অবতার মানে তো অবতরণ। নেমে আসা, মাটির পৃথিবীতে নেমে আসা। পঞ্চভূতে তৈরি জগৎ ও জীবনের এই প্রপঞ্চের মধ্যে অলৌকিক অপ্রপঞ্চ থেকে নেমে আসা। The great discent. এমন করে নেমে আসার প্রয়োজন হয় কেন ? সেই চিরাচরিত বিশাল যুক্তিটা তো আছেই যা শত-কোটি বার উচ্চারিত হয়েছে গীতা থেকে—‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।’ এখানে ধর্ম বলতে কোনও ফুল-বেলপাতা-নৈবেদ্যের ধর্মও বোঝাচ্ছে। না এবং কোনও বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের কথাও বোঝানো হচ্ছে না। অতএব শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব কারও এটা মানতে আপত্তিও থাকবে না যে, ধর্ম মানে এখানে সামাজিক শৃঙ্খলা, আদেশ, ধর্ম মানে এক সার্বিক সুমঙ্গলযেখানে রাজার শাসন থেকে আরম্ভ করে সাধারণের শাসিত বোধের যন্ত্রণা তৈরি হয় না, এই ধর্ম এমনই যেখানে উত্তমাধম-মধ্যমের সঠিক সুস্থিতির সঙ্গে আইনের শাসন, প্রশাসনের পালন এমনকী বৃষ্টিবাদল, বন্যা, ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক সুস্থিতিও যুক্ত হয়ে যায়। লক্ষ করে দেখবেন—‘রামাষণ-মহাভারত এবং পুরাণগুলির মধ্যে খ্যাতকীর্তি রাজাদের রাজ্য-শাসনের বর্ণনায় ঠিক সময়ে বৃষ্টি হওয়া থেকে আরম্ভ করে চতুবর্ণের সুস্থিতি, সব কিছু একেবারে তুরীয় অবস্থায় চলে আসে এবং এটাই ধর্মের সুস্থিতি। একই সঙ্গে লক্ষণীয়, যে-মুহূর্তে অধর্মের অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় এবং যখন পরম ঈশ্বরকে বৈকুণ্ঠের আসন ছেড়ে নেমে আসতে হয় ভুঁয়ে অভ্যুত্থানম্ অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্–সে মুহূর্তে অন্য সব কিছুর ভেঙে পড়া বৈপরীত্যের চেয়েও রাজার অত্যাচার প্রশাসকের অপশাসন এবং রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহারই কিন্তু ঈশ্বরাবতারের ‘প্রিকণ্ডিশন’ হয়ে ওঠে। ধর্মের সুস্থিতির ক্ষেত্রে রাজধর্মের এই অন্বয়টুকুই হয়তো মহাভারতে এই বাক্যটা অপরিহার্য করে তুলেছে যে, হাতির পা যেখানে পড়ে সেখানে যেমন অন্য পশুর পায়ের ছাপ আর দেখা যায় না, তেমনই একটি রাষ্ট্রের সর্বপ্রকার ধর্ম রাজধর্মের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয় এবং ধর্মান্ রাজধর্মেষু সর্বান্ / সর্বাবস্থাং সম্প্রলীনান্ নিবোধ।
