রাজধানীতে একজন স্থপতি আসিয়াছেন ৷ পূর্তশাস্ত্রে পারঙ্গম পণ্ডিত, আবার হাতে-হাতিয়ারেও কাজ করিতে সুদক্ষ ৷ স্থপতির মালমসল্লার ভাগবাটয়ারার হিসাব-নিকাশ যেমন নির্ভুল, মিশ্রণ-কৌশলের পারিপাট্য যেরূপ নিখুঁত, পরিকল্পনাও তেমনই মনোরম, আর কারুকলাও সেইরূপ চমৎকার ৷ হাতে যাদুদণ্ড আছে ৷ রাজ্যেশ্বর শিল্পীকে সমাদরে গ্রহণ করিলেন ৷ রাজা, যুবরাজ, মন্ত্রী, রাজমহিষী, যুবরাজ্ঞী, মন্ত্রী-পত্নী, রাজসভাসদগণ, রাজ্যের জনসাধারণ সকলেই শ্রদ্ধায় সমাদরে শিল্পীকে আপনার জন করিয়া লইলেন ৷
রাজসভা হইতে নির্দেশ পাইয়া, রাজাবরোধ হইতে অনুরুদ্ধ হইয়া স্থপতি বিশ্রাম-নিকেতন, প্রমোদ-গৃহ গড়িয়া দেন, মনোরম আশ্রয় পাইয়া সকলেই সন্তুষ্ট ৷ দিন যায়, ক্রমে শিল্পীর ভাবান্তর ঘটিল ৷ আত্মসমাহিত স্থপতি নিরালা সাধনায় একদিন এক অপূর্ব ভবন রচনা করিলেন ৷ উপকরণ রাজির বস্তুপুঞ্জের সে কি সুসমঞ্জস সমাবেশ! নরনারী প্রাঙ্গণে আসিয়া সসম্ভ্রমে মস্তক অবনত করিল ৷ মানবের বিলাস-নিকেতন কখন দেবমন্দিরে পরিণত হইয়াছে, শিল্পীর কিন্তু সাধনার বিরাম নাই ৷ মন্দিরের লতাপাতা ফুল কোকিল ভ্রমর একদিন জীবন্ত হইয়া উঠিল ৷ মন্দির কুঞ্জে রূপান্তরিত হইয়া গেল ৷ সহজ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া মাধুর্যের যুগলবিগ্রহ শ্রীরাধাকৃষ্ণ স্বেচ্ছায় আসিয়া কুঞ্জে অধিষ্ঠিত হইলেন ৷ এই স্থপতি বিদ্যাপতি ৷
বিদ্যাপতি অভিজাত বংশের সন্তান ৷ তিনি বিদ্বান্‌, তিনি সুরসিক সামাজিক ৷ বিদ্যাপতি একাধারে কবি, পণ্ডিত, লোকশিক্ষক, ঐতিহাসিক, ভূবৃত্তান্ত-প্রণেতা, কাহিনী-রচয়িতা, স্মৃতির নিবন্ধকার এবং বিধি- বিধানের গ্রন্থ-লেখক৷ লোকচরিত্রে অভিজ্ঞ, ভূয়োদর্শনে সুশিক্ষিত, সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বিদ্যাপতি ৷ পাণ্ডিত্যের সঙ্গে রসজ্ঞতার, বুদ্ধির সঙ্গে মননশীলতার,ভূয়োদর্শনের সঙ্গে প্রয়োগ-নৈপুণ্যের, সৌন্দর্যপ্রিয়তার সঙ্গে কালোচিত সুরুচি ও সংযমের মিলনে কবি-জীবন এক মহিমান্বিত সম্পদে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল ৷
বিদ্যাপতি রাজসভার কবি ৷ রাজার, সভাসদবর্গের, এমন কি অন্তঃপুরিকাগণের সন্তুষ্টির দিকেও কবির সতর্ক দৃষ্টি ছিল ৷ সুতরাং তাঁহার কবিতায় বুদ্ধির চাতুর্য আছে, মনোবিলাসের কলাকৌশল আছে ৷ আবার পাণ্ডিত্যের অনুরূপ ছন্দ-ঝঙ্কার ও ভাষায় অলঙ্কারের সঙ্গে রসভাবোচ্ছলিত হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোলও আছে ৷ বিদ্যাপতি রাজসভার কবি এবং জনসাধারণেরও কবি ৷ তিনি সংস্কৃত ছাড়িয়া প্রাদেশিক ভাষায়, জনসাধারণের