দীর্ঘ তিন শত বৎসরের পরাধীনতা ৷ এমন এক দুর্ধর্ষ জাতি বাঙ্গালা অধিকার করিয়াছে যাহাদের ভাষা পৃথক, ধর্ম পৃথক; অশনে বসনে, আচারে ব্যবহারে ও দয়াধিকারে যাহারা একেবারেই বাঙ্গালীর বিপরীতধর্মী ৷ দেশে তাহারা স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে ৷ বাঙ্গালী জাতির জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া আসিতেছে ৷ সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছে ৷ যাহাদের দেশ, যাহারা ছিল দেশের একমাত্র অধিবাসী, এই নবাগত বৈদেশিকগণের সংঘাতে সেই হিন্দু জাতির সংখ্যা ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হইতেছে ৷ কিন্তু এই নিদারুণ বিপদ-পাতেও বাঙ্গালী একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়ে নাই, সম্পূর্ণরূপে আত্মহারা হয় নাই ৷ অন্ধকারেও সে পথ খুঁজিয়াছে, আত্মপ্রকাশের আত্মসম্প্রসারণের চেষ্টা করিয়াছে৷ ইতিহাসের পৃষ্ঠা হইতে আজিও এই প্রচেষ্টার পরিচয় লোকপ্রাপ্ত হয় নাই৷ গৌড়েশ্বর দনুজমর্দনদেব এইরূপ একজন দৃঢ়প্রচেষ্ট ইতিহাসপ্রসিদ্ধ পুরুষ ৷ নিজ বাহুবলে তিনি পরহস্ত হইতে বাঙ্গালার রাজদণ্ড কাড়িয়া লইলেন ৷ সুবর্ণগ্রাম সপ্তগ্রাম ও গৌড়ের মুদ্রা-মুদ্রণালয় হইতে নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করাইলেন ৷ রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ বৃহস্পতিকে আনিয়া স্মৃতির নূতন নিবন্ধ-রচনায় নিযুক্ত করিলেন ৷ কিন্তু তাঁহার সাধনা সফল হইল না ৷ স্বাধীনতার বোধনবাসরেই বিসর্জনের বাদ্য বাজিয়া উঠিল ৷ মহারাজের লোকান্তরের শোচনীয় অশৌচমধ্যেই পুত্র যদু মুসলমানধর্ম গ্রহণপূর্বক সিংহাসন রক্ষা করিলেন ৷
রাজনীতির খেলায় বাঙ্গালী হারিয়া গেল ৷ জাতি অন্য দিকে আপন মুক্তির পথ খুঁজিতে লাগিল ৷ সৌভাগ্যক্রমে এই সময়ে একজন সন্ন্যাসী আসিয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন ৷ স্মরণীয় কীর্তি এই প্রেমোদ্দাম সন্ন্যাসীর পুণ্যাভিধান শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরী ৷ পশ্চিম বাঙ্গালার প্রাণকেন্দ্র তখন শ্রীধাম নবদ্বীপ ৷ নবদ্বীপের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নজন্য দেশবিদেশের ছাত্রবৃন্দ আসিয়া গুরুগৃহে বাস করিতেন ৷ বিভিন্ন স্থানের খ্যাতনামা অধ্যাপকবৃন্দ বিবিধ শাস্ত্র আলোচনার জন্য নবদ্বীপে উপস্থিত হইতেন ৷ নবদ্বীপের প্রান্তবাহিনী সুরধুনীর পুলিনপরিসর বাঙ্গালার চট্টগ্রাম, আসাম, ঢাকা, যশোহর প্রভৃতি অঞ্চলের ধনীদরিদ্র-নির্বিশেষে পুণ্যার্থিগণকে প্রলুব্ধ করিত ৷ এই জন্যই চট্টগ্রামের বিষয়ী ভক্ত শ্রীপুণ্ডরীক বিদ্যানিধি, আসাম ত্রিহুতের সন্ন্যাসাশ্রমী শ্রীপরমানন্দ পুরী, নবদ্বীপের নিকটবর্তী কুমারহট্টের শ্রীঈশ্বরপুরী, শান্তিপুরের আচার্য শ্রীঅদ্বৈত প্রভৃতি ভক্তগণ শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাইয়াছিলেন ৷ জাতির দুঃখ-দুর্দশা যে কয়জন বাঙ্গালীর চিত্তকে ব্যথিত ও আশঙ্কিত করিয়াছিল, বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎচিন্তা যাহাদের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিয়াছিল, তাহাদের লইয়া আচার্য অদ্বৈত ক্ষুদ্র গোষ্ঠী গঠনপূর্বক ধীরে ধীরে গণ-আন্দোলনের সূচনা করিলেন ৷
