প্রায় পাঁচ শত বৎসর গত হইয়া গেল, দেশে যে সমস্যা উদ্ভূত হইয়াছিল, আজিও তাহার নিরসর হয় নাই ৷ বরং সে দিনের অপেক্ষা আজিকার সমস্যা আরো জটিল, সমাধানের পথ আরো বিঘ্নবহুল— বাধাসঙ্কুল; অবস্থা সমধিক শোচনীয় ৷
তুর্কীগণ অল্পদিন হইল এ দেশে আসিয়াছে, কিন্তু এই অল্পদিনের মধ্যেই নবাগত বৈদেশিক সভ্যতা, আচার, ব্যবহার দেশকে উদ্‌ভ্রান্ত করিয়াছে, দেশবাসী ভোগবিলাসের মোহমদিরায় মজিয়া আত্মনাশের পথে দ্রুতগতিতে ছুটিয়াছে, তথাপি বিগত স্বাধীনতার মৃতসঞ্জীবনীধারা একেবার স্তব্ধ হইয়া যায় নাই ৷ হৃদয়-বিশেষে আপন স্বরূপে উত্তাল তরঙ্গে, কোথাও বা শীর্ণ স্রোতে, কোথাও বা ফল্গু প্রবাহে তখনো দেশকে সরস সজীব এবং সতেজ রাখিয়াছে ৷ তখনো বাঙ্গালার নৌবাট হীহী রব শত্রুর হৃদয়ে ভীতির স্পন্দন তুলিত ৷ তখনো বাঙ্গালীর করী তুরগ পদাতিক সৈন্যের প্রখর প্রতাপ দিল্লীর সুদুর্গম সম্রাট প্রাসাদে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিত ৷ গৌড় -সিংহাসন বিদেশীর করায়ত্ত হইলেও রাজ্যরক্ষা করিত বাঙ্গালী; তখনো সেনাপতি বাঙ্গালী, মন্ত্রী বাঙ্গালী, সৈন্যাধ্যক্ষ বাঙ্গালী; সিংহাসনের বত্রিশ পুত্তলিকা তখনো অতীত গৌরবে গর্বান্বিত ছিল, কাপুরুষের জড়ত্বে চৈতন্যহীন হয় নাই ৷ দনুজমর্দন, প্রতাপ, কেদার ইহার ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যঞ্জনা ৷
কিন্তু কাল তখন পরিবর্তিত হইয়াছে, দেশের রূপ বদলাইয়াছে, দেশবাসী জনসাধারণ নূতন পথে চলিয়াছে ৷ তাই দেশের দুর্দশায়, সমাজের বিশৃঙ্খলায় বিগলিতপ্রাণ সহৃদয় জনগণের নেত্রে যে নব গঙ্গোত্রীর প্রবাহ বহিয়াছিল, সুরধুনীতীরে নবদ্বীপে তাহারই পুঞ্জীভূত মূর্তি আকার পরিগ্রহ করিয়াছিলেন যুগাবতার শ্রীমন্‌ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবরূপে ৷ দেশ-কাল-পাত্রের উপযোগী, অথচ সর্বজনীন এবং চিরন্তন যে মহাবাণী তিনি প্রচার করিয়াছিলেন তাহাই এ যুগের একমাত্র সত্যবার্তা ৷
গত চারি শত বৎসর ধরিয়া বাঙ্গালীর জীবন নব নব প্রতিভায় বিকশিত হইয়াছে ৷ কিন্তু বাঙ্গালার দুর্ভাগ্য, জাতি কায়মনোবাক্যে সর্বান্তঃকরণ সেই মহাসত্য গ্রহণ করিয়া আজিও সাগর-সঙ্গমের সন্ধানে সমর্থ হয় নাই ৷ অভিশপ্ত সাগর-সন্তানগণ আজিও মুক্তিলাভে কৃতার্থ হইতে পারে নাই ৷
