একখানি পুঁথি পাইয়াছি, পুঁথিখানি খণ্ডিত ৷ ৪২ পাতা হইতে ৫০ এবং ৫৬ পাতা হইতে ৬০, মোট এই ১৬ খানি পাতা আছে। পদাবলীর পুঁথি,—পুঁথির মধ্যে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, যদুনাথ, জ্ঞানদাস, শ্যামানন্দ ও লোচন এই ছয়জন পদকর্তার পদ আছে ৷ নায়ক-নায়িকার পূর্বরাগাদি অবস্থার লক্ষণ বর্ণনার পর তাহরই উদাহরণস্বরূপ এক একজন পদকর্তার পদ উদ্ধৃত হইয়াছে ৷ সঙ্কলয়িতা বা লিপিকরের কোনো পরিচয় নাই৷
অত্র পদং বলিয়া প্রথমেই এই পদটি আছে,— শ্রীরাধিকার পূর্বরাগ ৷৷
“অম্বর হেরি রহল ধনি সম্বিত কম্পিত ঘন ঘন অঙ্গ ৷
বাহু পশারি ধাই ধরু কাকরু কো বুঝে মরম তরঙ্গ ৷৷
সুন্দরী হাসি বচন কঁহু থোর ৷
নিল অঞ্চল লই সঘনে আলিঙ্গই নয়নে অঝরে ঝরো লোর ৷৷
কি শুনিলুঁ কি করলুঁ কো জানে কৈছন ঐছন পুন কহে বাত ৷
দরশন পরশে সরস মন মানস কোই করব হাত হাত ৷৷
অধমুখ হোই রহই কুল কামিনি ভাবিনি ভাব গভীর ৷৷
বিদ্যাপতি ভণ মরমহি জাগত অদভূত শ্যাম শরির ৷৷
তত্রৈব ৷৷

নিশি দিষী ভাবি ভবনে ধনি রহই ৷
দারুণ মদন দহনে তনু দহই ৷৷
সুন্দরী আকুল পরাণ ৷
মরম কি দুষখ কোই নাহি জান ৷৷
ঘন তনু কম্পই ঝম্পই কাম ৷
মনে মনে সঘনে জপয়ে প্রিয় নাম ৷৷
কানু কমল তনু অতুল উজোর ৷
স্মঙরিতে মনোহি নয়নে বহে লোর ৷৷
সখিগণ পরশে সরস যদি হোই ৷
মনোমথ হৃদয়ে বিদারই সোই ৷৷
রেণু পর পতই সোতই খিতি মাঝ ৷
উঠইতে লোটই ঘটই বাহু লাজ ৷৷
সখিগণ দেখি নিমিখ নাহি ছোড় ৷
বিদ্যাপতি ভণ ঘন তনু মোড় ৷৷
ইহার পর গোবিন্দদাসের বিখ্যাত — “ঢল ঢল সজল জলদ তনু সোহন মোহন অভরণ সাজ” এই পদটি আছে ৷
অথ কৃষ্ণস্য পূর্বরাগ ৷৷ পদম ৷৷
“রতন মন্দির মাঝে বৈঠল সুন্দরী”

গোবিন্দদাসের পদ ৷৷ ইহার পর বিদ্যাপতির পদ ৷

রাই কো পেখি উপেখি জগ ভাবিনি ভাবি রহই হৃদি মাঝ ৷
এ অপরূপশী কো নিরমায়ল কো বিধি বিদগধ রাজ ৷৷
মাধব মদন দহনে তনু ভোর ৷
ক্ষেনে ক্ষেনে উঠই মূরুছি তনু লোটই সুবল সখা করূ কোর ৷৷
মরম সখাসনে সকল নিবেদন কিয়ে ভেল পাপ পরাণ ৷
তছু মুখ নিরখি তরখি জীঊ জায়ত কতহিঁ করব সমাধান ৷৷
অরুণিম অধরে সুধাকত বরিখত বচন অমিয়া তছু মাঝ ৷
হেন মনে হোই চরণে ধরি রোদই পরিহরি গৌরব লাজ ৷৷
সো নাহি পায়ল বিধি না ঘটায়ল পুন যদি অনুকূল হোয় ৷
বিদ্যাপতি ভণ এই নিবেদন আনি মিলায়বি মোয় ৷৷

