“নামলীলাগুণাদীনাং উচ্চৈর্ভাষা তু কীর্তনম্‌” শ্রীহরির নাম, লীলা ও গুণাদির উচ্চভাষণই কীর্তন ৷ নবধা ভক্তির দ্বিতীয় অঙ্গ কীর্তন ৷ এই কীর্তন ‘জপ’ নামেও পরিচিত ৷ শ্রীভগবান্‌ গীতায় বলিয়াছেন ‘যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি’৷ জপ ত্রিবিধ — মানসিক জপ, মনে মনে জপ, উপাংশু-জপ ৷ মনুসংহিতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৮৫ সংখ্যক উপাংশু-জপের প্রশংসা আছে মনু বলিতেছেন—
বিধিযজ্ঞাজ্জপযজ্ঞো বিশিষ্টো দশভিগু ণৈঃ
উপাংশুঃ স্যাচ্ছতগুণঃ সহস্রো মানসঃ স্মৃতঃ৷৷
দশ-পৌর্ণমাসাদি বিধি যজ্ঞ অপেক্ষা প্রণবাদির জপযজ্ঞ দশগুণ অধিক শুভপ্রদ ৷ সেই জপযজ্ঞের অপেক্ষা উপাংশুজপ (যে জপমন্ত্র উচ্চারিত হইয়া নিকটস্থ অপর লোক কর্তৃক শ্রুত হয় না) শতগুণে ফলপ্রদ এবং মানসজপ সহস্রগুণে শুভপ্রদ (শ্রীশ্যামাকান্ত বিদ্যাভূষণের অনুবাদ ৷)
অপরে শুনিতে পাইবে না, অথচ আমার ওষ্ঠোচ্চারিত মন্ত্র আমি শুনিতে পাইব, ইহারই নাম উপাংশু জপ ৷ তৃতীয় জপ বাচিক জপ— উচ্চকণ্ঠে হরি-কীর্তন ৷
এই কীর্তন নামকীর্তন ও লীলাকীর্তন ভেদে দুই প্রকার ৷ নামকীর্তনে শ্রীহরির নাম ও করুণার কথাই প্রধান ৷ আর লীলাকীর্তনে তাঁহার রূপ গুণ ও বিবিধ মনোহারী লীলার বর্ণনাই প্রাধান্য লাভ করে ৷ নামকীর্তনই হউক আর লীলাকীর্তনই হউক তাহা যথাযথ তাল-প্রয়োগে এবং বিশুদ্ধ সুরে ও বিবিধ রাগ-রাগিণী-যোগে গীত না হইলে কীর্তন-পদবাচ্য হইবে না ৷
শ্রীহরিভক্তিবিলাস ( ৮ম বিলাস, ২৪৭ শ্লোকে) বলিতেছেন —

৷৷ বারাহে ৷৷
ব্রাহ্মণো বাসুদেবার্থং গায়মানোঽনিশং পরম্‌৷
সম্যক্‌ তালপ্রয়োগেণ সন্নিপাতেন বা পুনঃ৷৷
টীকায় আছে —
সন্নিপাতেন বিবিধ রাগাদি সমুচ্চয়েন ৷
ব্রাহ্মণ নিরন্তর বাসুদেবের গুণ গান করিবেন ৷ এই গান সম্যক্‌ তাল প্রয়োগে এবং বিবিধ রাগাদিতে গীত হইবে ৷
* * *
নারায়ণানাং বিধিনা গানং শ্রেষ্ঠতমং স্মৃতম্‌ ৷
গানেনারাধিতো বিষ্ণুঃ স্বকীর্ত্তিজ্ঞানবর্চ্চসা
দদাতি তুষ্টঃ স্থানং স্বং যথাস্মৈ কৌশিকায় বৈ ৷৷
নরগণের সকল আরাধনার শ্রেষ্টতম হইল নারায়ণের গুণগান ৷ ভগবান্ নাম-গুণলীলায় আরাধিত হইলে প্রীতি লাভ করেন এবং গায়ককে কৌশিকের ন্যায় নিজ স্থানে লইয়া যান ৷
গায়ক ভাবাবিষ্ট হইলে স্বতন্ত্র কথা ৷ স্বাভাবিকভাবে উচ্চ কণ্ঠে হরিকীর্তন-গানে নৈর্মলতার উপর লক্ষ্য রাখিতে হইবে৷ ভক্তি-রত্নাকর বলিতেছেন —
উচ্চারণেন বাক্যস্য সম্যগর্থাববোধনম্‌
উচ্চারণে বাক্যের সকল বোধ হয় ৷
অদোষ রসযুক্তার্থ নৈর্ম্মল্য কহয় ।৷

শ্রীভগবানের লোককণ্যাণপ্রদ কীর্তিকথনই কীর্তন ৷ শ্রীমদ্‌ ভাগবতে উল্লিখিত আছে— ব্রজরাখালগণ সখা শ্রীকৃষ্ণের গুণ গান করিতেন ৷ রাসে গোপী-গীত এবং মাথুর-বিরহে ভ্রমর-গীত এবং মাথুর -বিরহে ভ্রমর-গীত ভক্ত-গণের আস্বাদ্য বস্তু ৷ যে গানে হৃদয় নির্মল হয়, যে গানে শ্রীভগবদ্‌পাদপম্মের স্মৃতি জাগ্রহ হয়, তাহাই জগতের অভ্যুদয়প্রদ সঙ্গীত ৷ সঙ্গীত মানবহৃদয়ের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি ৷ ভক্তহৃদয়ের অভিব্যক্তি বলিয়া কীর্তন সর্বশ্রেষ্ঠ ৷
শ্রীমদ্ভাগবতে কীর্তনের উল্লেখ আছে ৷
হিরণ্যকশিপুর প্রশ্নে শ্রীপ্রহ্লাদ বলিতেছেন —

শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম ৷
অর্চ্চনং বন্দনং দাস্য সখ্যমাত্মনিবেদনম ৷৷
ইতি পুংসার্পিতা বিষ্ণৌ ভক্তিশ্চেন্নবলক্ষণা।
ক্রিয়েত ভগবত্যদ্ধা তন্মন্যেঽন্বিতমুত্তমম্‌ ৷৷