যাঁহারা বলেন ভগবান্‌ ভাষ্যকারের প্রচারিত মায়াবাদ দেশের সর্বনাশ করিয়াছে, যাঁহারা বলেন শ্রীচৈতন্য-প্রচারিত প্রেমধর্ম দেশের ক্ষাত্রশক্তিকে বিলুপ্ত করিয়াছে, তাঁহারা যুগধর্মের মর্মগ্রহণে সচেষ্ট হইয়াছেন কিনা জানি না ৷ বাঙ্গালার ভাগ্য-পরিবর্তনের আমূল কাহিনী যাঁহারা জানেন, অপ্রত্যাশিত ঘটনা পরম্পরায় মুক্তিকামী বাঙ্গালীর ক্ষাত্র-প্রচেষ্টার শোচনীয় বিফলতার ইতিকথা তাঁহারা অবগত আছেন ৷ তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া বলিবার প্রয়োজন নাই যে রুধির প্রসিদ্ধ স্বাধীনতা এদেশে একালের ধাতু-প্রকৃতির অনুকূল নহে, সে কালেও ছিল না ৷ আত্মশুদ্ধি না ঘটিলে, মনোভাব পরিবর্তিত না হইলে, যে কোন ধর্মাবলম্বীর দ্বারাই যে দেশের সর্বনাশ সংসাধিত হইতে পারে, ইতিহাসে তাহার প্রমাণের অভাব নাই ৷ কৃষ্ণচন্দ্র , মীরজাফর, জগৎশেঠ ইঁহারা যে বৈষ্ণব ছিলেন, ভরসা করি এমন কথা কেহ বলিবেন না ৷
অবশ্য, শুষ্ক আচারের কঙ্কালকে আঁকড়িয়া ধরিয়া হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করা, খোল করতালের সম্মিলিত রোলের সঙ্গে সঙ্গে ভাগবত প্রসঙ্গের ব্যঙ্গাত্মক প্রাণহীন উচ্চ চীৎকার করা, অথবা অন্তরে পূতিগন্ধ রাখিয়া বাহিরে দেহখানি কণ্ঠীতিলকে সুশোভিত করা যে ধর্ম নহে, এ কথা তো কেহ অস্বীকার করে না ৷ ত্যাগের ছদ্ম আবরণে ভোগের যে লালসাতুর বীভৎসতা সমাজের সর্বনাশ সাধন করিতেছে, বৈরাগ্যের গৈরিক বসনের অন্তরালে বিলাসের যে অভিনব সজ্জা দেশকে প্রলুব্ধ করিতেছে, ধর্মের নামে মঠমন্দির গড়িয়া প্রণামী-গ্রহণ, দীক্ষাদান প্রভৃতি যে ঘৃণিত ব্যবসায় শুরু হইয়াছে, ইহার সর্বতোভাবে উচ্ছেদসাধন যে সর্বাগ্রে বাঞ্ছনীয় এ কথা কে না বলিবে? কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেব তো ইহার জন্য দায়ী নহেন ৷
তাঁহার বাণী তো এ বার্তা প্রচার করে নাই ৷ তাঁহার উপদেশ সুস্পষ্ট; তিনি নিজের জীবনে আচরণ করিয়া, ভক্তদের দ্বারা আচরণ করাইয়া, সংসারী হইতে সন্ন্যাসী পর্যন্ত সকল শ্রেণীর মানবের শৃঙ্খল মুক্তির পথ নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন৷ অধিকার এবং রুচি-ভেদে ঋজু -কুটিল নানা পথবৈচিত্র্যের কথা গোদাবরীতীরে রায় রামানন্দের সঙ্গে আলোচনায় বেশ পরিষ্কার ব্যাখ্যাত হইয়াছে ৷ আজ তাহার প্রয়োজন আছে কিনা জানি না, তবে অসাম্প্রদায়িক ভাবে কালোপযোগী প্রণালীতে এই সমস্ত বিষয় যে বিশদরূপে আলোচিত হওয়া উচিত এইরূপই আমাদের বিশ্বাস ৷
আমি দিগ্‌দর্শন হিসাবে মহাপ্রভুর অভিন্নহৃদয় সহচর অক্রোধ পরমানন্দ শ্রীনিত্যানন্দদেবের জীবনী সম্বন্ধে কিছু বলিতেছি৷