উদ্ধৃত পদে সুবল সখার নাম প্রমাণিত করে, পদটি বিদ্যাপতির নহে ৷

শুনহে সুবল সখা আর কি হইব দেখা
পাষরিতে নারি সুধামুখি ৷
এ কথা কহিব কায় কেবা পরতীত যায়
মোর প্রাণ আমি তার সাখি ৷৷
সখা হে ভাবিতে গুণিতে তনু শেষ ৷
না জানি কি করে বিধি যদি কার্য্য নহে সিদ্ধি
আনলে করিব পরবেশ ৷৷
সুনিয়া সুবল কয় কিছু না করিহ ভয়
অবিলম্বে আনি দিব তারে ৷
পুরাব তোমার আশ তবে সে জানিবে দাস
বিলাস করিবে রসভরে ৷৷
কর যোড় করি শ্যাম সখায় করে পরনাম
ইহ লোকে তুমি মোর বন্ধু ৷
বিদ্যাপতি বোলে রাখ রাঙ্গা পদতলে
এইবার তরাহ ভবসিন্ধু ৷৷

বলা বাহুল্য, মৈথিল বিদ্যাপতির পদে সুবলসখার স্থান নাই৷
পদগুলি একই বিদ্যাপতির লেখা ৷ একই পুঁথিতে এইরূপ উদাহরণের মধ্যে ইহাই স্বাভাবিক ৷ এই সমস্ত পদ নগেনবাবুর ‘বিদ্যাপতি’ অথবা পণ্ডিত শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র রায় এম-এ সম্পাদিত ‘অপ্রকাশিত পদরত্নাবলী’ ইত্যাদি গ্রন্থে পাওয়া যায় না ৷ পদকল্পতরুর সঙ্গে মাত্র একটি পদের মিল আছে ৷ পদগুলি মিথিলার বিদ্যাপতির নহে ৷ ইহাও সম্ভব নয় যে কোনো ‘জয়গোপাল’ নিজের রচনা বিদ্যাপতির নামে চালাইয়া দিয়াছেন ৷ কারণ, বিদ্যাপতির পদের সঙ্গে পরিচয় না থাকিলে অনুকরণ চলিতে পারে না ৷ পরিচয় থাকিলে অন্ততঃ ব্রজবুলিতে পদ লিখিয়া ভণিতা জুড়িবার চেষ্টাই স্বাভাবিক ৷ বাঙ্গালায় পদ লিখিয়া বিদ্যাপতির নামে চালাইতে চেষ্টা করিবার মত নির্বুদ্ধি জয়গোপালেরা নহেন ৷ বাঙ্গালায় লেখা আরো অনেক পদ বিদ্যাপতির ভণিতায় আছে ৷ সহজ-সাধনের পদের অনুরূপ পদও বিদ্যাপতির ভণিতায় পাওয়া যায় ৷ এই সমস্ত পদ আলোচনা করিয়া মনে হয় ‘বিদ্যাপতি’ উপাধিযুক্ত কোনো বাঙ্গালী পদকর্তা ছিলেন ৷ এ অনুমানের বেশ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও আছে ৷ প্রমাণ এই —
শ্রীখণ্ডের রামগোপাল চৌধুরী বিখ্যাত লোক ছিলেন ৷ তাঁহার ‘রসকল্পবল্লী’ গ্রন্থের নাম রসজ্ঞ সমাজে সুপরিচিত ৷ ইনি শ্রীখণ্ডের দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত রতিকান্ত ঠাকুরের শিষ্য । ইঁহারই পুত্র পীতাম্বর দাস রসকল্পবল্লীর কোরক লইয়া রসমঞ্জরী রচনা করেন ৷ রামগোপাল দাস (দাস ইঁহাদের বৈষ্ণবোচিত দীনতার পরিচায়ক) “বাণ অঙ্গ শর ব্রহ্ম নরপতি শাকে” রসকল্পবল্লী রচনা শেষ করিয়াছিলেন ৷ অঙ্গে শব্দে ষড়ঙ্গ, অষ্টাঙ্গ এমন কি নবধা ভক্তি-লক্ষণ ধরিয়া নবাঙ্গও বুঝাইতে পারে ৷ এই হিসাবে ১৫৯৫ শকাব্দ হয় ৷ ইঁহার রচিত ‘শ্রীখণ্ডের (নরহরি সরকার ঠাকুর ও রঘূনন্দন সরকার ঠাকুরের) শাখা নির্ণয়’ নামে একখানি গ্রন্থ আছে ৷ এই গ্রন্থে — শ্রীরঘূনন্দনের শাখা গণনায় ইনি লিখিয়াছেন —
