(কার্ত্তিকী শুক্লা প্রতিপদ)
‘‘ভজ নিতাই গৌর রাধে শ্যাম।
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।’’
(১)
পুনঃ গিরি-ধারণ, পূরব লীলাক্রম,
নবদ্বীপে করিলা প্রকাশ।।
শুদ্ধভক্তি গোবর্দ্ধন, পূজা কর জগজন,
এই বিধি দিলা কলিমাঝে।’’
প্রচারিলা গৌরহরি—ভজ সবে ভক্তিগিরি
হরিনামে দিয়ে সেবা করি—ভজ সবে ভক্তিগিরি
ভক্তি,–গোবর্দ্ধনের পূজা কর
হে জগজন,–আমার বচন ধর—ভক্তি,গোবর্দ্ধনের পূজা কর
শ্রবণাদি নব অঙ্গ, কল্পতরুময় শৃঙ্গ,
পঞ্চরস-ফল তাহে সাজে।।’’
বলেন আমার গৌরহরি—অপরূপ ভক্তি-গিরিধারী
ভকতি-গোবর্দ্ধনের—বালাই লয়ে মরে যাই রে
ভক্তি,–গোবর্দ্ধনের শোভার—বালাই লয়ে মরে যাই রে
মন্দবায়ু বেপথু সুন্দর রে ।
প্রেমমণি পাবে ইষ্টবর রে।।
নিজেন্দ্রিয়-উপচারে—ভক্তি,–গোবর্দ্ধনের পূজা কর
কলিরাজ-ইন্দ্রের পূজা ছাড়—ভক্তি,–গোবর্দ্ধনের পূজা কর
প্রাণগৌরাঙ্গের আজ্ঞা পেয়ে—সকলেই হল রত
ভক্তি-গোবর্দ্ধনের পূজায়—সকলেই হল রত
কলিপীড়িত জীব যত—সকলেরই হল রত
ভক্তি-গোবর্দ্ধনের পূজায়—সকলেরই হল রত
দেখিয়া লোকের গতি, কলিযূগ-সুরপতি,
ক্রোধে তনু কম্পিত হইল।’’
আমরা,–পূজা ছাড়ি কলিজীব—ভক্তি-গোবর্দ্ধন পূজে
অধরম-ঐরাবতে, কুমতি-ইন্দ্রাণী-সাথে,
সসৈন্যেতে সাজিয়া আইল।।’’
কলিজীবে দণ্ড দিবার লাগি—সসৈন্যে সাজিয়া আইল
লোকের হইল বড় ডর।
লোভ-মোহ-শিলাঘাতে, মাৎসর্য্যাদি—খরবাতে,
ধৈর্য্য-ধর্ম্ম উড়ে নিরন্তর।।’’
ধৈর্য্য-ধর্ম্ম উড়াইছে—মাৎসর্য্য-তর্ক-বাতাসে
কলিজীব ত্রাস পেয়ে—ব্যাকুল হয়ে ডাকে রে
নির্দ্দয়-কলির পীড়ন হতে—কে আমাদের রক্ষা করবে
আমার,–একনিষ্ঠ পুত্র জীব যত—দেখি,—কলিপীড়নে হেতছে পীড়িত
জগৎ-জীবের অনুভব না থাকুক—আমি ত’ বটি জগৎ-পিতা
কলিজীবে রক্ষা করা—কর্ত্তব্য তো হয় আমার
আমার অযোগ্য-কলিজীব—কেমন করে উদ্বার করবো
ভক্তভাব সারোদ্ধার, নিজে করি অঙ্গীকার,
ভক্তি-গিরি করিলা ধারণে।।’’
কলির জীবে রক্ষা লাগি—ভক্তি-গিরি করিলা ধারণ
কলি-ভয় খণ্ডিল সকলে।’’
শ্রীগৌরাঙ্গের আজ্ঞা পেয়ে—পীড়ন হতে রক্ষা পেল
তবে কলি-দেবরাজ, পাইয়া পরাভব-লাজ,
স্তুতি করে চরণ-কমলে।’’