শ্রীনিত্যানন্দদেব — বীরভূমের একচক্র গ্রাম তাঁহার জন্মস্থান ৷ পিতার নাম হাড়াই পণ্ডিত, মাতার নাম পদ্মাবতী ৷ নিত্যানন্দের বয়স যখন দ্বাদশ বৎসর, সেই সময় একজন সন্ন্যাসী একচক্রায় আসিয়া আপনার পথের সঙ্গী করিবার জন্য এবং সেবা-শুশ্রূষার জন্য হাড়াই পণ্ডিত ও পদ্মাবতীর নিকট তাঁহাদের এই পুত্রটিকে ভিক্ষাগ্রহণ করেন ৷ সেকালের গৃহস্থের এই আতিথেয়তা ও দ্বাদশ বৎসরের বালকের এই পিতৃ-মাতৃভক্তি বৈষ্ণব কবিগণের লেখনীকে পবিত্র করিয়াছে ৷ কিন্তু একালে তাহার স্থান কোথায়? সন্ন্যাসী একচক্রা ত্যাগ করিলেন ৷ বালক নিতাই অজানা পথে সেই অচেনা যাত্রীর সঙ্গী হইলেন ৷ তাহার পর কত দিন গেল, কত দেশ-দেশান্তর ফিরিতে হইল; কালে সেই সন্ন্যাসীর লোকান্তর ঘটিল ৷ অতঃপর একদিন শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরী তাঁহাকে উপদেশ দিলেন — তুমি নবদ্বীপে যাও ৷ নিতাই নবদ্বীপে আসিলেন ৷ শ্রীচৈতন্যদেব তাঁহাকে অগ্রজের মর্যাদায় গ্রহণ করিলেন ৷
শ্রীবাস অঙ্গনে তখন নামকীর্তন শুরু হইয়াছে, এইবার নদীয়ার রাজপথে প্রকাশ্যভাবে প্রচারকার্য আরম্ভ হইল ৷ এই কার্যে অগ্রবর্তী হইলেন হরিদাস এবং নিত্যানন্দ ৷ একজন বিশ্বাসের জ্বলন্ত মূর্তি এবং সহিষ্ণুতার অবতার, আর একজন অক্রোধ পরমানন্দ করুণার সাকার বিগ্রহ ৷ ধর্মকে কেমন করিয়া জীবনের সঙ্গে গ্রহণ করিতে হয়, স্বীয় মতের উপর কিরূপ সুদৃঢ় নিষ্ঠা থাকিলে তাহা সর্ববিধ বিরুদ্ধতাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়, ব্রহ্ম হরিদাসের জীবন তাহার উজ্জ্বল উদাহরণ ৷ ক্ষমতা-বিষমত্তের উদ্যত ফণা কিরূপে করুণার মন্ত্রে শান্ত করিতে হয়, অত্যাচারের দৃপ্ত দাবানল আপনার শোণিতদানে কেমন করিয়া নির্বাপিত করিতে হয় জগাই-মাধাই -এর উদ্ধারে নিত্যানন্দের আচরণ তাহার সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ৷
অধুনা সমাজ-সংস্কারের কথা উঠিয়াছে ৷ দেশের উন্নতিকল্পে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ রাষ্ট্রনৈতিক প্রচেষ্টার অঙ্গ বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে৷ কিন্তু সুনির্দিষ্ট-পন্থা, উপযুক্ত কর্মী, এবং জাতীয় প্রকৃতির অনুকূল প্রণালীবদ্ধ কার্যের অভাবে যে তাহা সফল হইতেছে না সেদিকে তো কাহারো দৃষ্টি দেখিতেছি না ৷ শহরের বুকে সভা বসাইয়া উচ্চ চীৎকারে আকাশ কাঁপাইয়া এবং পংক্তিতে বসিয়া বিংশতি মুদ্রার মিষ্টান্ন গলাধঃকরণে যে অস্পৃশ্যতা দূরীভূত হয় না, ইহা বুঝিবার লোক যদি বাঙ্গালায় না থাকে, তবে তাহা অপেক্ষো দুর্ভাগ্যের বিষয় কি হইতে পারে! এই চৌরস পথটি হয়তো রাজনৈতিক চালবাজীর অথবা খ্যাতি ও অর্থ উপার্জন প্রভৃতি কার্যসিদ্ধির পক্ষে প্রশস্ততর হইতে পারে, কিন্তু সমাজের সংবাদ যাঁহারা জানেন তাঁহারাই বলিবেন সম্পূর্ণ কার্যসিদ্ধির একমাত্র সহায়ক খ্যাতিহীন পল্লীবাসীর সঙ্গে ইহার কোন সংস্রব নাই ৷ সাধুজনের করণীয় আছে, অবশ্য স্বীকার করি, তথাপি একজন অসাধুকে তুমি অসাধু নও বলিয়া আলিঙ্গন দিলেই যে তাহার অসাধুতা অন্তর হইতে অন্তর্হিত হইয়া যায় ইহা স্বীকার করিতে পারি না ৷
