2, 6).The Bhagavata, while mentioning Gopi, whom Krishna took aside during Rasa dance, says: anayaradhito nunam bhagava haririsvarah (X,30.28), form this comes the traditioinal derivation of the word Radha “who worship or placates.”
“The word Radha must have once became a common noun, and the meaning was “beloved, a desired woman”. Its neuter counterpart Radhas”, “a desired object, a gift”, occurs in Vedic and the masculine cognate appears in Avestan Rasa i.e. “lover”, “a desired husband”, e.g.-

বাঙ্গালা — হওমো তাওস্‌-চিৎ যাও কইনীনো
অঁংহইবে-দবঘম্‌ অগবাবো ৷
হইতীম্‌ বাদম-চ বকষ ইতি
মোষু জইদ্যন্যো হুক্রতুমা ৷৷
সংস্কৃত অনুবাদ — সোমঃ তাশ্চিৎ যাঃ কন্যকাঃ
আসিবে দীর্ঘম্‌ অশ্রুবঃ ৷
সত্যং বাধং ব ভক্ষতি
মোক্ষু গদ্যমানং সুক্রতুঃ ৷৷

“Those maidens who have remained husbandless for a long time, to them the wise Haomo, being entreated, soon give faithful lovers (husbands)”, [Yasna 9. verse 10″] (অন্যত্রও তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছেন৷)
ডঃ সুকুমার সেন “রাধা-সম্বন্ধে মন্তব্য করার প্রসঙ্গে সেনরাজ-কবি উমাপতিধরের “রত্নচছায়াচ্ছুবিতজলধৌ মন্দিরে দ্বারকায়া * * রাধাকেলিভপরিমলধ্যামূর্ছা মুরাবেঃ” এই শ্লোক-সম্পর্কে বলেছেন, রাধার আধিদৈবিক উন্নয়নে এই প্রথম ধাপ৷ শেষ ধাপ শ্রীচৈতন্যের বিবহোন্মত্ত রূপ৷ পদাবলী সাহিত্যে “রাধা”-শব্দ ও তার অর্থ-সার্থকতার ক্রমবিকাশ কিংবা রাধা-রূপের ক্রমপরিণতি বেশ লক্ষ্য করার বিষয়৷ অবশ্য পরম ও চরম-তত্ত্ব রূপে শ্রীরাধার স্থান ও চিন্তা যে পার্থিব জগতের অনেক উচ্চে তার কিছুটা আভাস পূর্বে দিয়েছি ৷ বৈষ্ণব-কবিচিন্তার পূর্বাপর বিকাশকাহিনী-রূপে চৈতন্যপূর্ব ও চৈতন্যোত্তর পদাবলী-সাহিত্যে “রাধা”-শব্দের প্রয়োগ ও বিকাশের যে বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য আছে তা স্বীকার্য ৷ চৈতন্যপূর্ব পদাবলীতে শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের উচ্চেও নয়, নিম্নেও নয়, বরং সমান আসনেই অধিষ্ঠিত ৷ কিন্তু চৈতন্যোত্তর পদাবলীতে শ্রীরাধার স্থান ও গৌরব শ্রীকৃষ্ণের মহিমাকেও অতিক্রম করেছে , অর্থাৎ শ্রীরাধা সেখানে শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা সচল ও মহান৷ মোটকতা শ্রীচৈতন্যের অভ্যুদয়ের পর থেকে আজ-পর্যন্ত বৈষ্ণব পদাবলীতে কোন পরিবর্তন দেখা না দিলেও ষোড়শ শতকের মধ্যবতী সময়ে পদাবলীসাহিত্যে শ্রীরাধার বিকাশ শ্রীকৃষ্ণবিরহবিধুর শ্রীচৈতন্যের রূপ নিয়ে অন্ততঃ গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সাধকেরা শ্রীচৈতন্যকে গ্রহণ করেছিলেন শ্রীরাধারই অঙ্গদ্যুতি-রূপে, অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের খোলে (শরীরে) শ্রীরাধার প্রকাশ৷ শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণদাস কবিরাজ “শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থে এই তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন৷