আমাদের প্রাচীনেরা একটা অদ্ভুত প্রতীক ব্যবহার করেছেন—এই পৃথিবীকে তাঁরা তাঁদের জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পশু গোরুর সঙ্গে তুলনা করে যখনই কোনও রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে, তখনই তাঁকে স্বর্গলোকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্রহ্মার কাছে। আর পৃথিবীতে রাজারা অহংকারী অত্যাচারী হয়ে উঠলেই যে তাঁরা দৈত্য-দানবের পর্যায়ে প্রবেশ করেন, সে কথা আমরা ভাগবত পুরাণে স্পষ্ট দেখেছি—ভূমি-র্দৃপ্ত-নৃপ-ব্যাজ-দৈত্যানীকশতাযুতৈঃ। অত্যাচার ভারী হয়ে উঠলে বসুন্ধরা পৃথিবীও তাঁর অন্তরবাসী মানুষগুলিকে নিয়ে ঔদ্ধত্যের কশাঘাতে বিদীর্ণ হতে থাকেন। কিন্তু একটা সময় তিনি আর সহ্য করেন না। তিনি যজ্ঞীয় ধেনুর রূপ ধারণ করে পৌঁছে যান সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে নালিশ জানাতে। যন্ত্রণায় তাঁর চোখে জল আসে, অত্যাচারিতের আবেগ তাঁর সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়—গৌর্ভূত্বাশ্রুমুখী খিন্না ক্রন্দস্তী করুণং বিভোঃ। আবার সব সময় যে তিনি গোরূপ ধারণ করছেন তাও নয়। তাঁর একটা লক্ষ্মী-রূপও আছে, ভূমি-লক্ষ্মী। পরম ঈশ্বরেরে অন্তরঙ্গা শক্তির মধ্যেও কতকগুলি ভাগ আছে। সেই বিভাগের অন্যতমা হলেন ভূশক্তি অর্থাৎ এক অর্থে এই বসুন্ধরা পৃথিবীও নারায়ণ বা বিষ্ণুর স্ত্রী। অত্যাচরিতা স্ত্রীর নালিশ শুনে ভগবান বিষ্ণু ভূ-ভাব হরণের জন্য নেমে আসেন পৃথিবীতে।
এই যে অত্যাচারিতা পৃথিবীর জন্য পৃথিবীতেই নেমে আসা, এটাই তো সেই ‘অবতরণ’, অবতার। তবে কিনা এই নেমে আসাটা সমস্ত আভিধানিক অর্থ সার্থক করে নেমে আসা, নিজের বিরাট ঐশ্বর্য, তেজ থেকেও নেমে আসা বটে। বিরাটত্বকে সংবৃত্ত করে মানুষের বোধ্য হয়ে নেমে আসা। এটা তো মানতেই হবে—সে আপনি ভগবান বিশ্বাস করুন আর নাই করুন—আপনাকে মানতেই হবে যে, বিরাট কোনও তেজঃপুঞ্জের সামনে আমাদের সবার চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
স্বয়ং ভগবান যদি তাঁর তেজঃপুঞ্জ নিয়ে দেখা দেন, তবে তা সইতে পারবে না কেউ। অর্জুনকে দিব্যচক্ষু দান করে ভগবান তাঁর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সেই দিব্যচক্ষুতেও তাঁর অবস্থা হয়েছিল—ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। কৃষ্ণকে তিনি অন্যদের ভয় পাওয়ার অজুহাত দিয়ে বলেছিলেন—সবাই বড় ভয় পাচ্ছে, আমিও ভয় পাচ্ছি –দৃষ্টা লোকঃ প্রব্যথিতা স্তথাহম্। একটু পরে এসব অজুহাত ঝেড়ে ফেলে বলেছেন—আমি কোথাও দিক খুঁজে পাচ্ছি না, শান্তি পাচ্ছি না—দিশো ন জানে ন লভে চ শর্মে—আমি আর সইতে পারছিনা, তুমি যদি ভগবানের চেহারাতে দেখা দাও, তাহলে অন্তত আমাদের চিরাভ্যস্ত চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তিতে দেখা দাও—তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেন সহস্রবাহো ভব বিশ্বমুর্তে।
