প্রবন্ধের নাম শুনিয়া লোকে হাসিবে ৷ আজিকার দিনে কিনা নাম সঙ্কীর্তন ৷ যে দিনে লোক চাঁদের ওপিঠ-এপিঠ তোলপাড় করিতেছেন সেদিন কিনা লোকের কাছে নাম সঙ্কীর্তনের কথা — কথাটা তোলাই তো ধৃষ্টতা ৷ একথা আমি যে না জানি এমন নয় ৷ আমি ‘গণসংযোগের’ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দিক্‌ হইতে কথাটার উত্থাপন করিতেছি ৷
আমি শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুকে শ্রীরাধাকৃষ্ণ-মিলিততনু বলিয়াই বিশ্বাস করি৷ কিন্তু এই নিবন্ধে মহাপুরুষবাদের দিক দিয়া বিষয়টির আলোচনা করিব ৷ মহাপুরুষগণ যখন আবির্ভূত হন, তখন তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী গড়িয়া ওঠে৷ ইঁহাদের মধ্যে বিদ্বান্‌ ব্যক্তি থাকেন, সমাজের প্রভাবশালী কেহ থাকেন, ধনবানও দুই-একজনের অভাব ঘটে না ৷ ইঁহারাই নূতন ভাবধারার ধারক ও বাহকরূপে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন ৷ ইঁহারা মহাপুরুষের একান্ত আপনার জন অত্যন্ত প্রিয়পাত্র, কৃপাভাজন, সজ্জন ৷
মহাপুরুষের কিন্তু দৃষ্টি থাকে জনসাধারণের উপর ৷ কারণ তিনি জানেন জনসাধারণ উন্নত না হইলে কোন সমাজ— তথা জাতি তথা দেশ উন্নত হয় না ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভু এই রহস্য উত্তমরূপেই অবগত ছিলেন ৷ তাই সর্বাগ্রে তিনি দৃষ্টি দিয়াছিলেন জনসাধারণের উপর, সে দৃষ্টি তাঁহার প্রসারিত হইয়াছিল একেবারে সমাজের নিম্নস্তরে ৷ এমন জনদরদী, এমন অহৈতুকী করুণাপরায়ণ, এমন পতিতবন্ধু অধম দুর্গতগণের, এমন আপনার জন পৃথিবীতে বোধ হয় আর কেহ নাই ৷
মানব চরিত্রের রহস্যবেত্তা ছিলেন বলিয়াই লক্ষপতি ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে ছাড়িয়া তিনি খোলা-বেচা শ্রীধরের সঙ্গে সৌহার্দ স্থাপন করিয়াছিলেন ৷ কোন ধনশালীর গৃহে না গিয়া শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর ভিক্ষালব্ধ তণ্ডুলের অন্ন ভোজন করিয়াছিলেন ৷ যেখানে মনুষ্যত্বের সন্ধান পাইয়াছিলেন, এই মহামানব সেইখানেই গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন, তাহাকেই বক্ষে তুলিয়া লইয়াছিলেন ৷ গণসংযোগের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়রূপে তিনি নাম সঙ্কীর্তনের প্রবর্তন করিয়াছিলেন ৷ দেশের শাসক ছিলেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ৷ রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা তিনি পান নাই ৷ এই জন্যই রাজনীতিকে অন্তরালে রাখিয়া তাহারই সমান্তরালে তিনি জাতি গঠনের উপাদানস্বরূপ বাছিয়া লইয়াছিলেন নাম সঙ্কীর্তন ৷ নাম সঙ্কীর্তনে যোগ দিবার পথে কাহারও কোন বাধা ছিল না,জাতিভেদ ছিল না, উচ্চনীচ ভেদ ছিল না ৷ সঙ্কীর্তনের উদারতর সমতলে ব্রাহ্মণে চণ্ডালে কোলাকুলি করিতেন ৷ কোনরূপ আইনের আশ্রয় না লইয়াই তাই তিনি এই অভিনব উপায়ে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন ৷
ধর্মহীন মানুষ পশুর সমান ৷ যাহার ধর্ম নাই, যে দুর্নীতিপরায়ণ লোভী, পরশ্রীকাতর, ব্যভিচারী, অর্থলোলুপতায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সে তো নরপিশাচ ৷ ধর্মকে ছাড়িয়া মানুষ বাঁচিবে কিরূপে, সমাজ বাঁচিবে কিরূপে, জাতি বাঁচিবে কিরূপে ৷ তাই মহাপ্রভু কলির যুগধর্ম,সর্বোত্তম লোকধর্ম নাম-সঙ্কীর্তনের প্রবর্তন করিয়াছিলেন ৷ যোগ অভ্যাস করিতে হইবে না, নির্জনে গিয়া তপস্যা করিতে হইবে না, যজ্ঞ করিতে হইবে না, অকপটে নাম কর, তোমার সর্বসিদ্ধি করতলগত হইবে ৷ এই নামের স্মিত জ্যোৎস্না তোমার চিত্তদর্পণকে পরিমার্জিত করিবে ৷ জ্যোৎস্না-শীকর ভবদাবানল নিভাইয়া দিবে ৷ অন্তরে শ্রেয়রূপ কুমুদকে সুবিকশিত করিয়া তুলিবে ৷ এই নামের সুধাধারা পানে বিদ্যাবধূ পুনরুজ্জীবিতা হইবেন ৷ নামের পূর্ণোদয়ে তোমার হৃদয়ের আনন্দাম্বুধি উদ্বেলিত হইয়া উঠিবে ৷ প্রতিপদে তুমি এক অনাস্বাদিতপূর্ব অমৃতের আস্বাদনে ধন্য হইবে ৷ তোমার মনপ্রাণ — ইন্দ্রিয় হইতে অন্তরাত্মা পর্যন্ত সেই চন্দ্র কিরণের পুণ্য-স্নানে কৃতার্থতা লাভ করিবে ৷
একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পার— প্রকাশ্যে না পার গোপনে ৷ ইহার তো সময় অসময় নাই, দেশের কালের কোন বাধ্যবাধকতা নাই৷ মহাপ্রভুর শ্রীমুখবাক্য— ‘খাইতে শুইতে যথা তথা নাম লয় ৷ দেশ কাল নিয়ম নাই সর্বসিদ্ধি হয় ৷’
যদি বল তৃণের মত সুনীচ, তরুর মত সহিষ্ণু এবং অমানী মানদ না হইলে নাম কীর্তনে অধিকার জন্মিবে না ৷ না না, নামের জন্য তোমাকে কোন অধিকার অর্জন করিতে হইবে না ৷ সদা হরিকীর্তন কর ইহাই একমাত্র বিধি, হরিই একমাত্র কীর্তনীয় ৷ কীর্তন করিতে করিতে এই সমস্ত অবস্থা তোমার আপনিই আসিবে ৷ নামে আচণ্ডাল ব্রাহ্মণের সমান অধিকার ৷ সুতরাং আগে শুচি হও পরে নাম করিবে, এ বিধি নাম কীর্তনে প্রযোজ্য নয় ৷ মহাপ্রভু বলিয়াছেন — “যেরূপে লইলে নাম প্রেম উপজায় ৷ তাহার