আমি তোমায় না চিনিয়ে—দেখায়েছি আপন-প্রভাব
তোমায় চিন্তে পারি নাই বলে—অপরাধ ক্ষমা কর(মাতন)
সামান্য,–ব্রাহ্মণ-বালক মনে করেছি—চিনিতে পারি নাই প্রভু
তুমি যে,–কলিপাবন-অবতার—চিনিতে পারি নাই প্রভু
অপরাধ ক্ষমাইয়া, কহে কিছু দীন হইয়া,
যত জীব তোমার আশ্রয়।
যে বা তোমার গুণ গায়, তাহে মোর নাহি দায়,
এই সত্য করিল নিশ্চয়।।’’
যে,–তোমার নামের আস্বাদ পাবে—তারা—আমার হাত এড়াইবে
যে,–নাম-আশ্রয় লবে তোমার—তারে আমার নাই অধিকার
প্রভু তারে দয়া কৈল, ধন্য-কলি নাম থুইল,
অদ্যাপিও ঘোষয়ে সংসার।’’
গৌরহরির কৃপা পাইল—অধন্য-কলি ধন্য হইল
চৈতন্য-দাসেতে বলে, গোবর্দ্ধন-লীলাচ্ছলে,
যুগে যুগে জীবের উদ্ধার।।’’
উদ্ধারিয়া ঘোর-কসি-রক্ষা কৈলা গৌরহরি
ভক্তি-গোবর্দ্ধন ধরি—রক্ষা কৈলা গৌরহরি
(২)
গিরি গোবর্দ্ধন, যাত্রা মনোরম,
শ্রবণ-মঙ্গল গীত।।
একদিন ব্রজে, ইন্দ্র-পূজা-কাজে,
সাজে গোপগোপী যত।
জানিয়া কারণ, নন্দের নন্দন,
কহেন আপন-মত।।
শুন গোপরাজ, গোপের সমাজ,
না পূজ দেবার রাজা।’’
পূজ,–গোবর্দ্ধন-গিরিরাজে—দেবরাজে পুজ কিবা কাজে
সাবধানে কর পূজা।।’’
দেবরাজ-ইন্দ্রের পূজা ছাড়—গিরি,–গোবর্দ্ধনের পূজা কর
এই সে উচিত, মোর অভিমত,
পাইবে বাঞ্ছিত ফল।
নানা-উপাচারে, বস্ত্র-অলঙ্কারে,
সত্বরে সাজিয়া চল।।’’
বাঞ্ছিত-ফল লাভ করবে—গিরি,–গোবর্দ্ধনের পূজা কৈলে
বিপ্রে দেহ দান, হইবে কল্যাণ।
না ভাবিও আন চিতে।
কহে কৃষ্ণদাস, সবার উল্লাস,
শ্রীবাস-বচন-রীতে।।’’
(৩)
গিরি-গোবর্দ্ধন পূজে নিকটে যাইয়া।।
মিষ্টান্ন পক্কান্ন আনি ধরিলা সকলে।
কৃষ্ণগুণ গায় নানা-বাদ্য-কোলাহলে।।
হেনই সময় কৃষ্ণ দেব-মায়া-মতে।
আরোহণ একরূপে করিলা পর্ব্বতে।।
দেখি গোপগোপীগণ প্রণাম করিলা।
সবে কহে গোবর্দ্ধন মূর্ত্তিমন্ত হইলা।।
প্রণাম করিয়া কহে যতেক গোপগণ।
যত ব্রজবাসী সবে পাইয়া আহ্লাদ।
পর্ব্বতের স্থানে মাগি নিল আশীর্ব্বাদ।।
নানা-দ্রব্য-অলঙ্কারে সাজায় গোধনে।
বেদের বিবিত দান দিলেন ব্রাহ্মণে।।
কৃষ্ণের সহিত তবে গেলা গোবর্দ্ধনে।
ইন্দ্র-যজ্ঞ-ভঙ্গ-কথা কৃষ্ণদাস ভণে।।’’
(৪)
না কৈল ইন্দ্রের পূজা।’’
ইন্দ্রদেবের পূজা ছাড়ি তবে—গোবর্দ্ধনের পূজা করে সবে