‘কবিরঞ্জন’ বৈদ্য আছিলা খণ্ড বাসি ৷
যাহার কবিতা গীতে ত্রিভুবন ভাসি ৷৷
তার হয় শ্রীরঘূনন্দনে ভক্তি বড় ৷
প্রভুর বর্ণনা পদ করিলেন দড় ৷৷
পদং যথা—
শ্যাম গৌরবরণ এক দেহ ইত্যাদি ৷
গীতেষু বিদ্যাপতিবদ্‌বিলাসঃ ৷
শ্লোকেষু সাক্ষাৎ কবিকালিদাসঃ ৷৷
রূপেষু নির্ভর্ৎসিতপঞ্চবাণঃ ৷
শ্রীরঞ্জনঃ সর্ব্বকলানিধানম্‌ ৷৷
ইহা হইতে বুঝা যায় শ্রীখণ্ডের কবিরঞ্জন বৈদ্য সুকবি ছিলেন এবং তাঁহার বিদ্যাপতি উপাধি ছিল ৷ লোকে তাঁহাকে ‘ছোট বিদ্যাপতি’ বলিত ৷ মিথিলার বিদ্যাপতিরও ‘নব জয়দেব’ উপাধি ছিল এবং কবিতায় তিনি সে উপাধি ব্যবহার করিতেন ৷ “সুকবি নব-জয়দেব’ উপাধি ছিল এবং কবিতায় তিনি সে উপাধি ব্যবহার করিতেন ৷ “সুকবি নব-জয়দেব ভণিওরে” ইত্যাদি ৷ বলা বাহুল্য, শ্রীখণ্ডের কবি বিদ্যাপতি উপাধি ব্যবহার করিতেন বলিয়াই লোকে তাঁহাকে ‘ছোট বিদ্যাপতি’ বলিত ৷ অবশ্য ‘নব-জয়দেবে’র মত কবিতায় কিছু নিজে নিজে ‘ছোট বিদ্যাপতি’ ভণিতা দেওয়া যায় না ৷ ইঁহার নাম ‘কবিরঞ্জন’ অথবা ‘কবি-রঞ্জন’ অর্থাৎ নাম শুধুই রঞ্জন, লেখক বলিবার সময় কবিরঞ্জন বৈদ্য বলিয়াছেন —সন্দেহ হয় ৷ শ্লোকে কবিরঞ্জন বলিতে গেলে ছন্দ ভঙ্গ হয়, তাই বোধ হয় শ্রীরঞ্জন বলা হইয়াছে ৷ ইঁহার অনেক গানে কিন্তু কবিরঞ্জন ভণিতা আছে ৷ “শ্যাম গৌরবরণ এক দেহ” পদটি উদ্ধৃত করিতেছি৷ পদটিতে শ্রীমহাপ্রভুর তত্ত্ব বর্ণিত হইয়াছে —
শ্যাম গৌরবরণ একদেহ ৷
পামর জন ইথে করয়ে সন্দেহ ৷৷
সৌরভে আগর মুরতি রস সার ৷
পাকল ভেল জনু ফল সহকার ৷৷
গোপ জনম পুন দ্বিজ অবতার ৷
নিগমে না জানয়ে নিগুঢ় বিহার ৷৷
প্রকট করল হরিনাম বাখান ৷
নারি পুরুখ মুখে না শুনিয়ে আন ৷৷
ত্রিপুরাচরণ কমল মধুপান ৷
সরস সঙ্গীত কবিরঞ্জন গান ৷৷
কোন কোন পুঁথিতে এই পদ কবিশেখরের নামে আছে ৷ কবিশেখরও শ্রীখণ্ডের রঘূনন্দনের শিষ্য সুতরাং কোন লিপিকার-কর্তৃক এরূপ পরিবর্তন আশ্চর্যের বিষয় নহে ৷ পদটি পদকল্পতরুতে আছে ৷
যে বিখ্যাত পদটির ব্যাখ্যা লইয়া পণ্ডিতে পণ্ডিতে মতভেদের আর অন্ত নাই, সেই “চরণ নখ রমণি রঞ্জন ছাঁদ” পদটি এই শ্রীখণ্ডের কবিরঞ্জনের ৷ নগেনবাবু তাঁহার বিদ্যাপতি পুস্তকে পটি “চরণ-নখর মণি রঞ্জন ছাঁদ” এই আকারে গ্রহণ করিয়া বিদ্যাপতির ভণিতা জুড়িয়া দিয়াছেন এবং বহুবিধ ব্যাখ্যা বিস্তার করিয়াছেন ৷ রামগোপাল দাস-সংক্ষেপে গোপাল দাসের পুত্র পীতাম্বর দাস তাঁহার ‘রসমঞ্জরী’ গ্রন্থে এই পদ কবিরঞ্জনের ভণিতায় গ্রহণ করিয়াছেন ৷ রসমঞ্জরীর ভণিতা—
কহ কবিরঞ্জন শুন বরনারি ৷
প্রেম অমিয়-রসে লুবুধ মুরারি ৷৷