ভাষায় কবিতা লিখিয়াছেন ৷ মানুষের ভালবাসার কথা বলিয়াছেন, লৌকিক উৎসবের গান রচনা করিয়াছেন ৷ দেশপ্রথার অনুসরণে, বংশানুক্রমের অনুসরণে হরগৌরী-লীলার মহিমা গাহিয়াছেন৷ কিন্তু শ্রীরাধাকৃষ্ণলীলা গানই কবির অভীপ্সিত বিষয় ৷ এই গানে তাঁহার অন্তরের স্বতঃ উৎসারিত ভাবলহররী ছন্দে বন্দী হইয়া আছে ৷ এই গানে তিনি আপনার জীবনের সুর খুঁজিয়া পাইয়াছেন ৷
বিদ্যাপতির রচিত শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণলীলাত্মক কতকগুলি গান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য আস্বাদন করিতেন ৷ তজ্জন্য ঐ সমস্ত গান একটি বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত হইয়াছে ৷ আশ্চর্যের বিষয়, ঐ ঐ গানের কয়েকটি বাঙ্গালা ভিন্ন অপর কোথাও পাওয়া যায় নাই ৷ এমন কি কবির জন্মভূমি মিথিলার কোন একজন লোকও সে গান মনে করিয়া রাখে নাই ৷ কোন পুরানো লেখকের পুঁথির পাতায় তাহার নিদর্শন মিলে না ৷ কোন রাজকীয় গ্রন্থাগারেও তাহার অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় নাই৷ ঐ একই কারণে গানগুলি সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ রহিয়া গিয়াছে ৷
বিদ্যাপতির গানের অনুকরণ হইয়াছিল প্রচুর ৷ অনেক বাঙ্গালী পদকর্তার পদ বিদ্যাপতির পদের সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে ৷ কিছুদিন পূর্বে একজন সম্পাদক কয়েকজন বিভিন্ন পদকর্তার পদ বিদ্যাপতির নামে ছাপাইয়া দিয়াছিলেন৷ পরে অবশ্য তাহার কিছু কিছু সংশোধিত হইয়াছিল ৷ সর্বশেষে সংস্করণে এ বিষয় বিশেষরূপে আলোচিত হইয়াছে ৷ একজন বাঙ্গালী পদকর্তার উপাধি ছিল বিদ্যাপতি, ছোট বিদ্যাপতি ৷ তাঁহার রচিত দুই-চারটি পদও বিদ্যাপতির নামে চলিতেছে ৷
বিদ্যাপতির বঃয়সন্ধির পদগুলি প্রসিদ্ধ ৷ কিন্তু মিথিলায় প্রচলিত নেপাল প্রভৃতি স্থান হইতে প্রাপ্ত বিদ্যাপতির বয়ঃসন্ধির পদের সঙ্গে বাঙ্গালায় প্রচলিত বিদ্যাপতি ভণিতাযুক্ত পদের পার্থক্য আছে ৷ বাঙ্গালায় একজন বিখ্যাত পদকর্তা ছিলেন নয়নানন্দ কবিরাজ ৷ ইঁহার বয়ঃসন্ধির পদের প্রসিদ্ধি ছিল ৷ শ্রীখণ্ডের রামগোপাল দাস প্রণীত রঘূনন্দন-শাখা-নির্ণয় গ্রন্থে লিখিত আছে —
রঘুনন্দন শাখা নয়নানন্দ কবিরাজ ৷
যাঁর শাখা উপশাখায় ভরিল ভবমাঝ ৷৷
বয়ঃসন্ধির রসে হয় যাহার বর্ণন ৷
ভাগ্যবান যেই সেই করয়ে স্মরণ ৷৷
