যমুনা কিনারে

চামড় কাঠের বাঁহুক ষোড়িআঁ

চামড় কাঠের বাঁহুক ষোড়িআঁ
ভেরছ কৈল সীকা।
আগেঁ বড়ায়ি জাএ পাছে ভার বহে কাহ্ন
মাঝে রাধিকা জাএ বিকা।।
লড়িলা জনার্দ্দন কান্ধে লআ ভার
দধি বিকে মথুরার রাজে।
দেখি সব দেবাগন খলখলি হাসে ল
ভাবে মজিলা দেবরাজে ।।ধ্রু।।
সোনার ভাণ্ডে দধি দুধ সজাইআঁ
রূপার ভাণ্ডত সজাইল ঘী।
সে ভার দেব বনমালী বহে ল
উলসিলী গোআলার ঝী।।
ভার লআঁ জীয়িতেঁ পসার টলিআঁ গেল
ছাড়ায়িল কিছু দুধ দহী।।
সোনার রূপার ভাণ্ড তেরছ হৈল ল
দেখি বুকে ঘাঅ দিল রাহী।।
লাজ পাআঁ কাহ্নাঞিঁ ভার এড়িআঁ মিল
দেখি সব সখিগণ হাসে।
বাসলীচরণ শিরে বন্দিআঁ
গাইল বড়ু চণ্ডীদাস ।।

অন্তঃকথন:
মর্ত্যে অবতরণ করে ভগবানের কতই লীলা, কখনও তিনি দুর্দান্ত কালীয় নাগ কে দমন করেন কখনো বা আবার সামান্য মজুরের মত শ্রীরাধিকার দধিদুগ্ধের ভান্ড বহন করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভার খন্ডে আমরা ভগবানের সেই ভারীরূপের লীলা প্রত্যক্ষ করি! অনেকদিন শ্রীমতির সাক্ষাৎ না পেয়ে কানাইয়ের তো মন উচাটন। বড়াইয়ের সঙ্গে যুক্তি করেন কি করে রাধাকে ঘরের বাইরে আনা যায় ! সেই যুক্তিমত বড়াই গিয়ে দধিদুগ্ধ বেচার জন্য শ্রীরাধিকাকে বার করেন পথে ! আর অন্যদিকে কানাই তখন চামড় কাঠের বাঁক বানিয়ে তাতে পাটের দড়ির শিকে তৈরী করে রাধার ভারী হবার প্রস্তূতি নিতে থাকেন। শরতের রোদ্দুরে দধিদুগ্ধের ভান্ড বহন করে যমুনা পার করে শ্রীরাধিকা তো ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। মথুরার পথ তো কমদূর নয়। ওদিকে সখীরাও এগিয়ে গেছেন, শ্রীরাধিকা তো ভেবে পান না কি করবেন। তখন যুক্তি মত বড়াই রাধাকে বলেন তুমি ভার বহন করার জন্য একজন মজুর নাও না কেন? তাহলেই তো ভাবনা থাকে না ! বড়াইয়ের কথায় রাই মজুরের খোঁজ করতেই এসে হাজির হলেন কানু ! ভার বইবার এতো আয়োজন করে, রাধিকার ডাকে সারা দিয়ে কৃষ্ণ এসে ত গেলেন, কিন্তু ভার বইতে তাঁর লজ্জা আর যায় না। ভাবেন মনে কংসবধের জন্য মর্ত্যে এসে শেষে কিনা ভার বইব! রাধা কানাইয়ের দ্বিধা দেখে শেষ অবধি কথা দেন কৃষ্ণ যদি ভার বয়ে দেন রাধাও তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন। তখন হৃষ্ট মনে কানু তুলে নিলেন রাধিকার ভার। এই গানটি ভগবান কৃষ্ণের সেই ভারবহনের বর্ননা দিচ্ছে। চামড় কাঠের সেই ভারদন্ড কাঁধে নিয়ে কানাই চলেছেন বড়াই আর রাধিকার পেছনে পেছনে। কৃষ্ণ বইছেন সামান্য দধি দুদ্ধের ভার ! এই দৃশ্য দেখে স্বর্গের দেবতারাও খিলখিল করে হাসছেন আর ভাবছেন দেবতাদের রাজা যিনি তিনি অবধি একি পাপে মজেছেন ! এদিকে সোনার ভান্ডে দধি দুগ্ধ আর রূপার ভান্ডে ঘি নিয়ে কানাই চলেছেন দেখে শ্রীমতির মনে খুশির সীমা নেই । কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের কি আর অভ্যেস আছে এই মজুরের কাজ করার ! চলতে চলতে হঠাৎ পা গেল টলে ! বাঁক হেলে গিয়ে দধি দুগ্ধ উছলে পড়ল মাটিতে! আর এক কান্ড দেখে রাধিকা তো রেগে উঠলেন, এগিয়ে এসে 'বুকে ঘাঅ দিল রাহী' অর্থাৎ কিনা কানাইয়ের বুকে শ্রীমতি দিলেন এক ঘা বসিয়ে ! রাধার হাতে সেই ঘা খেয়ে কানাই তো লজ্জায় মরে যান আর কি ! ভার বওয়া অবধি ঠিক ছিল কিন্তু তা বলে বুকে আঘাত! এ সওয়া যায় না! কানাই নামিয়ে দিলেন কাঁধের ভার, আর কিছুতেই বইবেন না তিনি। আর এইসব কান্ড দেখে সখীরা তো হেসে আকূল ! হাসির কথাই বটে জগতের ত্রাতা যিনি তিনি কিনা সামান্য পদস্খলনের জন্য শ্রীমতীর হাতে মার খাচ্ছেন! এ লীলার মাহাত্য বোঝা ভার ! আমরা শুধু রসটুকুই আস্বাদন করতে পারি।

পদকর্তা:বড়ু চন্ডীদাস
রাগ:মাহারঠারাগ
তাল:একতালী
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী