‘‘ভজ নিতাই গৌর রাধে শ্যাম।
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।
রামরায় রসের সাগর।’’
জয় রামানন্দ জয়—গৌর-পিরীতি-রত্নালয়
আপনি চৈতন্য যাহে,’’
রসোন্মাদী নাগরী-নাগর।।’’
রামরায় রস-সাগরে—মনোসাধে অবগাহে
গৌরপ্রেমরসঘন, ভবানন্দ নন্দন,
জয় জয় রামানন্দরায়।
আলালনাথ-সন্নিধানে বেঙ্কটপুর-নাম-গ্রামে
কৃপা করি’ হইলা উদয়।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নাম, শ্রীরাধারমণ-রাম,
তাহারে আনন্দ বিতরিতে।
শ্রীবিশাখা-সুন্দরী, রামানন্দ-নাম ধরি’,
উদয় হইলা অবনীতে।।
শৈশবেতে সঙ্গী-সনে, রাধাকৃষ্ণ-গুণ-গানে,
দু’নয়নে প্রেমধারা বয়।
রাধাকৃষ্ণ-প্রেমলীলা, বিনে অন্য নাহি খেলা,
নিতি নব নিকুঞ্জ রচয়।।
কৈশোরেতে অল্পদিনে, সর্ব্বশাস্ত্র অধ্যয়নে,
সুপণ্ডিত-প্রধান হইলা।
ভকতি-সিদ্ধান্ত-খনি, রসিক-মুকুট-মণি,
নিজগুণে জগৎ-জিনিলা।।
প্রতাপরুদ্র মহারাজ, জানিলেন জগমাঝ,
রামানন্দ অপূর্ব্ব-রতন।
করিবারে রাজকাজ, যোগ্য জানি সভামাঝ,
রাজ্যভার করিলা অর্পণ।।’’
গোদাবরী-নদী-তীরে—রাজা হৈলা বিদ্যানগরে
আইলেন দোলায় চড়িয়া।
সঙ্গে পাত্রমিত্রগণ, চলে বন্দী বাদকগণ,
পাঠক-পুরোহিত অগ্রে লইয়া।
করি নিত্যকৃত্য স্নান, আঁখি মুদি করে ধ্যান,
নিজ-ইষ্ট শ্যাম নবঘন।
শ্যামরূপ হেরিবারে, যতেক যতন করে,
তত হেরে গৌরবরণ।।
আজানুলম্বিত-ভুজ, এক নব ন্যাসীরাজ,
হেরে,–রসভূপ মানস-মোহন।
গৌররূপে আলো করি’, হৃদি-সিংহাসনোপরি,
বসি করে সর্ব্বস্ব-হরণ।।’’
অপরূপ চোর এ কে রে
হৃদে বসে সর্ব্বস্ব হরে—অপরূপ চোর এ কে রে
ব্যাকুল হইয়া রায়, নয়ন মেলিয়া চায়,
দেখে ঘাট ছাড়ি’ কতদূরে।
বসি’ জল-সন্নিধানে, করে নাম-সঙ্কীর্ত্তনে,
চিতচোরা সেই ন্যাসীবরে।।
সূর্য্য-শত-সম জ্যোতি উজ্জ্বল-কনক-কাঁতি,
পরিধানে অরুণ-বসন।’’
সূর্য্য-শত-সম জ্যোতি—উজ্জ্বল-কনক-কাঁতি
সুবলিত-দীর্ঘকায়, পুলক কদম্ব তায়,
ঢলঢল-কমল-নয়ন।।
হেরিয়া সে ন্যাসীবরে, ধৈরয ধরিতে নারে,
মন-প্রাণ হৈল উচাটন।’’
রামরায় মনে গণে—এ বটে কোনজন
গৌর বরণ হিরণ কিরণ-চিতচোরা এ কোনজন
প্রাণপণে প্রাণ টানে, আসি’ পড়ে শ্রীচরণে,
করিলেন আত্ম সমর্পণ।।’’
কৈল আত্ম সমর্পণ—কে হে তুমি প্রাণের প্রাণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কহ বলি’, আলিঙ্গিতে কুতুহলী,
ন্যাসী পুছে তুমি রামানন্দ।’
সার্ব্বভৌম বলেছে আমায়—তুমি কি রামানন্দরায়