যে অস্পৃশ্য তাহাকে আপনার অস্পৃশ্যতা আপনি দূর করিতে হইবে, শিক্ষায়, চরিত্রে, আচারে, ব্যবহারে আপনাকে মানুষ করিয়া তুলিতে হইবে ৷ অবশ্য সেজন্য অগ্রগামীদিগের সাহায্যের ও সহানুভূতির বিশেষ আবশ্যক ৷ নতুবা আমলাতন্ত্রের ভেদনীতির সুযোগ গ্রহণ করিয়া এক পক্ষ যদি দাবী করিয়া বসেন, কিংবা অপর পক্ষ যদি কার্যসিদ্ধির জন্য হীনতর আপোষে মিলন রচনা করেন তাহাতে অস্পৃশ্য-স্পৃশ্য উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন ৷
মিলন হয় সমানে সমানে, পরস্পরের যোগ্যতাই পরস্পরকে সখ্যসূত্রে আবদ্ধ করিয়া থাকে৷ আপনার দুর্বলতা বুঝিয়া নিজেকে সংশোধন করিয়া তবে অন্যের সম্মুখীন হইতে হইবে, এ কথা উভয় পক্ষ হইতে বলা যাইতে পারে ৷ চোরের দলে ভিড়িয়া সাধুও চোর হইয়া যায়, আবার সাধুর সংসর্গে চোরও সাধুতা লাভ করে ৷ সুতরাং সমাজ-শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে হইলে এরূপ ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া উচিত ৷ অনেকেই জানেন, তথাকথিত অনাচরণীয় সম্প্রদায়ের সুবর্ণবণিক-জাতীয় উদ্ধারণ দত্ত মহাশয় গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে শ্রদ্ধায় আজিও দ্বাদশ গোপালের অন্যতম বলিয়া পূজাপ্রাপ্ত হন ৷ উদ্ধারণ দত্ত শ্রীনিত্যানন্দের প্রিয়তম ভক্ত ছিলেন ৷ কবি বলিতেছেন —
অবধৌত নাহি ছিল জাতির কথাটী,
উদ্ধারণ দত্ত যাঁর ভালে দয়ে কাঠী ৷
উদ্ধারণকে তিনি এতই স্নেহ করিতেন ৷ কিন্তু এই উদ্ধারণ দত্ত অথবা যে তথাকথিত নীচ জাতীয় ‘ঝারু ঠাকুর’ আজিও সমগ্র বৈষ্ণব সমাজে সম্মানিত, তাঁহার কথা ছাড়িয়া দিলেও বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই, যাহা হইতে বুঝিতে পারা যায় যে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের প্রকৃত অধিকারী কে ৷ কেমন করিয়া সমাজের অস্পৃশ্যতা দূর করিতে হয়, সে স্পর্শমণি তোমার হৃদয়ে আছে কি, যাহার স্পর্শে লৌহ কাঞ্চনে পরিণত হইবে? সে চরিত্রবল তোমার কোথায় যাহার যাদুদণ্ড আমার সমস্ত দৈন্য, সমস্ত হীনতা মুছিয়া ফেলিয়া আমাকে মনুষ্যত্বলাভের উদ্বুদ্ধ করিবে ? এ নিবন্ধে আমরা বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করিতেছি