নিম্নের শ্লোকে সঙ্কীর্তনের উল্লেখ পাইতেছি—
কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গপাঙ্গাস্ত্র পার্ষদৈঃ
যজ্ঞৈঃ সঙ্কীর্তনপ্রায়ৈ র্যজন্তিহি সুমেধসঃ ৷৷
নারদের নামে প্রচলিত সঙ্গীতগ্রন্থ আছে৷ ‘নারদ-পঞ্চরাত্র’ গ্রন্থখানি মহর্ষি নারদ-বিরচিত ৷ আধুনিক কোন কোন ব্যক্তি বলেন, এই গ্রন্থখানি দুই হাজার বৎসর পূর্বে বা তাহার দুই-একশত বৎসর পরে রচিত হইয়াছিল ৷ এই গ্রন্থে বর্ণিত আছে, এক জন্মে নারদ উপবর্হন নামে গন্ধর্বগণের অধিপতি ছিলেন ৷ সঙ্গীতবিদ্যায় তাঁহার প্রভূত পারদর্শিতা ছিল ৷
নারদ-পঞ্চরাত্রের ‘পঞ্চম রাত্রম’ শ্রীব্যাসদেব বলিতেছেন — ব্রহ্মার আদেশে —
অথ গন্ধর্ব্বরাজস্তু ভগবানাজ্ঞয়া বিধেঃ ৷
সঙ্গীতজ্ঞঃ জগৌ তত্র কৃষ্ণরাসমহোৎসবম্‌ ৷৷
সুষমং তালমানঞ্চ সতানং মধুরশ্রুতম্ ৷
বীণা-মৃদঙ্গ-মুরজ-যুক্তং ধ্বনিসমন্বিতম্‌ ৷৷
রাগিণীযুক্তরাগেণ সময়োক্তেন সুন্দরম্ ৷
মাধুর্য্যং মূর্চ্ছনাযুক্তং মনসো হর্ষকারণম্‌ ৷৷
বিচিত্রং নৃত্যরুচিরং রূপবেশমনুত্তমম্ ৷
লোকানুরাগ বীজঞ্চ নাট্যোপযুক্তহস্তকম্‌ ৷৷
অনন্তর ঐশ্বর্যশালী গন্ধর্বরাজ উপবর্হন ব্রহ্মার আদেশানুসারে সেই সভাস্থলে কৃষ্ণের রাসমহোৎসব গান করিলেন ৷ সেই সঙ্গীত সুশোভন তাল মান সুতান সুমধুর বীণা মৃদঙ্গ মুরজধ্বনি মিশ্রিত শ্রুতিমধুর ৷ সময়োচিত রাগিণীযুক্ত সেই গান রাগমূর্ছনাযুক্ত বলিয়া মাধুর্যময় ও মনের উল্লাসকারক ৷ সেই সভায় উপস্থিত বিচিত্র রুচির নৃত্যকারী নটদিগের মনোহর রূপ ও উত্তম বেশ অনুরাগের বীজস্বরূপ এবং হস্তাদির চালন নাট্যোপযুক্ত ৷ উপবর্হনের গানে মৃদঙ্গের সঙ্গে বীণা ও মুরজের উল্লেখ রহিয়াছে ৷
সেকালের ভাষায় রচিত বৌদ্ধচার্যগণের বহু সাধনসঙ্গীত পাওয়া গিয়াছে ৷ আচার্যগণ, তাঁহাদের শিষ্যগণ এবং সাধারণ গৃহস্ত সকলেও সে সমস্ত সঙ্গীত গান করিতেন ৷ এই সমস্ত সঙ্গীত যে সুরে ও তালে গাওয়া হইত, সেই সেই সুর ও তাল একেবারে লোপ পায় নাই ৷ তাহার মধ্যে কোন কোন সুর ও তাল অজিও কীর্তনে ব্যবহৃত হয় ৷
বৌদ্ধ সাধনসঙ্গীতের পরই কবি জয়দেবের নাম উল্লেখ করিতে পারি ৷ শ্রীগীতগোবিন্দের কবিত্ব, ছন্দ ও ভাষা যেমন অনবদ্য, ইহার অন্তর্নিহিত সাধন-সঙ্গেতও তেমনই অভিষ্টপ্রদ ৷ শ্রীরাধাকৃষ্ণের উপাসনা-রহস্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এই শ্রীগীতগোবিন্দ ৷ গ্রন্থখানি সঙ্গীতরাজ্যেও প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল ৷ কি সঙ্গীতজ্ঞগণ, কি বৈষ্ণবাচার্যগণ সকলেই স্বীকার করেন কবি জয়দেব সুগায়ক এবং সুরে তালে অভিজ্ঞ ছিলেন ৷ নিজ-রচিত সঙ্গীতে তিনি নিজেই রাগ ও তালের সন্নিবেশ করিয়াছিলেন ৷ বৌদ্ধ গানের পর জয়দেবের গান, তাহার পর মঙ্গলগান ও চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির মধ্য দিয়া কীর্তনের ধারা প্রায় অব্যাহত আছে ৷
চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পরেই শ্রীগৌরাঙ্গদেবের আবির্ভাব ৷ বৈষ্ণবাচার্যগণ শ্রীগৌরাঙ্গদেবকে সঙ্কীর্তনের জনক বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকেন ৷ তাহার কারণ তিনিই শ্রীহরিনামকীর্তন যুগধর্ম বলিয়া প্রচার করেন ৷ সঙ্ঘবদ্ধভাবে হরিনামকীর্তনের প্রথা তাঁহারই প্রবর্তিত ৷ তিনিই নীলাচলে শ্রীপাদ স্বরূপ দামোদর ও শ্রীল রামানন্দ রায়ের সঙ্গে চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির পদাবলী, কবি জয়দেবের শ্রীগীতগোবিন্দ কাব্য, রামানন্দ রায়ের জগন্নাথবল্লভ নাটক ও বিল্বমঙ্গলের কৃষ্ণকর্ণামৃত আস্বাদনপূর্বক উক্ত পদাবলী প্রভৃতিকে শাস্ত্রের মর্যাদা দান করিয়া গিয়াছেন ৷ তদবধি উক্ত গ্রন্থাদি ভক্তগণের পরম আস্বাদ্য বস্তুতে পরিগণিত হইয়াছে ৷ গোদাবরীতীরে রায় রামানন্দের সঙ্গে সাধ্যসাধনবিচারে শ্রীগীতগোবিন্দকে তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের সঙ্গে একই কক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করিতে দ্বিধাবোধ করেন নাই ৷ সুকণ্ঠ সুগায়ক শ্রীস্বরূপ দামোদর তাঁহাকে চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি ও জয়দেবের পদাবলী গান করিয়া শুনাইতেন ৷ সেই হইতেই লীলাকীর্তন সুরু হইয়াছিল ৷
সংসারাশ্রমে থাকিবার সময় কেমন করিয়া অধ্যাপক নিমাই আপন ছাত্রগণকে কীর্তন শিখাইয়াছিলেন শ্রীচৈতন্যভাগবতে তাহার বর্ণনা আছে —
শিষ্যগণ বলেন কেমন সংকীর্ত্তন ৷
আপনে শিখায় প্রভু শ্রীশচীনন্দন ৷৷
হরি হরয়ে নম কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ ৷
গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন ৷৷
দিশা দেখাইয়া প্রভু হাততালি দিয়া ৷
আপনে কীর্ত্তন করে শিষ্যগণ লইয়া ৷
(মধ্যখণ্ড)

