হালিশহরের শতানন্দ খান একজন বিষয়ী ব্যক্তি ছিলেন ৷ ইনি জাতিতে ব্রাহ্মণ; উপাধি দেখিয়া মনে হয় গৌড়-দরবারে ইঁহার প্রতিপত্তি ছিল ৷ ‘খান’ ইঁহার সুলতান-দত্ত উপাধি ৷ ইঁহারই জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীল ভগবান্‌ আচার্য, পণ্ডিত এবং ভক্ত ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর সন্ন্যাস-গ্রহণের পর মহাপ্রভুর সান্নিধ্যলাভের আশায় ইনি পুরীধামে আসিয়া বাস করেন ৷ মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ পার্ষদ শ্রীল স্বরূপ দামোদরের সঙ্গে ভগবান্‌ আচার্যের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল ৷ শতানন্দ খান বিষয়ী হইলেও বিদ্যানুরাগী ছিলেন ৷ কনিষ্ঠ পুত্র গোপালকে তিনি বেদান্ত অধ্যয়নের জন্য কাশীধামে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন ৷ সেকালের ইহা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৷
শ্রীভগবান্‌ আচার্য মাঝে মাঝে মহাপ্রভুকে ভিক্ষা -গ্রহণে আমন্ত্রণ করিতেন ৷ একদিন এইরূপ আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন ৷ কিছু ভাল চাউলের প্রয়োজন ৷ মহাপ্রভুকে মাঝে মাঝে কীর্তন শুনাইতেন সুকণ্ঠ ছোট হরিদাস ৷ আচার্যের বিশেষ অনুগত তিনি ৷ আচার্য ছোট হরিদাসকেই পাঠাইলেন শ্রীমতী মাধবী দেবীর নিকট চাউল আনিতে ৷ মাধবী ছিলেন পুরীর সম্ভ্রান্ত সজ্জন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের চিহ্নিত সেবক শ্রীশিখি মাহিতির ভগিনী ৷ সেদিন মহাপ্রভু ‘গণ’ মধ্যে সাড়ে তিনজনের সবিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল ৷ স্বরূপ দামোদর, শ্রীরায় রামানন্দ ও শিখি মাহিতি এই তিনজন, আর রমণী বলিয়া মাধবী দেবী অর্ধজন ৷ ছোট হরিদাস এ হেন একজন ভগবদ্‌ভজনপরায়ণা বর্ষিয়সী মহিলার নিকট গিয়া চাউল আনিয়াছিলেন ৷
রন্ধনাদি শেষ হইয়াছে, আচার্য জগন্নাথদেবের কিছু মহাপ্রসাদও আনাইয়াছেন ৷ মহাপ্রভু আসিয়া ভোজনে বসিলেন ৷ উৎকৃষ্ট অন্নের প্রশংসা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— এমন সুন্দর চাউল কোথায় পাইলে? আচার্য বলিলেন—মাধবী দেবীর নিকট হইতে আনাইয়াছি ৷ মহাপ্রভুর প্রশ্ন, কে আনিয়াছে ? আচার্য উত্তর করিলেন, ছোট হরিদাস ৷ ভোজনান্তে গম্ভীরায় আসিয়া মহাপ্রভু গোবিন্দকে বলিলেন, — ছোট হরিদাসের ‘দ্বারমানা’, আজি হইতে তাহাকে আর এখানে আসিতে দিও না ৷ বৈষ্ণব হইয়া প্রকৃতি সম্ভাষণকরে, আমি তাহার মুখদর্শন করিতে চাহি না ৷ শুনিয়া ছোট হরিদাসের মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল ৷ তপস্বিনী-প্রধানা রমণী মাধবী দেবী, তাঁহার নিকট হইতে চাউল আনিয়াছি, তাহাতেই এত অপরাধ! তিনি প্রায়োপবেশনে দেহত্যাগের সঙ্কল্প করিলেন ৷ তিন দিন উপবাসের পর স্বরূপ দামোদর প্রভৃতি ভক্তগণ মহাপ্রভুর নিকট গিয়া মার্জনা ভিক্ষা চাহিলেন ৷ এই প্রথম অপরাধ, না জানিয়া করিয়াছে, ক্ষমা কর ৷ মহাপ্রভু কাহারও কথা শুনিলেন না ৷ শেষে সকলে মিলিয়া শ্রীপরমানন্দ পুরীকে গিয়া ধরিলেন ৷ শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য শ্রীপাদ ঈশ্বর পুরীর সতীর্থ শ্রীপরমানন্দ পুরীকে মহাপ্রভু বিশেষ শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন ৷ পরমানন্দকে দেখিয়া মহাপ্রভু স-সম্ভ্রমে গাত্রোত্থানপূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন— আপনার শুভাগমনের কারণ কি ? কি আদেশ ? পরমানন্দ জানাইলেন, ছোট হরিদাসের জন্য প্রদাস ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি ৷ মহাপ্রভু বলিলেন, আপনি সকলকে লইয়া এখানে থাকুন, আমি আলালনাথে চলিয়া যাইতেছি৷ তিনি যখন সত্যই গোবিন্দকে লইয়া প্রস্থানোদ্যত হইলেন, পরমানন্দ বিনয়-বচনে তাঁহাকে শান্ত করিয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং সকলকেই সমস্ত কথা জানাইলেন ৷ তখন স্বরূপ দামোদর প্রভৃতি হরিদাসের নিকট গিয়া বলিলেন, তুমি যদি এরূপভাবে উপবাস কর, প্রভুর জেদ চাপিয়া যাইবে ৷ তুমি স্নান ভোজন কর, কিছুদিন গেলেই তাঁহার দয়া হইবে ৷ হরিদাস স্নান ভোজন করিলেন ৷
বৎসর অতীত হইতে চলিল, কই মহাপ্রভুর তো কৃপা হইল না ৷ দূর হইতে দর্শন হয়, কিন্তু ডাকিয়া তো কথা বলেন না কীর্তন শোনেন না ৷ মনোদুঃখে হরিদাস প্রয়াগে গিয়া দেহত্যাগ করিলেন ৷ বৎসরান্তে মহাপ্রভু যখন হরিদাসকে মার্জনাপূর্বক কাছে ডাকিলেন, সকলেই জানাইলেন, এই তো কয়দিন পূর্বে হরিদাস কোথায় চলিয়া গিয়াছে ৷
প্রয়াগ হইতে এক বৈষ্ণব নবদ্বীপে আসিয়া শ্রীবাস পণ্ডিতকে ছোট হরিদাসের দেহত্যাগের সংবাদ জ্ঞাপন করেন ৷ শ্রীবাস পুরীধামে আসিয়া মহাপ্রভুকে হরিদাসের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন এবং প্রয়াগে দেহত্যাগের সংবাদও জানাইলেন ৷ মহাপ্রভু উত্তর দিলেন, ‘স্বকর্মফলভুক্‌ পুমান্‌’৷
ব্রহ্ম হরিদাস হইতে পার্থক্যরক্ষার জন্য বৈষ্ণব-সাহিত্যে এই হরিদাস ‘ছোট হরিদাস’ নামে পরিচিত ৷ দুর্জ্ঞেয় চরিত্র শ্রীমহাপ্রভুর ৷ অন্তর্যামী তিনি, তিনিই জানেন কেন ছোট হরিদাসকেই উপলক্ষ্য রাখিয়া তিনি সমগ্র সম্প্রদায়কে শিক্ষাদান করিয়াছিলেন ৷