অর্জুনের মতো মহাবীর, যিনি কৃষ্ণের পরম সখা বটে, তাঁর যদি দিব্যচক্ষু লাভ করেও এমন ভীতি তৈরি হয়, সাধারণ মানুষের কী হবে! ফলত ঈশ্বরাবতারের প্রথম প্রিকন্ডিশন হল তাঁকে তেজ কমিয়ে মানুষের মাঝে আসতে হয়, আবার তেজ দেখাতেও হয়। তবে মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া অথবা নিজেকে খণ্ডিত, হ্রস্ব করে নেওয়ার মধ্যে আরও অনেক তত্ত্ব আছে স্বয়ং ঈশ্বরের সে সব কথা পরে আসবে। আপাতত এটাও জানানো খুব জরুরি যে, সব সময়েই যে তিনি নিজেকে খাটো করে, নিতান্তই মনুষ্য বোধ্য কোমলতার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হবেন, তা কিন্তু নয়। সেই কোমলতা এবং মনুষ্য বোধ্যতা ভগবানের মানুষ হয়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এমনিতে দশাবতারের অনেকেই আছেন, যাঁরা খুব রাগী, এমনকী ‘মিলিট্যান্ট’-ও বটে। আর শুধু এই দশ অবতারের সংখ্যা-বিধানেও অবতার-প্রসঙ্গ শেষ হয় না। কারণ এ-কথাও শাস্ত্রপ্রমাণে খুব স্পষ্ট যে, অবতার দশটামাত্র নয়, অবতারের সংখ্যা অনেক—অবতারা হ্যসংখ্যেরা হরে স্বত্ত্বনিধে দ্বিজাঃ। এই বচনটা ভাগবত পুরাণের এবং এই পুরাণ এত উদারভাবে অবতারের তত্ত্বটা বুঝেছে যে, সেটা এক দিকে যেমন ভীষণ রকমের বাস্তব, তেমনই তা অন্যদিকে দৃঢ় শ্রদ্ধালু জনের ব্যক্তিকেন্দ্রকে পুষ্টি জোগায়।
অবশ্য এই উদার-বোধেরও মূলে আছে ভগবদ্গীতা যা প্রথম সেই বাস্তবের স্পর্শ দিয়েছে আমাদের আবেগমথিত চেতনার মধ্যে। আমরা তো মাঝেমাঝে ভাবি একথা যে কী করে রবীন্দ্রনাথ এত লেখা লিখলেন এবং এমন করেই বা লিখলেন কেমন করে ! একই ভাবে আইনস্টাইন থেকে জগদীশ বোস, লিঙ্কন থেকে লেনিন, গান্ধী থেকে গুয়েভারা—অনেকের কথা ভাবলেই আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধির মধ্যে কোটি চমৎকার তৈরি হয়। ঠিক এই বিস্ময়-মিশ্রিত শ্রদ্ধাই কিন্তু আমাদের ব্যক্তি-জীবনের গুরু কিংবা অতিশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সম্বন্ধেও সত্য যখন আমারা তাকেঁও অবতার বলে মনে করি। ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ যখন আপন বিভূতিযোগের কথা বলছেন, তখন একটি বিশেষ জাতি বা বস্তুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বা বস্তুকে তিনি আপন বিভূতি বলে প্রকট করেছেন। এগুলির মধ্যে অনেক ভালোর সঙ্গে খারাপ জিনিসিও আছে। তিনি যখন বলেন—ছলনা কপটতার মধ্যে আমি হলাম জুয়াখেলা—দ্যূতঃ ছলয়তামস্মি—তখন বুঝি, অনন্ত ভালোর মতো অনন্ত খারাপের মধ্যেও তিনিই আছেন। যে কারণে ভগবতী চণ্ডীর মধ্যে দেবীস্তবে—যিনি স্বয়ং সুকৃতি জনের হৃদয়ে লক্ষ্মী স্বরূপা, তেমনই পাপবুদ্ধি মানুষের ঘরে তিনিই অলক্ষ্মী। পৃথিবীর অনাদ্যনন্ত সংসার চক্রে যেমন ভালো-মন্দ দুইই আছে এবং দুটিকেই যেহেতু আমাদের শাস্ত্রকারেরা অসীম ব্যাপ্ত-বোধে অবেক্ষণ করেন, সেই কারণে পৃথিবীতে যেমন ঈশ্বরাবতার ঘটে, তেমনই দৈত্য-দানবেরও অবতার হয়। ভুলে যাবেন না—চারদিন দুর্গাপুজোর সময় যেমন আমরা দুর্গার উদ্দেশে অন্নভোগ নিবেদন করি, তেমনই মহিষাসুরকেও কিন্তু আমারা থালা সাজিয়ে ভোগ দিই। এইভাবে রাবণ-কুম্ভকর্ণও একভাবে পাপশক্তির অবতার, দন্তবত্রু-শিশুপালও তাই, আবার মহাভারতের দুর্যোধনও এক অবতার।
গীতায় অশেষ ব্যক্তি এবং বস্তুজাতির শ্রেষ্ঠটিকে নিজের বিভূতি হিসেবে দেখিয়ে সর্বশেষে ভগবান বললেন—পৃথিবীতে যা কিছুর মধ্যেই কোনও ঐশ্বর্য আছে, যা কিছুই ভীষণ সুন্দর, যা কিছুর মধ্যেই স্ফীত শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটে, তা সবই আমারই তেজের আংশিক প্রকাশ—যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিত মেব বা। এই কথাটা ভীষণ দামি, আমার মনে হয়—অবতারতত্ত্বের সবচেয়ে দামি কথা এটাই। ‘যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিত মেব বা। এই কথাটা ভীষণ দামি, আমার মনে হয়—অবতারতত্ত্বের সবেচয়ে দামি কতা এটাই।‘যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং’—‘সত্ত্ব’ বলতে শুধু মানুষ বোঝায় না, প্রাণশক্তিসম্পন্ন মানুষ, পশু, পাখি সব বোঝায়। আর বিভূতি হল, ঐশ্বর্য, তবে এই ঐশ্বর্য টাকা পয়সা নয়। এ হল ঈশ্বরভাব, অনেক ‘চমৎকার’ সৃষ্টির ক্ষমতা। ‘ভূতি’ মানে সমৃদ্ধি, বিভূতি চরম সমৃদ্ধির প্রকাশ যা খানিকটা ‘বিভব’ শব্দের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে কিনা শুধু ঈশ্বরভাব, সমৃদ্ধি, বিভব–এসব অর্থ দিয়ে ‘বিভূতি’-কে বোঝানো যায়। বিভূতি-র মধ্যে একটা চমৎকার প্রদর্শনের বৃত্তি আছে, যাতে চমক লাগে মানুষের।