পাই অপমান, ক্রোধে কম্পমান,
সাজিল দেবের রাজা।।’’
ইন্দ্ররাজ সাজেন আজি—জগজনে দণ্ড দিবার লাগি
অজ্ঞানে মোহিত হইয়া।
কহে গোপপুরী, মহাবৃষ্টি করি,
আজি ডুবাইব যাইয়া।।
আমা,–ছাড়ি পূজে গোবর্দ্ধনে—আজি, উচিত-দণ্ড দিব ব্রজজনে (মাতন)
ডাকি মেঘ-গণে, যতেক পবনে,
আজ্ঞা দিলা সুরপতি।
শিলা বৃষ্টিকরি, ভাঙ্গ ব্রজপুরী,
যাও যাও শীঘ্রগতি।।
আপনি তখনে, চড়িয়া বাহনে,
ব্রজ হস্তে দেবরাজ।
সঙ্গে সেনাগণ, ছাইয়া গগন,
আইলা গোকুল-মাঝ।।
চতুর্দ্দিকে মেঘে, ধায় বায়ু-বেগে,
দিনে হৈল অন্ধকার।
খর বরিষণে, ব্রজের ক্ষেপণে,
ভাঙ্গিল ঘর-দুয়ার।।
প্রলয়ের হেন, বৃষ্টিধারা ঘন,
ঝঞ্ঝনা চিকুর পড়ে।
হাহাকার করি, পথাপথ ছাড়ি,
ব্রজবাসী সব নড়ে।।
পড়িয়া সঙ্কটে, কৃষ্ণের নিকটে,
আইলা গোকুলবাসী।’’
দেবরাজ ইন্দ্রের কোপ হতে—আমাদের রক্ষা কর বলে
তারে,–ছাড়ি করি গোবর্দ্ধনপূজা—দেবরাজ মোদের দেয় সাজা
ধেনুগণ যত, যূথে যূথে কত,
দাঁড়াল নিকটে আসি।।’’
কৃষ্ণের চাঁদমুখ-পানে—তারা,–একদিঠে চেয়ে রইল
অনন্য শরণ হয়ে—একদিঠে চেয়ে রইল
কৃষ্ণ মহামতি, গোকুলের পতি,
কর পরিত্রাণ বলে।’’
জনমিয়ে এই গোকুলে—আমাদের,–কত বিপদে রক্ষা কৈলে
এই ব্রজবাসী সকলে—কত বিপদে রক্ষা কৈলে
হে গোকুল-সুধাকর—এই বিপদে রক্ষা কর
চৈতন্যের দাস করি এই আস,’’
করি গোকুল উদ্ধার—পরিত্রাণ কর সবার
(৫)
দেখিা জানিল কৃষ্ণ ইন্দ্র করে বল।।
এতেক ভাবিয়া কৃষ্ণ নন্দের নন্দন।
এক হস্তের তুলিয়া ধরিয়া কৌতুকে।
সবারে ডাকেন আর জননী জনকে।।
আইস আইস সবে শিশু বৎসরগণ লইয়া।
এই গর্ত্তে থাক আসি নির্ভয় হইয়া।।
গোপকুল বলে কৃষ্ণ শুনহে বচন।
হাত হৈতে তোমার যদি পড়ে গোবর্দ্ধন।।’’
ব্রজের বিশুদ্ধ-প্রেমের—বালাই লয়ে মরে যাই
ঈশ্বরজ্ঞান নাই কৃষ্ণে – ঐশ্বর্য্য তো জানে না
ব্রজবাসীজন কৃষ্ণের—ঐশ্বর্য্য তো জানে না
বিশুদ্ধ সম্বন্ধ প্রেমের –ঐশ্বর্য্য তো জানে না
ভূমি,–বালক বৈ ত নও—কতক্ষণ বা ধরে রাখ্বে
এত বড় গোবর্দ্ধন—কতক্ষণ বা ধরে রাখ্বে
হাত হৈতে পড়ে যদি—কতক্ষণ বা ধরে রাখ্বে
সকল গোকুলপুরী যাবে রসাতলে।
কিসে হৈতে রক্ষা তবে পাইবে সকলে।।