একদিন শ্রীবাস -অঙ্গনে কীর্তনের সময় শ্রীমহাপ্রভু তিনটি সম্প্রদায় গঠন করিয়া গাহিয়াছিলেন এবং নাচিয়াছিলেন ৷ (শ্রীচৈতন্যভাগবত,মধ্যখণ্ড)
শ্রীহরিবাসরে হরিকীর্ত্তন বিধান ৷
নৃত্য আরম্ভিলা প্রভু জগতের প্রাণ ৷৷
পুণ্যবন্ত শ্রীবাস -অঙ্গনে শুভারঙ্গ ৷
উঠিল কীর্ত্তন-ধ্বনি গোপাল গোবিন্দ ৷৷
ঊষাকাল হৈতে নৃত্য করে বিশ্বম্ভর ৷
যূথে যূথে হৈল যত গায়ক সুন্দর ৷৷
শ্রীবাস পণ্ডিত লঞা এক সম্প্রদায় ৷
মুকুন্দ লইয়া আর জন কত গায় ৷৷
লইয়া গোবিন্দ দত্ত আর কতজন ৷
গৌরচন্দ্র নৃত্যে সবে করেন কীর্ত্তন ৷৷
বৃন্দাবন দাস এই নৃত্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়াছেন ৷ এই পদাংশ বোধ হয় তাঁহারই রচিত ৷
চৌদিকে আনন্দধ্বনি শচীর নন্দন নাচে রঙ্গে ৷
বিহ্বল হইয়া সব পারিষদ সঙ্গে ৷৷
হরি ও রাম ৷৷ ধ্রু৷৷
কাজি-দলনের দিনেও অদ্বৈত আচার্য, হরিদাস এবং শ্রীবাসকে লইয়া প্রধান তিনটি সম্প্রদায় গঠিত হইয়াছিল ৷ এ-দিনের কীর্তনে এই পদ গীত হইয়াছিল—
তুয়া চরণে মন লাগুহুঁ রে ৷
সারঙ্গধর (শার্ঙ্গধর ?) তূয়া চরণে লাগুহুঁ রে ৷৷
বৃন্দাবন দাস বলিয়াছেন —
চৈতন্যচন্দ্রের এই আদি সংকীর্ত্তন ৷
ভক্তগণ গায় নাচে শ্রীশচীনন্দন ৷
শ্রীমহাপ্রভুর এই কীর্তনাভিযানের বর্ণনায় তিনি লিখিয়াছেন —
বিজয় হইলা হরি নন্দঘোষের বালা
হাতে মোহন বাঁশী গলে দোলে বনমালা ৷৷
এই দুই ছত্র কবিতাও একটি পদাংশ বলিয়া মনে হয় ৷ শ্রীচৈতন্য-ভাগবতে অন্য একটি পদাংশ আছে, অনেকে ইহার ব্যাখ্যায় ভ্রমে পড়িয়াছেন ৷ নিম্নে পদ ও ব্যাখ্যা তুলিয়া দিলাম ৷
শ্রীরাগ :
নাগ বলিয়া চলি যায় সিন্ধু তরিবারে ৷
যশের সিন্ধু না দেয় কূল অধিক অধিক বাড়ে ৷৷
কি আরে রামগোপালে বাদ লাগিয়াছে ৷
ব্রহ্মা রুদ্র সুরসিদ্ধ মুনীশ্বর আনন্দে দেখিছে ৷৷
শ্রীবৃন্দাবন দাস শ্রীনিত্যানন্দ-মহিমা বর্ণনা-প্রসঙ্গে বলিতেছেন, অনন্তরূপী শ্রীনিত্যানন্দসহস্র বদনে নিরন্তর কৃষ্ণযশ গান করিতেছেন ৷
গায়েন অনন্ত শ্রীযশের নাহি অন্ত ৷
জয়ভঙ্গ নাহি কারু দোঁহে বলবন্ত ৷৷
এই কথাটি উদ্ধৃত পদাংশে পুনরায় বলিতেছেন — “নাগ (অনন্তদেব সহস্র মুখে) শ্রীকৃষ্ণমহিমা বলিয়া বলিয়া মহিমাসিন্ধু উত্তীর্ণ হইবার জন্য চলিয়া যান ৷ কিন্তু কৃষ্ণের যশের সিন্ধু কূল দেয় না ৷ মহিমাসমুদ্রের সীমা পাওয়া যায় না ৷ মহিমা-সমুদ্র আরও উত্তাল হইয়া উঠে, অধিক অধিক বাড়ে ৷ কি আহা, রাম (বলরাম—অনন্তদেব) এবং গোপালে (শ্রীকৃষ্ণে) এই মহিমাকথন ও মহিমাসিন্ধুর আধিক্যবৃদ্ধিরূপ বিবাদ বাধিয়াছে ৷ ব্রহ্মা, রুদ্র এবং অপরাপর দেবতা, সিদ্ ধও মুনীশ্বরগণ এই (যশ বর্ণন ও যশোরাশি বৃদ্ধি) বিবাদ আনন্দে দেখিতেছেন ৷
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতেও কীর্তনের বর্ণনা আছে ৷
শ্রীমন্‌ মহাপ্রভু দাক্ষিণাত্য হইতে পুরীধামে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন ৷ সংবাদ পাইয়া বাঙ্গালার ভক্তগণ পুরীধামে গিয়াছেন ৷ তাঁহাদের দেব-দর্শন ও প্রসাদ-গ্রহণের পর —
সবা লঞা গেল প্রভু জগন্নাথালয় ৷
কীর্ত্তন আরম্ভ তাঁহা কৈল মহাশয় ৷৷
সন্ধ্যাধূপ দেখি আরম্ভিলা সংকীর্ত্তন ৷
পড়িছা আনি দিল সবারে মাল্য চন্দন ৷৷
চারিদিকে চারি সম্প্রদায় করে সংকীর্ত্তন ।
মধ্যে নৃত্য করে প্রভু শচীর নন্দন ৷৷
অষ্ট মৃদঙ্গ বাজে বত্রিশ করতাল ৷
হরিধ্বনি করে বৈষ্ণব কহে ভাল ভাল ৷৷
কীর্ত্তনের মহামঙ্গল ধ্বনি যে উঠিল ৷
চতুর্দ্দশ লোক ভরি ব্রহ্মাণ্ড ভেদিল ৷৷
পুরুষোত্তমবাসী লোক আইল দেখিবারে ৷
কীর্ত্তন দেখি উড়িয়া লোক হৈল চমৎকারে ৷৷
তবে প্রভু জগন্নাথের মন্দির বেড়িয়া ৷
প্রদক্ষিণ করি বুলে নর্ত্তন করিঞা ৷৷
আগে পাছে গান করে চারি সম্প্রদায় ৷
আছাড়ের কালে ধরে নিত্যানন্দ রায় ৷৷
অশ্রু পুলক কম্প প্রস্বেদ হুঙ্কার ৷
প্রেমের বিকার দেখি লোক চমৎকার ৷৷
পিচকারির ধারা যেন অশ্রু নয়নে ৷
চারিদিকের লোক সব করয়ে সিনানে ৷৷
বেড়ানৃত্য মহাপ্রভু করি কতক্ষণ ৷
মন্দিরের পাছে রহি করেন কীর্ত্তন ৷৷
চারিদিকে চারি সম্প্রদায় উচ্চৈঃস্বরে গায় ৷
মধ্যে তাণ্ডব নৃত্য করে গৌর রায় ৷৷
বহুক্ষণ নৃত্য করি প্রভু স্থির হইলা ৷৷
চারি মহান্তেরে তবে নাচিতে আজ্ঞা দিলা ৷৷
অদ্বৈত আচার্য্য নাচে এক সম্প্রদায় ৷
আর সম্প্রদায়ে নাচে নিত্যানন্দ রায় ৷৷
আর সম্প্রদায়ে নাচে পণ্ডিত বক্রেশ্বর ৷
শ্রীবাস নাচেন আর সম্পদায় ভিতর ৷৷
মধ্যে রহি মহাপ্রভু করে দর্শন ৷
তাহাঁ এক ঐশ্বর্য্য তাঁর হৈল প্রকটন ৷৷
চারিদিকে নৃত্য গীত করে যত জন ৷
সবে দেখে করে প্রভু আমারে দর্শন ৷৷
চারিজনের নৃত্য প্রভুর দেখিতে অভিলাষ ৷
সেই অভিলাষে করে ঐশ্বর্য্য প্রকাশ ৷৷
—শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা)

শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার সময় — সাত সম্প্রদায় কীর্তনীয়া গান করিয়াছিলেন ৷
তবে মহাপ্রভু সব লঞা নিজগণ ৷
স্বহস্তে পরাইলা সবারে মাল্য চন্দন ৷৷
পরমানন্দ পুরী আর ভারতী ব্রহ্মানন্দ ৷
শ্রীহস্তে চন্দন পাঞা বাড়িল আনন্দ ৷৷
অদ্বৈত আচার্য্য আর প্রভু নিত্যানন্দ ৷
শ্রীহস্তে-স্পর্শে দুইয়ে হইলা আনন্দ ৷৷
কীর্তনীয়াগণে দিলা মাল্য চন্দন ৷
স্বরূপ শ্রীবাস তার মুখ্য দুইজন ৷৷
চারি সম্প্রদায় হৈল চব্বিশ গায়ন ৷
দুই দুই মার্দ্দঙ্গিক হৈল অষ্টজন ৷৷
তবে মহাপ্রভু মনে বিচার করিঞা ৷
চারি সম্প্রদায় কৈল গায়ন বাঁটিঞা ৷৷
নিত্যানন্দ অদ্বৈত হরিদাস বক্রেশ্বরে ৷
চারিজনে আজ্ঞা দিল নৃত্য করিবারে ৷৷
প্রথম সম্প্রদায় কৈল স্বরূপপ্রধান ৷
আর পঞ্চজন দিল তার পালি গান ৷৷
দামোদর নারায়ণ দত্ত গোবিন্দ ৷
রাঘব পণ্ডিত আর শ্রীগোবিন্দানন্দ ৷৷
অদ্বৈত আচার্য্য তাঁহা নৃত্য করিতে দিল ৷
শ্রীবাস প্রধান আর সম্প্রদায় কৈল ৷৷
গঙ্গাদাস হরিদাস শ্রীমান্‌ শুভানন্দ ৷
শ্রীরামপণ্ডিত তাঁহা নাচে নিত্যানন্দ ৷৷
বাসুদেব গোপীনাথ মুরারি যাঁহা গায় ৷
মুকুন্দ প্রধান কৈল আর সম্প্রদায় ৷৷
শ্রীকান্ত বল্লভ সেন আর দুইজন ৷
হরিদাস ঠাকুর তাঁহা করেন নর্ত্তন ৷৷
গোবিন্দ গোষ প্রধান কৈল আর সম্প্রদায় ৷
হরিদাস বিষ্ণুদাস রাখব যাঁহা গায় ৷৷
মাধব বাসুদেব আর দুই সহোদর ৷
নৃত্য করেন তাঁহা পণ্ডিত বক্রেশ্বর ৷৷
কুলীনগ্রামের এক, কীর্তনীয়া-সমাজ ৷
তাঁহা নৃত্য করে রামানন্দ সত্যরাজ ৷৷
শান্তিপুর আচার্য্যের এক সম্প্রদায় ৷
অচ্যুতানন্দ নাচে তাহাঁ আর সব গায় ৷৷
খণ্ডের সম্প্রদায় করে অন্যত্র কীর্ত্তন ৷
নরহরি নাচে তাহাঁ শ্রীরঘুনন্দন ৷৷
জগন্নাথ আগে চারি সম্প্রদায় গায় ৷
দুই পার্শ্বে দুই পাছে এক সম্প্রদায় ৷৷
সাত সম্প্রদায়ে বাজে চৌদ্দ মাদল ৷
যার ধ্বনি শুনি বৈষ্ণব হইল পাগল ৷৷
শ্রীবৈষ্ণব ঘটা মেঘে হইল বাদল ৷
সংকীর্তনামৃত সহ বর্ষে নেত্রজল ৷৷
ত্রিভুবন ভরি ওঠে সংকীর্তনের ধ্বনি ৷
অন্য বাদ্যাদির ধ্বনি কিছুই না শুনি ৷৷
সাত ঠাঞি বুলে প্রভু হরি হরি বলি ৷
জয় জয় জগন্নাথ কেহ হাত তুলি ৷৷
আর এক শক্তি প্রভু করিলা প্রকাশ ৷
এক কালে সাত ঠাঞি করেন বিলাস ৷৷
সবে কহে প্রভু আছে এই সম্প্রদায় ৷
অন্য ঠাঞি নাহি যায় আমার দয়ায় ৷৷
– শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা৷

শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর তিরোধানের পর শ্রীনিত্যানন্দপুত্র বীরচন্দ্রের কর্তৃত্বে যে তিনজন আচার্য বৈষ্ণব-সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তাঁহাদের নাম শ্রীল শ্রীনিবাস আচার্য, শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর এবং শ্রীল শ্যামানন্দ ৷ উত্তরবঙ্গের খেতরীর ভূস্বামী শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্তের পুত্র শ্রীনরোত্তম শ্রীধাম বৃন্দাবনে গিয়া শ্রীলোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ এবং শ্রীপাদ শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট ব্যাকরণ ও বৈষ্ণব গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করেন ৷ শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী শ্রীস্বরূপ দামোদরের অন্তরঙ্গ শিষ্য ৷ তিনি তাঁহার নিকট সঙ্গীতও শিক্ষা করিয়াছিলেন মহাপ্রভুর বিরহকাতর, দেহত্যাগে কৃতসঙ্কল্প, দাস গোস্বামী উন্মাদের মত বৃন্দাবনে চলিয়া আসেন ৷ কৃষ্ণ দাস কবিরাজ তাঁহার অন্তরঙ্গ সেবক ৷ কবিরাজ গোস্বামী শ্রীরঘুনাথের নিকট শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের বহু উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলেন ৷
শ্রীবৃন্দাবনে এই সময় সঙ্গীতের যথেষ্ট চর্চা ছিল ৷ সঙ্গীতাচার্য তানসেনের গুরুদেব অদ্বিতীয় সঙ্গীতসাধক শ্রীহরিদাস স্বামী এই সময় শ্রীধামে বর্তমান ছিলেন ৷ তাঁহার নিকট অথবা তাঁহার কোন শিষ্যের নিকট নরোত্তম যে সঙ্গীত-শিক্ষা প্রাপ্ত হন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই ৷ নরোত্তম বৃন্দাবন হইতে জন্মভূমি দর্শন করিতে আসিয়া পিতৃব্য-পুত্র সন্তোষের অনুরোধে খেতরীতে কুটীর বাঁধিয়া বাস করেন, সংসারশ্রমে প্রবেশ করেন নাই ৷ কয়েকটি বিগ্রহ-প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে তিনি খেতরীতে একটি বৈষ্ণব-সম্মেলন অনুষ্ঠান করিলে শ্রীসন্তোষ এই উৎসবের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিয়াছিলেন ৷ এই উৎসবে তৎসাময়িক সমস্ত খ্যাতনামা বৈষ্ণব, সুপণ্ডিত সাধক, গায়ক ও বাদক উপস্থিত হইয়াছিলেন ৷ এই উৎসবের অধিনেত্রী ছিলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর সহধর্মিণী শ্রীজাহ্নবী দেবী ৷ এই সম্মেলনে নরোত্তম কীর্তনগানের রস-কীর্তনের যে পদ্ধতি প্রবতর্ন করেন, তাহা সমগ্র বৈষ্ণবমণ্ডলী-কর্তৃক অনুমোদিত হইয়াছিল ৷ এই সম্মেলনই প্রথম প্রণালীবদ্ধভাবে গৌরচন্দ্রিকা গানের পর লীলাকীর্তনগানের প্রথা প্রবর্তিত হয় ৷ দেখিতেছি এই সম্মেলনে নিজে কীর্তন গাহিবার জন্য নরোত্তম বিশেষভাবে প্রস্তুত হইয়াছিলেন এবং একটি সুশিক্ষিত সম্প্রদায়ও গঠন করিয়াছিলেন ৷ নরোত্তম যে সুরে রস-কীর্তন গান করিয়াছিলেন, খেতরী গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত বলিয়া পরগণার নামে সেই সুরের নাম হয় গড়েরহাটী বা গড়ানহাটী ৷ নরোত্তমের প্রধান বাদক দুইজনের নাম শ্রীগৌরাঙ্গদাস ও শ্রীদেবীদাস ৷ প্রধান দোহার গায়ক দুইজনের নাম শ্রীদাস ও গোকুলানন্দ ৷ প্রাচীন বৈষ্ণব সমাজে জনশ্রুতি শুনিয়াছি, ইঁহারা চারিজনে পুরীধামে গিয়া শ্রীপাদ স্বরূপ দামোদরের নিকট গীত ও বাদ্য শিক্ষা করিয়া আসিয়াছিলেন ৷ খেতরীর মহোৎসবে —
শ্রীঠাকুর মহাশয় মনের উল্লাসে ৷
সুসজ্জ হইতে আজ্ঞা দিল দেবীদাসে ৷৷
দেবীদাস গায়ক বাদকগণ লইয়া ৷
আইলেন গৌরাঙ্গ প্রাঙ্গণে হর্ষ হইয়া ৷
* * *
শ্রীগৌরাঙ্গদাস তাল পাট আরম্ভয়ে ৷
প্রথমেই মন্দ মন্দ বাদ্য প্রকাশয়ে ৷৷
* * *
এথা সর্ব্ব মোহান্ত কহয়ে পরস্পরে ৷
প্রভুর অদ্ভুত সৃষ্টি নরোত্তম দ্বারে ৷৷
— নরোত্তম-বিলাস
ভক্তিরত্নাকরে —
প্রথমেই দেবীদাস মর্দ্দল বামেতে ৷
করে হস্তাঘাত প্রেমময় শব্দ তাতে ৷৷
অমৃত অক্ষর প্রায় বাদ্য সঞ্চারয়ে ৷
শ্রীবল্লভ দাসাদি সহিত বিস্তারয়ে ৷৷
শ্রীগৌরাঙ্গ দাসাদিক মনের উল্লাসে ৷
বায় কাংস্য, তালাদি প্রভেদ পরকাশে ৷৷
অনিবদ্ধ নিবদ্ধ গীতের ভেদ দ্বয়ে ৷
অনিবদ্ধ গীত গোকুলাদি আলাপয়ে ৷৷
অনিবদ্ধ গীতে বর্ণন্যাস স্বরালাপ ৷
আলাপে গোকুল কণ্ঠধ্বনি নাশে তাপ ৷৷