( তিনি “বিদগ্ধমাধব” (১ ২ ) থেকে প্রমাণ্যদিয়েছেন —
হরিপুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ ৷
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতি বঃ শচীনন্দন ৷৷
শ্রীস্বরূপগোস্বামীকৃত কড়চা থেকেও তিনি প্রমাণ উদ্ধৃত করেছেন —
রাধা কৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতির্হ্লাদিনী শক্তিরম্মা-
দেকাত্মানাবপি ভুবিপুরা দেহভেদং গতৌ তৌ
চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা তদ্দ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং
রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্‌ ৷
– শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা ৪-৫)

সুতরাং পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মচিন্তায় শ্রীরাধার সজীবতা পূর্ণ-সার্থকতার পাদপীঠে উন্নীত হয়েছিল বল্লেও অত্যুক্তি হয় না৷ তাছাড়া চৈতন্যোত্তর যুগে বৈষ্ণব-দার্শনিকেরা যখন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনের প্রতিষ্ঠা করেন বৌদ্ধিক যুক্তিজালের আশ্রয় নিয়ে, তখন ব্রহ্মের সঙ্গিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী শক্তিত্রয়ের কল্পনা করেছিলেন সগুণব্রহ্ম সত্তার প্রতিপাদক অপার্থিব গুণত্রয় সৎ, চিৎ ও আনন্দকে উপলক্ষ্য করে৷ “ঈশ্বর সৎস্বরূপ হইয়াও যে শক্তির দ্বারা স্বয়ং সত্ত্ব ধারণ করেন এবং অন্যান্য সকলকে ধারণ করেন, সেই সর্বদেশে, সর্বকালে, সর্বদ্রব্যে ব্যাপ্ত শক্তিকে “সন্ধিনী” বলা হয়৷ “হ্লাদিনী” বা আনন্দদায়িনী শক্তি যাহার দ্বারা ভগবান স্বয়ং আনন্দস্বরূপ হইয়াও নিজে আনন্দ-আস্বাদন করেন৷ শ্রীরাধা হ্লাদিনী শক্তি৷” (ডঃ শ্রীবিমানবিহারী মজুমদারঃ “রবীন্দ্রসাহিত্যে পদাবলীর স্থান” (১৩৬৮), পৃঃ ৯৭৷ ) শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক ও বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের পরবর্তী বৈষ্ণবাচার্যেরা ব্রহ্মশক্তি ও “রাধা”-সম্বন্ধে এই রকম ব্যাখ্যাই করেছেন ৷ শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণদাস -কবিরাজ “শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত”-গ্রন্থে এই ব্যাখ্যা বা অর্থের পরিচয় দিয়ে বলেছেন —
সচ্চিদানন্দপূর্ণ কৃষ্ণের স্বরূপ ৷
একই চিচ্ছক্তি তাঁর ধরে তিন রূপ ৷৷
আনন্দাংশে হ্লাদিনী, সদংশে সন্ধিনী৷
চিদংশে সংবিৎ যারে “জ্ঞান” করি মানি৷৷
শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে এই তিন শক্তির বিকাশ সম্ভব হলেও পরবর্তী বৈষ্ণবাচার্যেরা যখন শ্রীচৈতন্যের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ-রাধার অন্তর্নিবেশ করেন তখন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনতত্ত্বের রূপ আর একটি অভিনব তত্ত্ব ও অর্থ নিয়ে বিকাশ লাভ করে৷ নীলাচলের শ্রীচৈতন্য-পরিকরদের মধ্যে — বিশেষভাবে বাসুদেব সার্বভৌম, রায় রামানন্দ,স্বরূপ-দামোদর, রাজা