দুঃখের বিষয়—নয়নানন্দ কবিরাজ রচিত কোন পদই আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই ৷ শ্রীপাদ গদাধর পণ্ডিতের ভ্রাতুষ্পুত্র নয়নানন্দ ঠাকুর একজন বিখ্যাত পদকর্তা ৷ হয়তো ইঁহার পদের সঙ্গে নয়াননন্দ কবিরাজের পদ মিশিয়া আছে ৷ আমি নয়নানন্দ ভণিতার একটি মাত্র বয়ঃসন্ধির পদ পাইয়াছি ৷ ইহা কবিরাজ নয়নানন্দ রচিত বলিয়াই অনুমান করিয়াছি ৷
বিদ্যাপতি-পদাবলীর অধিষ্ঠানভূমি —মানবতার ভূমি ৷ মানবীয় সুখ-দুঃখবোধই বিদ্যাপতির কবিহৃদয়ের অনুভূতির রংএ অনুরঞ্জিত হইয়াছে ৷ এই অনুভূতির বৈশিষ্ট্যই বিদ্যাপতির কবিত্ব ৷ বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণে বিদ্যাপতির অভিনবত্ব এক চিরন্তন চিত্রের সৃষ্টি করিয়াছে ৷ বয়ঃসন্ধির শুভ সন্ধিক্ষণেই বিদ্যাপতি আপনার অনুভূত সৌন্দর্যের ঘনীভূত বিগ্রহকে, শ্রীমতী রাধারাণীকে দেখিবার সৌভাগ্য প্রাপ্ত হইয়াছেন ৷ এই দৃষ্টি পূজার দৃষ্টি না হইলেও উপাসনার দৃষ্টি ৷ যেন অন্তরঙ্গ অন্তঃপুরিকার প্রণয়াঞ্চিত দৃষ্টি ৷ মিথিলা অধবা নেপালে প্রাপ্ত বয়ঃসন্ধির পদগুলি হইতে বাঙ্গালায় প্রচলিত পদগুলি অধিকতর ব্যঞ্জনা-সমৃদ্ধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ ৷ ঊষার অরুণোদয়ে বিকাশোন্মুখ শতদলের প্রতিটি দল কবির দৃষ্টিসম্পাতে অভিনন্দিত হইয়াছে ৷ শৈশবের নিদ্‌মহল হইতে কৈশোরের স্বপ্নরাজ্যে আধ-তন্দ্রা আধ-জাগরণের রহস্যলোকে কবি ক্ষণেকের জন্যও কিশোরীর সঙ্গ ত্যাগ করেন নাই ৷ সমুজ্জ্বল হীরকখণ্ড হাতে পাইয়া মণিকার যেমন ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখে, কবি তেমনই করিয়া কিশোরী শ্রীরাধাকে অন্তর-বাহির কত দিক হইতে কত রূপে কত দিন ধরিয়াই না দেখিয়াছেন ৷ আবার এই দর্শনের সার্থক পরিণতি ঘটিয়াছে শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগে ৷ গোধূলির ম্লান পাণ্ডুর আলোকে মন্দির হইতে পথে বাহির হইয়াছেন শ্রীরাধা৷ যৌবন-গরবিনী অলস মন্থর-গমনে চলিতে চলিতে চঞ্চল কটাক্ষে ঈষৎ হাসিয়া পালটিয়া শ্রীকৃষ্ণকে দেখিয়া গিয়াছেন৷ যমুনা-সলিলে স্নানরতা শ্রীমতী, স্নানান্তে সিক্ত বসনে গৃহ-প্রত্যাগতা শ্রীরাধা—এই অপরূপ সৌন্দর্যময়ীকে শ্রীকৃষ্ণ যখনই দেখিয়াছেন তখনই শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টির সঙ্গে কবির দৃষ্টিভঙ্গী মিলিত হইয়াছে ৷
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে দেখিয়াছেন ৷ শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়াছেন—না, শ্রীরাধা তাঁহাকে দেখা দিয়াছেন ! শ্রীরাধার দেখা দিবার, নিজেকে দেখাইবার সে ভঙ্গীই বা কত অপরূপ, কত সুন্দর, কত মনোহারী৷
প্রথম দর্শনে কিন্তু শ্রীরাধার শ্রীকৃষ্ণকে দেখিবার ইচ্ছা ছিল না ৷ কে যেন জোর করিয়াই দেখাইয়াছে ৷ শ্রীরাধা বলিতেছেন —