রাঢ়দেশ সঙ্গীতের পীঠভূমি ৷ রাঢ়দেশ অতি প্রাচীনকাল হইতেই জৈন, বৌদ্ধ, সৌর, শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধনক্ষেত্র ৷ জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সাধকগণের অনেক গীত রাঢ়েই রচিত হইয়াছিল ৷ অতি পূর্ব হইতেই রাঢ়ের সঙ্গীতের একটি নিজস্ব ধারা ছিল ৷ উত্তরে রাজমহল হইতে দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত রাঢ়ের বিস্তীর্ণ সীমায় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেন্দ্র ছিল ৷ শ্রীমহাপ্রভুর আবির্ভাবের পর বৈষ্ণবগণ এই সমস্ত কেন্দ্রে এবং বহু নূতন প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রে শাস্ত্র ও সঙ্গীতাদির শিক্ষালয় স্থাপন করিয়াছিলেন ৷ এইরূপ দুইটি পুরাতন কেন্দ্র শ্রীখণ্ড ও কান্দরা, এবং একটি নূতন কেন্দ্র ময়নাডাল ৷ তিনটিই বীরভূমে ছিল ৷ প্রায় ৭৫ বৎসর পূর্বে শ্রীখণ্ড ও কান্দরা বর্ধমানের অন্তভুর্ক্ত হইয়াছে৷ খেতরীর উৎসব হইতে ফিরিয়া জ্ঞানদাস, বন্ধু মনোহর , কান্দরার মঙ্গল ঠাকুরের পৌত্র বদন, শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দন ও ময়নাডালের মঙ্গল ঠাকুরের শিষ্য নৃসিংহ মিত্র ঠাকুরকে লইয়া রাঢ়ের প্রাচীন সঙ্গীত ধারার সংস্কার সাধন করেন ৷ কান্দারা মনোহরসাহী পরগণার অন্তর্গত বলিয়া এই ধারার নাম হয় মনোহরসাহী ৷ কান্দারা, ময়নাডাল ও শ্রীখণ্ড মনোহরসাহী কীর্তনের তিন প্রধান কেন্দ্র ৷ ময়নাডালের চতুষ্পাঠী কীর্তনের সঙ্গীত ও বাদ্য-শিক্ষা এবং শ্রীখণ্ডের চতুষ্পাঠী ব্যাকরণ, অলঙ্কার, কাব্য, দর্শন, সঙ্গীত ও বাদ্য শিক্ষাদানের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল ৷
কীর্তন-গানের অপর একটি প্রসিদ্ধ ধারার নাম রাণীহাটী বা রেণেটী ৷ বর্ধমান জেলার সাতগাছিয়া থানায় রেণেটী এখন একটি ক্ষুদ্র গ্রাম ৷ ইহা পরগণা রাণীহাটীর অন্তর্গত ৷ রেণেটীর নিকটবর্তী দেবীপুর-নিবাসী বিখ্যাত পদকর্তা বিপ্রদাস ঘোষ রেণেটী পরগণার নামে একটি সুরের নামকরণ করেন ‘রেণেটী’৷ কীর্তনের অন্য একটি সুর মন্দারিণী, সরকার মন্দারণের নামের ইহার নামকরণ হয় ৷ রাঢ়ের প্রাচীন সুর, মঙ্গলকাব্যের গানের সুর ৷ কৃষ্ণমঙ্গল, চৈতন্যমঙ্গল এই সুরে গীত হয় ৷ প্রাচীনকালে ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গলও এই সুরেই গাওয়া হইত, এখনও হয় ৷ মন্দারিণীতে নয়টি তাল ব্যবহৃত হয় ৷ কীর্তনের আর একটি সুর আছে ৷ ঝাড়খণ্ডী ৷ ইহাও রাঢ়ের প্রাচীন সুর, লোক-সঙ্গীতের সুর, মঙ্গলকাব্যের সুর ৷ এসিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি ৩৫৩০।৭১বি ও বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে ২২ পৃষ্ঠায় ত্রিপদী কবিতার সুর লেখা আছে ঝাড়িখণ্ডি ৷
পঞ্চকোট সেরগড়বাসী শ্রীগোকুল ৷
পূর্ব্ববাস কড়ই কবীন্দ্র ভক্তাতুল ৷৷ (ভক্তিরত্নাকর)

কড়ই-নিবাসী কবীন্দ্র গোকুল সেরগড় পরগণায় আসিয়া বাস করেন ৷ সেরগড় ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত ৷ পূর্বে বীরভূমের বক্রেশ্বর পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত ছিল ৷ কবীন্দ্র গোকুল এই সুরের কিছু সংস্কারসাধন করেন ৷ এই সুর এখন লুপ্ত হইয়াছে।
সুরের গতি আপন পরিমিত কালের মধ্যে আদ্যন্ত সমভাবে স্থায়িত্ব লাভ করিলে তাহাই লয় নামে অভিহিত হয় ৷ এই লয় প্রদর্শনের নামই তাল ৷ সঙ্গীতশাস্ত্রে তালই ছন্দ ৷ ছন্দ আবার কতিপয় সমানুপাতিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত ৷ এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলির নাম মাত্রা৷
গড়েরহাটী — বিলম্বিত লয়, দীর্ঘ, ছন্দ, মাত্রার সারল্য ও প্রসাদগুণযুক্ত৷ মার্গসঙ্গীতে ধ্রুপদের সঙ্গে তুলনীয় ৷ তালের সংখ্যা একশত আট৷
মনোহরসাহী — লয় ও ছন্দ অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত, সুরের কারিগরী ও মাত্রার জটিলতায় সমৃদ্ধ ৷ মার্গসঙ্গীতে খেয়ালের সমতুল্য ৷ চুয়ান্ন তালের গান ৷
গড়েরহাটী ও মনোহরসাহী সুরে কীর্তনে আখরের পরিপাটি বিশেষ লক্ষণীয় ৷
রেণেটী — লয় ও ছন্দ সংক্ষিপ্ত ৷ তরল সুর ৷ আখর কম ৷ ইহাকে ঠুংরীর সঙ্গে তুলনা করা চলে ৷ যাঁহারা বন্দীপুরনিবসী আখরিয়া গোপালের ভাগিনেয় (হুগলী) বাসুদেবপুরের বেণী দাস কীর্তনীয়ার রেণেটী সুরের কীর্তন শুনিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে বহুপ্রসিদ্ধ কীর্তনীয়া নিত্যধামগত গণেশ দাসের মুখে শুনিয়াছি যে রেণেটীর মাধুর্য মনোহরসাহী অপেক্ষা কোন অংশে কম নহে ৷ তাল ছাব্বিশ ৷
কীর্তনের এই পাঁচটি অঙ্গ— কথা, দোঁহা, আখর, তুক ও ছুট ৷
কথা — সঙ্গীতশাস্ত্রেও লক্ষ-লক্ষণের সমাবেশ আছে ৷ লক্ষ্য অর্থে গান (কথা), লক্ষণ তাহার শাস্ত্র (রাগ ও নিয়মাদি)৷ কথার অন্য অর্থও আছে ৷ শ্রীকৃষ্ণের, রাধার, বড়াইয়ের ও সখীগণের উক্তি প্রত্যুক্তি এক গান হইতে অন্য গানের যোগসূত্র, গানের কোন একটি পংক্তির অর্থ গায়ককে কথা কহিয়া বিশদ করিয়া দিতে হয় ৷ কীর্তনে ইহাকেই কথা বলে ৷
দোঁহা— ছন্দে বদ্ধ দুই-চারি চরণে সূত্রাকারে অভিব্যক্ত বিষয় ৷ বৌদ্ধদের রচিত হাজার বছরের পুরাণো দোঁহা-কোষ পাওয়া গিয়াছে ৷ দোঁহা হইতে ‘দোহার’ কথার উৎপত্তি কিনা কে বলিবে ? অনেকে বলেন, মূল গায়কের গাহিবার পর গান দুই হার— দুইবার গাহে বলিয়া ইহাদের নাম দোহার ৷ দোঁহা শব্দে উভয় বুঝায়, দুই পার্শ্বের গাহিবার সঙ্গী; হয়তো এইজন্য বলে দোহার ৷ ইহাদের গান দোহারী ৷ সঙ্গীত গানের সূত্র ধরাইয়া দেওয়া, গানে মূল গায়কের অনুসরণ ও সহায়তা করা এবং আসরে সুরের রেশ জমাইয়া রাখা দোহারের কাজ ৷ চরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থের পয়ার বা ত্রিপদীর দুই-এক চরণ, হিন্দী কবির রচিত দোঁহা, ‘উজ্জ্বল-নীলমণি’ প্রভৃতি গ্রন্থের শ্লোকাংশ, কীর্তনে দোঁহা নামে পরিচিত ৷
আখর — কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, — “কীর্তনের আখর কথার তান ৷” মহাকবির যোগ্য ব্যাখ্যা ৷ “আখর” কীর্তনের আসরে শুনিয়া বুঝিতে হয় ৷ ইহাকে কীর্তন গানের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য বলিতে পারি ৷ কীর্তনের মাধুর্য-আস্বাদনে আখর প্রধান সহায় ৷ পদকর্তৃগণের বিনা সূতায় গাঁথা মালার রহস্যগ্রন্থি উন্মোচনে আখর-ই একমাত্র উপায় ৷ ইহা রসের ভাণ্ডার অনর্গল করিবার মন্ত্র, উন্মোচনের কুঞ্চিকা ৷ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বার্তিক ৷
তুক —অনুপ্রাসবহুল ছন্দোময়, মিলনাত্মক-গাথা তুক আখ্যায় অভিহিত ৷ কোন কোন তুকে গানের মতে কয়েকটি “কলি” থাকে ৷ এগুলি সাধারণতঃ তুক বা তুক্ক-গান নামে পরিচিত ৷ তুককীর্তন গায়কগণের গুরুপরম্পরাক্রমে সৃষ্ট ৷ অনেক অজ্ঞাত পদকর্তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র (ভনিতাহীন) পদ বা পদাংশ তুক্ক বা তুক নামে চলিতেছে ৷
তুক গানের উদাহরণ— (গোষ্ঠ যাত্রা)
ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ পায় রহি রহি চলি যায়
যায় পদ রহিয়া রহিয়া রহিয়া গো ৷
বুঝি উহার কেহ আছে আসিতেছে অতি পাছে
তেঞি চায় ফিরিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া গো ৷৷
হায় আমরা কি করিলাম নবনী পাসরি এলাম
খানিক রাখিতাম ননী দেখাইয়া দেখাইয়া দেখাইয়া গো ৷৷
যদি ব্রজের বালক হতাম নেচে নেচে সঙ্গে যেতাম ৷
শ্যাম মাঝে যেত নাচিয়া নাচিয়া নাচিয়া গো ৷৷
রাণী টানে ঘর পানে রাখাল টানে বন পানে
রাই টানে নয়নে নয়নে নয়নে গো ৷
যদি ফুলের মালা হতাম শ্যাম অঙ্গে দুলে যেতাম
যেতাম হেলনে দোলনে দোলনে ভাসিয়া গো ৷৷
রবি বড় তাপ দিছে বন্ধু মুখ ঘামিয়াছে
কপালের তিলক যায় ভাসিয়া ভাসিয়া গো ৷
হেন মনে করি মায়া মেঘ হয়ে করি ছায়া
বন্ধু যাক জুড়াইয়া জুড়াইয়া জুড়াইয়া গো ৷৷
(পাঠান্তর পাইয়াছি — বন্ধুর শ্রম নাশিয়া নাশিয়া নাশিয়া গো)