ভগবদ্গীতা বলছে—যেখানেই এই অসামান্যতার স্বাক্ষর যেখানেই সেই চরম সৌন্দর্য, বল, বিদ্যা, সরসতার অভিজ্ঞান, সেখানেই বুঝবে—আমার অংশ-তেজ নিহিত আছে—তাঁর মধ্যেই সে লোক-চমৎকার ‘পরাভিভবন-সামর্থ্য’ রয়ে গিয়েছে। ভাগবদ্গীতার এই অসাধারণ বক্তব্যটা যদি বোঝেন, তাহলে এই চলমান মনুষ্যসমাজে অনেক মানুষকেই কিন্তু আমারা অবতার বলে মানতে পারি—কেননা তাঁদের মধ্যে ‘ঈশিত্ব’ আছে অর্থাৎ ঈশ্বর-ভাব আছে, ‘বশিত্ব’ আছে, তাঁরা মানুষ বশ করতে পারেন। খুব সহজেই আপনারা বুঝতে পারেন যে, এটা কোনও তান্ত্রিকের সিদ্ধি নয়—এ হল সেই প্রভাব যেখানে শত-সহস্র স্বতো বিভিন্ন মানুষ একত্রে মোহিত হন, একত্রে প্রভাবিত হন।
বস্তুত পৌরাণিক মনীষী যখন বলেন—অবতারা হ্যসংখ্যেয়া—অবতারের সংখ্যা করা যায় না, তখন বুঝতে হবে, তিনি আমাদের পূর্ব-ব্যাখ্যাত অর্থেই অবতারের বিশদ-ভাবনা করেছেন। তা নইলে ভাগবত পুরাণের প্রায় আরম্ভেই তো সেই বিরাট বিশ্বরূপের কথা বললেন ভাগবতের কবি—সহস্র-মূর্ধ-শ্রবণাক্ষি-নাসিকম্। বললেন—এই বিরাট ব্যাপ্ত পুরুষই সমস্ত অবতারের বীজ। তারই অংশে এবং অংশাংশে-ই দেবতা-মানুষ-পশু-পাখি সব কিছু। বিরাট এই সৃষ্টিটাই যদি অপূর্ব নির্মাণ নিপুণ সেই বিধাতার পরম কীর্তি হয়, তবে যিনি এই সৃষ্টি করলেন তাঁকে তো ঈশ্বরাংশের মধ্যে গণ্য করতেই হবে। আর অংশ মানেই তো তিনি অবতার। ভাগবত পুরাণ এই চমৎকারগুলি খেয়াল করেছে। ফলে অবতারের প্রথম ভাবনায় তাঁর কাছে ঈশ্বরাবতার অন্তত বাইশটি। তার মধ্যে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন সবই আছে বটে, কিন্তু দশাবতারের তত্ত্ব ছাপিয়ে সেখানে প্রথম অবতার ব্রহ্মা, যদিও ব্রহ্মা মানেও ঠিক অবতার নয়, কেননা অনন্তশায়ী সেই পুরাণ-পুরুষের নাভি-কমলে জাত ব্রহ্মা একান্ত এক ঈশ্বরাংশ হলেও তিনি ঠিক অবতার নন। অবতার হতে গেলে অন্য একটা ‘ফর্ম’ লাগে যা এই পার্থিব জগতের খানিকটা চেনা।
যাই হোক, ভাগবতপুরাণের এই বিরাট অবতার-তালিকাতে দ্বিতীয় হলেন বরাহ অবতার। তবে তাঁর কথা এখনই বলে আমি বিখ্যাত দশাবতারের প্রণালীটা এখনই ভেঙে দিতে চাই না। বরঞ্চ ‘স্কিপ’ করে ভাগবতী বর্ণনার তৃতীয় অবতার নারদের কথায় যেতে চাই। অবতার ভাবনায় নারদও একজন অবতার এবং আমি এঁদের কথা বলেছি এইজন্য যে, দেখুন, কত উদার আমাদের চেতনা। আমরা শুধু অলৌকিক এবং মনুষ্যবুদ্ধিতে অনবধারণীয় ঈশ্বরাংশকেই অবতার বলিনি। একজন বহুপ্রতিভ মানুষও সেই অবতার হতে পারেন, যেমনটা নারদ।
