জলচর মীন থেকে উভচর কচ্ছপ, কচ্ছপের পর এক পূর্ণ পশু—বরাহ, তারপরেই অর্ধেক পশুর সঙ্গে অর্ধেক মানুষ, অবশেষে পূর্ণ এক মানুষ, আকারে খাটো, কিন্তু পূর্ণ মনুষ্য-বৃত্তিসব পূর্ণ এক মানুষ—প্রাণের পার্থিব বিবর্তনে আমাদের পৌরাণিকও কিছু অন্যভাবে ভাবেন যেন। নরসিংহের মিশ্ররূপের পরেই সোজাসুজি এক সঠিক আকৃতির মানুষ রূপে ঈশ্বরকে অবতীর্ণ করাতে যেন পৌরাণিকের লজ্জা ছিল, নাকি সংকুচিত ছিলেন সেই পরম ঈশ্বর—কিন্তু বামন অবতার যেন সর্বত্র ছোট হয়েও বড় হয়ে ওঠার কাহিনি।
আপনারা জানেন যে, আবতার-প্রসঙ্গ এলেই বিষ্ণুর কথা আসবে, এবং বিষ্ণু মানেই স্মরণে আসবে তাঁর সহায়ক ভূমিকার কথা। পণ্ডিতেরা বলেন—বামন অবতারের উৎস কিন্তু সেই প্রাচীন ঋগ্বেদ, যেখানে বৃত্র-বধের জন্য বিষ্ণুর সহায়ক ভূমিকার কথা সবার আগে বলতে হবে। তবে ওই সহায়তার সাধারণ বৃত্তি থেকেও বড় হয়ে উঠবে কীভাবে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন, সেই কথাটা। আশ্চর্য হতে হবে শুনে যে, আজও আমরা প্রত্যেকটি ভারতীয় যদি সামান্যতম একটা পূজো করতে বসি, অন্নপ্রাশন দিতে বসি, বিয়ে করতে বসি, শ্রাদ্ধ করতে বসি, তাহলে প্রথম আরম্ভে যে মন্ত্রটা পড়ব তার সঙ্গে আদ্যোপান্ত জড়িয়ে আছেন আমাদের বামন অবতার।
ঋগ্বেদে আছি যে, বৃত্রাসুর এক সময় সপ্তসিন্ধুর জলধারা রুদ্ধ করে রেখেছিল। ইন্দ্র তাঁর অধিকৃত নগর-দুর্গগুলি ভেঙে দিয়েছিলেন। শেষ যুদ্ধের দিন ত্বষ্টা ইন্দ্রের জন্য বজ্র নির্মাণ করেছিলেন। ‘ত্বষ্টার গৃহে বসেই তিনি প্রচুর সোমপান করে যখন যুদ্ধে গেলেন তখন বিষ্ণুকে তিনি বলেছিলেন—সখা আমার ! তুমি তোমার পা দিয়ে জায়গা তৈরি করে দাও আমার বজ্রের – সখে বিষ্ণো বিতরং বিক্রমস্ব / দৌর্দেহি লোকংবজ্রায় বিষ্কভে। ইন্দ্র বলেছিলেন—বিষ্ণু ! তুমি আমি দুজনে মিলেই বৃত্রকে বধ করব, মুক্ত করব এই সপ্ত সিন্ধুর ধারা—হনাব বৃত্রং রিণচাব সিন্ধুন। ইন্দ্র-বিষ্ণুর পারস্পরিকতার এই হল প্রথম ঋগ্বৈদিক স্তর, যেখানে বিষ্ণু তাঁর ‘পদ-বিক্রমণ’ করে ইন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করেছিলেন মানুষের।
ঋগ্বেদের এই দু-চারটে মন্ত্র-পঙ্ক্তিই শুধু নয়, আরও অনেকগুলি মন্ত্রেই যে শব্দটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে, তা হল এই ‘বি-ক্রম’, ‘বিক্রমণ’। খেয়াল করে দেখুন, কোন খ্রিষ্টপূর্বাব্দিক কালে মন্ত্রদ্রষ্টা কবি বেদের মধ্যে বিষ্ণুর পা-ফেলা, পাদ-বিহরণ অর্থে ‘বিক্রমণ’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন, আর কোন কালে দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে বাংলার জয়দেব কবি বামনাবতারের প্রস্তাবনায় সেই ‘বিক্রমণ’ শব্দটাই স্মরণ করলেন—বলিসদ্ভুত বামন। আসলে ‘ক্রম’ ধাতুর অর্থ চলা, হাঁটা, সরে যাওয়া। বি-ক্রম বা বিক্রমণ মানে he extended, distributed himself to, spread over, developed into—he strode out asunder in all directions to animate and inanimate objects. পণ্ডিতজনেরা বিষ্ণুর এই সর্বতোগামী পদ-বিস্তারকে সূর্যকিরণের একাত্মতায় দেখেছেন, কেননা বিষ্ণু তাঁদের মতে বৈদিক বিশিষ্টতায় সূর্যই বটে। তৈত্তিরীয় সংহিতার মতে, বিষ্ণুর এই পাদবিহরণে ইন্দ্র শক্তিলাভ করেছিলেন এবং তিনি যখন বৃত্রবধের জন্য ব্রজ তুললেন হাতে, তখন শুধু বিষ্ণুর ওই তৃতীয় চরণের বলেই তিনি মারতে পেরেছিলেন বৃত্রকে। এই তৃতীয় চরণের অনুগ্রহেই পৃথিবীতে স্থির-স্থিতি হয়েছে মানুষের, আর শেষে বলতে হবে—আমরা আজও মনে রেখেছি বিষ্ণুর সেই তৃতীয় চরণ, কেন না নিত্য-নৈমিত্তিক যে কোনও কাজে, যে কোনও পূজোয় আমরা প্রথমে সে তৃতীয় চরণ বন্দনা করি—ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাততম্– আকাশে যে চক্ষুটি চিরকালীন উন্মীলিত হয়ে আছে, যেভাবে চির-উন্মীলিত দেবতার চোখ করুণাদৃষ্টি করে আমাদের, বিদ্বান মানুষেরা সে আতত দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকেন বিষ্ণুর সে পরম পদের দিকে।
বেদ এবং ব্রাহ্মণগুলিতে বিষ্ণুর পরম পদের মহিমা যেভাবে বৃত্র-বধ এবং পৃথিবীর মঙ্গল-বিধানের ভাবনায় চিহ্নিত হয়েছে, পৌরাণিকেরা সেই ভাবনাকে কাহিনির মাধ্যমে আমাদের কাছে বোধ্য এবং লোকগ্রাহ্য করে তুলেছেন। বিষ্ণুর পদ-বিক্রমণ, তাঁর পদপ্রসারণ যেহেতু পৃথিবী এবং তার চলমান জীবনকে ধারণ করে, তাই মহাভারতে বৃত্রবধের কাহিনিতে বিষ্ণুর উদ্দেশে বলা হয়েছে—পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, আকাশ-এ তিন ভুবন তুমি তোমার তিনটি চরণে আবৃত করে রেখেছ—ত্রয়ো লোকাস্ত্বয়া ক্রান্তা স্ত্রিভি বিক্রমণৈঃ পুরী। অতএব শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুর সেই ধারণ-পালনের পার্থিব মাহাত্ম্যই কিন্তু বড় হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত, অর্থাৎ অবতার-গ্রহণের সে ‘প্রাইমারি মোটিফ’—ভূ-ভারহরণ এবং পালন। এই তত্ত্বটাই প্রাথমিক সূত্র হিসাবে এসেছে বামন অবতারের কাহিনিতে।