কলহান্তরিতার তুক—
তোমায় নিতে আসিনি ৷
গায়ের ধূলো ঝেড়ে উঠছো কি হে, তোমায় নিতে আসিনি ৷
আমি ফুল নিতে এসেছি ৷ কৃষ্ণকলি ফুল নিতে এসেছি ৷
বাসি ফুলে হবে না ৷ ঝরা ফুলে হবে না ৷
মান রাজার পূজা হবে, করবে পূজা কমলিনী ৷৷

ছুট— তালেরই একটির নাম ছুট ৷ ছুট গানও আছে ৷
কীর্তনের আর একটি অঙ্গ “ঝুমর ৷” ঝুমর বা ঝুমরী একটি সুর ৷ পদাবলীতে পাই— “ঝুমরী গাইছে শ্যাম বাঁশী বাজাইয়া ৷” ভক্তিরত্নাকরে ঝুমরীর উল্লেখ আছে ৷ কিন্তু “ঝুমর” অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয় ৷ কীর্তনে পালা গান গাহিয়া মিলন গাহিতে হয় ৷ কিন্তু দুই-তিনজন কীর্তনীয়া একই আসরে পরপর যেখানে একই রসের পালা গান গাহিয়া থাকেন, সেখানে মিলন গাওয়া চলে না ৷ সেখানে দুই ছত্র “ঝুমর” গাহিয়া কীর্তনীয়াকে আসর রাখিতে হয় ৷ শেষের গায়ক মিলন গাহিয়া কীর্তন সমাপ্ত করেন ৷
লীলা-কীর্তন বা রস-কীর্তন চৌষট্টি রসের গান বলিয়া বিখ্যাত ৷
শ্রীপাদ রূপ গোস্বামী ভক্তি-রসামৃতসিন্ধু এবং উজ্জ্বল-নীলমণি গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়া বৈষ্ণব সমাজের মহোপকার সাধন করিয়া গিয়াছেন ৷ সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্য-ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন ৷ উজ্জ্বল-নীলমণি না পাঠ করিলে কীর্তন-গায়ক এবং শ্রোতা উভয় পক্ষকেই অসুবিধায় পড়িতে হয় ৷ উজ্জ্বল-নীলমণি রস-পর্যায় ও নায়ক-নায়িকা-লক্ষণের অপূর্ব গ্রন্থ ৷ উজ্জ্বল রস, আদি রস বা শৃঙ্গার রস প্রধানতঃ দুই ভাগে বিভক্ত ৷ এই দুই ভাগ— বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ ৷ অনুরক্ত যুবক-যুবতীর প্রগাঢ় রতি অ-সমাগমে উৎকৃষ্টতাপ্রাপ্ত হইয়াছে, অভীষ্টসিদ্ধি করিতে পারিতেছে না— এই অবস্থার নাম বিপ্রলম্ভ ৷ আর নায়ক-নায়িকার পরস্পর মিলনে যে উল্লাস, তাহার নাম সম্ভোগ ৷ বিপ্রলম্ভ — পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্ত্য ও প্রবাস—এই চারি ভাগে, এবং সম্ভোগ—সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ, সঙ্কীর্ণ সম্ভোগ, সম্পন্ন সম্ভোগ ও সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ —এই চারিভাগে বিভক্ত ৷ এই আটটি রসের প্রত্যেকের আবার আট-আট করিয়া ভাগ আছে ৷ একুনে মোট চৌষট্টি রস ৷ চৌষট্টি রসের নায়িকার অপর যে প্রভেদ, পরে তাহার উল্লেখ করিব ৷

