শ্রীপুরুষোত্তম আচার্য্যে পিতার নাম পদ্মগর্ভাচার্য ৷ শ্রীহট্টের অন্তর্গত ভিটাদিয়া গ্রামে পিতৃনিবাস ৷ নবদ্বীপের শ্রীজয়রাম চক্রবর্তী আপন কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিয়া পদ্মগর্ভকে নবদ্বীপে লইয়া আসেন ৷ পুরুষোত্তম নবদ্বীপেই জন্মগ্রহণ করেন ৷ পুরুষোত্তমের জন্মের পর পত্নী-পুত্রকে নবদ্বীপে রাখিয়া পদ্মগর্ভ অধ্যয়নের জন্য প্রথমে মিথিলা, পরে কাশীধামে উপস্থিত হন ৷ শ্রীল মাধবেন্দ্রের গুরুদেব শ্রীপাদ লক্ষ্মীপতি পুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে পদ্মগর্ভ লক্ষ্মীপতির নিকট দীক্ষিত হইয়া ভিটাদিয়ায় ফিরিয়া যান ৷ ভিটাদিয়ায় তিনি পুনরায় বিবাহ করিয়াছিলেন ৷ এই পত্নীর নাম কমলা ৷ কমলার গর্ভে পদ্মগর্ভের যে পুত্র জন্মে তাঁহার নাম লক্ষ্মীনাথ ৷ মনে হয়, গুরুদেব লক্ষ্মীপতির নাম অনুসারে লক্ষ্মীনাথ নাম রাখা হইয়াছিল ৷ মাতামহের গৃহে প্রতিপালিত পুরুষোত্তম নিমাই পণ্ডিতের বাল্যবন্ধু৷ সেইজন্য পূর্ববঙ্গ ভ্রমণকালে নিমাই পণ্ডিত পুরুষোত্তম কনিষ্ঠ লক্ষ্মীনাথের গৃহে দুই-একদিন অবস্থান করিয়াছিলেন ৷
শ্রীগৌরাঙ্গদেব সন্ন্যাস গ্রহণ করিলে পুরুষোত্তম মনের দুঃখে কাশীধামে গিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করেন ৷ সন্ন্যাস-গ্রহণের সময় দীক্ষিত শিষ্যকে দশনামী সম্প্রদায়ের গিরি, পুরী, ভারতী প্রভৃতি আপন আপন গুরুর উপাধি গ্রহণ করিতে হয় ৷ এই উপাধি গ্রহণের সময় স্ব স্ব সম্প্রদায়-প্রচলিত প্রথামত একখণ্ড বস্ত্র (যোগপট্ট) পৃথক্‌ পৃথক্‌ ছান্দে শিষ্যের দেহের ঊর্দ্ধাংশে কণ্ঠ বক্ষ ও পৃষ্ঠে বাঁধিবার বিধি আছে ৷ যোগপট্ট গ্রহণের পর শিষ্য গুরুর উপাধি গ্রহণ করেন, তৎপূর্বে নহে ৷ পুরীর শিষ্য পুরী, তীর্থের শিষ্য তীর্থই রহিবেন, ইহাই নিয়ম ৷ পুরুষোত্তম সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু যোগপট্ট গ্রহণ করেন নাই ৷ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে উল্লিখিত আছে —
সন্ন্যাস করিল শিখা সূত্র ত্যাগরূপ ৷
যোগপট্ট না লইল নাম হইল স্বরূপ ৷৷

পুরুষোত্তম সন্ন্যাস লইলেন, নাম হইল দামোদর ৷ কিন্তু যোগপট্ট না লওয়ায় স্বরূপ দামোদর নাম হইল ৷ শ্রীপাদ নিত্যানন্দও সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু যোগপট্ট না লওয়ায় তিনিও নিত্যানন্দ স্বরূপ নামে অভিহিত হইতেন ৷ নিত্যানন্দ অবধূত সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন ৷ ব্রহ্মাবধূত, শৈবাবধূত, ভৈরবাবধূত, শাক্তাবধূত,বৈষ্ণবাবধূত ইত্যাদি অবধূতের সম্প্রদায়ভেদ আছে ৷