তেঁহ কহে সেই হঙ, চরণে শরণ চাঙ,
তব দাসাধম শূদ্র মন্দ।।’’
এই গোদাবরী-তীরে—তুমি এলে,–এই দাসাধমে দর্শন দিতে
ন্যাসীমণি তা শুনিয়া, দুই-বাহু পসারিয়া,
রামানন্দে হৃদয়ে ধরিলা।’’
আইস রামানন্দ বলে—বাহু পসারি’ কৈলা কোলে
সহজ-প্রেম উদ্দীপনে, প্রভু ভৃত্য দুইজনে,
দোঁহে-অচেতন ভূমিতে পড়িলা।।’’
দোঁহে,–অচেতন ভূমিতে পড়িলা।।’’
আমার মনে এই ত’ লয়
ব্রজভূমি হতেও ভাগ্যবতী
হৃদে কি ধরেছে কখন
বুকে কি ধরেছে কখন
একাসনে রাই-কানু-মিলন-বুকে কি ধরেছে কখন
ব্রজভূমি হতেও গোদাবরী-তীর—তাই বলি ভাগ্যবতী
কম্প-অশ্রু-পুলক-গায়, দোঁহে ভূমে গড়ি যায়,’’
রামরায় জড়িত গোরারায়—গোদাবরী-তীরের সৌভাগ্য বাড়ায়
দোঁহে,–জড়াজড়ি মাতোয়ারা—সবাই বলে এরা কারা
গোরা,–
কল্লোলে ভাসিল ত্রিভুবনে।।’’
গোরা রামরায় মিলনে—উপজিল প্রেম-তরঙ্গ
গোদাবরী-নদীতীরে, সেই রাত্রি বিপ্রঘরে,
নিরজনে মিলন দোঁহার।
ইষ্টগোষ্ঠী কৃষ্ণকথা, রায় বক্তা প্রভু শ্রোতা,
বয়ে যায় প্রেমের পাথার।।
প্রেমসিন্ধু গোরারায়, রায় মেঘ বরিষয়,
সিন্ধু তাহে রত্ন-আলয় হইল।
পহিলহি-পদ শুনি, আবেশেতে ন্যাসীমণি,
রামরায়ের মুখ আচ্ছাদিল।।
ইষ্টগোষ্ঠী সমাপণ, করজোড়ে নিবেদন,
করে যায় গৌরাঙ্গ-চরণে।
যে তত্ত্ব স্ফূরালে মোরে, ব্রহ্মাদিরও অগোচরে,
আমি কভু না জানি স্বপনে।।’’
আপন-সুখ-কারণে—আপনি করাইলা স্ফুরণে
কলিতে সন্ন্যাসীবেশে, মোরে দেখা দিলে এসে,
এবে হেরি শ্যাম-গোপরূপ।
স্বর্ণ-পঞ্চালিকা-ঢাকা, মূরলীবদন বাঁকা,
এ কি তব লীলা অপরূপ।।
প্রভু কহে তাহা শুনি, তুমি ভক্ত-চূড়ামণি,
তোমার,–সর্ব্বভূতে কৃষ্ণ-দরশন।’’
আপন-ভক্তি-স্বভাবেতে—কৃষ্ণ দেখে সর্ব্বভূতে
রায় কহে গৌরহরি, ছাড় তুমি ভারিভুরি,
নিজরূপ না কর গোপন।।’’
সকলই ত’ জেনেছি
তোমার যত ভারিভুরি—সকলই ত’ জেনেছি
তবে প্রভু মৃদু হাসি’, গূঢ়রূপ পরকাশি,
প্রিয়-রামানন্দে দেখাইলা।
রসরাজ মহাভাব, দুই তনু অভিনব,
স্বরূপ-রহস্য প্রকাশিলা।।
বিবর্ত্তে বিবর্ত্ত রঙ্গ, তাহাতে বিলাসরঙ্গ,
হেরি’ রায় মূরছিত ভেল।’’
রামরায়ে নিজরূপ—দেখায় গোরা রসভূপ
পরশে চৈতন্য দিয়া, রামরায়ে উঠাইয়া,
মহানন্দ-সিন্ধু উথলিল।।
আজ্ঞা দিয়া আনি তারে, নীলাচলে চোরাঘরে,
অন্তরঙ্গ-রস আস্বাদনে।’’
গম্ভীরা-ভিতরে গোরারায়—জাগিয়া রজনী পোহায়
রামরায়ের কণ্ঠ ধরি’—জাগিয়া রজনী পোহায়
প্রেম-বৈচিত্র্য-লীলা,’’