অদ্বৈতাচার্যের বয়স, পাণ্ডিত্য, চরিত্রবল, স্বধর্মনিষ্ঠা, ভগবদ্ভক্তি, জনজীবনের প্রতি সহজ সহানুভূতি, মানুষের অধঃপতনেও মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনায় সুতীব্র বেদনাবোধ, মমতা ও অকপট আর্তি নরনারীকে অভিনব প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিল ৷ হরিনাম-মন্ত্রের সিদ্ধসাধক যবন হরিদাসের প্রতি তাঁহার উদার আচরণ, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের পরিবর্তে পিতৃশ্রাদ্ধদিনে তাঁহাকে শ্রাদ্ধান্ন নিবেদন বর্ণাশ্রমের গণ্ডী পার হইয়া তথাকথিত অন্ত্যজ অস্পৃশ্যগণের অন্তর স্পর্শ করিল ৷ গোলোক-ভূলোকের ব্যবধান বিলুপ্ত হইয়া গেল ৷ অমা-রজনীর অন্ধকারকে দীর্ণ করিয়া বাঙ্গালী-ভাগ্যের উদয়শৈলে নবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গচন্দ্র উদিত হইলেন ৷
এদিকে সমাজপতিগণ কমঠবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছেন ৷ কূর্ম যেমন আপন কঠিন পৃষ্ঠাবরণের অন্তরালে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লুক্কায়িত রাখিয়া নিজেকে নিরাপদ মনে করে, সমাজপতিগণের নির্দেশে হিন্দু জনসাধারণ তেমনই কঠোর আচারনিয়মের প্রাণহীন কঙ্কালের আবরণে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে লাগিলেন ৷ জাতির জীবনস্রোত অবরুদ্ধ হইয়া গেল ৷ শ্বাসরোধী বিষবাষ্প সংক্রামক সর্বনাশের সৃষ্টি করিল ৷ ওদিকে রাজধানী অরাজক ৷ বাঙ্গলার রত্ন সিংহাসনের মণিদীপ্তি দুর্দান্ত হাবসীগণকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে ৷ তাহারা গৌড়ের রাজ্যাবরোধে রাজমুণ্ড লইয়া গেণ্ডুয়া খেলায় প্রমত্ত হইয়াছে ৷ সিংহাসনে দুইটা দিন নিশ্চিন্তে উপবেশনের উপায় নাই ৷ কখন কি হয় সর্বদাই এই আশঙ্কা ৷ বাঙ্গালার সে এক সঙ্কটময় সময়; শ্রীগৌরাঙ্গের আবির্ভাবের আট বৎসর পরে হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে সৈয়দ হুসেন শাহকে সুলতান নির্বাচিত করেন ৷ সহস্র বৎসর পূর্বে পাল-নরপতি গোপালদেবের নির্বাচনের পর বাঙ্গালী এই দ্বিতীয়বার রাজা নির্বাচিত করিল ৷

ছাত্র নিমাই আপন প্রতিভায় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন ৷ অধ্যাপক নিমাই অনন্যসাধারণ পাণ্ডিত্যে দিগ্বিজয়ী হইয়া উঠিলেন ৷ ছাত্রবস্থা হইতে নিমাই উদ্ধত; গৃহ, গঙ্গাতীর, চতুষ্পাঠী— সর্বত্রই এই ঔদ্ধত্য বালক-বালিকা-যুবক-বৃদ্ধ সকলকে একটা মাধুর্যমিশ্রিত অস্থিরতায় উত্যক্ত করিয়া তুলিত ৷ অনেকেরই সাধ যাইত এভাবে উত্যক্ত হইতে ৷ যাঁহারা এড়াইয়া চলিতেন তাঁহাদেরও মনে হইত যেন নিমাই-এর দৃষ্টিপথে পড়েন; কিন্তু ঔদ্ধত্যে অধ্যাপক সীমা ছাড়াইয়া গেলেন ৷ নিমাই- এর পিতৃভূমি ছিল শ্রীহট্ট; শ্রীহট্টের লোক দেখিলে তাঁহার ঔদ্ধত্য উদগ্র হইয়া উঠিত ৷
তাবৎ শ্রীহট্টিয়ারে চালেন ঠাকুর ৷
যাবৎ তাহার ক্রোধ না হয় প্রচুর ৷৷
বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রীমুরারি গুপ্ত, সমবয়সী শ্রীগদাধর প্রভৃতি ভয়ে তাঁহাকে এড়াইয়া চলিতেন ৷ কোন অধ্যাপকই তাঁহার সহিত তর্কযুদ্ধে আঁটিয়া উঠিতেন না ৷ শুধু নবদ্বীপে নয়, পশ্চিম ও পূর্ব উভয় বঙ্গেই নিমাই -এর প্রসঙ্গে একটা সাড়া পড়িয়া গেল ৷ নিমাই-এর রূপ ছিল অপরূপ; এমন রূপ যে সহজেই সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করিত ৷ তাই নিমাই-এর ঔদ্ধত্যে কেহ বিরক্ত হইতেন না, কেমন যেন কৌতুকমিশ্রিত একটা আনন্দ অনুভব করিতেন এবং আপন অজ্ঞাতসারেই বার বার এই ঔদ্ধত্য আস্বাদনের জন্য লালায়িত হইয়া উঠিতেন ৷ এমন করিয়াই নিমাই সকলের হৃদয়েই আনুকূল্যে প্রাতিকূল্যে আপনার স্থান করিয়া লইলেন ৷
নিমাইকে জীবনে তিন-তিনটি শোকের আঘাত সহ্য করিতে হইয়াছিল ৷ তাঁহার শৈশবেই স্নেহময় অগ্রজ বিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন ৷ বাল্যেই তিনি পিতৃদেবকে হারাইয়াছিলেন ৷ আবার প্রথম যৌবনেই পত্নী লক্ষ্মীদেবীকে হারাইলেন ৷ অতঃপর তিনি পিতৃকৃত্য সম্পাদনের জন্য গয়াধামে গমন করেন ৷ এই গয়াধামেই তাঁহার জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে ৷ পূর্বেই বলিয়াছি, আচার্য অদ্বৈতের গণ-আন্দোলন যখন আবেগে তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল, সেই সময়েই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার, জীবন-বেদনার মূর্ত প্রতীকরূপেই নিমাই পণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটিয়াছিল ৷ অধ্যাপক নিমাই-এর খ্যাতি যখন দিগন্ত প্রসারিত, সেই সময় শ্রীপাদ ঈশ্বর পুরী নবদ্বীপে শুভাগমন করিয়াছিলেন ৷ মাসাধিক কাল অবস্থানে তাঁহার সহিত শ্রীগৌরাঙ্গের ঘনিষ্ঠ পরিচয় সংস্থাপিত হইয়াছিল ৷ সেই ঈশ্বরপুরী গয়াধামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ৷ পুরীপাদের দর্শনে কৃতকৃতার্থ নিমাই তাঁহার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন ৷ এই দীক্ষাগ্রহণ ও শ্রীবিষ্ণু-পাদপদ্ম দর্শনে নিমাই পণ্ডিত যেন আত্মসম্বিবৎ ফিরিয়া পাইলেন; তাঁহার হৃদয়-পাদপদ্ম দর্শনে নিমাই পণ্ডিত যেন আত্মসম্বিবৎ ফিরিয়া পাইলেন; তাঁহার হৃদয়-সমুদ্র যুগপৎ মানব-প্রেম ও ভগবৎ-প্রেমের ও উত্তাল সঙ্গমে উদ্বেল হইয়া উঠিল ৷ বাঙ্গালার নবজাগ্রত যৌবন তাঁহাকে আশ্রয় করিয়াই মূর্তি পরিগ্রহ করিল ৷ গয়াধাম হইতে ফিরিয়া আসিলেন নিমাই পণ্ডিত এক নূতন মানুষ ৷

তিনি হরিনাম-কীর্তনকেই মানবজীবনের সাধ্যসার বলিয়া নির্ণয় করিলেন ৷ নামকীর্তনের মাধ্যমেই আচণ্ডাল ব্রাহ্মণকে একতাবদ্ধ করিবার স্থির সঙ্কল্পে সুস্থিত হইলেন; জনসংযোগ, গণ-আন্দোলন এবং জাতিগঠনের প্রধানতম উপায়রূপে হরিনাম প্রচারই হইল তাঁহার জীবনব্রত ৷ নিমাই এই উপলক্ষে নিজেকে প্রস্তুত করিতে লাগিলেন ৷ এই প্রস্তুতিপর্বের অনুষ্ঠান তাঁহার জীবনের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ৷ স্বর্গের মন্দাকিনী ধারা যেমন বিন্দু বিন্দু রূপে গোমুখীর গুপ্ত কক্ষে সঞ্চিত হইয়াছিল, তাহার পর একদিন উদগ্র গর্জনে, বিপুল প্লাবনে পাষাণপ্রাচীর ভগ্ন করিয়া ঝরঝর নির্ঝরে সহস্রধারে ভারতের বক্ষে ঝরিয়া পড়িয়াছিল, তেমনই শ্রীগৌরাঙ্গের কীর্তনগান শ্রীবাস অঙ্গনে তাঁহার নয়নের জলে পরিস্রুত হইয়া একদিন আপনার উদ্বেলিত প্রেম প্রবাহে সারা ভারতবর্ষকে অভিসেচন করিয়াছিল ৷ বাঙ্গালায় মিলিতভাবে নামকীর্তন ছিল না ৷ নামকীর্তন শ্রীগৌরাঙ্গদেবের অভিনব সৃষ্টি ৷ লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, নিমাই কোন প্রকাশ্য স্থানে ইহার শুভারম্ভ করেন নাই; মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক মাত্র তাঁহার সঙ্গী ৷ এই সঙ্গিগণ-সহযোগে কোন প্রকাশ্য স্থানে নামকীর্তন অনুষ্ঠিত হইলে প্রতিবন্ধকতার অগ্নিদাহে অথবা বিদ্রুপের করকাপাতে ইহা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইত ৷
নিমাই শ্রীবাস অঙ্গনে নামকীর্তন আরম্ভ করিলেন ৷ দুয়ারে কবাট পড়িল ৷ কয়েকজন অন্তরঙ্গ ভক্ত মাত্র সঙ্গী ৷ তিনি একান্তভাবে তাঁহাদিগকে শিক্ষাদান করিয়াছেন, নানারূপে তাঁহাদের পরীক্ষা লইয়াছেন; আপনার সঙ্গে সঙ্গীগণকেও প্রস্তুত করিয়া তুলিয়াছেন ৷ কৌতূহলী জনতা শ্রীবাস-দুয়ারে সমবেত হইয়াছে। দিনের পর দিন অসহ কৌতূহলে তাহারা অঙ্গনে প্রবেশের চেষ্টা করিয়াছে, পথ খুঁজিয়াছে, কিন্তু কৃতকার্য হয় নাই ৷ নিমাই কাহারো অনুরোধ উপরোধে কর্ণপাত করেন নাই ৷ নিষ্ফল আক্রোশে কেহ কেহ শেষে প্রতিহিংসার আশ্রয় লইয়াছে ৷ চাপাল গোপাল নামক ব্রাহ্মণ যুবক শ্রীবাসের দুয়ারে মদ্যপূর্ণ ভাণ্ডাদি রাখিয়া এক সম্প্রদায়ের প্রতিহিংসাবৃত্তি পরিতৃপ্ত করিয়াছে ৷ কেহ কেহ সাঙ্গোপাঙ্গ-সহ শ্রীগৌরাঙ্গের নামে প্রকাশ্যে কুৎসা রটনা করিয়াও আপনার অন্তর্নিহিত ক্ষোভের পরিচয় দিয়াছে; একজন ব্রাহ্মণ তো অঙ্গন্র প্রবেশের ব্যর্থ প্রয়াসে শ্রীবাসের দ্বারে রাত্রি কাটাইয়া প্রভাতে গঙ্গাস্নানের সময় নিমাইকে দেখিয়াই অভিশাপ প্রদান করিয়াছেন, ‘তুমি যেমন আমার আশাভঙ্গ করিলে, তেমনই তোমার সংসারসুখ বিনষ্ট হইবে ৷’ কিন্তু এত করিয়াও নিমাই-এর নিকট অন্তরঙ্গ ভিন্ন অপর কেহ রজনীতে শ্রীবাস অঙ্গনে প্রবেশের অনুমতি প্রাপ্ত হয় নাই ৷
নিমাই যখন আপনাকে কৃতকৃত্য বলিয়া মনে করিলেন, তখন সর্বংসহ ব্রহ্ম হরিদাস এবং অভিন্নতনু অক্রোধ পরমানন্দ শ্রীপাদ নিত্যানন্দকে অনুরোধ করিলেন— নবদ্বীপের গৃহে গৃহে হরিনাম প্রচার কর ৷ প্রত্যেক গৃহস্থ যেন আপন আপন গৃহে বসিয়া প্রতি সন্ধ্যায় উচ্চ কণ্ঠে হরিকীর্তন করে ৷ আদেশ প্রতিপালিত হইল ৷ হরিকীর্তনের মধুর রোলে নগরীর আকাশ-বাতাস মাতিয়া উঠিল ৷ নবদ্বীপের বিধর্মী রাজপ্রতিনিধি কাজী সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন ৷ কয়েকজন হিন্দু এবং মুসলমান পারিষদের পরামর্শে তিনি আর নিষ্ক্রিয় থাকা যুক্তিযুক্ত মনে করিলেন না; একদিন অকস্মাৎ এক গৃহস্থের বাড়িতে আসিয়া করতাল কাড়িয়া লইলেন, মৃদঙ্গ ভাঙ্গিয়া দিলেন এবং আদেশ প্রচার করিলেন— অতঃপর নবদ্বীপে কেহ উচ্চকণ্ঠে হরিকীর্তন করিতে পারিবে না ৷
নিমাই-এর নির্ভুল অনুমান, তাঁহার ক্রমিক পদক্ষেপে কোন ভ্রান্তি ঘটে নাই ৷ তিনি ইহারই প্রতীক্ষা করিতেছিলেন ৷ এইবার নবদ্বীপে যে অঘটন ঘটিয়া গেল, তাহা যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনই অভূতপূর্ব ৷ ক্রোধোন্মত্ত নিমাই আদেশ করিলেন, কাজীর আদেশ অমান্য করিতে হইবে ৷ নিমাই-এর ক্রুদ্ধ কণ্ঠ নবদ্বীপের গৃহে গৃহে প্রতিধ্বনিত হইল ৷ বিদ্যুৎবেগে রটিয়া গেল শ্রীবাস অঙ্গন হইতে নামকীর্তন বাহির হইবে ৷ স্বয়ং নিমাই পণ্ডিত এই কীর্তনের দলে নৃত্য করিবেন ৷ কৌতূহলী নগরবাসী, ক্ষুব্ধ নগরবাসী, ধর্মোন্মত্ত নগরবাসী কাতারে কাতারে নিমাই-এর পদপ্রান্তে আসিয়া উপস্থিত হইল ৷ এক অকিঞ্চন ব্রাহ্মণ-সন্তানের, দরিদ্র অধ্যাপকের আদেশে এক সুবৃহৎ নগরের অগণিত জনসাধারণ, মহামান্য বঙ্গেশ্বরের প্রতাপান্বিত শাসকের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হইয়া উঠিল ৷ লোকে দুয়ারে দুয়ারে পূর্ণঘট স্থাপন করিল, কদলীতরু রোপণ করিল, আম্রপল্লব দুলাইয়া দিল, দীপাবলী সাজাইয়া দিল ৷ সন্ধ্যার পূর্বেই শ্রীবাস অঙ্গন হইতে নামকীর্তনের দল লইয়া বাহির হইলেন নিমাই পণ্ডিত ৷ প্রথম দলের প্রধানরূপে অগ্রসর হইলেন আচার্য অদ্বৈত, দ্বিতীয় দলে রহিলেন ব্রহ্ম হরিদাস, আর তৃতীয় দলে শ্রীপাদ নিত্যানন্দসহ মহাপ্রভু স্বয়ং ৷ নিমাই পণ্ডিত ইহার পূর্বেই মহাপ্রভুরূপে পরিচিত হইয়াছিলেন ৷ হাজার হাজার লোক তাঁহাদের অনুগমন করিল । ইহাদের কাহারো হাতে পতাকা , কাহারো হাতে জ্বলন্ত মশাল, কাহারো হাত ঘণ্টা, কাহারো হাতে শিঙ্গা, কাঁসর ইত্যাদি ৷ দুর্গোৎসবের সময়ে বাজাইবার জন্য যাহার ঘরে যে বাদ্যযন্ত্র ছিল,যে যাহা পাইয়াছে সংগ্রহ করিয়াছে ৷ নবদ্বীপের পথে পথে হরিনাম গান করিয়া মহাপ্রভু সদলে কাজীর বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন ৷ উন্মত্ত জনতা কাজীর ঘর-দুয়ার ভাঙ্গিয়া ফেলিল, উদ্যানাদি নিশ্চিহ্ন করিয়া দিল ৷ অবশেষে কাজী আপন ভ্রম বুঝিতে পারিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন; আদেশে প্রত্যাহার করিয়া লইলেন ৷ হিন্দুর আপন ধর্মাচরণের, উচ্চকণ্ঠে হরিনাম কীর্তনের অবাধ অধিকার স্বীকৃত হইল ৷ এইদিনের কথা বাঙ্গালার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া রাখিবার কথা ৷ বাঙ্গালী এইদিন আপনার এক নূতন শক্তির সাক্ষাৎকার প্রাপ্ত হইয়াছে — এইদিনে বাঙ্গালীর এই জনমেই জন্মান্তর ঘটিয়োছে ৷