অবনত আনন কএ হম রহ লিহু বারল লোচন চোর ৷৷
পিয়া মুখরুচি পিরএ ধাওঅল জনি সে চাঁদ চকোর ৷৷
ততহু সঞে হঠে হটি মোঞে আনল ধএল চরণ রাখি ৷
মধুপ মাতল উড়এ ন পারএ তইঅও পসারএ পাখি ৷৷
মাধব বোললি মধুর বাণী সে সুনি মৃদু মোঞে কান ৷
তহি অবসর ঠাম বাম ভেল ধরি ধনু পচবান ৷৷
তনু পসেবে পসাহনি ভাসলি পুলক তইসন জাগু ৷
চুনি চুনি ভএ কাঁচুঅ ফাটলি বাহু বলয়া ভাগু ৷৷
ভণ বিদ্যাপতি কম্পিত করহো বোলল বোল না যায় ৷
রাজা শিবসিংহ রূপনারাঅন সাম সুন্দর কায় ৷৷
অপূর্ব চিত্র! মাধবের সহিত যখন দেখা হইল, আমি মুখ নীচু করিয়া রহিলাম ৷ লোচন চোরকে বারণ করিলাম ৷ (নয়ন চুরি করিয়া তাহাকে দেখিতে গেল ৷ আমি নয়নকে নিবৃত্ত করিলাম ।) কিন্তু চকোর যেমন চাঁদের দিকে ধায়, আমার নয়ন তেমনই প্রিয়-মুখরুচি পান করিবার জন্য ধাবিত হইল ৷ সেখানে হইতে জোর করিয়া আমি চোখকে হঠাইয়া আনিলাম, চরণের দিকে চোখ রাখিলাম ৷ মধুপানোন্মত্ত মধুকর যেমন উড়িতে পারে না, তথাপি পক্ষ বিস্তার করে (তেমনই আমার চোখ চরণে লাগিয়া থাকিলেও বারংবার মাধবের মুখ দেখিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল) মাধব কথা বলিল, আমি শুনিয়া কান বন্ধ করিলাম ৷ সেই অবসরে পঞ্চবাণ মদন ধনু ধরিয়া আমার প্রতি শত্রুতা করিল, অর্থাৎ আমাকে আহত করিল ৷ স্বেদে দেহের প্রসাধন ভাসিয়া গেল ৷ এমন পুলক জাগিল কাঁচুলি চুন চুন করিয়া ফাটিয়া গেল ৷ বাহুর বলয় ভাঙ্গিয়া গেল ৷ বিদ্যাপতি বলিতেছেন — কর কম্পিত হইতেছে, বলিবার কথা বলা যায় না ৷ রূপনারায়ণ রাজা শিবসিংহ শ্যামসুন্দর কায় ৷
কবিতাটি অমরুশতকের একটি শ্লোকের মর্মানুবাদ ৷ তথাপি শ্লোকের সঙ্গে মিলাইয়া পড়িলেই বুঝিতে পারি এ কবিতা মৌলিক রচনার মতই রসোত্তীর্ণ ৷
তদ্‌ক্ত্রাভিমুখং মুখং বিনমিতং দৃষ্টিঃ কৃতা পাদয়ো
স্তৎ সংলাপ কুতূহলাকুলতরে শ্রোত্রে নিরুদ্ধে ময়া ৷
পাণিভ্যাং চ তিরাবৃত সপুলকস্বেদোগ্‌মো গণ্ডয়োঃ
সখ্যঃ কিং করবাণি যান্তি শতধা মৎকঞ্চুকীসন্ধয়ঃ ৷৷
(অমরুশতক ১১ শ্লোক)
মুখোমুখি হওয়া মাত্র নামায়ে লইনু মুখ
আঁখি রাখি পায়ের উপরে ৷
তার মুখে দুটি কথা শুনিতে কি ব্যাকুলতা
তবু রই কর্ণ রুদ্ধ করে ৷৷
রোমাঞ্চিত দুই গণ্ডে ফুটে ওঠে স্বেদবিন্দু
ঢেকে রাখি করতল দিয়া ৷
কিন্তু কি করিব সখি কাঁচুলিটা বুঝি মোর
ফেটে যায় শতধা হইয়া ৷৷
(ডঃ শ্রীবামাপদ বসুর অনুবাদ)
অমরুর এই শ্লোক কোন মানিনীর সখীর প্রতি উক্তি ৷ আর বিদ্যাপতির পদটি পূর্বরাগে শ্রীরাধা বলিতেছেন সখীকে ৷ বিদ্যাপতির পদ বর্ণনামাধুর্যে সমধিক সুন্দর হইয়াছে ৷ আর একদিনের কথা; এই দিনই বিদ্যাপতির রাধার স্বরূপ প্রকাশিত হইয়াছে ৷ তিনি আপনার মনের কথা বলিয়া ফেলিয়াছেন ৷