পিতা যে কবিরঞ্জনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়াছেন, পুত্রের পুঁথিতে তাঁহারই পদ উদ্ধৃত হইয়াছে, — অন্ততঃ এই কবিরঞ্জনের ভণিতায় এইরূপই মনে হয় ৷ উভয়েই শ্রীখণ্ডবাসী ৷ মিথিলায় বিদ্যাপতির কবিরঞ্জন ভণিতার কোন পদ পাওয়া যায় না ৷ তাছাড়া এমনও হইতে পারে যে, শ্রীখণ্ডের কোন অনুরক্ত লিপিকর কবিরঞ্জন নাম তুলিয়া ভণিতায় বিদ্যাপতি উপাধি জুড়িয়া দিয়াছেন ৷
পদকল্পতরুতে কবিরঞ্জন ভণিতায় এই কয়েকটি পদ আছে —
১৷ আর কবে হবে মোর শুভখণ দিন
২৷ কি কহব রে সখি আজুক বিচার
৩৷ কি পুছসি রে সখি কানুহ নেহ
৪৷ পুরুষ রতন হেরি মন ভেল ভোর
৫৷ উদসল কুন্তল ভারা
৬৷ কি কব রাইয়ের গুণের কথা
৭৷ আরে সখি কবে হাম সো ব্রজে যাওব

আমার পুঁথিতে
১৷ সুরচন বেশ বয়েস নব কৈশোর
২৷ শুন গো রাজার ঝি
৩৷ শুন ধনি রমণি শিরোমণি রাধে
৪৷ যতন করিয়া হরি
৫৷ সখিগণ আপন করু
৬৷ শ্যাম নাম যবে
৭৷ ধনি ভেল মানিনী
৮৷ সুন্দরি দূরে কর মান দূরন্ত
৯৷ বিমুখ দেব যব
১০৷ নিরলস চিত ভীত মানি
১১৷ সহচরি বচন শ্রবণে যব শুনল
১২৷ কেনে বা পোহাল্য নিশি
১৩৷ হোর দেখ বরজ-রাজ-কুলনন্দন
১৪৷ মাধব বিপিনে গমন
১৫৷ বেলি অবসানে বসিল ধনি
১৬৷ হরি যব রথপর
১৭৷ হোর দেখ গকুল
১৮৷ মাধব করে ধরি বহুত
১৯৷ মাধব রথপর যব
২০৷ তীন কারণ তীন খোঁয়াঙলু
২১৷ শ্যামরু শোকে সিন্ধু নিরমাওল
অথ কৃষ্ণস্য দূতী গমনং —
শুন গো রাজার ঝি কহিতে আসিঞাছি ৷
কানু হেন ধনে বধিলে পরাণে এ কাজ করিলে কি ৷৷
বেলি অবসান বেলে তুমি গিঞাছিলে জলে ৷
তাহারে দেখিঞা মুচকি হাসিঞা ধরিলে সখির গলে ৷৷
দেখি তুয়া মুখ ছান্দে স্থির নাহি প্রাণ কান্দে (বান্ধে ?)
তুরিতে গমন চিনিতে নারিলাম উহাই বলিয়া কান্দে ৷৷
গোপতে বরত সেবি বর দিল দেবাদেবী ৷
থুরি দরশনে আস না পুরল ভণে বিদ্যাপতি কবি ৷৷