আমরা কিন্তু তবু আমাদের পুরাতন পরম্পরাতেই অবতার-ভাবনা করতে ভালোবাসি—সেই দেবাসুর দ্বন্দ্ব, সেই পদ-বিক্রমণ, সেই ব্রাহ্মী ব্যাপ্তি-ভাবনা এবং অবশেষে শিষ্ট-পালনের সঙ্গে তাঁর করুণা-বৃত্তির প্রকাশ। সেই যে নরসিংহ অবতারে আমরা দৈত্যকুলে প্রহ্লাদকে দেখেছি, তিনি বিষ্ণুভক্ত হলেও দৈত্য তো বটেই। সেই দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের নাতি হলেন দৈত্যরাজ বলি, বৈরোচন বলি—প্রহ্লাদের ছেলে বিরোচন, তাঁর ছেলে বলি। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য সব সময় বলি-রাজার উন্নতির ভাবনা করেছেন এবং বলি তাঁর আপন বীর স্বভাবে এক সময় ভার্গব শুক্রাচার্যের রথে চড়ে দ্যুলোক-ভূলোক-স্বর্গ সব সবটাই জয় করে নিলেন একে একে। দেবগুরু বৃহস্পতি দেবতাদের বললেন—ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণরা অনেক তেজে তেজীয়ান করে দিয়েছে এই দৈত্যরাজ বলিকে। ওর সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা এখন তোমাদের নেই। তোমরা অদৃশ্য হও বা লুকিয়ে পড়ো কোথাও। নিজের সমৃদ্ধ সন্তানদের এইভাবে ভেঙে পড়তে দেখে দেবমাতা অদিতি তাঁর স্বামী কশ্যপের পরামর্শে ভগবান শ্রীহরির অর্চনা করলেন। একটি পুরাণ হলেও এইটুকু খেয়াল করতে হবে যে, অদিতির প্রার্থনায় এক যজ্ঞপুরুষের আকৃতি ভেসে আসছে, তাঁর স্তুতি-শব্দে বামন-দেবের প্রাচীন সেই যজ্ঞ-সম্বন্ধ উচ্চারিত হচ্ছে – যজ্ঞেশ যজ্ঞপুরুষাচ্যুত-তীর্থপাদ/ তীর্থশ্রব শ্রবণ-মঙ্গল-নামধেয়।
অদিতির আর্তি এবং প্রার্থনায় ভগবান শ্রীহরি তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন—এখনকার এই অসুরদের নিয়ে আমার খুবই সমস্যা হয়েছে। আমাদেরই বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণরা তাঁকে সুরক্ষা দিচ্ছেন এবং তারা ভালো লোক, অতএব এইবার যুদ্ধ-টুদ্ধ করে বিক্রম প্রকাশ করাটা একেবারেই ঠিক হবে না—যৎ তে’নুকুলেশ্বর-বিপ্রগুপ্তা/ ন বিক্রমস্তত্র সুখং দদাতি। যাই হোক, মা জননী ! তোমার দেবতা-ছেলেরা যাতে তাদের নিবাস-স্থান খুঁজে পায়, সকলে যাতে সুখে থাকে, সে ব্যবস্থা আমি করব। আমি তোমার ছেলে হয়ে জন্মাব, তারপর তোমার ছেলেদের কীভাবে স্থানাস্থিত করা যায়, সেটা দেখছি। অর্থাৎ কি না আমরা বলব অবতার গ্রহণের ‘প্রাইমারি মোটিফ’-এ প্রাথমিক এবং অর্ধেকটাই যেখানে দুষ্টের দমন, সেটাই এখানে অর্ধেক ‘ডিনায়েড’ হয়ে যাচ্ছে। ভাগবত পুরাণের শ্রোতা পরীক্ষিত যখন শুকদেবকে প্রশ্ন করছেন, তখন তাঁর মনেও একটা সংশয় তৈরি হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—সূত্রাকারে শুনেছি এসব কথা যে, ভগবান শ্রীহরি দৈত্যরাজ বলির কাছে তাঁর তিনখানি পা রাখার জন্য ভূমি প্রার্থনা করেছিলেন, সর্বভূতেশ্বর হওয়া সত্ত্বেও ভগবানের যাচনা-বৃত্তিটাও যেমন অদ্ভুত, তেমনই বলি তেমন কোনও অপরাধও করেননি, ভগবদ্-বিদ্বেষও ছিল না তাঁর মনে, তবু তাঁকে বামন-রূপী বিষ্ণু একেবারে বেঁধে ফেললেন বিনা প্রয়োজনে—এসবের মানে কী—যাচে্ঞশ্বরস্য পূর্ণস্য বন্ধনং চাপ্যনাগসঃ ?