কাশীধামের গুরু শ্রীচৈতন্যানন্দ স্বরূপকে বেদান্ত পড়াইতেছিলেন ৷ কিন্তু শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ দামোদরকে উত্যক্ত করিয়া তুলিল ৷ তিনি পুরীধামে শ্রীমহাপ্রভুর পদপ্রান্তে আসিয়া উপস্থিথ হইলেন। কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে দামোদরের কথা বলিতে গিয়া বলিয়াছেন —

কৃষ্ণ রস তত্ত্ব বেত্তা দেহ প্রেমরূপ ৷
সাক্ষাৎ মহাপ্রভুর দ্বিতীয় স্বরূপ ৷৷

আবাল্য পরিচিত বন্ধু, বন্ধুকে বড় মর্যাদার চক্ষে দেখেন না ৷ একসঙ্গে খাওয়া-শোওয়া ওঠ-বসা— পরস্পর পরস্পরকে ভালভাবেই জানেন ৷ এই জন্যই মর্যাদার কোন প্রশ্ন থাকে না ৷ কিন্তু সে বন্ধুই যদি অকপটে একজন আর একজনের মহত্ত্ব স্বীকার করেন— শুধু মহত্ত্ব স্বীকার নহে, পরমেশ্বরবুদ্ধিতে একেবারে পদপ্রান্তে প্রণত হন, তবে তাহার প্রামাণ্য যে শতশাস্ত্র প্রমাণ হইতেও অধিকতর গুরুত্বসম্পন্ন, এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে ৷ কোন স্বার্থ নাই, কোন অভিসন্ধি নাই; কোন হেতু নাই, কোন প্ররোচনা বা প্রলোভন নাই, সুতরাং নিষ্কিঞ্চনের এই স্বীকৃতির মূল্য প্রচুর ৷
স্বরূপ দামোদর প্রকাণ্ড পণ্ডিত, অনন্যসাধারণ রসবেত্তা, অধ্যাত্মশাস্ত্রের তথ্য ও তত্ত্বে তাঁহার অসামান্য অধিকার ৷ স্বরূপ দামোদর মহানুভব ৷ যে ঋষি-সম্প্রদায় ব্রহ্মকে রসস্বরূপ বলিয়া, মধু বলিয়া, ভূমা বলিয়া, আনন্দ বলিয়া জানিয়াছিলেন ও জানাইয়াছিলেন, স্বরূপ দামোদর সেই ঋষিকুলেরই যোগ্যতম উত্তরাধিকারী ৷ এই সত্যদ্রষ্টা মহাপ্রভুর বিষয়ে বলিয়াছেন —
শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কীদৃশো বানয়ৈবা
স্বাদ্যো যেনাদ্ভুতমধুরিমা কীদৃশো বা মদীয়ঃ ৷
সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কীদৃশং বেতি লোভাৎ
তদ্ভাবাঢ্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ ৷৷
উদ্ধৃত শ্লোকে লক্ষ্য করিবার বিষয় দুইটি—শ্রীরাধার প্রণয়-মহিমা, আর শ্রীকৃষ্ণের মদীয় মধুরিমা ৷ বুঝিতে কোন বাধা নাই যে, শ্রীরাধার প্রণয়মাধুর্য শ্রীকৃষ্ণ আস্বাদন করিয়াছিলেন শ্রীবৃন্দাবনে৷ ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই সেই প্রণয়ের মহিমায় ৷ শ্রীকৃষ্ণ আপন মাধুর্যের কথা আপনি জানেন না; বরং স্বমহিমার কথাটা কিছু কিছু তাঁহার জানা আছে ৷
