দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন বস্তুটা যদি অবতার গ্রহণের ‘প্রাইমারি মোটিফ’ হয়, তবে কূর্ম-অবতারের ক্ষেত্রে ওই দুটি বৈশিষ্ট্যকে এককথায় পরিণত করে বলতে হবে জগতের সুরক্ষা অথবা ‘সাসটেন্যান্স’। আর ঈশ্বরাবতের পারিভাষিকতায় কূর্ম অবতার আক্ষরিক অর্থেই ভূভার হরণ করেছেন সপ্তদ্বীপা পৃথিবীর তলায় পিঠ পেতে দিয়ে। এটা অবশ্য বলতে হবে যে, বিষ্ণুর কূর্মাবতারের সঙ্গে সমুদ্রমন্থনের পুরাকল্পটাও জড়িত এবং সেটার পৌরাণিক প্রমাণের সঙ্গে রামায়ণেরও প্রমাণ আছে।
রামায়ণে যেটা দেখছিলাম, সেটাই খুব স্বাভাবিক। ভারী মন্দর পর্বতকে সমুদ্রে এনে ফেলা হয়েছে, তাকে ব্যবহার করার সময় নিজের গুরুভারেই সে প্রবেশ করল পাতালে। দেবতারা এবার ভগবান বিষ্ণুর শরণ নিলেন। বললেন—আপনি সকলের গতি। এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন আমাদের, আপনি পাতাল থেকে মন্দর পর্বত তুলে এনে প্রতিপালন করুন আমাদের—পালয়াস্মান্ মহাবাহো গিরিমৃর্দ্ধতুর্মহসি। ভগবান বিষ্ণু পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য, সৃষ্ট জীবের মঙ্গল সাধনের জন্য কচ্ছপ-রূপ ধারণ করলেন এবং আপন পৃষ্ঠের ওপর ধারণ করলেন মন্থন দণ্ড মন্দর পর্বতকে—পর্বতং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা শিশ্যে তত্রোদধৌ হরিঃ।
একটা বড় প্রশ্ন উঠে যায় এখানে। কূর্মরূপী বিষ্ণু কোনটা ধারণ করলেন—মন্দর পর্বতকে, নাকি পৃথিবীকে! সত্যি বলতে কী, সমুদ্রমন্থন করার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বিপন্নতা তৈরি হয়েছে, তার স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় মন্দর-পর্বতকে ধারণ করা মানে বস্তুত পৃথিবীর ‘পিভট্’ বা ‘অ্যাক্সিস’ ঠিক রাখা। আর ভগবান বিষ্ণুর প্রথম কাজ ভূভার হরণ করা। ভূ-শক্তি তাঁর অন্তরঙ্গা এক শক্তি, তাঁর অন্যতমা স্ত্রী, লক্ষ্মীর মতোই তাঁর মর্যাদা। অতএব মন্দর পর্বতের কেন্দ্র স্থির করতে সাহায্য করে বিষ্ণু আসলে পৃথিবীকেই ধারণ করে আছেন—ক্ষিতিরতিবিপুলতরে তিষ্ঠতি তব পৃষ্ঠে/ধরণী-ধারণ-কিণ-চক্র-গরিষ্ঠে। গীতগোবিন্দের কবি দুটি জব্বর কথা বলেছেন তাঁর কবি বুদ্ধিতে। আমরা জানি—কচ্ছপের পৃষ্ঠদেসে যে কঠিন আবরণ, সেটি তার আপন সুরক্ষার কারণে প্রাকৃতিকভাবেই নির্মিত। তার পৃষ্ঠলগ্ন এই চক্র নানা ঘর্ষণে আরও কঠিন হয়ে ওঠে দিনের পর দিন। কবি কল্পনা করছেন—পৃথিবীর সুরক্ষায় দায়বদ্ধ বিষ্ণুর এই কূর্ম-পৃষ্ঠের চক্রটি পৃথিবীকে ধারণ করতে করতে ভীষণ কড়া হয়ে উঠেছে—ধারণী-ধারণ-কিণ-চক্র-গরিষ্ঠে। কবির ভাবটা এই যেন, সেই আদিম সময় থেকেই কূর্ম-প্রজাতির এই কঠিন পৃষ্ঠ-আবরণ তৈরি হয়েছে কূর্ম-অবতারের শারীরিক স্বরূপে। পৃথিবীর উপকারের জন্য যা তৈরি হল, তা তার আত্মোপকারে প্রযুক্ত হয়েছে তখন থেকে।
দ্বিতীয়ত, জয়দেবের দশাবতার-স্তোত্রের ক্রিয়াপদটি—তিষ্ঠতি—বর্তমান-কালে ব্যবহৃত। অর্থাৎ তখনই শুধু পৃথিবী ধারণ করেছিলেন তা নয়, এখনও ধারণ করে আছেন—এই ধারণ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতেও সব অর্থেই—cosmogonic, cosmographic and genealogical বস্তুত, কচ্ছপ হচ্ছে মানব-সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন প্রজাতির প্রাণী। তার প্রজননী ক্ষমতাও যথেষ্ট বলে মূহূর্তের মধ্যে এটি ‘ফ্যার্টিলিটি কাল্ট’-এর প্রতীক হয়ে ওঠে। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি—মৎস্যাবতারের ক্ষেত্রে জলের মধ্যেই প্রজননের যে বিপুল প্রাণনা সৃষ্টি হয়েছে সভ্যতার অগ্রগতিতে সেই বিষ্ণুর রূপ এখন উভচর। কচ্ছপ জলেও চলে স্থলেও চলে। সভ্যতার প্রায় সমবয়সি। এই প্রাণীটিকে সকলে চেনে—মানুষের কথকতায়, রূপকথায়, পুরাকথায় এই কচ্ছপ প্রপিতামহের বিচরণ সংক্রমণ। সেই সতত পরিচিত প্রাচীন প্রাণীর মধ্যে আজ ভগবান বিষ্ণুর শক্তি-সংক্রান্তি ঘটেছে। তিনি কূর্মরূপ অবতীর্ণ হয়ে সেই যে নিজের পৃষ্ঠদেশ পেতে দিয়ে সপ্তদ্বীপা বসুমতীকে ধারণ করেছিলেন, আজও সে কাজ তাঁর শেষ হয়নি।
গীতগোবিন্দের কবি বলেছেন ‘তিষ্ঠতি’—তিনি এখনও ধরে আছেন পৃথিবীকে। তবে এই দেশ-কাল অতিক্রান্ত বিষ্ণুর ব্যাপ্তি-ভাবনা অখিল কবিকুলের হৃদয়েই ছিল বলে মনে হয়। একটি প্রাচীন শ্লোকে এক কবি লিখেছেন, বড় কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা কথা দিলে কথা রাখেন সব সময়—অঙ্গীকৃতং সুকৃতিনঃ পরিপালয়স্তি—অঙ্গীকার করলে তা থেকে সরে আসেন না বড় মানুষ। এই যে সমুদ্রমন্থনকালে ভগবান শিব বিষপান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন, সে ভয়ংকর বিষ কিন্তু এখনও উগরে দেননি তিনি। হয়তো বা এই অঙ্গীকার পালনের কারণেই এখনও বিষ্ণুরূপী কুর্মদেব তাঁর পৃষ্ঠভাগ থেকে নামিয়ে দেননি পৃথিবীকে—অদ্যাপি নোজ্ঝতি হরঃ কিল কালকূটং / কূর্মো বিভর্তি ধরণীং খলু পৃষ্ঠভাগে/ সত্যিই অঙ্গীকার ভেঙে চলে যান না বড় মানুষ।