সুলতান হুসেন শাহের রাজত্বকালে শ্রীগৌরাঙ্গদেব সন্ন্যাস গ্রহণ করেন ৷ তাঁহার সন্ন্যাসগ্রহণের সমগ্র বঙ্গদেশ একদিকে যেমন ব্যথায় বেদনায় কাঁদিয়াছে, অন্যদিকে তেমনই আশান্বিত হইয়াছে, ভরসায় বুক বাঁধিয়াছে ৷ হিন্দু -মুসলমানের মিলিত প্রচেষ্টায় সিংহাসন প্রাপ্ত হইয়া হুসেন শাহ কয়েকজন হিন্দুকে উচ্চপদে নিযুক্ত করেন ৷ তাঁহাদের মধ্যে শ্রীরূপ ও শ্রীসনাতনের নাম উল্লেখযোগ্য ৷ রাজবল্লভরূপে রাজনৈতিক কারণে হিন্দু জনসাধারণের আপনজন বলিয়া সামাজিক প্রয়োজনে, ইঁহারা উভয়ে নবদ্বীপের প্রতিটি সংবাদের জন্য উৎকর্ণ হইয়া থাকিতেন, সমস্ত ঘটনাই নখদর্পণে রাখিতেন ৷ নবদ্বীপ বিদ্যানগর -নিবাসী মহেশ্বর বিশারদের পুত্র শ্রীবাসুদেব সার্বভৌমের কনিষ্ঠ সহোদর বিদ্যাবাচস্পতি সনাতনের গুরু ছিলেন ৷ সেই সূত্রে সাক্ষাৎপরিচয় না থাকিলেও রূপ-সনাতন দুই ভ্রাতা যে নিমাই পণ্ডিতকে জানিতেন, সে বিষয়ে কোন সংশয় নাই ৷ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত হইতে জানিতে পারি, শ্রীগৌরাঙ্গদেবের সঙ্গে ইঁহাদের পত্র-ব্যবহার ছিল ৷ শ্রীগৌরাঙ্গদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের পর হইতে ইঁহারাও সংসারত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন ৷ প্রধানতঃ ইঁহাদের সহিত সাক্ষাতের জন্যই মহাপ্রভু শ্রীবৃন্দাবন-যাত্রার ছলে গৌড়ের নিকটবর্তী রামকেলি গ্রামে আগমন করিয়াছিলেন ৷
মহাপ্রভুর সন্ন্যাস-গ্রহণে সমগ্র বাঙ্গালা আলোড়িত হইয়াছিল ৷ তিনি স্বয়ং ভগবান্‌, অথবা ভগবানের অবতার, কিংবা তিনি একজন উচ্চ কোটির সাধক— নানাজনে নানারূপে তাঁহাকে দেখিত ৷ সুতরাং তাঁহার সন্ন্যাস স্বাভাবিক বলিয়াই সাধারণে গ্রহণ করিয়াছিল ৷ লোকে দুঃখানুভব করিয়াছিল মহাপ্রভুর জননী ও জায়া, শচীমাতা ও দেবী বিষ্ণুপ্রিয়ার স্মরণে ৷ কিন্তু রূপ ও সনাতনের বৈরাগ্য একটা বিস্ফোরণের মত প্রচণ্ড আঘাতে বাঙ্গালার জনমনের বৃথা গর্বকে বিধ্বস্ত করিয়া দিল ৷ মানুষের মন হইতে বিদ্যা তথা পদমর্যাদার মোহ অপসারিত হইল ৷ সে সময় ইহার প্রয়োজন ছিল ৷ ঐশ্বর্যের ক্রোড়ে আজন্ম সুখলালিত কৃতবিদ্য যুবক, বাঙ্গালার শীর্ষস্থানীয় সুপ্রতিষ্ঠিতি শ্রেষ্ঠ রাজবল্লভ—বিলাসের মোহ,ক্ষমতার মাদকতা হেলায় ত্যাগ করিয়া বিবাহিত জীবনের সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্য অবলীলায় বিসর্জন দিয়া কিসের প্রত্যাশায় কোন্‌ ভরসায় পথতরুতল আশ্রয় করিলেন, ভাবিয়া যেন লোক কূলকিনারা পাইল না ৷ কোন্‌ সে বস্তু , যাহা লাভের জন্য এই দুইজন মনীষী স্বেচ্ছাকৃত দারিদ্রে ভিক্ষাটনেও লজ্জাবোধ করিলেন না, মানুষ তাহার অনুসন্ধানে ব্যগ্র হইয়া উঠিল ৷ স্নেহের ফল্গুধারা অন্তরে নিরুদ্ধ রাখিয়া কি কঠোর নির্মমতায় মহাপ্রভু ইঁহাদিগকে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, আদর্শের অগ্নিদাহে শ্যামিকাকে নিঃশেষপূর্বক কোন পদ্ধতিতে আকরের স্বর্ণকে তিনি শতবানে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন, জগদ্‌গুরুর সেই শিক্ষণীয় শিক্ষকতা বাঙ্গালী যুবকযুবতীর অবশ্য জ্ঞাতব্য বিষয় বলিয়া