না, আমাদের বলিবার উদ্দেশ্য ইহাই যে যদিও ধনী দরিদ্র এবং তথাকথিত শিক্ষিত অশিক্ষিত লইয়া সমাজে নব জাতিভেদের সৃষ্টি হইয়াছে, কাঞ্চনকৌলন্য বিস্তারলাভ করিয়াছে, তথাপি গুণের পূজা আজিও একেবারে লুপ্ত হয় নাই ৷ গুণবান্‌ সজ্জন ব্যক্তি যে জাতীয় হউন, পল্লীসমাজে তিনি কখনো অনাদৃত হইয়াছেন বলিয়া শুনি নাই ৷ সুতরাং এ কার্যে অগ্রসর হইতে হইলে আপন অন্তরের সর্ববিধ অস্পৃশ্যতা সর্বাগ্রে দূর করিতে হইবে ৷ যে অস্পৃশ্য আছে, সমাজে তাহাকে অন্তরে বাহিরে সকল রকমে মানুষ করিয়া তুলিতে হইবে ৷ প্রচুর রজতমুদ্রা না দিলে স্বজাতীয়া সুন্দরী একটি কৃষ্ণাঙ্গী বালিকা যদি বর্ণদোষেই আমার নিকট অস্পৃশ্য বলিয়া পরিগণিত হয়, তবে অন্য জাতির অস্পৃশ্যতা নাশে অগ্রসর হওয়া আমার ধৃষ্টতা ভিন্ন আর কি হইতে পারে ? একত্র ভোজনে যদি অস্পৃশ্যতা দূর হইত তাহা হইলে এতদিন তাহার অস্তিত্ব থাকিত না, কারণ ছত্রিশ জাতি মিলিয়া আশ্রম বিশেষে গিয়া বাবুর্চি নামধেয় সূপকার -পাচিত ভোজ্য গ্রহণে আমরা অনেকদিন হইতেই অভ্যস্ত হইয়াছি, কিন্তু সমাজের অস্পৃশ্যতার পাপ সে দিনেও যেমন ছিল, আজিও তো তেমনি রহিয়াছে ৷
সমাজের প্রকৃত সংস্কারকার্য সে কালে কত দূর অগ্রসর হইয়াছিল, শ্রীনিত্যানন্দ-প্রমুখ শ্রীচৈতন্যপার্ষদগণ তাহাতে কিরূপ কৃতকার্য হইয়াছিলেন, ইতিহাসে তাহার অনেক কাহিনী উল্লিখিত আছে ৷ শ্রীনিত্যানন্দের জীবনের অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি ৷ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নীলাচলে অবস্থান করিতেছেন ৷ বিরহের অসহ আকুলতায় প্রাণ তাঁহার অধীর হইয়া উঠিয়াছে, কানু-প্রেমবিষে অন্তর জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিতেছে ৷ দিন যায়, রাত্রি আসে; আহার নাই, নিদ্রা নাই, মুখে শুধু কৃষ্ণ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ ধ্বনি ৷ সন্ন্যাস-ক্লিষ্ট গোরা-তনু দিন দিন ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে ৷ কষিত কাঞ্চনকান্তি মলিন হইয়া গিয়াছে, ভক্তগণের উৎকণ্ঠার আর অবধি নাই ৷ রায় রামানন্দ, স্বরূপ দামোদর নিশিদিন বিনিদ্র নয়নে পাশে বসিয়া অবিরাম কৃষ্ণনাম শুনাইয়া তাঁহাকে ভুলাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন ৷
এমনি একদিন মহাপ্রভু—

বিরলে নিতাই লইয়া হাতে ধরি বসাইয়া
মধুর কথা কহে ধীরে ধীরে ৷
জীবেরে সদয় হঞা হরিনাম লওয়াও গিঞা
যাও নিতাই সুরধুনী তীরে ৷৷