আমাদের বহুদিনের সন্দেহ ছিল — বিদ্যাপতি দুইজন ৷ নহিলে বিদ্যাপতির নামে এই বাঙ্গালা পদ বা তথাকথিত ব্রজবুলির পদগুলি কে রচনা করিল? তারপর রামগোপাল দাসের শাখা-নির্ণয় দেখিয়া এই সন্দেহ দৃঢ় হয় ৷ এখন বিদ্যাপতির ভণিতাযুক্ত এই পদগুলি দেখিয়া প্রতীতি হইয়াছে শ্রীখণ্ডের কবিরঞ্জন বিদ্যাপতিই এই সমস্ত পদের রচয়িতা ৷ কবিরঞ্জন ভণিতার পদগুলিও আমাদের অনুমানের সমর্থন করিতেছে ৷ পদাবলী সাহিত্যে কবিরঞ্জন নামধারী বা উপাধিধারী কোনো দ্বিতীয় কবির সন্ধান পাওয়া যায় না ৷ এই কবি ঠাকুর রঘুনন্দনের সমসাময়িক ৷ এই সময়েই রায়-শেখর জ্ঞানদাস প্রভৃতি সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণব কবিগণ বর্তমান ছিলেন ৷ সে আজ প্রায় সাড়ে তিন শত বৎসর পূর্বের কথা ৷
কবির কবিত্ব-পরিচয় হিসাবে আর কয়েকটি পদ উদ্ধৃত করিয়া দিলাম ৷ দুই-তিন রকমের পদ, কোনটাই বাছাই নয় ৷

অথ সখী ভর্ৎসন—
সখিগণ আপন করি হাম জান ৷
অন্তর বাহির না কহিল ভাণ ৷৷
স্ত্রীবধে যা কর ভয় নাহি হোয় ৷
তা কর আগে সোঁপিল মোয় ৷৷
পহিলহি আদর নয়ন বিভঙ্গ ৷
করইতে কোর আনল ভেও রঙ্গ ৷৷
এ সকল হামে সহা নাহি জায় ৷
পরিতি পুরুখ সনে কো করু চায় ৷৷
বিদ্যাপতি কহ অব নাহি জান ৷
সুপুরুখ লাগি তেজবি নিজ প্রাণ ৷৷
ভবন বিরহ —
কেনে বা পোহাল্য নিষি দিশী কেনে আইল ৷
ভাবিয়া মরিব কত বিপরিত হৈল ৷
সখি হে কি কহিব কহ ৷
প্রবোধ না মানে চিত করে দহ দহ ৷৷
গুরু গরবিত কত কহে কুবচন ৷
না করে আঁখির আড় নিজ পতি জন ৷৷
বিহানে যাইব বন্ধু আসিব জামিনি ৷
কত না চাহিব পথ কুলের কামিনি ৷৷
বিদ্যাপতি কহে এই লয় মোর মনে ৷
করহ যুগতি বন্ধু না জাও গহনে ৷৷