কাঁদিয়া যশোদা দেবী কহে গোপগণে।
একাকি পর্ব্বত কৃষ্ণ ধরিবে কেমনে।।’’
আমার প্রাণ গোপাল—দুধের বালক বৈ ত নয়
এত বড় গোবর্দ্ধন—একা কেমন করে ধর্বে
সবে মিলি গোবর্দ্ধন ধর বলরাম।।’’
দুধর বালক গোপাল আমার—একা এমন করে ধর্বে
এত বড় গোবর্দ্ধন—একা কেমন করে ধর্বে
চৈতন্য-দাসেতে কহে শুন যশোমতি।
গোকুল রাখিতে তুয়া সহায় শ্রীপতি।।’’
(৬)
আচম্বিতে দরশন দিলা।।’’
নিজ-সখীগণ সঙ্গে লয়ে—চল যাই দেখে আসি বোলে
আজ,–গোকুল-নাথে নানা ছলে—চল যাই দেখে আসি বোলে
দাঁড়াইয়া রূপের ভরে, ধরি সহচরী করে,’’
বৃষভানু-রাজ-নন্দিনী—রাই আমার,–রূপের খনি রমণীমণি
আমার,–কৃষ্ণমন-আকর্ষিণী—রাই আমার,–রূপের খনি রমণীমণি
কৃষ্ণমোহিনী—রাই আমার,–রূপের খনি রমণীমণি
মুখ জিনি শশী ষোলকলা।।’’
রাইয়ের,–মুখ জিনি শশী ষোলকলা—সকলি রূপেতে করিয়া আলা
স্মিত সুরধুনী-ধারে, রসের ঝরণা ঝরে।
হেরি হেরি তৃপিত নয়ান।।
নব-অনুরাগ-বাতে, স্থির নাহি বাঁধে চিতে,
পাসরিলা নিজ-মরিয়াদ।
কাঁপে তনু থরথরে, পর্ব্বত দোলয়ে করে,’’
কিশোরীর বদন হেরে—নব-অনুরাগ-বাতে
গোয়ালে গণিল পরমাদ রে ।।’’
শ্রীকৃষ্ণের কর হতে—বুঝি গোবরর্দ্ধন খসি পড়ে
দেখ ভাই,–ঐযে কৃষ্ণের কর কাঁপছে—আর বুঝি ধরতে নারছে
লগুড় লইয়া করে, কেহ কেহ গিরি ধরে,
উদার ব্রজের গোপগণ রে।
ললিতাদেবী হাসি, দাঁড়াইলা আগে আসি,’’
ললিতা দাঁড়াল আসি—কৃষ্ণের,–কর কাঁপার কারণ জেনে
আঁখি, পড়েছে রাইয়রে রূপে—বলে,–তাইতে কৃষ্ণের কর কাঁপে
দেখে’ মোহিনী রাইয়ের রূপে—বলে,–তাইতে কৃষ্ণের কর কাঁপে
যদি,–ক্রমে কর অবশ হয় তবে—বড়ই প্রমাদ ঘট্বে জেনে
যদি,–কর হতে গোবর্দ্ধন পড়ে তবে—মরিবে সব ব্র্জবাসী
রাইয়েরে করিয়া অদর্শন রে।।
ভাব সম্বরিয়া’ হরি, রাখিল গোকুলপুরী,
ইন্দ্রেরে করিয়া পরাজয় রে।।’’
ইন্দ্র দর্প খর্ব্ব করি—রাখিয়া গোকুলপুরী
চৈতন্যদাসের বাণী, ত্রিভুবনে জয়ধ্বনি,
গোবর্দ্ধনলীলা রসময় রে ।।’’
(৭)
ব্রজের জীবন প্রাণধন।।
পরিবার সহ ব্রজবাসী।
গর্ত্ত হৈতে উঠিলা হরষি।।
সেইখানে লীলায় শ্রীহরি।
স্থাপিলেন গোবর্দ্ধন গিরি।।
নন্দ-আদি যত গোপগণে।
আশীর্ব্বাদ করে কায়মনে।।
কেহ কেহ করে আলিঙ্গন।