সামর সুন্দর এ বাট আএল তা মোরি লাগলি আঁখি ৷
আরতি আঁচর সাজি ন ভেলে সবে সখীজন সাখি ৷৷
কহা হি মো সখি কহা হি মো কথা এ তাহেরি বাসা ৷
দুরহু দুগুন এড়ি মৈঁ আবওঁ পুনু দরসন আসা ৷৷
কি মোরা জীবনে কি মোরা জৌবনে কি মোরা চতুর পনে ৷
মদন বাণে মুরছলি আছঞো সহওঁ জীব অপনে ৷৷
আধ পদে যে ধরইতে দেখল নাগর জনসমাজে ৷
কঠিন হিরদয় ভেদি ন ভেলে জাও রসাতল লাজে’ ৷৷
সুরপতি পাএ লোচন মাগওঁ গরুড় মাগওঁ পাখী ৷
নন্দেরি নন্দন মৈ দেখি আবওঁ মন মনোরথ রাখী ৷৷
পদটিতে ভণিতা নাই ৷ তথাপি চিনিতে কষ্ট হয় না যে এ পদ বিদ্যাপতির ৷ শ্যামল সুন্দর এই পথে আসিল সেই হেতু আমার চোখে লাগিল ৷ অনুরাগপ্রাবল্যে অঞ্চলে (অঙ্গ) সাজানো হইল না, সখীগণ সঙ্গেই আছে ৷ সখি আমাকে বল, আমাকে বল, কোথায় তাহার অধিবাস (বাসস্থান), দ্বিগুণ দূর হইলেও পুনর্বার দর্শনের আশায় আমি ঐ দ্বিগুণ পথ এড়াইয়া আসিব (দ্বিগুণ পথ অতিক্রম করিব) ৷ আমার জীবনে যৌবনে ও চতুরপনায় (চাতুরীতে) কি প্রয়োজন ৷ মদনবাণে মূর্ছিত হইয়া রহিয়াছি ৷ কোনরূপে জীবনের ভার সহ্য করিতেছি ৷ সেই নাগর জনসাজে অর্থাৎ লোকজনের সামনে আমাকে তাহার দিকে আধ পা আগাইতে দেখিল ৷ (আমার) কঠিন হৃদয় ভিন্ন হইল না ৷ লজ্জা রসাতলে গেল ৷ ইন্দ্রের চরণে লোচন প্রার্থনা করি, গরুড়ের নিকট পাখা প্রার্থনা করি ৷ মনোরথে মন রাখিয়া নন্দের নন্দনকে দেখিয়া আসি ৷
এই যে নন্দনন্দনকে দেখিবার জন্য অন্তরের আকুতি, এই যে দুর্নিবার আবেগমিশ্রিত কৌতূহল, ইহাই বিদ্যাপতির রাধার প্রকৃত স্বরূপ ৷ দ্বিজ চণ্ডীদাসের শ্রীরাধা শ্যামনাম শুনিয়া ব্যাকুল হইয়া বলিয়াছেন — “পাসরিব করি মনে পাসরা না যায় গো, কি করিব কি হবে উপায়” — তাহাকে ভুলিতে চাই, ভুলিতে পারি না, কি উপায় হইবে সখি ? দ্বিজ চণ্ডীদাসের রাধা বলেন — “যেখানে তাহার বসতি, নয়নে দেখিয়া আমার যুবতিধর্ম কিরূপে রক্ষা করিব?” আর বিদ্যাপতির রাধা বলেন — “আমার বল সখি, আমায় বল কোথায় তাহার বাস, দ্বিগুণ দূর পথ এড়িয়াও আমি তাহাকে দেখিবার আশায় আসিব ৷” কিন্তু দেখিবার বিপদ্‌ও তো কম নয় ৷ ছি ছি কি লজ্জার কথা — আমি শ্যামকে দেখিবার জন্য সকল লোকের সমক্ষেই যন্ত্র-চালিতার মত একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপনার অজ্ঞাতসারেই আধ পদ আগাইয়া গিয়াছিলাম, আর শ্যাম কিনা স্বচক্ষে তাহা দেখিল ৷ না দেখিয়া থাকিতে পারি না, আবার দেখা না দিয়াও থাকিবার উপায় নাই ৷ অথচ সামনাসামনি দেখার কত না বিড়ম্বনা! বয়ঃসন্ধিতে, পূর্বরাগে, রসোদ্গারে বিদ্যাপতির রাধার এই একই চিত্র ৷ উদ্ভিন্ন যৌবনের স্বভাবধর্ম এক সুশিক্ষিতা রাজকুমারীর হৃদয়কে আশ্রয় করিয়া প্রিয়তমের প্রতি উন্মুখ হইয়াছে ৷ অন্তরে বাহিরে অস্থিরতা ৷