নিত্যানন্দকে সংসারে ফিরিয়া দার-পরিগ্রহের অনুরোধ করিলেন ৷ নিত্যানন্দের মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল ৷ এতদিন পরে আজ তোমার এ কি আদেশ প্রভু ! তুমি কেন তবে সন্ন্যাসী হইলে! প্রেমময়ী গুণবতী ভার্যা, স্নেহময়ী মাতা, অমানুষী প্রতিভা, অসাধারণ শাস্ত্রর্থ-জ্ঞান ৷ অলৌকিক রূপলাবণ্য , অতুলনীয় যশ খ্যাতি, গুণমুগ্ধ আত্মীয়স্বজন ভক্ত বন্ধু, তোমার কিসের অভাব ছিল, নিষ্ঠুর ! যৌবনে যুবতী ভার্যা পরিত্যাগ করিয়া অভাগিনী বিষ্ণুপ্রিয়ার শিরে বাজ হানিয়া — জননীর নয়নের মণি তুমি, বিশ্বরূপের শোকে পাগলিনী, স্বামীর শোকে মর্মপীড়িতা স্থবিরাক কাঁদাইয়া তুমি কেন সংসার ছাড়িলে ৷ আর আমি আকুমার সংসারত্যাগী, আমার প্রতি তোমার এই আদেশ ! প্রভু তাঁহাকে বুঝাইতে লাগিলেন —
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি আপনার মুখে ৷
মূর্খ নীচ দরিদ্র ভাসাব প্রেম সুখে ৷৷
তুমিও রহিলে যদি মুনি ধর্ম ধরি ৷
আপন উদ্দাম ভাব সব পরিহরি ৷৷
তবে মূর্খ নীচ যত পতিত সংসার ৷
বল দেখি আর কেবা করিবে উদ্ধার ৷৷
ভক্তিরস দাতা তুমি তুমি সম্বরিলে ৷
তবে অবতার তুমি কেনে বা করিলে ৷৷
এতেক আমার বাক্য সত্য যদি চাও ৷
তবে অবিলম্বে তুমি গৌড়দেশে যাও ৷৷
মূর্খ নীচ পতিত দুঃখিত যত জন ৷
ভক্তি দিয়া কর গিয়া সবার মোচন ৷৷

নিত্যানন্দ ভাবিতে লাগিলেন— সন্ন্যাসী হইয়া কি করিয়া এমন কাজ করিব! চিরদিনের তরে এ কলঙ্ক-পশরা শিরে না তুলিয়া দিলে কি তোমরা তৃপ্তি হইতেই না ! লোকে কি বলিবে বল দেখি — পরছিদ্রান্বেষী সমাজ ! তাহার উপর ধৌত শুক্ল বস্ত্রে মসীবিন্দুর মত সন্ন্যাসীর আচার-ভ্রংশতা তো সহজেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে ৷ কিন্তু আর তো প্রতিবাদের উপায় নাই, চিন্তা করিয়া কোন ফল নাই; আদেশ যখন, তখন যাইতেই হইবে ৷ নিত্যানন্দ সেই আদেশ গ্রহণ করিলেন ৷ জীবনের আজন্মপোষিত কামনার সঙ্গে ব্রহ্মচর্যের ধারণা, সন্ন্যাসের সাধনা সমুদ্রসৈকতে প্রভুপদে বিসর্জন দিয়া, প্রাণাপেক্ষা প্রিয় শ্রীগৌরাঙ্গ-সঙ্গ চিরতরে পরিত্যাগ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তিনি বাঙ্গালার পথে অগ্রসর হইলেন ৷
শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরী, শ্রীঈশ্বর পুরী, শ্রীলক্ষ্মীপতি পুরী, শ্রীকেশব ভারতী প্রভৃতি বাঙ্গালী সন্ন্যাসীগণের নাম ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ৷ তদানীন্তন গৌড়েশ্বর-সম্রাট্‌ হুসেন শাহের অন্যতম সচিব ও ধনাধ্যক্ষ শ্রীরূপ-সনাতন ভ্রাতৃদ্বয়ের তীব্র বৈরাগ্য আজিও ত্যাগী সন্ন্যাসীর আদর্শস্থল হইয়া আছে ৷ সপ্তগ্রামের ধনকুবের-পুত্র যুবক রঘুনাথ দাসের সংসারত্যাগ-কাহিনী আজিও লোকলোচনে অশ্রুসঞ্চার করে ৷ সুতরাং সে কালে শ্রীনিত্যানন্দের প্রৌঢ় বয়সে এই সংসারে প্রত্যাবর্তন যে কত বড় মহত্ত্ব, কি অপরিসীম ত্যাগস্বীকার, কি অপূর্ব দাস্য ও নিষ্ঠার পরিচায়ক, এ কালের অনেকে তাহা বুঝিতে পারিবেন কিনা সন্দেহ ৷