ভাগবত পুরাণে চতুর্থ অবতার নর-নারায়ণ নামে যুগ্ম ঋষি। তাঁরা ভীষণ রকমের তপস্যা করেছিলেন এমনটাই ভাগবতী শ্রুতি। নর-নারায়ণ ঋষির কথা মহাভারতেও নানা প্রসঙ্গে আছে এবং মহাভারতের সবচেয়ে বড় ‘পয়েন্ট’ হল—ভবিষ্যতে অর্জুন এবং কৃষ্ণ নাকি এই যুগ্ম ঋষিরই রূপান্তর অর্থাৎ অবতার। ভাগবত পুরাণ যেহেতু সমস্ত অবতার স্বরূপকেই সেই পরম পুরুষের অংশ-কলা বলে ভাবে এবং কৃষ্ণকেই একমাত্র পূর্ণ মনুষ্য অবতার বলে মানে, তাই ঘুণাক্ষরেও নর-নারায়ণের প্রসঙ্গে টীকাকারেরাও মহাভারতীয় কৃষ্ণার্জুনের প্রসঙ্গ আনেননি। একইভাবে সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা কপিলমুনিও একজন অবতার হিসেবে কীর্তিত। অবতারের তালিকায় আছেন দত্তাত্রেয় ঋষি, যজ্ঞদেব, ঋষভদেব, পৃথিবীর আদি রাজা পৃথু, এমনকি বৈদ্য ধন্বন্তরীর সঙ্গে বিষ্ণুর মোহিনী মুর্তিটিও আছেন, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বুঝি ভাগবত পুরাণের মহাকবির কতখানি দূরদৃষ্টি ছিল এবং তা কতটা বাস্তব। ভাগবতের এই লিষ্টি দেখে আমি সবচেয়ে অবাক এবং আপ্লুত হই যখন দেখি বিখ্যাত সব অবতার নামের সঙ্গে মহাভারতের কবি দ্বৈপায়ন ব্যাসের নাম একই সঙ্গে কীর্তিত হচ্ছে। বিশালবুদ্ধি ব্যাসের নাম আমাদের এই জাগতিক সংকেত দিয়ে দেয় যাতে বোঝানোযায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রকর, সাংগীতিক বৈজ্ঞানিক—সমস্ত শ্রেষ্ঠতার মধ্যেই সেই পরম ঈশ্বরাবেশ আছে—এমনকী অলক্ষ্মীর চরমতার মধ্যেও সেই ঈশ্বরাবেশের বিপ্রতীক সাংহারিক রূপ—তিনি এঁদের মধ্যে বেশি করে আছেন—যা শ্রীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেষ্বলক্ষ্মীঃ/পাপাত্মনাং কৃতধিয়াং হৃদয়েষু বুদ্ধিঃ।/শ্রদ্ধা সতাং কুলজনপ্রভবস্য লজ্জা/ তাং তাং নতাঃ স্ম পরিপালয় দেবি বিশ্বমা।
অবতার গ্রহণের প্রশ্ন এলেই ভগবান বিষ্ণুর কথা প্রথমে আসবে। পণ্ডিতজনে বলেছেন—বেদে-ব্রাহ্মণে বিষ্ণুর বিশিষ্টতাই এই যে, তিনি সব সময় দেবতাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ঋগ্বেদের যে বিখ্যাত মন্ত্রটি আজও ভারতের ঘরে ঘরে সর্ব-আরম্ভের মন্ত্র—তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদং—সেই মন্ত্রের আগেই কিন্তু এই চেতনা তৈরি করে দেওয়া হয় যে, দ্যাখো, বিষ্ণু সকলকে রক্ষা করেন, সমস্ত ধর্মকে তিনি ধারণ করেন, তাঁকে কেউ আঘাত করতে পারে না—বিষ্ণু র্গোপা অদাভ্যঃ/অতো ধর্মাণি ধারয়ন্। বেদ বলেছে—বিষ্ণুর কাজগুলোর দিকে তাকাও, তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের যোগ্যতম সখা—ইন্দ্রস্য যুজ্যঃ সখা। এটা কিন্তু অদ্ভুত যে, বিষ্ণু ইন্দ্রের মতো এই বিরাট যোদ্ধাপুরুষ দেবতা নন কোনও, অথচ বিরাট যুদ্ধকার্যে কিংবা তাঁর যুদ্ধের প্রক্রিয়াগত সাফল্যে তিনি ইন্দ্রের সদা-সহায়। দেব সহায় তিনি। লক্ষ করে দেখবেন—বিষ্ণুর এই সহায়তার বৈদিক তাৎপর্যটাই কিন্তু অবতার গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সব সময় মিশ্রিত হয়। সমস্ত পুরাণগুলিতে যখনই সেই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের উত্থান তৈরি হয়েছে, তখনই দেখবেন—দেবতারা আসছেন ব্রহ্মার কাছে এবং ব্রহ্মা তাঁদের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছেন বিষ্ণুর কাছে। অবশেষে দেব-সহায়ক ভূমিকায় বিষ্ণু অবতার গ্রহণ করছেন। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এই তিন ভুবন জুড়ে বিষ্ণুর ব্যাপ্ত রূপ, অতএব সেখানে কোনও বড় অন্যায় যখন ‘অর্ডার’ নষ্ট করে তখনই তিনি রূপান্তর গ্রহণ করে অবতরণ করেন—ধর্ম সংরক্ষণের জন্য এবং ধর্মস্থাপনের জন্য—
ধর্মসংরক্ষাণার্থায় ধর্মসংস্থাপনায় চ।
তবে কিনা অবতরণের জন্য পরম ঈশ্বরের এই যে রূপান্তর গ্রহণ, সেটা খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের ‘ইনকারনেশন’, ঠিক নয়। কারণ ‘ইনকারনেশন’ বলতে ‘coming in flesh’ অর্থাৎ অঙ্গধারণ করে ঈশ্বরের নেমে আসার ব্যাপার থাকে একটা। আমাদের দেশে ঠিক এমনটা নয়। তিনি কোথায় কী বেশে কোন রূপে আসবেন, সেটা তাঁর ইচ্ছা এবং প্রয়োজনের অনুসারী। ফলত এখানে—বেদে যেমনটা আছে—রূপাং রূপাং প্রতিরূপো বভূব তাই বিভিন্নভাবে তিনি আসেন।
এটা অবশ্য মনে রাখা দরকার যে, বিষ্ণুর অবতরণের ক্ষেত্রে দশ অঙ্কটা নিয়েও ভাবনা হয়েছে অনেক। কত অদ্ভুত সব চর্চা হয়েছে এই দশ-সংখ্যা নিয়ে যে, সব কিছুরই বৈদিক মূল অন্বেষণ খুঁজে বার করতে হবে বলেই এই চর্চা প্রায় অমূলক হয়ে ওঠে আমাদের মতো ক্ষুদ্রকের কাছে। পণ্ডিতেরা কেউ দশ অবতারের পরম্পরা তৈরির ক্ষেত্রে। ঋগ্বেদের দশজন সোনার মতো রাজার উল্লেখ করা হয়েছে—যো মে হিরম সন্দৃশে। দশ রাজ্ঞো অসংহত। আবার ইন্দ্রের স্তব করার সময় রাজা ত্রসদস্যুর দেওয়া দশ ঘোড়ার বাহন নিয়ে যজ্ঞ স্থলে যেতে চাইছেন—এখানে এই দশটি ঘোড়ার মধ্যেও কেউ কেউ দশ অবতারের পূর্বচ্ছয়া দেখতে পেয়েছেন। আমরা শুধু বলি –শুধু এগুলি কেন দশ সংখ্যা দিয়ে আরও কত কিছু আছে বেদে, সেগুলিই বা বাদ যায় কেন ? এই ধরনের বলাৎকৃত গবেষণা আমাদের ঠিক লাগে না। বরঞ্চ ইন্দো-ইরাণিয় কৃষ্টিতে জেন্দ্ আবেস্তায় দেবতার যে দশ রূপ আছে সেগুলি এক্ষেত্রে একটা তুলনীয় প্রকরণ বলে গণ্য হতে পারে। আবেস্তাতেও বৃত্রঘ্ন (বেরিথ্রঘ্ন) ইন্দ্রের দশটি রূপ—বায়ু, বৃষ, অশ্ব, উষ্ট্র, বরাহ, একটি কুমার যুবক, কাক, ভেড়া, হরিণ এবং একটি মানুষ।