স্বর্গে স্ততি করে দেবগণ।।
যশোদা রোহিণী হর্ষ পাঞা।
চাঁদমুখে চুম্বয়ে চাপিয়া।।
আনন্দেতে নাচে বিদ্যাধরী।
পুষ্প বর্ষে অপ্সরা কিন্নরী।।
দেবরাজ পাইয়া পরাভব।
করযোড়ে করে নানা স্তব।।
নিজ অপরাধ ক্ষমাইয়া।
গেলা আপনার গণ লইয়া।।
চৈতন্যদাসেতে ইহা গায়।
যুগে যুগে ভক্তের সহায়।।’’
ভক্তের সহায় গিরিধারীর—বালাই লয়ে মরে যাই রে(মাতন)
(৮)
জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ।।
এইমত মহাপ্রভু চলিলা নীলাচলে।
চারিভক্ত-সঙ্গে কৃষ্ণ-কীর্ত্তন কুতূহলে।।
ভিক্ষা মাগি একদিন একগ্রামে গিয়া।
আপনি বহুত অন্ন আনিলা মাগিয়া।।
পথে বড় বড় দানী বিঘ্ন নাহি করে।
তা’ সভারে কৃপা করি আইলা রেমুণারে।।
রেমুণাতে গোপীনাথ পরমমোহন।
ভক্তি করি কৈল প্রভু তাঁর দরশন।।
তাঁর পাদপদ্ম নিকট প্রণাম করিতে।
তাঁর পুষ্পচূড়া পড়িল প্রভুর মাথাতে।।
চূড়া পায়া প্রভু মনে আনন্দিত হৈঞা।
বহু নৃত্যগীত কৈলা ভক্তগণ লঞা।।
প্রভুর প্রভাব দেখি প্রেমরূপগুণ।
বিস্মিত হইলা গোপীনাথের দাসগণ।।
নানামত প্রীতে কৈল প্রভুর সেবন।
সেই রাত্রি তাঁহা প্রভু করিলা বঞ্চন।।
মহাপ্রসাদক্ষীর লোভে রহিলা প্রভু তথা।
পূর্ব্বে ঈশ্বরীপুরী তাঁহে কহিয়াছেন কথা।।
ক্ষীরচোরা গোপীনাথ প্রসিদ্ধ তাঁর নাম।
ভক্তগণে কহে প্রভু সেই ত আখ্যান।।
পূর্ব্বে মাধবপূরীর লাগি ক্ষীর কৈল চুরি।
অতএব নাম হৈল ক্ষীরচোরা হরি।।
পূর্ব্বে শ্রীমাধবপুরী আইলা বৃন্দাবন।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে গেলা গিরি গোবর্দ্ধন।।
প্রেমের মত্ত নাহি তাঁর দিবারাত্রি জ্ঞান।
ক্ষণে উঠে ক্ষণে পড়ে নাহি স্থানাস্থান।।
শৈল-পরিক্রমা করি গোবিন্দ-কুণ্ডে আসি।
স্নান করি বৃক্ষতলে আছে সন্ধ্যায় বসি।।
গোপবালক এক দুগ্ধভাণ্ড লৈয়া।
আসি আগে ধরি কিছু বোলেন হাসিয়া।।
পুরী এই দুগ্ধ লৈয়া কর তুমি পান।
মাগি কেন নাহি খাও কিবা কর ধ্যান,,
‘‘বালকের সৌন্দর্য্যে পুরীর হইল সন্তোষ।
তাহার মধুর-বাক্যে গেল ভোক শোষ।।
পুরী কহে কে তুমি কাঁহা তোমার বাস।
কেমনে জানিলে আমি করি উপবাস।।
বালক কহে গোপ আমি এইগ্রামে বসি।
আমার গ্রামেতে কেহ না রহে উপবাসী।।