অন্তরে চঞ্চল প্রেম ধৈর্য জানে না, বাহিরে উচ্ছলিত যৌবন বাঁধ মানে না ৷ গৃহে গুরুজন, বাহিরে প্রতিবেশী স্বজন, সমাজ ৷ যমুনা যাইবার সঙ্কীর্ণ পথে দেখা হয় ৷ কিন্তু নয়ন ভরিয়া দেখিবার সাধ্য নাই ৷ দেখা দিবার বড় সাধ, কিন্তু সমাজের সহস্র চক্ষু নিরোধের উপায় নাই ৷ এমনই দ্বন্দ্বের মাঝখানে একদিন মিলন ঘটিল ৷ সখীগণ কত না সাবধানে গৃহের বাহির করিয়া, কত না যতনে সাধিয়া বুঝাইয়া বন্ধুর হাতে হাতে আনিয়া সঁপিয়া দিল ৷ কিন্তু মিলন তো স্থায়ী হইল না ৷ দেখিতে দেখিতে সুখের দিন ফুরাইয়া আসিল ৷ আনন্দের হাট ভাঙ্গিয়া পড়িল ৷ মাধব মথুরায় চলিয়া গেলেন ৷ উৎসবময়ী কিশোরীর কলগান, তাহার নটন হিল্লোল মুহূর্তে স্তব্ধ হইয়া গেল ৷ গোকুল ভরিয়া করুণার রোল উছলিয়া উঠিল, গৃহে গৃহে হাহাকার ৷ কানু-বিরহাতুরা শ্রীরাধার সে কি মর্মন্তুদ বেদনা ৷ যাতনা মরণাধিক, কিন্তু মরণ বোধ হয় মাধবের মতই অকরুণ ৷
বিদ্যাপতির মিলনের আনন্দ এবং বিরহের বেদনা, দুয়েরই পরিমাপ হয় না ৷ আবার বিরহের পর মিলনের রাজকীয় সমারোহ, সে উৎসবও বোধ হয় তুলনাহীন ৷ “আজু রজনী হম ভাগে পোহায়ল পেখলুঁ পিয়া মুখ চন্দা” কোন্‌ বিদ্যাপতির রচনা জানি না ৷ এ গান যিনিই লিখিয়া থাকুন, মৈথিল কোকিলের রাজসভাকবি বিদ্যাপতির শ্রীরাধাকে তিনি একান্ত নিবিড়ভাবেই চিনিয়াছিলেন, ইহা নিঃসন্দেহ ৷ চিত্রের এমন সুসঙ্গত চিত্রণ, উপক্রম-উপসংহারের এমন সুসমঞ্জস মিলন অতি অল্পসংখ্যক চিত্রকরের তুলিকাতেই সুসম্পন্ন হইয়াছে ৷ দুঃখের বিষয় বাঙ্গালায় বিদ্যাপতির পদাবলী লইয়া বিশেষ আলোচনা হয় নাই ৷ তথাপি অকুণ্ঠ অন্তঃকরণে একথা স্বীকার করিতেছি যে বিদ্যাপতি-সম্পাদনে কলিকাতা গ্রে স্ট্রীটের মিত্রগোষ্ঠী একটা ঐতিহ্যের সৃষ্টি করিয়াছেন ৷ স্বর্গগত সারদাচরণের আরব্ধ ব্রত তাঁহার সুযোগ্য পুত্র ৺শরৎকুমারের স্মরণীয় কৃতিত্বে উদ্‌যাপিত হইয়াছে ৷ তিনি রাজোচিত মর্যাদায় রাজসভা-কবিকে বাঙ্গালী পাঠক-সমাজের নিকট সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন ৷ পদাবলী-সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ ৺খগেন্দ্রনাথ মিত্র মহাশয় পদাবলীর পাঠ নির্ণয় ও ব্যাখ্যা রচনা করিয়াছেন ৷ কবির জীবন-কথা ও জীবন-কাল লইয়া আলোচনা করিয়াছেন—ডক্টর ৺বিমান বিহারী মজুমদার ৷ এ সুসম্পাদিত গ্রন্থখানিকে আমরা বাঙ্গালী পাঠকসমাজের পক্ষ হইতে স্বাগত জানাইতেছি৷
