নরোত্তম কীর্তনের যে পন্থা দেখাইলেন, তাহার নাম হইল ‘গরাণহাটী’ কীর্তন৷ খেতরি যে পরগণায় অবস্থিত, সেই পরগণার নাম, ,সম্ভবতঃ ‘গড়ের হাট’ ছিল৷ এখন তাহার কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না৷ এই গড়ের হাট হইতে গড়েরহাটী গড়ানহাটী বা গরানহাটী নাম হইয়া থাকিবে৷ এইরূপ মনোহরসাহী পরগণা (বর্ধমান জেলা) হইতে মনোহরসাহী নামে কীর্তনের সুর হইয়াছে৷ রাণীহাটী (বর্ধমান জেলায়) হইতে রেনেটি এবং মান্দারন (মেদিনীপুর) হইতে মন্দারিনী বা মান্দারিনী সুরের সৃষ্টি হইয়াছে৷ মনোহরসাহী অপেক্ষা রেনেটি ও মন্দারিনী সুর সরল ও সুলভ৷ সুরের কারুকার্য মনোহরসাহী কীর্তনে যেরূপ আছে, সেরূপ অন্য কোনও সুরে নাই৷ কথিত আছে শ্রীনিবাস আচার্য মনোহরসাহী ও রেনেটি সুরের সৃষ্টিকর্তা৷ জ্ঞানদাস, বলরামদাস প্রমুখ পদকর্তার প্রভাবে মনোহরসাহী কীর্তন গান এক সময়ে অত্যন্ত উৎকর্ষ লাভ করিয়াছিল৷ ইঁহারা নরোত্তমদাসের সমসাময়িক৷ রেনেটি গীত টেঁয়া বৈদ্যপুরে বৈষ্ণবদাস৷ (গোকুলানন্দ সেন) ও তাঁহার বন্ধু উদ্ধবদাস (কৃষ্ণকান্ত মজুমদার) প্রভৃতির দ্বারা সুসমৃদ্ধ হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়৷
কীর্তনের এই শ্রেণীবিভাগ সুরের প্রণালী অথবা বৈচিত্র্য অনুসারে হইয়াছিল৷ কীর্তনের বৈশিষ্ট্যগুলি ইহাদের প্রত্যেকটির মধ্যেই অল্পবিস্তর বর্তমান ছিল যথা শ্রুতি ও গমকের প্রাধান্য, রাগরাগিণীর বিশিষ্ট ভঙ্গী, ছন্দের নূতনত্ব (দশকুশী, ডাঁসপাহিড়া, তেওট ইত্যাদি) এবং আখরের যোজনা ইত্যাদি৷
উল্লিখিত চারিটি ঠাট ছাড়া আরও একটি ঠাটের উল্লেখ কখনও কখনও দেখা যায়; উহার নাম ঝাড়খণ্ডী৷ ঝাড়খণ্ড বর্তমান মেদিনীপুর জেলার একটি অংশ বটে৷ কিন্তু এই ঠাটের কীর্তন সুপ্রচলিত নহে৷
সরলতা ও গাম্ভীর্যে গরাণহাটী কীর্তন ধ্রুপদের সহিত তুলনীয়৷ মনোহরসাহীর স্বরবৈচিত্র্য খেয়ালের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়৷ কলাচাতুর্যে ও মাধুর্যে কীর্তনমাত্রই ঠুংরি গানের সহিত তুলনীয় হইতে পারে৷
কীর্তনের প্রসারের যুগে এইসকল সুরের প্রত্যেকেরই আভিজাত্য ও স্বাতন্ত্র্য ছিল৷ বর্তমানে এই সকল সুরের নিজস্ব গায়ক বিরল৷ ফলে ‘গরাণহাটী’-গায়ক ‘মনোহরসাহী’র কারুকার্য দ্বারা গান সাজাইয়া থাকেন৷ মনোহরসাহী -গায়ক ও রেনেটি বা মন্দরিনী সুরের ভাঁজ আমদানি করিতে দ্বিধাবোধ করেন না৷ ফলে হইয়াছে এই যে, এইসকল সুরের স্বাতন্ত্র্য ঠিক ধরিতে পারা যায় না৷ গায়কের অভাবেই এইরূপ ঘটিয়াছে বলিয়া মনে হয়৷ রাঢ় অঞ্চলে ‘কীর্তন’ বলিতে সাধারণতঃ ‘মনোহরসাহী’ কীর্তন বুঝাইয়া থাকে৷