বাংলার কীর্তনসংগীতের সম্পূর্ণ ইতিহাস পাওয়া যায় না৷ জয়দেবের সময় হইতে কীর্তনের প্রবাহ আসিয়াছে বলিয়া ধরা যায়৷ ঐ পদাবলী সম্বন্ধে আমাদের মনে এই প্রশ্ন আসে যে, জয়দেবের সময়ে তাঁহার কোমলকান্ত পদাবলীগুলি কি সুরে বা কি প্রণালীতে গীত হইত? জয়দেবের গীতগুলির ছন্দ আলোচনা করিলে বুঝিতে বিলম্ব হয় না যে, সে সময়ে সংগীতের রীতিমত চর্চা ছিল এবং সে সংগীতে ভাবসম্পদের বিকাশও যথেষ্ট ছিল৷ তাহা না হইলে ঐ প্রকারের গীতিকবিতা কখনও রচিত হইতে পারিত না৷ ‘মুঞ্চ ময়ি মানমনিদানং প্রিয়ে চারুশীলে’, বা ‘মাধবে মা কুরু মানিন মানময়ে’ প্রভৃতি পদের গতিভঙ্গী দেখিলেই বুঝা যায় যে, এই মধুর সংগীতে সুললিত সুর, কমনীয় ভাব ও ছন্দের বিচিত্র গতি— এই ত্রিধারা আসিয়া মিলিত হইয়াছিল৷ যাঁহারা বলেন যে প্রাচীন কালে গীত কথার অপেক্ষা রাখিত না,তাঁহারা এই বিষয়টি বিবেচনা করিয়া দেখিবেন৷ জয়দেবের পদাবলী যে সুরেই গীত হউক, তার মধ্যে যে কবিত্বের বিশেষ প্রাচুর্য ছিল একথা না বলিলেও চলে৷ সুতরাং কীর্তনের দুর্নিরীক্ষ্য অতীত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া এই কথাটিই আমাদের সর্বপ্রথমে মনে পড়ে যে, প্রথম হইতেই কীর্তনসংগীতে সুরের সঙ্গে কবিত্বের অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়৷
প্রচলিত গীতগোবিন্দের পদে কতকগুলি সুর ও তালের সমাবেশ আছে৷ সেগুলি জয়দেবের সময় হইতেই চলিয়া আসিতেছে অথবা পরবর্তী কালের যোজনা তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না৷ তবে পূজারি গোস্বামীর টীকা দেখিলে মনে না হইয়া পারে না যে, তিনি ঐ সুর ও তাল জয়দেবের পদের অঙ্গ বলিয়া মনে করিয়াছিলেন, কারণ তিনি উহারও টীকা করিয়াছেন৷ দশাবতার স্তোত্রের শিরোদেশে ‘মালবরাগেণ রূপকতালেন চ গীয়তে’ এইরূপ নির্দেশ আছে৷ পূজারি গোস্বামী তাঁহার বালবোধিনী টীকায় লিখিতেছেন : ‘গীতস্যাস্য মালবরাগ রূপকতাল ইত্যাহ মালবেতি৷ তস্য লক্ষণং যথা’ ইত্যাদি৷ তিনি রূপক তালেরও লক্ষণ দিয়াছেন৷ এইরূপ গুর্জরী, রামকিরী, বসন্তরাগ এবং নিঃসার, একতালী এবং যতিতালেরও লক্ষণ ও সংজ্ঞা দিয়াছেন৷ এই সকল রাগরাগিণী ও তাল প্রাচীন সন্দেহ নাই৷ শার্ঙ্গদেবের সংগীতরত্নাকরে (এবং তাহারও পূর্বে) ইহাদের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ এখানে জানিতে কৌতূহল হয় যে, এইসকল গীত প্রাচীন গীতপদ্ধতি— যাহাকে বর্তমানে হিন্দুস্থানী সংগীতরীতি বলা হয় — অনুসারে গাওয়া হইত অথবা কোনও নূতন পদ্ধতি অবলম্বিত হইতে শুরু হইয়াছিল৷
একটি লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, জয়দেবের পদাবলী নূতন ধরনের গীত প্রবর্তন করিয়া এক নূতন যুগের উদ্‌বোধন করিল৷ গৌড়রাজসভার বাঙালী কবি তখনকার উচ্চ অভিজাত শ্রেণীর রুচি অনুসারে সংস্কৃত পদ রচনা করিয়াছিলেন৷ তাঁহার আদর্শ কি ছিল জানিবার সুবিধা নাই অর্থাৎ তিনি পূর্বতন কোনও সংগীত বা পদাবলী হইতে প্রেরণা পাইয়াছিলেন কিনা বলা যায় না৷ কিন্তু ইহা অনুমান করা অসংগত নহে যে, এই শ্রেণীর গীত সে সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হইয়াছিল এবং তাহার অনুসরণে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস (এবং হয়তো আরও অনেক কবি যাঁহাদের নাম কালের মণিমঞ্জুষায় রক্ষিত হয় নাই) তাঁহাদের অমর সংগীত রচনা করিয়াছিলেন৷ ইঁহাদের গীতিকবিতার ধরন দেখিলে মনে হয়— (১) লোকের সংগীতের পিপাসা মিটাইবার উদ্দেশ্যেই এগুলি রচিত হইয়াছিল, (২) এইসময়ে বঙ্গে সম্ভবতঃ কোনও নুতনতর সংগীতের সৃষ্টি হইতেছিল, (৩) রাধাকৃষ্ণ-লীলার দিকে লোকের মন আকৃষ্ট হইতেছিল৷
সম্ভবতঃ সে সময়ে প্রাচীন রাগরাগিণীর উপর পল্লীগানের সুরের তুলি বুলাইয়া এক মনোমুগ্ধকর সুরশিল্প আবিস্কৃত হইতেছিল৷ সেই জন্যই হঠাৎ গীত-রচনার দিকে লোকের ঝোঁক পড়িয়া গেল৷ এই নূতনত্বের মোহ স্বীকার না করিলে পদাবলীর কল্লোলময় ধারার আবির্ভাব কোনও রূপে বুঝিতে পারা যায় না৷ মানুষ নূতন কিছুর আস্বাদ না পাইলে তাহাতে এমনভাবে উঠিয়া পড়িয়া লাগে না৷ সংস্কৃত বা বাংলা সাহিত্যে ইহার পূর্বে এরূপ গানরচনার প্রতি ঝোঁক দেখা যায় না৷
ইহার পরই শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব৷ শ্রীচৈতন্য যে ধর্ম প্রচার করিলেন তাহার একটি প্রধান বাহন হইল কীর্তন৷ অন্য অনেক ধর্মেও সংগীতের স্থান আছে; কিন্তু চৈতন্যের প্রেমধর্ম কীর্তনকে যেরূপ ভজনসাধনের অঙ্গ করিয়া তুলিল, এরূপ আর কোনও ধর্মে আছে কিনা সন্দেহ৷ চৈতন্যের ধর্মপ্রচারে, বিশেষতঃ কীর্তনগানে, দেশ মাতিয়া উঠিল৷