অনির্বচনীয় বিভু ঈশ্বর সেখানে মনুষ্য-গ্রাহ্য বাঙ্-মনো-বৃদ্ধির বিষয় হয়ে ওঠেন। ভাগবত পুরাণের মহাকবি এই সূক্ষ্ম মধুরভাবটুকু বুঝেছেন বলেই যে মুহূর্তে অদিতির গর্ভে ভগবান বিষ্ণু বামন-রূপে জন্মালেন, তখন গর্ভজাত সন্তানটিকে বামনের চেহারায় দেখে ভারী অবাক হলেন, তাঁর সমস্ত রূপবান দেব-সন্ততির বিপ্রতীপে এই বামন-পুত্রটিকে দেখে তাঁর মনে হল যেন ভগবানও বেশ একটা নাটকের নায়কের মতো অন্য এক বিশিষ্ট রূপ ধারণ করেছেন—বভূব তেনৈব স বামনো বটুঃ /সম্পশ্যতো দিব্যগতি র্যথা নটঃ।
বামন-দেবের একটা চেহারা আছে। আমাদের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বামন-দেবের চেহারা ব্রাহ্মণ-বটুর মতো, উপনয়ন লাভ করা প্রথম ব্রাহ্মণের মতো। এই ধ্যানমূর্তি তৈরি হবার পিছনে ঘটনা ছিল এইরকম—অদিতির গর্ভজাত এই পুত্রকে উপনয়ন দেবার ব্যবস্থায় এগিয়ে এলেন মহর্ষিরা। এই উপনয় উৎসবে স্বয়ং সূর্যদেব নেমে এলেন ভুঁয়ে, একেবারে মানুষোচিত ব্যবহারে ‘সবিতৃ-মণ্ডল-মধ্যবর্তী’ নারায়ণের কানে সাবিত্রী-মন্ত্র দিলেন আচার্যগুরুর মতো। দেবগুরু বৃহস্পতি তাঁকে যজ্ঞসূত্র দিলেন, পিতা কশ্যপ দিলেন মেখলা, পৃথিবী তাঁকে দিলেন অজিনাসন।
বামন-বটুর ব্রাহ্মণ্য মূর্তিখানিও এইভাবেই চিত্রিত হয়। উপনীত বামনদেব সেই নতুন ব্রাহ্মণের বেশে উপস্থিতি হলেন দৈত্যরাজ বলির কাছে। বলি তখন অশ্বমেধ যজ্ঞের তোড়জোড় করছেন। নর্মদার উত্তর তীরে। ব্রাহ্মণ-বটু বামন-দেবকে দেখে যজমান বলি তাঁকে আসন দিলেন বসার জন্য। যত্ন করে পা ধুইয়ে দিলেন বামন-দেবের, মাথায় ছোঁয়ালেন সেই চরণস্পৃষ্ট পবিত্র জল যা শিব-মহাদেব গঙ্গার ছলে ধারণ করেন মাথায়—গীতগোবিন্দের কবি হয়তো এই কারণেই বামনের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন—পদনখ-নীর-জনিত-জন-পাবন। বলি বললেন—তোমায় স্বাগত জানাই ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মর্ষিদেব তপস্যার ফলের মতো পবিত্র মূর্তি তোমার। আজকে আমার বংশের সৌভাগ্য যে, তুমি এসেছ এখানে, আমার পিতা-পিতামহরা তৃপ্তি লাভ করছেন তোমার এই যজ্ঞস্থলে আগমন দেখে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি এই সময়ে আমার কাছে কিছু চাইতে এসেছ—ত্বাম্ অর্থিনং বিপ্রসুতানুতর্কয়ে। তা বলো তুমি কী চাও। গোরু চাও, সোনা চাও না একটা ভালো বাড়ি চাও। ভালো খাবার-দাবার, নাকি একটা বামুন-ঘরের মেয়ে চাও বিয়ে করার জন্য—গাং কাঞ্চনং গুণবদ্ধাম মৃষ্টং/ তথান্নপোয়ম্ উত বা বিপ্রকন্যাস্। কোনও লজ্জা কোরো না হাতি, ঘোড়া, রথ, গ্রাম—যা চাও তুমি বলো।