এই সংস্করণ সম্বন্ধে বলিবার কথা অনেক ছিল ৷ কিন্তু এখানে তাহার স্থানাভাব ৷ মাত্র একটী প্রসঙ্গে দুই কথা বলিব ৷ বিমানবিহারী বলিতেছেন — “কবি প্রথম জীবনে প্রাকৃত নায়ক-নায়িকা লইয়া শৃঙ্গার রসের কবিতা লিখিলেও পরিণত বয়সে বৈষ্ণবীয় সাধনার রসে নিমগ্ন হইয়া রাধা-কৃষ্ণের লীলা-রস গান করিয়াছেন ৷ বর্তমান যুগের মৈথিল পণ্ডিতেরা এই সহজ সত্যটী মানিয়া লইতে চাহেন না ৷” কিন্তু এজন্য মাত্র মৈথিল পণ্ডিতদেরই দোষ দেওয়া যায় না ৷ অনেক বাঙ্গালী পণ্ডিতও এই অভিমত পোষণ করেন এবং এই কথা বলিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন যে জয়দেব বিদ্যাপতি ইঁহারা পঞ্চোপাসক স্মার্ত ছিলেন ৷ শ্রীচৈতন্যদেবের মতানুবর্তী বৈষ্ণব না হইলেও ইঁহারা যে বৈষ্ণব ছিলেন — সেকালেও যে বৈষ্ণব-ধর্ম প্রচারিত ছিল এবং যুগের অগ্রবর্তিরূপে অনেক সাধক অনেক কবি শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্বে প্রকৃত বৈষ্ণবোচিত সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন, একথা অস্বীকার করিয়াই তাঁহারা বিশেষ একরূপ আনন্দ অনুভব করেন ৷ তবে নিমানবিহারী যে আপন অভিমতের সমর্থনে বিদ্যাপতির আত্মনিবেদন পদ দুইটি প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত করিয়াছেন, আমি তাহা প্রামাণ্য বলিয়া গ্রহণ করিতে পারিলাম না ৷ আচার্য শঙ্কর-বিরচিত স্তোত্রে যদি পাওয়া যায়— রচয়িতা বলিতেছেন — বাল্যে বালাভিলাষী জড়িত-জড়মতি বাল্যলীলায় প্রসক্ত ছিলাম, যৌবনে বিষয়বিষধরের বিষদংনে বিষাক্ত অন্তঃকরণে তোমাকে স্থান দিতে পারি নাই ইত্যাদি ৷ আর সেই কথা ধরিয়া যদি তাঁহার চরিত্র বিশ্লেষণ করিতে যাই তাহা হইলে কোথায় গিয়া উপস্থিত হইব? যাঁহারা জনসাধারণের প্রতিনিধি, যাঁহারা জনসাধারণের পাথেয় রচনা করেন, তাঁহারা কি আপনাদের কথাই বলেন, না মানুষ যাহা অবলম্বন করিয়া যুগ হইতে যুগান্তরের পথে যাত্রা করিবে সর্বসাধারণের উপযোগী সেই শাশ্বত আশ্রয় রচনা করেন ! বিদ্যাপতির আত্মনিবেদনের পদ বাঙ্গালা ভিন্ন অন্যত্র পাওয়া যায় নাই ৷ সুতরাং এই পদ লইয়া বিদ্যাপতি-বিচার কতদূর যুক্তিযুক্ত, বিবেচনা করিতে বলি ৷ বিদ্যাপতির রচিত প্রাকৃত নায়ক-নায়িকার প্রেমের কবিতা, হরগৌরী-বিষয়ক কবিতা এবং শ্রীরাধাকৃষ্ণলীলার কবিতা লইয়া আলোচনা করিলেই বুঝা যায় কোন্‌ কবিতায় রসসমৃদ্ধ, কোন্‌ কবিতায় বিদ্যাপতি আপনাকে প্রকাশ করিয়াছেন, কোন্‌ কবিতায় বিদ্যাপতি চিরজীবী এবং বিদ্যাপতির কোন্‌ কবিতা কালজয়ী ৷