মনে করি ৷ মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গগণের মধ্যে যে কেহ শ্রীধাম বৃন্দাবন হইতে নীলাচলে আসিতেন, মহাপ্রভু তাঁহাদের প্রত্যেককে যেন গর্ববোধের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিতেন, ”শ্রীবৃন্দাবনে গিয়াছিলে, রূপ ও সনাতনকে দেখিয়া আসিলে ?” শ্রীবৃন্দাবনের পুণ্যস্থানসমূহ এবং দেব বিগ্রগহসমূহের সঙ্গে রূপ-সনাতনও যে সকলের অবশ্য দ্রষ্টব্য, সে বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয় ছিল বলিয়াই মহাপ্রভু এমন ব্যগ্রতার সঙ্গে সকলকে ইঁহাদের কথা জিজ্ঞাসা করিতেন ৷ সনাতন, রূপ ও তাঁহাদের অনুজপুত্র শ্রীজীবের দিব্যাবদান গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মকে এক অমর মহিমায় শ্রীমণ্ডিত করিয়াছে ৷
শ্রীগৌরাঙ্গের সন্ন্যাস,রূপ ও সনাতনের সংসারত্যাগ মানুষকে এক নূতন প্রেরণায় উজ্জীবিত করিল ৷ তথাপি যেন কিছু অসম্পূর্ণতা ছিল ৷ সপ্তগ্রামের রঘুনাথ দাসের গৃহত্যাগে তাহা সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হইল ৷ বাঙ্গালার অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র সমৃদ্ধিসম্পন্ন নগর সপ্তগ্রাম৷ এই গ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনাঢ্য দুই সহোদর ভ্রাতার নাম হিরণ্য দাস ও গোবর্ধন দাস ৷ ইঁহারা সপ্তগ্রাম অঞ্চল হইতে কুড়ি লক্ষ মুদ্রা রাজস্ব আদায় করিতেন ৷ বার লক্ষ মুদ্রা গৌড়দরবারে প্রেরণ করিতে হইত ৷ সুতরাং দুই ভ্রাতার বাৎসরিক আয় ছিল আট লক্ষ টাকা ৷ হিরণ্য দাসের কোন সন্তানাদি ছিল না ৷ গোবর্ধন দাসের একমাত্র পুত্র রঘুনাথ দাস ৷ রঘুনাথ বাল্যকালেই ব্রহ্ম হরিদাসের কৃপাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন ৷ এই সজ্জনসঙ্গই তাঁহাকে পরমপুরুষার্থ-প্রাপ্তির সৌভাগ্য দান করিয়াছিল ৷ রঘুনাথ মহাপ্রভুকে প্রথম দেখেন শান্তিপুরে অদ্বৈত-মন্দিরে ৷ সন্ন্যাসগ্রহণের পরেই মহাপ্রভু শান্তিপুরে শুভাগমন করিয়াছেন ৷ অন্যান্য বহুলোকের সঙ্গে রঘুনাথও মহাপ্রভুকে দেখিতে গিয়াছেন— সেই প্রথম সাক্ষাৎ ৷ দ্বিতীয়বারের সাক্ষাতও অদ্বৈত মন্দিরে ৷ নীলাচল হইতে মহাপ্রভুর বাঙ্গালায় পদার্পণে অদ্বৈত-মন্দিরে মহোৎসব শুরু হইয়াছিল ৷ এইবার রঘুনাথ বহু উপায়ন সঙ্গে শান্তিপুরে গিয়া মহাপ্রভুর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিবার পর ভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন ৷ নীলাচলে ফিরিবার পথে পুনরায় আচার্য -মন্দিরে শুভাগমন করিলে মহাপ্রভুর পদধারণপূর্বক রঘুনাথ সংসারত্যাগের বাসনা প্রকাশ করেন ৷ মহাপ্রভু বলিয়াছিলেন —
মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক ভাণ্ডাইয়া ৷
যথাযোগ্য বিষয় ভুঞ্জ অনাশক্ত হইয়া ৷

বানরের বৈরাগ্য অবলম্বন্ করিও না ৷ বানর যেমন গৃহপ্রাচীরে আসিয়া শান্তশিষ্টের মত বসিয়া থাকে, তাহার পর যেমন সুযোগ পাইলেই গৃহস্থগৃহে যাহা পায় তাহাই লইয়া পলায়ন করে অথবা নষ্ট করিয়া দেয়, এমন বৈরাগ্য দূরে পরিহার করিও ৷ যখন সময় হইবে, সংসারবন্ধন হইতে শ্রীহরি তোমাকে মুক্তিদান করিবেন ৷ বলিয়াছিলেন —
স্থির হইয়া ঘরে যাও না হও বাতুল ৷
ক্রমে ক্রমে পায় লোক ভবসিন্ধু কূল ৷৷