কেহো মাগি খায় অন্ন কেহো দুগ্ধাহার।
অযাচক জনে আমি দিয়েত আহার।
জল লইতে স্ত্রীগণ তোমারে দেখি গেলা।
স্ত্রী সব গুগ্ধ দিয়া আমারে পাঠাইলা।।
গোদোহন করিতে চাহি শীঘ্র আমি যাব।
আরবার আমি এই ভাণ্ডটি লইব।।
এত বলি বালক গেলা না দেখিয়ে আর।
মাঝবপুরীর চিত্তে হৈল চমৎকার।।
দুগ্ধ পান করি ভাণ্ড ধুইয়া রাখিল।
বাট দেখে সেই বালক পুন না আইল।।
বসি নাম লয় পুরী নিদ্রা নাহি হয়।
শেষ রাত্রে তন্দ্রা হৈল বাহ্যবৃত্তি লয়।।
স্বপ্নে দেখে সেই বালক সম্মুখে আসিয়া।
এককুঞ্জে লৈয়া গেলা হাতেতে ধরিয়া।।
কুঞ্জ দেখাইয়া কহে আমি এই কুঞ্জে রই।
শীত বৃষ্টি দাবাগ্নিতে দুঃখে বড় পাই।।
গ্রামের লোক আনি আমা কাঢ় কুঞ্জ হৈতে।
পর্ব্বত-উপরে লৈয়া রাখ ভালমতে।।
এক মঠ করি তাঁহা করহ স্থাপন।
বহুশীতল-জলে আমা করাহ স্নপন।।
বহুদিন তোমার পথ করি নিরীক্ষণ।
কবে আসি মাধব আমা করিবে সেবন।।
তোমার প্রেমবশে করি সেবা অঙ্গীকার।
দর্শন দিয়া নিস্তারিব সকল সংসার।।
শ্রীগোপাল নাম মোর গোবর্দ্ধনকারী।
ব্রজের স্থাপিত আমি ইহা অধিকারী।।
‘‘শৈলের উপর হইতে আমা কুঞ্জে লুকাইয়া।
ম্লেচ্ছ ভয়ে সেবক আমার গেল পলাইয়া।।
সেই হইতে রহি আমি এই কুঞ্জস্থানে।
ভাল হইল আইলা আমা কাঢ় সাবধানে।।
এত বলি সে বালক অর্ন্তদ্ধান কৈল।
জাগিয়া মাধবপুরী বিচার করিল।।
কৃষ্ণকে দেখিনু মুঞি নারিনু চিনিতে।
এতবলি প্রেমাবেশে পড়িলা ভূমিতে।।
ক্ষণেক রোদন করিমন কৈল ধীর।
আজ্ঞাপালন লাগি হইলা সুস্থির।।
প্রাতঃস্নান করি পুরী গ্রামমধ্যে গেলা।।
সবলোকে একত্র করি কহিতে লাগিলা।।
গ্রামের ঈশ্বর তোমার গোবর্দ্ধনধারী।
কুঞ্জে আছেন তাঁরে চল বাহির যে করি।।
অত্যন্ত নিবিড় কুঞ্জ নারি প্রবেশিতে।
কুঠার কোদালি লহ দ্বার যে করিতে।।
শুনি তাঁর সঙ্গে লোক চলিলা হরিষে।
কুঞ্জ কাটি দ্বার করি করিল প্রবেশে।।
ঠাকুর দেখিল মাটী তৃণে আচ্ছাদিত।
দেখি সবলোক হৈল আনন্দে বিস্মিত ।।
আবরণ দূর করি করিল চিহ্নিতে।
মহাভারী ঠাকুর কেহো নারে চালাইতে।।
মহা মহা বলিষ্ঠলোক একত্র হইয়া।
পর্ব্বত উপরে গেলা ঠাকুর লইয়া।।
পাথরের সিংহাসনে ঠাকুর বসাইল।