বামন-দেব বেশ খুশি হলেন বলির অভ্যর্থনা বাক্য শুনে। খানিক পরেই যাঁর সর্বস্ব হরণ করবেন তিনি, তার প্রশংসা না করেও পারলেন না। বললেন—তোমার বংশের আভিজাত্য এবং ভদ্রতা অনুযায়ীই তুমি কথা বলেছ। তোমার নিত্যকর্মে ভৃগুরা তোমাকে উপদেশ দিচ্ছেন, পারলৌকিক পুণ্যকর্মে উপদেশ দেন তোমার পিতামহ প্রহ্লাদ—তিনি তোমার এই দৈত্যবংশে চাঁদের আলো। অতএব যাচক ব্রাহ্মণ এসে এই বংশের কারও কাছে প্রত্যাখওাত হয়ে ফিরে যাবে, এমন মানুষ তোমার বংশে জন্মাতেই পারেন না। তোমার পিতা বিরোচনও যথেষ্ট দানী ছিলেন; ব্রাহ্মণবেশী দেবতাদের জন্য নিজের আয়ুটুকুও দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অতএব তাঁর ছেলের কাছে প্রার্থী হয়ে এলে সে বঞ্চিত হয়ে ফিরে যাবে না—সে কথা আমার সম্যক জানা আছে। তবে হ্যাঁ, তোমার মতো বড় মানুষের কাছে আমার প্রার্থনাও খুব বিশাল নয়। আমাকে শুধু আমার তিনখানা পা রাখার জায়গা দাও তুমি—পদানি ত্রীনি দৈত্যেন্ত্র সম্মিতানি পদা মম। আমি জানি, তুমি উদার মানুষ, অনেক কিছুই তুমি দেতে পারো, তবে কিনা বিদ্বান মানুষের এই নিয়ম,যতটুকু তার প্রয়োজন তার বেশি সে চায় না—যাবদর্থপরিগ্রহঃ।
বলি দৈত্যরাজ একটু হেসেই উঠলেন যেন মনে-মনে। মুখে বললেন—বটু ! তোমার কথাগুলো বুড়োরা খুব পছন্দ করবে। কিন্তু এমনিতে তুমি একেবার বাচ্চা ছেলে, একেবারে কাঁচা বুদ্ধির মানুষ তুমি, নিজের স্বার্থ কীভাবে দেখতে হয় সেটাও তুমি বোঝো না—ত্বং বালো বালিশমতিঃ স্বার্থংপ্রত্যবুধো যথা। তুমি তিন ভুবনের শাস্তা প্রভুকে মৃদু বাক্যে প্রসন্ন করে তার কাছে চাইছ তিনখানি পা রাখার জায়গা। যে নাকি তোমাকে জম্বুদ্বীপ, ঋষভ-দ্বীপ, প্লক্ষ্ম-দ্বীপ দিতে চাইছে, তার কাছে তুমি চাইছ ত্রিপাদভূমি—এমন বোকাও আছে এই পৃথিবীতে—পদত্রয়ং বৃণীতে যো’ বুদ্ধিমান্ দ্বীপদাশুষম্। আমার কাছে চেয়ে মানুষ যা পায় তাতে আর কোথাও চাইতে যেতে হয় না তাকে। বরঞ্চ বেশি কিছু তুমি যদি না চাও; ঠিক আছে, বেশি নিতে হবে না তোমাকে। কিন্তু খানিক জমি-জমা অন্তত নাও, যাতে অন্তত সচ্ছল জীবন চলে তোমার—তস্মাদ্ বৃত্তিকরীং ভূমিং বটো কামং প্রতীচ্ছমে।
মায়া-মানুষ বামন-দেব একটু অনাসক্তির দর্শন মিশিয়ে বললেন—এই পৃথিবীতে আমাদের মত প্রিয় বিষয় আছে, সে-সব কি একটা লোভী লোকেরও বাসনা-তৃপ্তি ঘটাতে পারে সম্পূর্ণভাবে। আমি ত্রিপাদ-ভূমি না চেয়ে একটা ধরো দ্বীপ চাইলাম তোমার কাছে। তারপর এখ দ্বীপের বদলে দুই দ্বীপ, তিনটি দ্বীপ, তারপর সপ্তদ্বীপা বসুমতী চেয়ে বসব তোমার কাছে। তার চেয়ে যতটুকু পেলাম, তাই নিয়ে যদি আমার সন্তুষ্টি-সন্তোষ থাকে, তবে তিন লোকের অধিকার-পাওয়া অসন্তুষ্ট লোকের তার মর্যাদা-অনেক বেশি। সব চাইতে বড় কথা,বামুন মানুষের এই যথেষ্ট, যা চাইলাম, তাই পেলাম, তাতেই বামুনের মর্যাদা বাড়ে—যদৃচ্ছলাভ-তুষ্টস্য তেজো বিপ্রস্য বর্ধতে।