যত ছিল নাড়া বেনে সব হল কীত্তুনে,
কাচি ভেঙে গড়ালে কর্তাল৷
এইরূপ প্রবাদ হইতে এবং
শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়৷
এই প্রকার উক্তি হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, ধর্মপ্রচারে কীর্তন কি বিপুল সহায়তা করিয়াছিল৷ এইজন্য বলা হয়, গৌর-নিতাই এই সংকীর্তনের জনয়িতা অর্থাৎ ইঁহারাই কীর্তনগানের প্রবর্তক৷ কিন্তু প্রশ্ন এই যে, ইহাঁদের পূর্বে কি কীর্তনগান ছিল না? যদি থাকিত, তবে ইহাঁদিগকে সংকীর্তনের জনয়িতা বলিবার সার্থকতা কি ?
বৃন্দাবনদাস স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন,
আজানুলম্বিতভুজৌ কনকাবদাতৌ
সংকীর্তনৈকপিতরৌ কমলায়তাক্ষৌ
বিশ্বম্ভরৌ দ্বিজবরৌ যুগধর্মপালৌ
বন্দে জগৎপ্রিয়করৌ করুণাবতারৌ৷৷
— চৈতন্যভাগবত
‘যাঁহাদের ভুজদ্বয় আজানুলম্বিত, কান্তি স্বর্ণের ন্যায় সুন্দর, চক্ষু কমলদলের ন্যায় আয়ত, সংকীর্তনের একমাত্র জনক, বিশ্বপালক, যুগধর্মরক্ষক জগতের প্রিয়কারী সেই নিত্যানন্দ ও চৈতন্যকে প্রণাম করি৷’
পুরীতে চৈতন্যদেবের এইসংকীর্তন শুনিয়া মহারাজ গজপতি প্রতাপরুদ্র তাঁহার সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘এ কি সংগীত ?’ পণ্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য বলিয়াছিলেন, ‘ইহা চৈতন্যদেবেরই সৃষ্টি৷’
চৈতন্যভাগবতে দেখা যায় যে, গয়া হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া শ্রীচৈতন্য যখন হরিনামে উন্মত্তবৎ হইয়া উঠিলেন, তখন তাঁহার টোলের ছাত্রেরা বলিলেন, ‘প্রভু আমরাও তোমার সঙ্গে কীর্তন করিব, কিন্তু কীর্তন কেমন করিয়া করিতে হয় তাহা তো জানি না৷ আমাদিগকে শিখাইয়া দেও৷’