বিপ্রলম্ভ

পূর্বরাগ —নায়ক-নায়িকা উভয়েরই পূর্বরাগ হয় ৷ কিন্তু এখানে নায়িকার পূর্বরাগের কথাই বলিতেছেন ৷ শ্রীকৃষ্ণ ১ সাক্ষাতে দর্শন, ২ চিত্রপটে দর্শন, ৩ স্বপ্নে দর্শন, শ্রীকৃষ্ণের গুণ, ৪ বন্দী বা ভাটমুখে শ্রবণ, ৫ দূতীমুখে শ্রবণ, ৬ সখীমুখে শ্রবণ, ৭ গুণীজনের গানে শ্রবণ, ৮ শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি শ্রবণ ৷
মান — মানও উভয়ের হয় ৷ এখানে নায়িকার মানের বর্ণনা— শ্রীকৃষ্ণের অপরাধের কথা ১ সখীমুখে শ্রবণ, ২ শুকমুখে শ্রবণ, ৩ শ্রীকৃষ্ণের মুরলীধ্বনিতে অন্যা নায়িকার নামের আভাস, ৪ শ্রীকৃষ্ণের দেহে ভোগচিহ্ন দর্শন, ৫ প্রতিপক্ষ নায়িকার অঙ্গে ভোগ-চিহ্ন দর্শন, ৬ গোত্রস্খলন, (নায়ক কর্তৃক ভ্রমক্রমে বা স্বপ্নে অন্যা নায়িকার নাম কথন), ৭ স্বপ্নে অন্য নায়িকার সঙ্গে দর্শন, কৌস্তুভ প্রতিবিম্বে নিজমূখ দেখিয়া অন্য নায়িকা বলিয়া ভ্রম, ৮ সাক্ষাতে অন্য নায়িকার সঙ্গে দর্শন ৷
প্রেম-বৈচিত্ত্য — নায়ক-নায়িকা দুইজনেই “দুহুঁ কোড়ে দোঁহে কান্দে বিচ্ছেদ ভাবিয়া”—ইহারই নাম প্রেম-বৈচিত্ত্য ৷ কিন্তু এখানে নায়িকার আক্ষেপানুরাগকেই প্রেম-বৈচিত্ত্য বলা হইয়াছে ৷ প্রেমের বিচিত্রতা ৷ ইহার মধ্যে বিরহের সুর আছে ৷ ১ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আক্ষেপ, ২ মুরলীর প্রতি, ৩ নিজের প্রতি, ৪ সখীর প্রতি, ৫ দূতীর প্রতি, ৬ বিধাতার প্রতি, ৭ কন্দর্পের প্রতি, ৮ গুরুজনের প্রতি আক্ষেপ ৷
প্রবাস — নায়কের দূরে গমনে নায়িকার বিরহ ৷ নিকট প্রবাস ও দূর প্রবাস ৷ নিকট প্রবাস— ১ কালী দমন, ২ গোচারণ, ৩ নন্দমোক্ষণ ৪ কার্যানুরোধে, ৫ রাসে অন্তর্ধানে সাময়িক অদর্শনজনিত বিরহ ৷ দূর প্রবাস — ১ ভাবী (প্রবাস গমনের বার্তা শুনিয়া) ২ মথুরা গমন ও ৩ দ্বারকা গমন ৷ ভবন — বর্তমান বিরহ এবং ভূত — অতীতস্মরণ ৷

সম্ভোগ

সংক্ষিপ্ত — ১ বাল্যাবস্থায় মিলন, ২ গোষ্ঠে গমন, ৩ গো-দোহনে, ৪ অকস্মাৎ চুম্বন, ৫ হস্তাকর্ষণ, ৬ বস্ত্রাকর্ষণ, ৭ বর্ত্মরোধন, ৮ রতি ভোগ ৷

সঙ্কীর্ণ — ১ মহারাস, ২ জলক্রীড়া, ৩ কুঞ্জলীলা, ৪ দানলীলা, ৫ বংশীচুরি, ৬ নৌকাবিলাস, ৭ মধুপান, ৮ সূর্যপূজা ৷
সম্পন্ন — ১ সুদূর দর্শন, ২ ঝুলন, ৩ হোলি, ৪ প্রহেলিকা, ৫ পাশা খেলা, ৬ নর্তকরাস, ৭ রসালস, ৮ কপটনিদ্রা ৷