ভবন বিরহ — (মাথুর )
বেলি অবসানে বসিল ধনি ৷
কেনে বা কি লাগি আকুল প্রাণি ৷৷
যেন কেহু কার করিল চুরি ৷
মারিতে আইসে তরাসে মরি ৷৷
জন ধন গৃহ না লয় মনে ৷
কি জানি কি লাগি এমনি কেনে ৷৷
হেনই সময়ে বাজিল ঢেড়ি ৷
ফুকারিঞা কহে সকল বাড়ি ৷৷
প্রভাতে উঠিয়া গকুল বাসি ৷
দধি দুগ্ধ ঘৃত পুরঞিা রাসি ৷৷
কৃষ্ণ বলরাম লইয়া সঙ্গ ৷
মথুরা যাইবে না হয় ভঙ্গ ৷৷
সুনিঞা বজর পড়িল শিরে ৷
বষন ভিজিল আঁখির নীরে ৷৷
পিছলে চলিতে পড়িয়া গেল ৷
জনু হৃদিমাঝে রহিল শেল ৷৷
বহিয়া যাইতে ডুবিল তরী ৷
ঐছন জানব বরজ নারী ৷৷
কি হবে কি হবে ক্রন্দন ধনি ৷
মুরুছি পড়ল রমণি মণি ৷৷
চেতন পাইঞা উঠিল রাই ।
কহিছে কিরূপে রহে মাধাই ৷৷
বুক মুখ বাঞা পড়িছে লোর ৷
কবি বিদ্যাপতি কান্দিয়া ভোর ৷৷

শ্যামরু শোকে সিন্ধু নিরমাওল তথিপর আনল ডারি ৷
সব গুণে হারল যো কছু রহি গেল হৃদি কম্পিত বরনারী ৷৷
সখি হে অব নাহি মিলব কান৷
গোপতি নন্দন সো কাহে মারব আপহি তেজব পরাণ ৷৷
গিরি তনয়াধব কতহিঁ নাম লব জপি জপি জীবন শেষ ৷
নিজ বসন লাগে আগি সব রজনী দশমি দশা পরবেশ ৷৷
অমরাবতি পতি ঘরণি গুণদ্বয় যদি মঝু হোয়ত মাই ৷
বিদ্যাপতি ভণ ভাবি মরব কাহে না মিলল নিঠুর মাধাই ৷৷

‘গোপতি নন্দন’ ইত্যাদির ব্যাখ্যা বোধ হয় এইরূপ হইবে— “সেই রাখালের হাতে কেন মরিব, আপনিই প্রাণত্যাগ করিব ৷ (কামের ভয়ে কামারি) গঙ্গাধরের নাম আর কত লইব, জপিতে জপিতে প্রাণ শেষ হইয়া গেল ৷ (অমরাবতীর পতি ইন্দ্র, তাঁহার ঘরণী শচীদেবী ৷ গুণদ্বয় অর্থাৎ দ্বিতীয় গুণ রজঃ, লেখক রজ ধরিয়াছেন) শচীরজ অর্থাৎ শচী-অঙ্গজ শ্রীগৌরাঙ্গদেব যদি আমার হন (তবে) বিদ্যাপতি কহিতেছেন নিঠুর মাধাই না-ই বা মিলিল, কি জন্য ভাবিয়া মরিব ৷”
এই পদ হইতে বুঝিতে পারা যায় এই বিদ্যাপতি শ্রীমহাপ্রভুর ভক্ত এবং তাঁহার পরবর্তী কবি ৷ সুতরাং আমরা যে আন্দাজ করিয়াছি, এই বিদ্যাপতিই শ্রীখণ্ডের কবিরঞ্জন বিদ্যাপতি—এ পদে তাহারও কিছু সমর্থন পাইতেছি৷
মহানস ব্রজভূমি মাহ৷
কয়লহি ভাবরসে স্বাদু সুধাধিক যোগিনি পাক নিরবাহ ৷৷
আগম যোগস্থল কো পরবেশব রোয়ে অমর নরবৃন্দ ৷
ভোখ পিয়াসে কোন বিলাওব দুলহ অমিয় মকরন্দ ৷৷
জগ ভরি জয় জয় নদিয়া মহাকাশে উয়ল গউর বর ইন্দু ৷
দূরে গেও উচ নীচ ভাসল ত্রিভুবন উছলল কৌমুদী সিন্ধু ৷৷
অভেদ সুর নর শ্বপচ দ্বিজবর সুচির অনর্পিত প্রেমা ৷
অঞ্চলে পাওল গোলক বৈভব রঙ্ক নিঃশঙ্কিত হেমা ৷৷
পাই পরমান্ন দীন অধমজন ধনি ধনি কলিযুগ বন্দে ৷
কবিরঞ্জন ভন ঐছে নিবেদন রঘুনন্দন পদ দন্দ্বে ৷৷