বলিরাজ মনে-মনে খশিই হলেন ব্রাহ্মণের ত্যাগবৃত্তি দেখে। বললেন—ঠিক আছে। যেমন তোমার ইচ্ছে, যতটুকু তোমার ইচ্ছে, ততটুকুই নাও তুমি। তারপর বামনকে ত্রিপাদ ভূমিদান করার জন্য কুশিতে জল নিলেন সংকল্প শব্দ উচ্চারণ করতে হবে বলে। এতক্ষণ সব কিছু দেখছিলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। অসম্ভব অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধিতে এই ব্রাহ্মণ-বটুকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার স্বরূপ বলে চিনতে তাঁর এতটুকুও অসুবিধে হয়নি। তিনি শিষ্য বলিরাজের আসন্ন বিপদ বুঝে আর না বলে থাকতে পারলেন না। বললেন—তুমি বুঝতে পারনি, বলি! ইনি বিষ্ণু, ঈশ্বরী মায়ায় তিনি এই বালক ব্রহ্মচারীর বেশ ধারণ করেছেন। ইনি তোমার ধন, ঐশ্বর্য সব কেড়ে নিয়ে তোমার পরম শত্রু দেবতাদের দেবেন। তিনটি পা রাখার জন্য জায়গা চেয়েছেন তো ইনি, তুমি দেখবে—ওই তিনটি পদের বৈষ্ণব ব্যাপ্তিতে ‘বিশ্বকায়’ হয়ে উঠবেন ইনি। তখন তোমার সংকল্প-মত সব দিয়ে তুমি নিজে কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবে, সেই চিন্তা করো—ত্রিভিঃ ক্রমৈরিমাল্লোঁকান্ বিশ্বকায়ঃ ক্রমিষ্যতি।
একটা প্রশ্ন উঠলই। বলি বামনকে ত্রিপাদ-ভূমি দান করার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন, এখন না বললে তো খুব অন্যায় হবে। শুক্রাচার্য এখানেও বোঝালেন বলিকে। বললেন—এমন দান যদি করো, যাতে তোমার জীবন, জীবিকা, বৃত্তি সব চলে যাবে, তেমন দানের কোনও প্রশংসা নেই শাস্ত্রে—ন তদ্দানং প্রশংসন্তি যেন বৃত্তির্বিপদ্যতে। আরে গাছটাকে যদি মূলসুদ্ধ উপড়ে ফেল, তাহলে তার ফল-ফুল আসবে কোত্থেকে। পাঞ্চভৌতিক এই শরীরটাকে তো আমরা দিন-রাত মিথ্যে-মিথ্যে, মায়া-মায়া বলে চ্যাঁচাচ্ছি, কিন্তু বল তো—এই মিথ্যে-মায়ার শরীরটা যদি ধ্বংসই হয়ে যায়, তাহলে তো এটাই বলতে হবে যে, মিথ্যারও একটা মূল্য আছে, মিথ্যার নাশে এই দেহটাই তো থাকবে না—এবং নষ্টানৃতঃ সদ্য আত্মা শুষেন্ন সংশয়ঃ। তখন কীসের ধর্ম, কীসের যজ্ঞ-দান-তপস্যা। সবশেষে শাস্ত্র একথাও বলে যে, মানুষের জীবিকা-বৃত্তির যদি চরম সংকট দেখা দেয়, যদি প্রাণ বাঁচানোর দায় আসে মানুষের, তাহলে মিথ্যাও বলতে হবে প্রয়োজনে, সেই মিথ্যে কোনও গর্হিত, জুগুপ্সিত বস্তু নয়। শুক্রাচার্য বলতে চাইলেন—তোমার দানের সংকল্প তৈরি হয়েছে, সেটা ভাল কথা, কিন্তু তোমার বেঁচে থাকার প্রাণ-বৃত্তি যেখানে সংকটে, সেখানে এখন ‘দান দেবো না’ বলায় দোষ নেই কোনও।