শ্রীপাদ স্বরূপ দামোদরের পূর্বে এমন সুস্পষ্টভাবে গৌরাঙ্গাবতারের গূঢ় রসহ্য কেহ ব্যক্ত করেন নাই ৷ মহাপ্রভুকে ভূতলে অবতারিত করিবার একতম কারণ শ্রীল অদ্বৈত আচার্য ৷ আচার্যই তাঁহাকে আনিয়াছিলেন, তাঁহাকে চিনাইয়াও দিয়াছেন ৷ যে দিন সন্ন্যাসী গৌরহরি সন্ন্যাস-গ্রহণের পর প্রথম শান্তিপুরে শুভাগমন করিলেন শ্রীল অদ্বৈতমন্দিরে, অবতারের নব রঙ্গমঞ্চে অবতরণের নান্দীপাঠ করিলেন আচার্য —
কি কহব রে সখি আনন্দ ওর ৷
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর ৷৷
বৈকুণ্ঠের নারায়ণ নহেন, ইনি বৃন্দাবনের মাধব ৷ শ্রীবাস অঙ্গনেরই নাটুয়া ইনি, কিন্তু এ নর্তকের এই নূতনতম লীলানাট্যের নিগূঢ় ইঙ্গিতটি আচার্য নিজ মন্দিরে নিজ মুখেই প্রকাশ করিলেন ৷ তবে সে ইঙ্গিত বুঝিবার সামর্থ্য সকলের ছিল না ৷ তাই স্বরূপ দামোদরকে এই পরিচয়ের ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছিল ৷ অতঃপর যাঁহারা জানিয়াছেন, তাঁহারা স্বরূপ দামোদ-কথিত পরিচয়ের সূত্র ধরিয়াই অগ্রসর হইয়াছেন ৷ অবশ্য চিনিয়াছেন জানিয়াছেন আপন আপন অনুভূতির সহায়তায়, কিন্তু অনুভরে পথ-প্রদর্শক স্বরূপ দামোদর৷
শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্নিহিত অভিলাষ— শ্রীরাধার প্রণয়-মহিমা কেমন, শ্রীরাধা আমার যে মাধুর্য আস্বাদন করেন, সে মাধুর্য কেমন, আর সেই মাধুর্য আস্বাদন করিয়া শ্রীরাধা যে আনন্দ পান সে আনন্দ কেমন— এই তিনটি বস্তু আস্বাদন করিবার জন্যই রাধা-ভাবাঢ্য— শ্রীরাধার ভাবে বিভাবিত, রাধাভাবে ধনী, শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র শচীগর্ভসিন্ধু হইতে সমুদিত হইয়াছেন ৷ ব্রজে শ্রীরাধার প্রেমমাধুর্য তাঁহাকে যে ঋণে বন্দী করিয়াছিল, উক্ত তিন বস্তুর আস্বাদন সে ঋণ-পরিশোধেরই নামান্তর ৷ বিশ্বের ঋণভার নিজ মস্তকে গ্রহণপূর্বক সমগ্র বিশ্বের প্রতিনিধি বিশ্বেশ্বর আপনি এই ঋণ পরিশোধের জন্য প্রাণ পণ করিয়াছেন ৷ দেবঋণ, ঋষিঋণ, পিতৃঋণ পরিশোধের দায়িত্ব যাঁহাদের স্মরণে ছিল, তাঁহারাও এই আনন্দের ঋণের কথা জানিতেন না— এই অপরিশোধ্য ঋণপরিশোধের চেষ্টা না করিলে যে প্রত্যবায় আছে, সে কথা বুঝিতে পারিতেন না ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভু সেই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন ও বিশ্ববাসীকে এই ঋণের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন, ঋণ-পরিশোধের পথ দেখাইয়াছিলেন, ইহাই মহাপ্রভুর চির-অনর্পিত বস্তু দানের মহাবদান ৷
কেমন করিয়া এই ঋণ পরিশোধ করিতে হইবে, মহাপ্রভু তাহারও উপায় নির্দেশ করিয়াছেন ৷ এই ঋণ অপরিশোধ্য, পরিশোধিত হয় না ৷ বিশ্বের নরনারীকে এই দায় গ্রহণ করিতে হইবে ৷ হয়তো তাহা হইলে এই ঋণের কিয়দংশ পরিশোধিত হইতে পারে ৷