বড় এক পাথর পৃষ্ঠে অবলম্বন দিল।।
গ্রামের ব্রাহ্মণ সব নবঘট লইয়া।
গোবিন্দকুণ্ডের জল আনিল ছানিয়া।।
নব শতঘট জল কৈল উপনীত।
নানা বাদ্য ভেরী বাজে স্ত্রীগণে গায় গীত।।
কেহ গায় কেহ নাচে মহোৎসব হৈল।
অনেক সামগ্রী যত্ন করি আনাইল।।
দধি-দুগ্ধ-ঘৃত আইল যতগ্রাম হৈতে।
ভোগ-সামগ্রী আইলা সন্দেশাদি কতে।।
তুলস্যাদি পুষ্প বস্ত্র আইল অনেক।
আপনে মাধবপুরী করে অভিষেক।।
অঙ্গ-মলা দূর করি করাইল স্নপন।
বহু তৈল দিয়া কৈল শ্রীঅঙ্গ চিক্কণ।।
পঞ্চগব্য-পঞ্চামৃতে স্নান করাইয়া।
মহাস্নান করাইল শতঘট দিয়া।।
পুনঃ তৈল দিযা কৈল শ্রীচরণ চিক্কণ।
শঙ্খ-গঙ্গোদকে কৈল স্নান সমাপন।।
শ্রীঅঙ্গ মার্জ্জন করি বস্ত্র পরাইল।
চন্দন তুলসী পুষ্প-মালা অঙ্গে দিল।।
ধূপদীপ করি নানা ভোগ লাগাইল।
দধি দুগ্ধ সন্দেশাদি যত কিছু ছিল।।
সুবাসিত জল নব পাত্রে সমর্পিল।
আচমন দিয়া পুনঃ তাম্বূল অর্পিল।।
আরতি করিয়া কৈল অনেক স্তবন।
দণ্ডবৎ করি কৈল আত্ম-সমর্পণ।।
গ্রামের যত তণ্ডুল দালি গোধুমাদি চূর্ণ।
সকল আনিয়া দিল পর্ব্বত হইল পূর্ণ।।
কুম্ভকারের ঘরে ছিল যত মৃদ্ভাজন।
সব আইল প্রাত হৈতে চড়িল রন্ধন।।
দশ বিপ্র অন্ন রাঁধি করে এক স্তূপ।
জন চারি পাঁচ রান্ধে নানাবিধ সূপ।।
বন্যশাক ফলমূলে বিবিধ ব্যঞ্জন।
কেহো বড়া-বড়ী কড়ি করে বিপ্রগণ।।
জন পাঁচ-সাত রুটী করে রাশি রাশি।
অন্ন-ব্যঞ্জন-রুটী সব রহে ঘৃতে ভাসি।।
নববস্ত্র পাতি তাতে পলাশের পাত।
রান্ধি রান্ধি তার উপর রাশি কৈল ভাত।।
তার পাশে রুটী রাশি কৈল ভাত।।
তার পাশে রুটী রাশি উপপর্ব্বত হৈল।
সূপ-ব্যঞ্জন-ভাণ্ড সব চৌদিকে ধরিল।।
তার পাশে দধি দুগ্ধ মাঠা শিখরিণী।
পায়স মাখলি সব পাশে ধরে আনি।।
হেনমতে অন্নকূট করিল সাজন।
পুরী-গোসাঞি গোপালেরে কৈল সমর্পণ।।
অনেক ঘট ভারি দিল সুশীতল জল।
বহুদিনের ক্ষুধায় গোপাল খাইলা সকল।।
যদ্যপি গোপাল সব অন্ন-ব্যঞ্জন খাইল।
তাঁর হস্ত-স্পর্শে অন্ন পুনঃ তৈছে হৈল।।
ইহা অনুভব কৈল মাধব-গোসাঞি।
তাঁর ঠাঞি গোপালের লুকা কিছু নাঞি।।
একদিনের উদ্যোগে ঐছে মহোৎসব হৈল।
গোপাল-প্রভাবে হৈল অন্যে না জানিল।।
আচমন দিঞা দিল বিড়ার সঞ্চয়।
আরতি করিল লোকে করে জয় জয়।।