প্রতাপ-রুদ্রদেব এবং বৃন্দাবন মণ্ডলের প্রথম স্তরের পরিকরবৃন্দ সনাতন-গোস্বামী, রূপ-গোস্বামী, গোপালভট্ট গোস্বামী প্রভৃতি অপেক্ষা বৃন্দাবনমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তরের বিদগ্ধ বৈষ্ণবসাধক জীব-গোস্বামী,কৃষ্ণদাস-কবিরাজ, রাঘব পণ্ডিত প্রভৃতি পরবর্তী পরিকরগণের সময়ে শ্রীরাধাকৃষ্ণের অভিন্ন রূপ শ্রীচৈতন্যকেন্দ্রিক গৌড়ীয় -বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ব আরো উন্নত আকার ধারণ করেছিল৷ অবশ্য পদাবলীকীর্তনের প্রসেঙ্গ এই গ্রন্থের পরবর্তী ভাগে শ্রীচৈতন্য এবং তাঁর সমসাময়িক ও তাঁর পরবর্তী বৈষ্ণবসমাজ ও বৈষ্ণবতত্ত্বের আলোচনার সময়ে এই সম্বন্ধে আরো বিস্তৃতভাবে অনুশীলন করার চেষ্টা করবো৷ পদাবলীকীর্তনের প্রতিষ্ঠা, প্রাণ বা অধিষ্ঠান একমাত্র পঞ্চরাত্রসংহিতা, শ্রীমদ্ভাগবত, পুরাণাদি গ্রন্থ ও গৌড়ীয় -বৈষ্ণবাচার্যগণ-লিখিত বিভিন্ন দর্শন-গ্রন্থ৷ শ্রীচৈতন্যসম্প্রদায় আচার্য যমুনাচার্য, রঙ্গ-রামানুজ ও নাথমুনি প্রভৃতি অনুসারী হলেও তা বিশেষভাবে শ্রীজীব -গোস্বামী ও শ্রদ্ধেয় বলদেব বিদ্যাভূষণ-ব্যাখ্যাত অচিন্ত্যভেদাবেদ তত্ত্বের অনুগামী ৷ শ্রীজীব-গোস্বামী ও শ্রদ্ধেয় বলদেব বিদ্যাভূষণ দুই জনেই আচার্য রামানুজের অচিৎ (প্রকৃতি) পদার্থের বিশ্লেষণ করে ঈশ্বর ও চিৎ-এর (জীবের) সঙ্গে কাল ও কর্ম-পদার্থদুটির যোগসূত্র রচনা করেছেন — যদিও শ্রীমদ্‌ভাগবতের ২৷৫৷১৪ শ্লোকে দ্রব্য, কর্ম, কাল, স্বভাব, জীব ও বাসুদেব তত্ত্বসমূহেরর উল্লেখ ও অনুশীলন বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয়৷ শ্রীজীব -গোস্বামী ও বলদেব বিদ্যাভূষণের মতে ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি ও কাল নিত্য পদার্থ এবং কর্ম বা অদৃষ্ট অনিত্য, সুতরাং বিনাশী পদার্থ ৷ শ্রীমদ্‌ভাগবতে সগুণ-ব্রহ্ম ঈশ্বরের উপাসনাই অভিপ্রেত ৷ শ্রীজীব গোস্বামী ও বলদেব বিদ্যাভূষণ সগুণ-ব্রহ্ম সেব্য-সেবকভাবের দ্বারাই মুক্তিলাভের কথা বলেছেন৷ এই সেব্য-সেবকভাব পাঁচ রকম–শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ৷ এদের মধ্যে মধুরভাবেই ভক্তির (এবং প্রেমেরও)পরাকাষ্ঠা৷ এই ভক্তি (ও প্রেম ) পার্থিব নয়, একান্তভাবে অপ্রাকৃতওঅপার্থিব।
শ্রীমদ্‌ভাগবতের মতো শ্রীজীব-গোস্বামী ওবলদেব পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের তিনটি শক্তির কথা বলেছেন ও সে তিনটি অপার্থিব শক্তি হোল ঃ (১) স্বরূপশক্তি — নিত্য লীলাধামে সন্ধিনী (অস্তি), সম্বিৎ (ভাতি) ও হ্লাদিনী (প্রীতি বা প্রিয়); (২) তটস্থাশক্তি — জীবশক্তি বা ভোক্তৃশক্তি, এবং (৩) বহিরঙ্গ মায়াশক্তি — সত্ত্ব-রজঃ-তমোগুণাত্মিকা শক্তি –যার পরিণাম দৃশ্য বিশ্বচরাচর ৷ বহিরঙ্গ মায়াশক্তি ঈশ্বরকে স্পর্শ বা আবৃত করে না (অদ্বৈত বেদান্তেও তাই) এবং আচার্য রঙ্গ-রামানুজেরই মতো পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ অতিপ্রাকৃত গুণসম্পন্ন ও চিজ্জডশক্তির আশ্রয়স্থল এবং কারণ –“অবিচিন্ত্যশক্তিকত্বাৎ”৷ অদ্বৈতবেদান্তীরা