শ্রীপাদ নিত্যানন্দের কৃপায় কিছুদিনের মধ্যেই সেই সুযোগ আসিল ৷ রঘুনাথ একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করিলেন ৷ ইন্দ্রসম ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধ সংসার, যুবকের পশ্চাতে পড়িয়া রহিল ৷ পড়িয়া রহিল স্নেহান্ধ জনক-জননীর মমতা, অপ্‌সরাসমা সুন্দরী পতিব্রতা যুবতী পত্নীর প্রেমাকূলতা ৷ পড়িয়া রহিল ভোগবিলাসের অজস্র সম্ভার, পার্থিব সুখের অফুরন্ত ভাণ্ডার ৷ হৃদয়সর্বস্ব শ্রীগৌরাঙ্গ-পদদ্বন্দ্ব সার করিয়া রঘুনাথ পথে আসিয়া দাঁড়াইলেন ৷ সংবাদ দাবানলের মত সমগ্র বাঙ্গালায় ছড়াইয়া পড়িল ৷ মানুষের মনে কাঞ্চন-কৌলীন্যের যে মত্ততা ছিল, ভোগসুখের যে মাদকতা ছিল, পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল ৷

দলে দলে নরনারী শ্রীমহাপ্রভু ও তাঁহার ভক্তগণের অনুবর্তী হইয়াছে ৷ পরপ্রত্যাশা ও পরানুকরণ পরিত্যাগপূর্বক স্বল্পবিত্ত, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র নরনারী আপনাদের পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়াছে ৷ যোজনান্তর সংস্কৃতি -কেন্দ্র, শাস্ত্র ও সঙ্গীত-শিক্ষার চতুষ্পাঠী ও সেই সঙ্গে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, বৃক্ষরোপণ, কূপখনন, পুষ্করিণী-প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ইষ্টাপূর্তের অনুষ্ঠান করিয়াছে; দেবমন্দির ও দেববিগ্রহ প্রতিষ্ঠাপূর্বক সমস্ত গ্রামকে একান্নবর্তী পরিবারের মত গড়িয়া তুলিবার জন্য যত্ন লইয়াছে ৷ রাজকীয় সাহায্য না লইয়াই পরস্পরের সহায়তায় তাহারা এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করিয়াছে ৷ ব্রাহ্মণ হইতে চণ্ডাল সকলেই — চণ্ডাল সকলেই— চরিত্রকেই মনুষ্যত্ব, সেবাকেই অবশ্য আচরণীয় ব্রত এবং অকপট ভক্তিকেই পুরুষার্থ জানিয়া জীবনগঠনে তৎপর হইয়াছে ৷ অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে আইনের প্রয়োজন হইল না । তথাকথিত অস্পৃশ্য ভুঁইমালী ঝড়ুঠাকুর মোহান্ত পদবী প্রাপ্ত হইলেন ৷ সপ্তগ্রামের অভিজাত বংশীয় গোবর্ধন দাসের জ্ঞাতিভ্রাতা কায়স্থ কালিদাস তাঁহার উচ্ছিষ্ট গ্রহণে দ্বিধা করিলেন না ৷ ব্রাহ্মণ আসিয়া বৈদ্য ও কায়স্থের পদবন্দনা করিলেন ৷ অনেকেই ইঁহাদের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ রাজকীয় সহায়তা নাই, আইনের বাধ্যতা নাই, অস্ত্রশস্ত্রের ঝন্‌ঝনা নাই, বলপ্রয়োগের ভীতি নাই, যেন কোন্‌ ঐন্দ্রজালিকের যাদুদণ্ডস্পর্শে বাঙ্গালার একটা মঙ্গলময় রূপান্তর ঘটিয়া গেল ৷ একজন কৌপীনসম্বল পুরুষের অঙ্গুলী হেলনে কোটী কোটী বাঙ্গালীর এই জাতীয় অভ্যুত্থান! বৃহত্তর ভারতের পটভূমিকায় ইহার আলোচনা হয় নাই ৷ তদানীন্তন বঙ্গের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনাপূর্বক সংস্কারমুক্ত মন লইয়া নিরপেক্ষ কোন ঐতিহাসিক শ্রীচৈতন্য-চরিত্রের পাঠোদ্ধারে ব্রতী হন নাই ৷ অথচ ইহার প্রয়োজনীয়তা আছে ৷
নিমাই পণ্ডিতের ঔদ্ধত্যের কথা বলিয়াছি; সে ছাত্র নিমাই, অধ্যাপক নিমাই ৷ এইবার সন্ন্যাসী নিমাই-এর যৎসামান্য পরিচয় দিতেছি ৷ নাম লইতে কোন বাধা-নিষেধ নাই, নাম লইতে লইতেই তুমি তৃণের মত নীচ হইবে, তরুর মত সহিষ্ণু হইয়া উঠিবে, অমানী মানদ হইয়া কৃতার্থতা লাভ করিবে, ইহাই ছিল মহাপ্রভুর উপদেশ ৷ এই আদর্শ তিনি নিজেও মান্য করিয়া চলিতেন ৷ মহাপ্রভু ছিলেন বিনয়ের খনি ৷ কিন্তু যথাস্থানে তাঁহার মধ্যে অধ্যাপক নিমাই জাগিয়া উঠিতেন ৷ (সুলতান) হুসেন শাহ প্রথম জীবনে বাঙ্গালায় আসিয়া ব্রাহ্মণ ভূস্বামী সুবুদ্ধি রায়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন ৷ সুবুদ্ধি রায় তাঁহাকে একটি পুষ্করিণীখননের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করিয়াছিলেন । কার্যে অবহেলা দেখিয়া কয়েকবার সাবধান করিয়া দিয়াও যখন দেখিলেন হুসেনের দায়িত্ববোধ নাই, তখন