সমৃদ্ধিমান — ১ স্বপ্নে বিলাস ২ কুরক্ষেত্র-মিলন, ৩ ভাবোল্লাস, ৪ ব্রজাগমন ৫ বিপরীত সম্ভোগ, ৬ ভোজন-কৌতুক, ৭ একত্র নিদ্রা, ৮ স্বাধীনভর্তৃকা ৷
শ্রীরাধার প্রতি শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগের সাক্ষাৎ দর্শনাদি প্রথম সাতটি হেতু গ্রহণীয় ৷ শ্রীরাধার বংশী নাই ৷ মান দুই প্রকার — সহেতু ও নির্হেতু ৷ শ্রীকৃষ্ণের সহেতু মান অসম্ভব ৷ তাঁহার নাম নির্হেতু ৷ শ্রীকৃষ্ণের আক্ষেপানুরাগের কোন সম্ভাবনা ঘটে না ৷ শ্রীরাধার অদর্শনে শ্রীকৃষ্ণের বিরহ আছে ৷ কিন্তু শ্রীরাধার স্থানান্তরে গমন নাই ৷ সম্ভোগেরও প্রকারভেদ আছে ৷ যেমন মুখ্য সম্ভোগ ও গৌণ সম্ভোগ ৷ মুখ্য সম্ভোগ প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ ভেদে দুই প্রকার ৷ গৌণ সম্ভোগ— স্বপ্ন-সম্ভোগ ৷ সম্পন্ন সম্ভোগ— আগতি ও প্রাদুর্ভাব ভেদে দ্বিবিধ ৷ লৌকিক ব্যবহার দ্বারা আগমন আগতি, আর প্রেম সংরম্ভে অকস্মাৎ আগমন প্রাদুর্ভাব, যেমন রাসমণ্ডলে আবির্ভাব ৷ উজ্জ্বল নীলমণিতে পূর্বরাগাদি বিষয়ে সুবিস্তৃত বিশ্লেষণ আছে ৷
কীর্তনীয়াগণ বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগের চৌষট্টি বিভাগের কীর্তনকেই চৌষট্টি রসের গান বলিয়া থাকেন ৷ ইহার মধ্যে মানের পর্যায়ে অভিসারিকাদির স্থান রহিয়াছে ৷ নিম্নে নায়িকার অভিসারিকাদি অষ্টাবস্থার ও তাহার আট আট চৌষট্টি ভেদের বিবরণ দিলাম ৷
(১) অভিসারিকা (যিনি স্বয়ং অভিসার করেন, অথবা নায়ককে অভিসার করান ) :—
জ্যোৎস্নাভিসারিকা, তামসাভিসারিকা, বর্ষাভিসারিকা, দিবাভিসারিকা, কুজ্‌ঝটিকাভিসারিকা, তীর্থযাত্রাভিসারিকা (গ্রহণাদি উপলক্ষ্যে স্নান ছলে, দেবদর্শন ছলে অভিসার), উন্মত্তাভিসারিকা (বংশীধ্বনি শ্রবণে), অসমঞ্জসাভিসারিকা (যাহার বেশ বাস অসম্বৃত) ৷
(২) বাসকসজ্জা (কান্তের আগমন প্রতীক্ষায় কুঞ্জ সাজাইয়া এবং নিজে সাজিয়া অপেক্ষামাণা) :—
মোহিনী (সুবেশধারিণী), জাগ্রতিকা (প্রতীক্ষায় জাগ্রতা রোদিতা (রোদেনপরায়ণা), মধ্যোক্তিকা (কান্ত আসিয়া প্রিয়বাক্য বলিবেন এইরূপ চিন্তা ও আলাপযুক্তা), সুপ্তিকা (কপটনিদ্রায় নিদ্রিতা), চকিতা (নিজাঙ্গছায়ায় কৃষ্ণভ্রমত্রস্তা), সুরসা (সঙ্গীত-পরায়ণা), উদ্দেশা (দূতী প্রেরণকারিণী)৷
(৩) উৎকণ্ঠিতা (কান্তের আগমনে বিলম্ব দেখিয়া উৎকণ্ঠাযুক্তা), দুর্মতি(কেন খলের বাক্যে বিশ্বাস করিলাম, এই চিন্তায় অনুতপ্তা) :—
বিকলা (পরিতাপযুক্তা), স্তব্ধা (চিন্তিতা), উচ্চকিতা (পত্রপতনে, পক্ষীর পক্ষ-সঞ্চালনে কান্ত আসিতেছেন, এই আশায় চকিতা), অচেতনা (দুঃখাভিভূতা), সুখোৎকণ্ঠিতা (কৃষ্ণধ্যান-মুগ্ধা, কৃষ্ণগুণ-কথননিরতা), মুখরা (দূতীর সঙ্গে কলহপরায়ণা), নির্বন্ধা (আমারি কর্মদোষে তিনি আসিলেন না, আমি বাঁচিব না— এইরূপ খেদযুক্তা)৷
(৪) বিপ্রলব্ধা (সঙ্কেত করিয়াও প্রিয় কেন আসিলেন না, এই চিন্তায় নির্বেদযুক্তা) :—
বিকলা (কান্ত আসিলেন না, সমস্ত বিফল হইল, এইরূপ খেদান্বিতা), প্রেমমত্তা (অন্যা নায়িকার সঙ্গে কান্তের মিলন হইয়াছে এইরূপ আশঙ্কান্বিতা), ক্লিষ্টা (যাঁহার সব বিষময় মনে হইতেছে), বিনীতা (বিলাপ-যুক্ত), নির্দয়া (কান্ত নির্দয় ইত্যাদি বাক্যে খেদযুক্তা), (প্রখরা শয্যা এবং বেশ ভূষণাদি অগ্নিতে অথবা যমুনায় বিসর্জন করিব, এইরূপ সঙ্কল্পযুক্তা), দূত্যাদরা (দূতীকে আদর কারিণী) ভীতা (প্রভাত হইতে দেখিয়া ভয়যুক্তা)৷
(৫) খণ্ডিতা (অন্যা নায়িকার সম্ভোগ-চিহ্ন-যুক্ত নায়ককে দেখিয়া কুপিতা) :—
নিন্দ্যা (কান্তকে নিন্দাকারিণী, ক্রোধা (অনুনয়রত কান্তকে তিরস্কারকারিণী), ভয়ানকা (কান্তকে সিন্দূর -কজ্জলে মণ্ডিত দেখিয়া ভীতা), প্রগলভা (কান্তের সঙ্গে কলহপরায়ণা), মধ্যা (অন্যা নায়িকার সম্ভোগ-চিহ্নে লজ্জান্বিতা), মুগ্ধা (রোষবাষ্পমৌনা), কম্পিতা (অমর্ষবশে রোদনপরায়ণা), সন্তপ্তা (কান্তের অঙ্গে ভোগ-চিহ্ন-দর্শনে তাপযুক্তা)৷
(৬) কলহান্তরিতা (প্রত্যাখ্যাত নায়ক চলিয়া গেলে পশ্চাত্তাপযুক্তা) :— আগ্রহা (আগ্রহযুক্ত নায়ককে কেন ত্যাগ করিলাম), ক্ষুব্ধা (পাদপতিত নায়ককে কেন দুর্বাক্য বলিলাম), ধীরা (পাদপতিত কান্তকে কেন দেখি নাই), অধীরা (সখীতিরস্কৃতা), কুপিতা (কান্তের মিথ্যা ভাষণ স্মরণে কোপযুক্তা), সমা (কান্তের একা দোষ নাই, দূতীর দোষ, সময়ের দোষ এবং আমার নিজের দোষেই আমি ক্লেশ পাইলাম), মৃদুলা (পরিতাপে রোদনপরায়ণা), বিধুরা (সখীর প্রবোধ দানে আশ্বস্তা) ৷
(৭) প্রোষিতভর্ত্তৃকা (পতি যাহার প্রবাসে ) :—
ভাবী কান্ত প্রবাসে যাইবেন এই সংবাদে কাতরা), ভবন্‌ (বর্তমান বিরহ) , ভূত (কান্ত মথুরায়), দশদশা (চিন্তা , জাগরণ, উদ্বেগ, কৃশতা , জড়তা, প্রলাপ, ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ, মৃত্যু ৷ পদাবলীতে মূর্চ্ছাই মৃত্যুনামে অভিহিত), দূত-সংবাদ (উদ্ধবাদি মুখে), বিলাপা (বিলাপপরায়ণা), সখ্যুক্তিকা (যাহার সখী কান্তের নিকট গিয়া বিরহ -বেদনা নিবেদন করেন), ভাবোল্লাসা (ভাব-সম্মিলনে উল্লসিতা)৷
(৮) স্বাধীনভর্ত্তৃকা (নায়ক যাহার সদা বশীভূত) :—
কোপনা (বিলাসে বাহ্য রোষযুক্তা), মানিনী (নায়ক অঙ্গে নিজকৃত বিলাসচিহ্ন দর্শনে), মুগ্ধা (নায়ক যাহার বেশবিন্যাসাদি করেন), মধ্যা (নায়ক যাহার নিকট কৃতজ্ঞ), সমুক্তিকা (সমীচীন উক্তি-যুক্তা), সোল্লাসা (কান্তের ব্যবহারে উল্লসিতা), অনুকূলা (নায়ক যাহার অনুকূল), অভিষিক্তা (অভিষেকপূর্বক নায়ক যাহাকে চামর ব্যজনাদি করেন৷) ৷
মিথিলার কবি ভানুদত্ত রসমঞ্জরী গ্রন্থে ‘অনুশয়ানা’ নায়িকার বর্ণনা করিয়াছেন ৷ সঙ্কেতস্থানের বিনাশে সন্তপ্তা নায়িকার নাম অনুশয়ানা ৷ বর্তমান স্থান নাশে দুঃখিতা, ভাবিস্থান নাশে দুঃখিতা এবং সঙ্কেত-স্থানে যাইতে না পারিয়া দুঃখিতা — এই তিন প্রকার অনুশয়ানা ৷ সঙ্কেতস্থানে অ-গমন হেতু অনুশয়ানার উদাহরণ—
রসাল মুকুলরাজি দুলিছে শ্রবণে
পাণ্ডুর বরণ গণ্ড পরাগ-নিকরে ৷
এ হেন মাধবে রাধা হেরিয়া নয়নে
বরষে যে অশ্রুজল অবিরলধারে ৷৷
(৺সতীশচন্দ্র রায়ের অনুবাদ)

শ্রীকৃষ্ণ আম্রকুঞ্জে মিলনের সঙ্কেত করিয়াছিলেন ৷ শ্রীরাধা অনিবার্য কারণে সেখানে যাইতে পারেন নাই ৷ শ্রীকৃষ্ণ যে আম্রকুঞ্জে গিয়াছিলেন এবং শ্রীরাধার দর্শন না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন, ইহা জানাইার জন্য তিনি রসালমঞ্জরী কর্ণে ধারণ করিয়া শ্রীরাধাকে দেখা দিয়াছেন ৷ শ্রীকৃষ্ণ ইঙ্গিতে বুঝাইতেছেন — রসালকুঞ্জে তোমার গমনের কথা কানেই শুনিয়াছি, অদৃষ্টে দর্শন ঘটে নাই ৷ আমি যে সেখানে গিয়াছিলাম, এই রসালমঞ্জরী তাহারই নিদর্শন ৷ শ্রীকৃষ্ণের এই অনুযোগে আপনার পরাধীনতার কথা স্মরণে শ্রীরাধা কাঁদিয়াছেন ৷
বাঙ্গালায় ঢপ কীর্তন নামে কীর্তনের একটি ধারার সৃষ্টি হইয়াছে ৷ মুর্শিদাবাদ জেলার রূপচাঁদ অধিকারী ইহার স্রষ্টা ৷ যশোরের মধুসূদন কান এই ধারার একজন বিখ্যাত গায়ক ৷ ইনি কীর্তনে স্বরচিত পদও গান করিতেন ৷ এই গান কম-বেশী প্রায় শতখানেক বৎসর চলিত হইয়াছে ৷ এক সময় ইহা সারা বাঙ্গালায় প্রসারলাভ করিয়াছিল ৷ প্রধানতঃ পণ্যা রমণীগণই এই গান শিখিয়া কীর্তনের ব্যবসায় করিত ৷ ইহারা কীর্তনওয়ালী নামে পরিচিতা ছিল ৷ অনেক গায়কও এই গান আয়ত্ত করিয়া ব্যবসা চালাইতেন ৷ এক সময় কলিকাতায় ধনী ও মধ্যবিত্ত-গৃহে , এমন কি , মফঃস্বলের কোন বড়লোকের বাড়ীর শ্রাদ্ধ-বাসরেও ঢপ গানের বিশেষতঃ কীর্তনওয়ালীর বিশেষ সমাদর ছিল ৷ আজকাল ঢপ গানের চলন কমিয়াছে ৷