শিষ্যগণ বলেন কেমন সংকীর্তন৷
আপনে শিখায় প্রভু শচীর নন্দন৷৷
হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ৷
গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন৷৷
দিশা শিখায়েন প্রভু হাতে তালি দিয়া৷
আপনি কীর্তন করে শিষ্যগণ লইয়া৷৷
– চৈতন্যভাগবত
এই হইতে নবদ্বীপে কীর্তন বা সংকীর্তনের আরম্ভ হইল৷ ‘এবে সংকীর্তন হৈল নদীয়া নগরে৷’ কাজেই মনে হয় যে মহাপ্রভু হইতেই সংকীর্তনের আরম্ভ৷ কিন্তু আবার অপর দিকে আমরা পাইতেছি যে, শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি দেলপূর্ণিমায় যখন চন্দ্রগ্রহণ হইয়াছিল তখন দলে দলে লোক সংকীর্তন করিতে করিতে গঙ্গাস্নানে আসিয়াছিল এবং সেই সংকীর্তনের মধ্যেই জগন্নাথ মিশ্রের ভবনে এক গৌরবর্ণ শিশু আবির্ভূত হইলেন৷
সর্ব নবদ্বীপে দেখা হই গ্রহণ৷
উঠিল মঙ্গলধ্বনি শ্রীহরিকীর্তন।।

… …

গঙ্গাস্নানে চলিলেন সকল ভক্তগণ।
নিরবধি চতুর্দিকে হরিসংকীর্তন৷৷
-চৈতন্যভাগবত
কীর্তনে নৃত্য : শ্রীচৈতন্যের কিশোর বয়সের ইতিহাস অনুসরণ করিলে দেখা যায় যে তিনি কীর্তন করিতে ভালবাসিতেন, শ্রীবাসের অঙ্গনে প্রতি নিশায় কীর্তন হইত এবং সেই কীর্তনের সঙ্গে প্রভু নৃত্য করিতেন৷ নৃত্য যে কীর্তনের এক অবচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল, তাহা চৈতন্যজীবনী হইতে উপলব্ধ হয়৷ সুতরাং কীর্তনকে আমরা যখন হইতে বিশিষ্ট ধর্ম-সংগীত হিসাবে পাইতেছি, তখন হইতেই নৃত্য তাহার একটি প্রধান অংশরূপে পরিগণিত দেখি৷ নৃত্যের মহিমা সম্বন্ধে পদ্মপুরাণে আছে—
‘কৃষ্ণভক্ত যখন নৃত্য করেন, তখন তাহার প্রভাবে বহুপ্রকার অমঙ্গল বিনষ্ট হয়৷ তাঁহার নৃত্যপর চরণযুগল ধরণীর, সঞ্চারিত নেত্রদ্বয়ের দৃষ্টি দিক্‌সমূহের এবং নৃত্যকালে ঊর্ধ্বোত্থিত বাহুদ্বয় সুরপুরের অমঙ্গল নাশ করে৷’
নবদ্বীপের ভক্তগণ যখন দলে দলে আসিয়া প্রভুকে প্রণাম করিত, তখন তিনি তাহাদিগকে উপদেশ দিতেন,
আপনে সভারে প্রভু করে উপদেশ৷
কৃষ্ণনাম মহামন্ত্র শুনহ বিশেষ৷৷
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে৷
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে৷৷
– চৈতন্যভাগবত
তিনি উপদেশ করিতেন,
কীর্তন করিহ সভে হাতে তালি দিয়া৷
হরয়ে নমঃ কৃষ্ণযাদবায় নমঃ৷
গোপাল গোবিন্দরাম শ্রীমধুসূদন৷৷
– চৈতন্যভাগবত
এইভাবে ঘরে ঘরে নগরে নগরে সংকীর্তন প্রচারিত হইতে লাগিল৷ দুর্গোৎসবের জন্য প্রায় প্রতি ঘরে যে মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খঘণ্টা থাকিত, কীর্তনের সময় সেই সকল বাদ্য বাজিত৷
মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ আছে সর্বঘরে৷
দুর্গোৎসবকালে বাদ্য বাজাবার তরে৷৷
সেই সব বাদ্য এবে কীর্তনসময়ে৷
গায়েন বায়েন সভে আনন্দ হৃদয়ে৷৷
– চৈতন্যভাগবত