একদিন তাহাকে চাবুক মারিয়াছিলেন ৷ আঘাতের চিহ্নটা নাকি সুলতানীর জৌলুশেও ঢাকা পড়ে নাই ৷ তাই দেখিয়া বেগম ক্রোধান্বিতা হন ৷ বেগমের আদেশে বদনার জল রায় মহাশয়ের মুখে ছিটাইয়া সুলতান তাঁহার জাতি নষ্ট করেন ৷ নবদ্বীপের পণ্ডিতমণ্ডলী মহামান্য শক্তিশালী সুলতানের ক্রোধ হইতে আত্মরক্ষায় অক্ষম এই দুর্বল জমিদারের প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেন— উত্তপ্ত তরল স্বর্ণ পান করিয়া প্রনষ্ট জাতিত্বকে পুনরুদ্ধার করিতে হইবে ৷ অর্থাৎ জাতি বাঁচাইতে নিজেকে মরিতে হইবে । রায় মহাশয় হতাশ হইয়া জাতি বাঁচাইবার পাঁতি আনিতে ৺কাশীধামে গমন করেন ৷ কাশীর পণ্ডিতগণও অপর কোন বিধি খুঁজিয়া পান নাই ৷ এই সময় মহাপ্রভু কাশীতে গিয়া উপস্থিত হন ৷ সুবুদ্ধি রায় তাঁহার শরণাপন্ন হইলে তিনি নবদ্বীপ ও কাশীর পণ্ডিতগণের মতের প্রতিবাদ করিয়া সুবুদ্ধি রায়কে হরিনাম-গ্রহণে উপদেশ দেন ৷ জাতিচ্যুত লজ্জিত জমিদার দেশে ফিরিতে অস্বীকৃত হইলে মহাপ্রভু তাঁহাকে বলেন— তুমি হরিনাম লইয়া বৃন্দাবনে গিয়া বাস কর ৷ এক কৃষ্ণনামাভাসেই সর্বপাপ হইতে মুক্ত হইবে, এবং দ্বিতীয়বার কৃষ্ণনাম উচ্চারণেই কৃষ্ণপদে প্রেমলাভ করিবে ৷ যবন হরিদাসের শবদেহ কোলে তুলিয়া তিনি কীর্তনমণ্ডলীতে নৃত্য করিয়াছিলেন ৷ তাঁহার সম্মুখেই ভক্তগণ শবদেহের পাদোদক লইয়া পান করিয়াছিলেন ৷ তিনি অনুমোদন না করিলে ইহা সম্ভব হইত না ৷
প্রত্যেক ভক্তেরই তাঁহার নিকট যথাযোগ্য সমাদর ছিল ৷ বিদ্বান্‌ ভূস্বামী পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি অপেক্ষা খোলাবেচা শ্রীধরকে তিনি কম স্নেহ করিতেন না ৷ ভিক্ষুক শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর নিকট তিনি যাচিয়া অন্ন ভোজন করিয়াছিলেন ৷ শ্রীবাসের গৃহদাসী দুঃখীও তাঁহার কৃপালাভ করিয়াছিল ৷ তাঁহার ভক্তগণ আপন মহিমায় জনগণের শ্রদ্ধাভাজন হইয়াছিলেন ৷ এইজন্য মহাপ্রভু কোনদিন কাহাকেও প্রশ্রয় দান করেন নাই ৷ ব্রাহ্মণ ভক্তকে শূদ্র রায় রামানন্দের নিকট কৃষ্ণকথা শুনিতে পাঠাইয়াছিলেন ৷ টীকাকার শ্রীধরের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করায় তিনি সুপণ্ডিত বল্লভ ভট্টকেও তিরস্কার করিয়াছিন ৷ ভববন্ধনছেদন তীক্ষ্ণধার কর্তরী, অপ্রাকৃত ভক্তিরসঘন বল্লরী, অপার ভবজলধিতরম তরণীর তরুণ কাণ্ডারী, ভোগবিলাস-লালসা ধ্বংসকরণের অধিকারী প্রভৃতি দন্তাপসারী সন্দংশের কোন প্রয়োজনই তাঁহার দেখা দেয় নাই ৷ তাঁহার সম্প্রদায়ে কাষ্ঠকাটা জগন্নাথ, নির্লোম গঙ্গাদাস, খঞ্জ ভগবান, এমন কি কুষ্ঠী বাসুদেবও সমাদৃত হইয়াছিলেন ৷ এই নিয়মনিষ্ঠ সন্ন্যাসী একদিন কায়স্থ রঘুনাথ দাসের হস্ত হইতে জগন্নাথেদেবের পর্যুষিত অন্নপ্রসাদ কাড়িয়া খাইয়াছিলেন ৷ মৃগচর্মপরিহিত ব্রহ্মানন্দ ভারতী তাঁহারই প্রভাবে চর্মাম্বর ত্যাগে বাধ্য হইয়াছিলেন ৷ অদ্বৈত আচার্যের এক ভৃত্য আচার্যের ঈশ্বরত্ব জ্ঞাপনপূর্বক প্রতাপরুদ্রের নিকট অর্থভিক্ষা করায় মহাপ্রভু কয়েকদিন তাঁহার মুখদর্শন করেন নাই ৷ এমন কত উদাহরণ দিব? চৈতন্যচন্দ্রের কৌমুদীপ্লাবনে উচ্ছ্বসিত বাঙ্গালীর জীবনবন্যা বদ্ধজলার বাঁধ ভাঙ্গিয়া একদিন সাগরে গিয়া মিলিত হইয়াছিল ৷ সে প্রবাহ সম্প্রতি শুকাইয়া আসিতেছে ৷ সাগরের জোয়ারও আর তাহার মধ্যে প্রবেশ করে না ৷ তবে যে মহাপ্রভু বলিয়াছেন —
পৃথিবীর মাঝে আছে যত দেশ গ্রাম ৷
সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম ৷৷

সে দিন কি আসিবে না? মহাপ্রভুর এই মহাবাণী সত্য ও সার্থক করিবার মত মানুষ কি বাঙ্গালায় কেহ নাই?