বলিরাজ প্রথমে সম্মান জানিয়েই গুরু শুক্রাচার্যকে বললেন—এটা তো আপনি সর্বথা সত্য কথা বলেছেন—অর্থ, কামনা, কিংবা যশের বাধা হয়ে ওঠে এমন কাজ সংসারী মানুষকে মানায় না, এটা সর্ব্বৈ সত্য। কিন্তু এই পৃথিবী তো অসত্যবাদী মানুষের ভার বহন করে না। আর আমিও তো নরক-ভোগের ভয় পাই না, ভয় পাই না দুঃখ-সমুদ্রে ডুবে যেতে, প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য শেষে যদি এমন অবস্থাই হয় যে, আমারই থাকার জায়গা নেই কোনও, তবে তাই হোক, আমি এই প্রবঞ্চনা করতে পারব না। তাছাড়া কী করে এটা সম্ভব ? আমি দৈত্যকুলের শ্রদ্ধেয়তম প্রহ্লাদ-মহারাজের নাতি, সেইখানে আমি যদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা না রাখি, তাহলে তো সেটা জুয়োচুরির মতো ঘটনা হবে। একজন জুযাড়ি এমন করে। সেই বঞ্চনা আমি সইিতে পারব না—প্রতিশ্রুত্য দদামীতি প্রহ্লাদিঃ কিতবো যথা। আমি দেব যেটা যা এই ব্রাহ্মণ-বটু চাইছে। হয়তো দৈত্যদের জীবনে এখন ঘনিয়ে আসবে মহাকাল, কিন্তু আমাদের যশোরাশির বৃদ্ধি হবে এই ঘটনায়। তুমি এসো ব্রাহ্মণ, এই ব্রহ্মচারী যা চাইছে দিতেই হবে আমাকে—ততো বটোরস্য দদামি বাঞ্ছিতাম্। শত শত মানুষ শত রকম যজ্ঞ করে যার আরাধনা করে, সে যজ্ঞপুরুষ বিষ্ণু আমার বরদাতাই হোন বা শত্রুই হোন, তিনি যতটুকু ভূমি চেয়েছেন আমি দেব।
দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য ভীষণ অখুশি হলেন। কিন্তু বলি তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে সংকল্প সাধক জল নিলেন হাতে এবং বিধিনিয়ম মেনে সংকল্পিত ত্রিপাদভূমি দান করলেন বামনদেবকে । বলিমহারাজের স্ত্রী বিন্ধ্যাবলি সোনার কলসে জল নিয়ে এসে পা ধুয়ে দিলেন বামনদেবের এবং বলি সে চরণ স্পৃষ্ট জল পরম শ্রদ্ধায় ধারণ করলেন মাথায়। স্বর্গ থেকে দেবতারা পর্যন্ত পুষ্প বৃষ্টি করলেন বলির এই অকপট নিষ্ঠা দেখে, শত্রুপক্ষের চরম সুবিধে হবে জেনেও বলি যে এইভাবে সংকল্প রক্ষা করলেন, তাতে স্বর্গের সহস্র দুন্দুভি বাজল প্রশংসায়, গন্ধর্ব-অপ্সরারা বলির ত্যাগবৃত্তির গান ধরলেন। কিন্তু এই সপ্রশংস মহান আবহের মধ্যেই বামন-বিষ্ণুর শরীর বর্ধিত হতে আরম্ভ করল—পৃথিবী, অন্তরিক্ষ, আকাশ, সমুদ্র সর্বত্র সেই বান-মূর্তি প্রসারিত, ব্যাপ্ত হল—তদ্বামনঃ রূপমবর্ধতাদ্ভুতং/হরেরনন্তস্য গুণত্রয়াত্মকম্।
এই বামন-মূর্তির বিস্তারে বিশ্ব-চরাচর কীভাবে বিধৃত হল এবং সেই মূর্তির প্রত্যঙ্গ-বিস্তারে কোথায় কোথায় বিশ্বের কোন কোন বস্তু দৃশ্যমান হল সেটা ভাগবতী বর্ণনায় যে বিশ্বরূপ-দর্শনের কবিতা। যাই হোক অবশেষে বামনের প্রথম চরণে ব্যাপৃত হল এই পৃথিবী আর দ্বিতীয় পদন্যাসে আবৃত হল স্বর্গলোক—সব জায়গায় কিন্তু সেই বৈদিক ক্রিয়াপদ—ক্রম্ ধাতুর সেই অথ-পদক্ষেপ—ক্ষিতিং পদৈকেন বলে র্বিচক্রমে/পদং দ্বিতীয়ং ক্রমত স্ত্রিবিষ্টপম্। বাকি থাকল সে তৃতীয় চরণ—তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদম্। বামনরূপী বিষ্ণুর কপটতা প্রকট