বঙ্গদেশের কবি তথা গীতগোবিন্দের স্রষ্টা জয়দেব ভগবান বিষ্ণুর কলিযুগের অবতারের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন কল্কি-রূপে পৌরাণিক ভাবনার কলিযুগের অন্তিম পর্যায়ে ভগবান বিষ্ণু কল্কি রূপে মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হবেন। ইনি বিষ্ণুর দশা অবতার। মহাভারতের বনপর্বে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় নানা বিষয়ে উপদেশ দিতে দিতে ভাবী কলিযুগের এক দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে কলিযুগের অন্তিম পর্যায়ের পৃথিবীর যে বর্ণনা আছে তা পাপে, অনাচারে পরিপূর্ণ, ম্লেচ্ছজাতির শাসনাধীন, চতুবর্ণের মানুষের আচার-ব্যবহার-বৃত্তি কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না সে যুগে। সৃষ্টির বা বলা ভাল মন্বন্তরের অন্ত অর্থাৎ প্রলয় দেখা দেবে এবং সেই প্রলয়ের আগে সৃষ্টি ধ্বংসের সংকেত হিসেবে নানা দুর্লক্ষণ দেখা যাবে । তারপর এক ভয়াবহ মহামারীতে কলিযুগের অবসান হবে। কলিযুগের এই অবসান এবং পুনরায় সত্যযুগের সূচনার কালে ‘সম্ভল’ নামক গ্রামে বিষ্ণুমশা নামক এক ব্রাহ্মাণের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করবেন স্বয়ং বিষ্ণু। বিষ্ণুমশার এই পুত্রেরই নাম কল্কি —
কল্কী বিষ্ণুমশার নাম দ্বিজঃ কালপ্রচোদিতঃ।।
উৎপ্যস্যতে মহাবীর্য্যো মহাবুদ্ধি পরাক্রমঃ ।
সম্ভূত সম্ভলগ্রামে ব্রাহ্মণাবসথে শুভে।।
মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী সেই নতুন সত্যযুগের সূচনা কালে এই কল্কিই অস্ত্র-শস্ত্র সৈন্যবল সংগঠিত করে ব্রাহ্মণের রাজত্ব এবং অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি রাজচক্রবর্তীরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবীতে আবার শান্তি, সুশাসন এবং সমৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি হবে। বিধর্মী ম্লেচ্ছ এবং পাপচরণকারী দস্যুদের তিনি সংহার করবেন এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে দক্ষিণাস্বরূপ সসাগরা পৃথিবী দান করবেন ব্রাহ্মণদের। এইভাবে সুদীর্ঘ রাজত্বকালে পাপ-অনাচার নির্মূল করার পর পৃথিবীতে সুশানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে কল্কি বৃদ্ধবয়সে বানপ্রস্থ অবলম্বন করবেন।
মহাভারতে বিষ্ণুর এই দশাবতার কল্কির যে জীবনবৃতান্ত পাওয়া যায় তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। পুরাণগুলিতেও কল্কির জীবন এবং কীর্তির কথা সংক্ষিপ্ত। পুরাণগুলিতেও কল্কির জীবন এবং কীর্তিরকথা সংক্ষেপেই বর্ণিত হয়েছে। তবে পুরাণগুলিতে কিছু কিছু নতুন তথ্য খুব স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যায়। বায়ুপুরাণে উল্লিখিত হয়েছে যে,কল্কি এভং তাঁর পিতা বিষ্ণুমশা পরাশরবংর্শীয় ব্রাহ্মণ।কল্কির রাজত্বকালে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর পৌরোহিত্য করবেন—এমন উল্লেখও পাওয়া যায়। ভাগবত পুরাণ উল্লেখ করেছে যে রাজর্ষি তথা ভগবান বিষ্ণুর অবতার কল্কির অশ্বের নাম হবে দেবদত্ত। বায়ুপুরাণ এবং ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে কল্কির ম্লেচ্ছদেশবিজয়ের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণও পাওয়া যায়। সেখানে বিন্ধ্যপর্বত তথা সম্পূর্ণ দাক্ষিণাত্য, গান্ধার প্রভৃতি উত্তরের জনপদ সমূহ ছাড়াও পারদ, পহ্লব, শক, তুষার, যবন, বর্বর,পুলিন্দ, দরদ, অন্ধ্রক, কিরাত প্রভৃতি জনজাতি কল্পিক পদানত হয়েছিল বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন উপপুরাণ কল্কিপুরাণে ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কির জন্ম এবং জীবন কাহিনী বিশদে বর্ণিত হয়েছে।
[দ্র. কল্কিপুরাণ, সম্পাদক, শ্রীমৎ স্বামীজগদীশ্বরানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মচক্র বেলুড়মঠ থেকে প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশ, ১৯৫৯]