নিত্যানন্দদেবও শিখা এবং যজ্ঞসূত্র ত্যাগ করিয়াছিলেন, কিন্তু আচার্য শঙ্কর-প্রবর্তিত দশনামী সম্প্রদায়ের নিদর্শন যোগপট্ট গ্রহণ করেন নাই৷ যাহা হউক , সমাজ তাঁহাকে গ্রহণ করিতে দ্বিধা করিল না ৷ অম্বিকা -নিবাসী সূর্যদাস সরখেল মহাশয় আপনার বসুধা এবং জাহ্নবী নাম্নী দুই কন্যাকে নিত্যানন্দের করে সমর্পণ করিয়া কৃতার্থ হইলেন ৷ কুলাচার্যগণ নিত্যানন্দকে বটব্যাল নাম পরিচিত করিয়াছেন ৷ জাহ্নবীদেবী নিঃসন্তান ছিলেন ৷ বসুধার গর্ভে নিত্যানন্দের বীরচন্দ্র নামে এক পুত্র এবং গঙ্গা নাম্নী এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেন ৷ বিবাহের পরে পত্নীসহ নিত্যানন্দ খড়দহে গিয়া বাস করিয়াছিলেন ৷ অতঃপর কখনও তিনি জন্মভূমি একচক্রায় আসিয়াছিলেন কিনা জানিতে পারা যায় না ৷ একচক্রা গ্রামে বীরচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত শ্রীবঙ্কিম রায় বিগ্রহ আজিও প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছেন ৷ নিত্যানন্দের তিরোভাবের পর জাহ্নবী দেবীই তদানীন্তন বৈষ্ণবসমাজের নেত্রীস্থানীয়া ছিলেন ৷ এই মহীয়সী মহিলার পবিত্রতম জীবন, মহান্‌ আদর্শ এবং বহুমূল্য উপদেশ শ্রীচৈতন্যদেবের পদাঙ্কিত পথে বৈষ্ণব-সমাজকে বহুদূর অগ্রসর করিয়া দিয়াছিল ৷ ইনি যখন শ্রীধাম বৃন্দাবন -দর্শনে গমন করেন, বৃন্দাবনস্থ শ্রীজীব গোস্বামী প্রমুখ বৈষ্ণবমণ্ডলী তখন বিশেষ ভক্তিসহকারে পরম সমাদরে ইঁহার অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন ৷
বৃন্দাবন হইতে প্রত্যাবর্তনের পর খেতরীর বৈষ্ণব-সম্মেলনে নেত্রীত্ব করিয়া যাজীগ্রাম যাইবার পথে জাহ্নবী দেবী একবার একচক্রায় আগমন করেন ৷ সে সময় কৃষ্ণদাস সরখেল,মাধব আচার্য, রঘুপতি বৈদ্য, মনোহর উপাধ্যায়, পরমেশ্বরী দাস, মুকুন্দ প্রভৃতি দেবীর অনুযাত্রী ছিলেন ৷ পুত্র বীরচন্দ্র ইঁহারই নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়া — পিতৃপদাঙ্ক অনুসরণে শ্রীচৈতন্যদেবের অভীপ্সিত কার্যসম্পাদনে জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন ৷ বীরচন্দ্রের সে কার্যের সহায় ছিলেন ঠাকুর নরোত্তম, আচার্য শ্রীনিবাস এবং প্রভু শ্যামানন্দ ৷