শয্যা করাইল নূতন খাট আনাইয়া।
নব বস্ত্র আনি তার উপরে পাতিয়া।।
তৃণটাটী দিয়া চারিদিক আবরিল।
উপরেহ একটাটী দিঞা আচ্ছাদিল।।
পুরী গোসাঞি আজ্ঞাদিল যতেক ব্রাহ্মণে।
আবাল-বৃদ্ধ গ্রামের লোক করাহ ভোজনে।।
সবলোক বসি ক্রমে ভোজন করিল।
ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীগণে আগে খাওয়াইল।।
অন্যগ্রামের লোক যেই দেখিতে আইল।
গোপাল দেখিয়া সবে প্রসাদ খাইল।।
পুরীর প্রভাব দেখি লোকে চমৎকার।
পূর্ব্ব-অন্নকূট যেন হৈল সাক্ষাৎকার।।
সকল-ব্রাহ্মণে পুরী বৈষ্ণব করিল।
সেই সেই সেবা-মধ্যে সবা নিয়োজিল।।
পুনঃ দিন শেষে প্রভুর করাইল উত্থান।
কিছু ভোগ লাগাইয়া করাইল জলপান।।
গোপাল প্রকট হৈল দেশে শব্দ হইল।
আশ-পাশ গ্রামের লোক দেখিতে আইল।।
এক-এক-দিন এক-এক-গ্রামের লইল মাগিয়া।
অন্নকূট করেসভে হরষিত হৈয়া।।
রাত্রিকালে ঠাকুরের করাইয়া শয়ন।
পুরী গেসাঞি কৈল কিছু গব্য ভোজন।।
প্রাতঃকালে পুনঃ তৈছে করিল সেবন।
অন্ন লইয়া এক গ্রামের আইল লোকগণ।।
অন্ন ঘৃত দধি দুগ্ধ গ্রামে যত ছিল।
গোপালের আগে লোক আনিয়া ধরিল।।
পূর্ব্বদিন প্রায় বিপ্র করিল রন্ধন।
তৈছে অন্নকূট গোপাল করিল ভোজন।
ব্রজবাসী লোকের কৃষ্ণে সহজে পিরীতি।
গোপাল সহজে প্রীত ব্রজবাসী-প্রতি।।
মহাপ্রসাদ অন্ন যত খাইল সব লোক।
গোপাল-দর্শনে খণ্ডে সবার দুঃখ শোক।।
আশ-পাশ ব্রজভূমের যতলোক সব।
এক-এক-দিন আসি করে মহোৎসব।।
গোপাল প্রকট শুনি নানা দেশ হৈতে।
নান দ্রবও লঞা লোক লাগিলা আসিতে।।
মথুরার লোক সব বড় বড় ধনী।
ভক্তি করি নানা-দ্রব্য ভেট ধরে আনি।।
স্বর্ণ রৌপ্য বস্ত্র গন্ধ নানা উপহার।
অসংখ্য আইসে নিত্য বাড়িল ভাণ্ডার।।
এক মহাধনী ক্ষত্রিয় করাইল মন্দির।
কেহো পাক ভাণ্ডার কৈল কেহ ত প্রাচীর।।
এক এক ব্রজবাসী এক এক গাভী দিল।
সহস্র সহস্র গাভী গোপালের হৈল।
গৌড় হইতে আইল দুই বৈরাগী ব্রাহ্মণ।
পুরী গোসাঞি রাখিল তারে করিয়া যতন।।
সেই দুই শিষ্য করি সেবা সমর্পিল।
রাজসেবা হইল পুরীর আনন্দ বাড়িল।।’’
জয় জয় গিরিধারী—জয় জয় মাধবপুরী
জয় জয় গিরিধারী—জয় মাধবেন্দ্রপুরী
গিরিধারী গৌরহরি—জয় মাধবেন্দ্রপুরী