খোল ও মৃদঙ্গ : মৃদঙ্গ সুপরিচিত বাদ্যযন্ত্র৷ এখনও আমরা মৃদঙ্গ বলিতে পাখোয়াজ বুঝি — পাখোয়াজের অঙ্গ যদিও মৃন্ময় নহে৷ তাহার রহস্য এই যে মৃদঙ্গ যখন উদ্ভাসিত হয় তখন তাহার উপাদান ছিল মৃত্তিকা৷ ত্রিপুরাসুর শিবকর্তৃক নিহত হইলে তাহার শোণিতাক্ত মৃত্তিকার দ্বারা এই যন্ত্র নির্মিত হইয়াছিল এবং তাহারই চর্ম ও অন্ত্রদ্বারা ইহার আবরণ ও দল প্রস্তুত হইয়াছিল৷ পরে কোন সময়ে বোধ হয় মৃত্তিকার ভঙ্গপ্রবণতাহেতু কাষ্ঠের দ্বারা ইহার অঙ্গ গঠিত হইয়াছিল৷ যাহা হউক, এমন মৃদঙ্গ, মর্দল বা মাদল সাধারণতঃ কাষ্ঠনির্মিত চর্মযন্ত্র৷ সম্ভবতঃ শ্রীচৈতন্যের সময়ে মৃত্তিকা পুনরায় ইহার উপাদানরূপে ব্যবহৃত হইল৷ প্রবাদ এই যে, শ্রীচৈতন্য যেমন কীর্তনের জনক, তেমনই কীর্তনে খোলেরও প্রবর্তক৷ ভক্তিরত্নাকর বলেন,
শ্রীপ্রভুর সম্পত্তি শ্রীখোল করতাল৷
তাহে কেহ অর্পয়ে চন্দন পুষ্পমাল৷৷
– ভক্তিরত্নাকর

অদ্যাপি কীর্তনের স্থলে শ্রীখোলে মাল্যচন্দন দিবার রীতি চলিয়া আসিতেছে৷ শ্রীচৈতন্যের ‘সম্পত্তি’ অর্থাৎ আবিষ্কার বলিয়াও বটে, ধর্ম সংগীতে ব্যবহৃত হয় বলিয়াও বটে, খোল শব্দটির পূর্বে বৈষ্ণবেরা ‘শ্রী’ যোগ করিয়া থাকেন; কিন্তু ইহার সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘মৃদঙ্গে’ শ্রী যোগের পদ্ধতি অপরিজ্ঞাত৷ মণিপুর রাজ্যে এখনও বৈষ্ণবধর্ম অনুসৃত হয়; সেখানে খোল-করতালের আরতি করিয়া কীর্তন আরম্ভ হয়ে দেখিয়াছি৷

বৈষ্ণব পদাবলীতে ‘রবাব’ হিন্দুদের রুদ্রবীণা মুসলমান আমলে রবাব নামে পরিচিত হয়), ‘বীণা’ ‘মুরলী’ প্রভৃতি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখা যায়৷ কিন্তু কীর্তনে এইসকল যন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায় না৷ ইহাতে মনে হয় যে, কীর্তনের কেবল মানবকণ্ঠের স্বাভাবিক শক্তির উপরই নির্ভর করা হইত; খোল-করতাল ব্যতীত অন্য কোনও যন্ত্রের সহকারিতার অপেক্ষা করিত না৷ তাহার ফলে কীর্তন-সংগীত সর্বসাধারণের পক্ষে সুখলভ্য হইল৷ সে সময়ে খোল-করতাল দুর্মূল্য ছিল না, কাজেই দারিদ্র পল্লীতে পর্যন্ত কীর্তনের ব্যবস্থা করা কঠিন ছিল না৷