নীলাচলে গম্ভীরাঘরে—প্রেম-বৈচিত্র্য-লীলা
সেই ত’ মধুর-নদীয়া
ব্রজের নিভৃত-কুঞ্জের নিভৃত-কুঞ্জ
যেখানে গৌর-স্বরূপ প্রকট—ব্রজের নিভৃত-কুঞ্জের নিভৃত-কুঞ্জ
তার আবার নিভৃত-উদ্যান
যার নীলাচল নাম—তার আবার নিভৃত-উদ্যান
সেই ত’ নিভৃত-গম্ভীরা—সে উদ্যান ঘর চোরা
ভাবোচ্ছাসে নিশি-জাগরণে।।’’
কিশোরী-আবেশে গোরারায়—নিভৃত-গম্ভীরা-ঘরে
এনে দেখা নহো প্রাণ যায়।’’
কোথা সে ত্রিভঙ্গ বাঁকা—এনে দেখা ও বিশাখা
রায় কহে বিনোদিনী, কেন হইলে উন্মাদিনী,
ঐ বাজে মধুর বাঁশরী।
ধৈরয ধরহ রাই, চল বৃন্দাবনে যাই,
মিলাইব শ্যাম-বংশীধারী।।
আবেশেতে গৌরহরি, রায়-স্বরূপের করে ধরি’,
বলে,–চল সখী বিলম্ব না সয়।
চল ত্বরা বৃন্দাবনে, পরাণ-বঁধূয়া বিনে,
দেহে মোর প্রাণ নাহি রয়।।’’
চল চল ও ললিতা বিশাখা
কোথা আছে প্রাণসখা—চল চল ও ললিতা বিশাখা
তখন—রায়-স্বরূপ-সহচরী, লয়ে গোরা-রাসেশ্বরী,
টোটা,–গোপীনাথ-সমীপেতে যায়।
হেরি’ গোরা গোপীনাথ, মানে পাইনু প্রাণনাথ,
ভাবোল্লাসে বামেতে দাঁড়ায়।।
ভাবনিধি গৌরহরি, রায় ভাব-পুষ্টিকারী,
ভাব বুঝি’ করয়ে সেবন।’’
আর সেবা জানে কেবা—ভাব করে ভাবের সেবা
আপন-নাটক-গীতি, শুনায় সতত নিতি,
সুখে গোরা করে আস্বাদন।।
গৌরাঙ্গ পরাণ-বন্ধু, রামরায় গুণসিন্ধু,
একবিন্দু জগত ডুবায়।’’
গৌর-লীলামৃত আস্বাদয়।।’’
রামরায় আশ্রয় করে—গৌর-লীলামৃত আস্বাদ করে
অর্জ্জুন অর্জ্জুন-গোপী—রামরায় আশ্রয় করে
প্রদুম্ম-মিশ্রের দ্বারে, জানাইলা জগতেরে,
নিজ-রামানন্দের মহিমা।
রাজা প্রতাপরুদ্র-রায়, যার কৃপায় গৌর পায়,
তার গুণের কে পাইবে সীমা।।
জয় রামানন্দ-রায়, কৃপা কর অমায়ায়,
একবিন্দু গৌরাঙ্গে মতি দিয়া।
গম্ভীরার গুপ্তধনে, ধনী কর নিজগুণে,
‘‘কহে দীন দ্বিজ অভাগিয়া।।’’
শ্রীগুরু-আনুগত্যে—কৃপা করে আস্বাদ করাও
নিভৃত-গম্ভীরা-বিহার—কৃপা করে আস্বাদ করাও
পরাণ-গৌরাঙ্গগণ তোমরা—কোথা বা লুকালে
পরাণগৌরাঙ্গ লয়ে—একে একে কোথা লুকালে
এই,–কালকলির কবলে ফেলে—একে একে কোথা লুকালে
আর জুড়াবার—দাঁড়াইবার স্থান নাই গে
প্রাণ-গৌরকথা শুনে প্রাণ—জুড়াইবার ঠাঁই নাই গো
অতঃপর মহাজনী আক্ষেপ-কীর্ত্তন—
………………………………………………………….
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।’’
গৌরহরি-বোল, হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল।।
‘‘শ্রীগুরু-প্রেমানন্দে নিতাই-গৌর-হরিবোল।।’’