লক্ষণ শুন স্বরূপ রাম রায় ৷” এই কথা বলিয়াই উক্ত তৃণাদপি সুনীচ, তরোরিব সহিষ্ণু ও অমানী মানদ হইতে বলিয়াছেন ৷ ইহা অধিকার অর্জনের কথা নহে ৷ বিশেষ অবস্থার কথা ৷ নাম কর নামে রুচি হইবে, তখন শুচিতা আপনিই আসিবে ৷ তাই বলিতেছিলাম— প্রকাশ্যে যদি লজ্জা হয়, কিছুদিন গোপনে করিয়া দেখ ৷ কিছুদিন গেলেই বুঝিতে পারিবে ৷ নাম তোমার নিত্যসঙ্গী, নামকে ছাড়িয়া থাকা তোমার পক্ষে অসম্ভব ৷ তখন প্রকাশ্যে নাম করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিবে ৷ আর পাঁচজনকে দলে টানিবার চেষ্টা করিবে ৷ আর যাঁহারা দেশের হিত চেষ্টা করেন, লোক-সংগ্রহের জন্য যাঁহারা প্রকৃতই যত্নপরায়ণ, তাঁহাদিগকে বলি— তাঁহারা আমার এই পরামর্শ পরীক্ষা করিয়া দেখুন ৷ ধর্মনিরপেক্ষ রাজ্য, ধর্মহীন রাজ্য তো নয় ৷ আপন আপন ধর্ম পালনে কোন বাধা নাই! তুমি ধর্মকে অবহেলা করিবে কেন? এই দেশের মাটী, জল, বায়ু, মানুষ এই সমস্ত মিলাইয়া এই সমস্তের উপযোগীরূপে ধর্ম স্বয়ং উদ্ভুত হইয়াছেন ৷ ইহা কাহারো নির্মাণ করা বস্তু নহে ৷ সুতরাং তুমি আপন জাতিধর্ম কুলধর্ম ত্যাগ করিবে কেন? আপন ঐতিহ্যভ্রষ্ট হইবে কেন? তোমার গৌরবান্বিত অতীতকে বিস্মৃত হইবে কেন? শোন নাই কি স্মৃতিহারা হইলে সর্বনাশ হয় ৷ শ্রীভগবান নিজ মুখে বলিয়াছেন, “স্মৃতিভ্রংশাদ্‌ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ৷” স্মৃতিভ্রংশে বুদ্ধিনাশ ঘটে, আর বুদ্ধিনাশে বিনাশ সুনিশ্চিত ৷ তাই আমার বিনীত অনুরোধ অতীতের যোগসূত্র হারাইও না৷ স্বধর্মচ্যুত হইও না ৷ স্বধর্মে থাকিয়া মৃত্য বরণ করিবে ৷ তথাপি পরধর্ম গ্রহণ করিবে না ৷
সঙ্কীর্তন—সম্যকরূপে কীর্তন ৷ একাকীও করিতে পার, পাঁচজনকে লইয়া মিলিতভাবেও করিতে পার ৷ নাম মনে মনেও করা চলে উচ্চৈঃস্বরেও করা যায় ৷ শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে অন্ত্যলীলায় বিংশ পরিচ্ছেদে স্বরূপ দামোদরের ও রাম রায়ের সঙ্গে রজনীতে কৃষ্ণকথা আলাপনরত মহাপ্রভু বলিয়া উঠিলেন —
হর্ষে প্রভু কহেন শুন স্বরূপ রাম রায় ৷
নাম সঙ্কীর্তন কলৌ পরম উপায় ৷৷
সঙ্কীর্তন যজ্ঞে করে কৃষ্ণ আরাধন ৷
সেইত সুমেধা পায় কৃষ্ণের চরণ ৷৷
নাম সঙ্কীর্তন হইতে সর্বানর্থ নাশ ৷
সর্ব শুভোদয় কৃষ্ণে পরম উল্লাস ৷৷
সঙ্কীর্তন হইতে পাপ সংসার নাশন ৷
চিত্ত শুদ্ধি সর্বভক্তি সাধন উদ্‌গম ৷৷
কৃষ্ণ প্রেমোদ্‌গম প্রেমামৃত আস্বাদন ৷
কৃষ্ণ প্রাপ্তি সেবামৃত সমুদ্রে মজ্জন ৷৷
হরিনাম সঙ্কীর্তন কলিতে সর্বাভীষ্ট লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় ৷ সঙ্কীর্তন যজ্ঞে একান্তচিত্তে অকপটে যে সুবুদ্ধি সজ্জন কৃষ্ণের আরাধনা করিবেন, তিনিই শ্রীকৃষ্ণপদ প্রাপ্ত হইবেন ৷ বিশ্বাস কর সঙ্কীর্তন হইতেই সর্ব অনর্থ বিনষ্ট হইবে ৷ তুমি সর্বশুভোদয়ে শ্রীমণ্ডিত হইবে ৷ তোমার চিত্ত শ্রীকৃষ্ণ প্রেমলাভে পরম উল্লসিত হইবে ৷ সঙ্কীর্তন হইতেই তোমার সংসার যাতনার অবসান ঘটিবে ৷ ভবদাবানল নির্বাপিত হইবে ৷ চিত্তের সর্বমালিন্য অপসৃত হইবে ৷ শুদ্ধচিত্তে সর্বভক্তি সাধনের উদ্‌গমে তুমি কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্ত হইবে ৷ কৃষ্ণপ্রেমামৃত আস্বাদনে ধন্য হইবে এবং মানবের চরম ও পরম প্রাপ্তি শ্রীকৃষ্ণ লাভ করিবে ৷ কৃষ্ণসেবামৃত সমুদ্রে নিমজ্জিত হইবে ৷ উদ্ধৃত পয়ার কয় ছত্র হইতে বুঝিতে পারা যায় — যোগী,জ্ঞানী, ভক্ত সকলেই হরিনাম কীর্তনে আপন আপন অভীষ্ট লাভ করিতে পারিবেন ৷
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে আদি লীলায় অষ্টম পরিচ্ছেদে দুই ছত্র পয়ার আছে —
বহু জন্ম করে যদি শ্রবণ কীর্তন ৷
তবু নাহি পায় কৃষ্ণ পদে প্রেমধন ৷৷
সাধক যদি অন্য কামনা বাসনা লইয়া শ্রবণ কীতর্ন করেন, তিনি তাহাই প্রাপ্ত হইবেন ৷ শ্রবণ কীর্তন নবধা ভক্তির অঙ্গ ৷ ভক্তির এক অঙ্গে নিষ্ঠা হইলে প্রেমের উদ্রেক হইবে ৷ আমি একমাত্র কৃষ্ণকেই চাই ৷ সার্ষ্টিসালোক্যাদি মুক্তি কিম্বা ব্রহ্মসাযূজ্য চাই না, ইন্দ্রত্ব চাই না, অপর কিছুই চাই না, একমাত্র কৃষ্ণসেবাই আমার চরম ও পরম কাম্য ৷ হৃদয়ে এই নিষ্ঠাই সুদৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল থাকা চাই, তবেই না কৃষ্ণ সেবাধিকার পাওয়া যাইবে ৷ তাই বলিয়াছেন বহু জন্ম অন্য কামনা লইয়া শ্রবণ কীর্তন করিলে কৃষ্ণপ্রেম পাওয়া যায় না ৷ কৃষ্ণপ্রেম নিত্যসিদ্ধ বস্তু ৷ কোন সাধনেই সে প্রেম পাইবার উপায় নাই ৷ একমাত্র নিষ্ঠাপূর্ণ নাম সঙ্কীর্তনেই তাহা পাওয়া যায় ৷ জীব কৃষ্ণের নিত্য দাস ৷ নাম সঙ্কীর্তনে এই দাসবুদ্ধি সুবিকশিত হইয়া উঠিবে ৷ জীবের নিত্যদাসত্ববোধকে উদ্বোধিত করিয়া সুন্দর ও সার্থক করিবে ৷ এই দাসত্বই সম্প্রসারিত হইয়া সখ্যে, বাৎসল্যে এমন কি কান্তাভাবে রূপান্তরিত হইতে পারে ৷ কারণ কি সখাগণ কি গুরুবর্গ কি কান্তাগণ সকলেরই অন্তরের অন্তস্তলে যে সেবাপ্রণোদনা রহিয়াছে, সেবিষয়ে তো কেন সংশয় নাই ৷