আমাদের ঋগ্বেদে অবশ্য ইন্দ্রের বিভূতিতেও তাঁকে বলা হয়েছে মানুষের মধ্যে তিনি দশম—দশমং নবং সুবিদ্বাংসং চর্কৃত্য চরণীনাম। অর্থাৎ তাঁর আরও নটা রূপ আছে, বিশেষত যেহেতু তৈত্তিরীয় আরণ্যকের মতো প্রাচীন গ্রন্থেও তাঁর দশ রকমের ভাব দেখেছি—ইন্দ্রস্য আত্মানং দশধা চরন্তম্—তাতেই আন্দাজ করতে পারি যে, আমাদের দশাবতারের বৈদিক প্রাক্তন অথবা ‘ভেদিক অ্যানটিসিডেন্ট’ ইন্দ্রই বটে এবং আমরা জানি তাঁর অনন্ত গুণ আমাদের বিষ্ণুর মধ্যেও আছে। তাছাড়া ইন্দ্রও তো মাঝে-মাঝে মায়া-রূপ ধারণ করেন, তাই অবতার গ্রহণের কালে ভগবদ্গীতা যখন ভগবানের স্বরূপতায় বলে—আমি আমারই প্রকৃতির মধ্যে স্থিত হয়ে আপন মায়ার মাধ্যমে এই পৃথিবীতে জন্মাই—প্রকৃতি স্বাম্ অধিষ্ঠায় সম্ভবিষ্যাম্যাত্মমায়য়া—তখন বুঝি, তিনি আমাদের জন্যই, আমাদের সুরক্ষার জন্যই নানা রূপে আসেন। তাছাড়া তাঁর যে সে বিশাল ব্যাপ্ত জ্যোতি-ব্রহ্ম রূপ, সেটা তো আমাদের ধরা-ছোঁয়া-মননেরও বাইরে, তাই বিষ্ণুপুরাণই বলে দিয়েছে বিষ্ণুর অবতারের কথা। বলেছে—তোমার পরম নিগূঢ় তত্ত্ব সে তো কেউ জানে না, কিন্তু তুমি যে রূপে অবতার গ্রহণ কর, দেবতারাও সেই অবতার-স্বরূপেরই প্রশংসা করেন—অবতারেষু যদ্ রূপং তর্দচন্তি দিবৌকসঃ। এর কারণটা আমরা জানি—বিষ্ণুর অবতার-স্বরূপটা মানুষের বোধগম্য। সেই জন্যই গুরু থেকে বড় মানুষ, মৎস্যাবতার থেকে কল্কি—এঁদের আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
আমাদের দেশে দশাবতারের মধ্যে প্রথমেই যে তিনটি বিখ্যাত প্রাণী বা পশু আছেন, তাঁদেরও আমরা প্রাণী, পশু বলে খুব অনাদর করতে পারিনি। ওঁদের তো ওসব বালাই নেই, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিক শব্দ জুড়ে সামান্যসম্মানে ওঁরা বলেন আমাদের প্রথম তিন অবতারই theriomorphic বা theriomorphous, গ্রিকে ther মানে বন্য পশু, সেই শব্দ থেকেই therion, অবশেষে বৈভাষিক মিশ্রণে theriomorphous মানে দাঁড়ায়—‘thought of having the form of a beast, used of a diety’ দেবতা যদি পশুর রূপে আসেন, তবেই সেটা তাঁরtheriomorphous চেহারা। আমাদের তো মুশকিল হয়ে যায়—‘ther’ কথাটা যেহেতু বন্য পশু অর্থে ব্যবহৃত, সেখানে আমাদের প্রথমাবতার ‘মীন’ বা মৎস্যকে আমরা কোন বর্গে চিহ্নিত করব, সেটা একটা শঙ্কা বটে। তবে হ্যাঁ, অবতার হিসেবে যে মৎস্যের চেহারাটা আমরা খুঁজে পাব, তাতে বন্য পশুদেরই বিপদ বাড়ে।