যেখানে মায়ার অনির্বচনীয়তার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন, সেখানে শ্রীজীব গোস্বামী, বলদেব বিদ্যাভূষণ এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যেরা শক্তি অবিচিন্ত্য (অচিন্ত্য) বলে তার আর স্বরূপ বিশ্লেষণ করেন নি৷ অবশ্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব-দর্শন সম্পূর্ণভাবে অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বৈষ্ণব পদাবলীকীর্তনের তত্ত্ব এবং আদর্শও ঐ বাদ ও তত্ত্বের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত ৷
অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ-সম্পর্কে শ্রীজীব-গোস্বামী “সর্বসম্বাদিনী” -গ্রন্থে বলেছেন ঃ “অপরে ত “তর্কাপ্রতিষ্ঠানাৎ”(ব্রহ্ম সূঃ ২৷১৷১১) ভেদেঽপ্য-ভেদেঽপি নির্মার্য্যাদদোষসন্ততিদর্শনেন ভিন্নতয়া চিন্তয়িতুমশক্যত্বাদেভেদং সাধয়ন্তঃ তদ্বদভিন্নতয়াপি চিন্তয়িতুমশক্যত্বাদ্ভেদসাধয়ন্তোঽচিন্ত্যভেদাভেদবাদং স্বীকুর্বন্তি৷” অর্থাৎ শ্রীজীব-গোস্বামী বলেছেন ঃ “অপর এক সম্প্রদায়ের বেদান্তীরা বলেন, তর্কের অপ্রতিষ্ঠার জন্য ভেদেও এবং অভেদেও নিখিল দোষসমূহ দর্শন করে ভিন্নত-রূপে চিন্তা করা অসম্ভব৷ সেজন্য যেমন ভেদসাধন করা কঠিন, তেমনি অভিন্নভাবে চিন্তা করে অভেদসাধন করাও দুষ্কর৷ এরূপে ভেদাভেদ উভয়ই সাধন করতে গিয়ে এঁরা ভেদাভেদসাধনে চিন্তার অসামর্থ্যতা উপলব্ধি করায় অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন৷ শ্রীজীব-গোস্বামীপাদ ও বলদেব বিদ্যাভূষণকে শ্রীমধ্বও শ্রীবল্লভেরই একটি নবীন সংস্করণ বলা যায়৷ আচার্য বল্লভাচার্যও জীব-গোস্বামী ও বলদেবের মতো স্বীকার করেন যে, মুক্তির আদর্শ নিত্যবৃন্দাবৃন্দাবনে পতিভাবে শ্রীকৃষ্ণের নিত্য সেবা ও আরাধনা করা উচিত ৷ সেই নিত্য-বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ-ভগবান পুরুষোত্তম -রূপে অতীন্দ্রিয় অক্ষর জ্যোতির্ময় নিরাকার ব্রহ্মকেও অতিক্রম করে বর্তমান৷ মাধ্বাচার্য মুক্তির প্রসঙ্গে একটু ভিন্নভাবে বলেছেন ঃ “মুক্তির্নৈজসুখানুভূতিবমলা, ভক্তিশ্চ তৎসাধনম্‌, হ্যক্ষরাদি ত্রিতযং প্রমাণমলিলাম্নায়য়ৈকবেদ্যো হরিঃ ৷” বৈষ্ণব-পদাবীলকীর্তনের প্রাণকেন্দ্র পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীহরি এবং শ্রীরাধা বা শ্রীরাধিকা তাঁর পরমা শক্তি৷ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ ও প্রকৃতি শ্রীরাধার অপ্রাকৃত ও অপার্থিব লীলাকেই বিভিন্ন পালায় বা লীলাকর্মে বিভক্ত করে বসে, রূপে ও ভাবে বৈষ্ণব মহাজন বা পদকর্তাগণ কীর্তনের পদাবলী রচনা করেছেন ও শ্রীকৃষ্ণ-রাধার মহিমা বর্ণনা করেছেন শাশ্বত মুক্তিরসধারা আস্বাদনের জন্য৷ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, “এ গ্রন্থের পরবর্তী ভাগে “পদাবলীকীর্তনে দর্শনতত্ত্ব” বিষয়বস্তুর আলোচনার সময়ে বিস্তৃতভাবে বৈষ্ণবদর্শনে ও কীর্তনগানে প্রকৃত তত্ত্বদৃষ্টিসম্পর্কে অনুশীলন করার চেষ্টা করবো ৷ বর্তমান আলোচনা তার আভাস মাত্র৷