হয়ে উঠল খুব স্পষ্টভাবে বলির অনুচর দৈত্য-দানবেরা তাঁদের প্রভু বলিরাজের এমন অদ্ভুত হেনস্তা দেখে অত্যন্ত রেগে গেল। তারা যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য প্রস্তুত হল। বিষ্ণুর পার্ষদ-ভৃত্যেরা বলির সাঙ্গোপাঙ্গ দৈত্যদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রসাতলে পাঠিয়ে দিলেন। পরিস্থিতি একটু শান্ত হতেই বামনদেবের ইঙ্গিতে বরুণের পাশ দিয়ে বলিকে বেঁধে ফেললেন অষ্টেপৃষ্ঠে। বলিও বন্ধন-মোচনের কোনও চেষ্টা করলেন না। বামন বলিকে বললেন—তুমি আমাকে ত্রিপাদভূমি দেবে বলে প্রতিজ্ঞাত হয়েছিলে, তা আমার দু’পায়ের বিস্তৃতিতেই সমস্ত ভূমি ব্যাপ্ত হয়ে গেছে, এবার তৃতীয় পদের আধার-স্থানটুকু দাও আমাকে—দ্বাভ্যাং ক্রান্তা মহী সর্বা তৃতীয়মুপকল্পয়। তুমি তো বলেছিলে—যতদূর পর্যন্ত সূর্য তার আলোক বিকিরণ করে, যতদূর পর্যন্ত চাঁদের জ্যোৎস্না ছড়িয়ে যায় এই বসুন্ধরার পিঠের ওপর, আর বলেছিলে—যতদূর মেঘ বর্ষণ করে জলধারা, ততধূর নাকি, তোমার রাজ্য—যাবদ্ বর্ষতি পর্জন্যস্তাবতী ভূরিয়ংতব। তা তোমার সামনেই তো আমার একটি পদক্রমেই আবৃত হল এ পৃথিবী, এই বিরাট শরীরে ব্যাপৃত হল আকাশ, দ্বিতীয় পদে আক্রান্ত হল স্বর্গ। এবার তৃতীয় পদের স্থানটুকু দাও। কথা দিয়ে কথা না রাখলে তো নরকেও স্থান হবে না তোমার।
বলি-মহারাজের যা চরিত্র, তাতে এত কথা বোধহয় বলবার প্রয়োজন ছিল না বামনের। তবু এসব কথায় যেন প্রার্থয়িতা ভগবানের মহা-মাহাত্ম্য যেন কোথায় লঘু হয়ে ওঠে যাচকের লঘুতায় এবং তা হয়তো বিপ্রতীপে বলিরাজের মতো এক ভূরিদাতার মাহাত্ম্য-বিবর্ধনের জন্যই। বামনদেবের তির্যক কথাবার্তা শুনে বলি বললেন—আমি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিই না কখনও। আর এটাও সত্যি যে, আপনার দুটি চরণ-বিন্যাসেই দ্যুলোক-ভূলোক পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কথা মিথ্যে হতে দেব না, আপনার তৃতীয় চরণ স্থাপন করুন আমার এই মাথার ওপর—পদং তৃতীয়ং কুরু শীর্ষ্ণিমে নিজম্। বলির সামনে এখন তিনি আর ক্ষুদ্র বামন-বটু নন, তিনি সেই ব্যাপ্তিময় বিরাট পুরুষ—যিনি অগ্নিতে যিনি জলেতে, যিনি তৃণতরুময় স্থলেতে। তবুও কৃপামূর্তির বামন-স্বরূপ এখনও অন্তর্হিত নয়, তিনি কথা বলছেন, ভিক্ষা চাইছেন, বলি শুধু এখন তাঁকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছেন। বলি বললেন—আমি নরক-টরকের ভয় পাই না, ভয় পাই না আপনার এই পাশবন্ধনের দণ্ডকেও। তাছাড়া আমি তো দোষও দর্শন করছি না আপনার। তিন ভূবনের এই বিশাল রাজত্ব নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও প্রমত্ততা ছিল আমার মনে, সেখানে আমার মতো মদান্ধ মানুষকে আপনি সত্য দেখার চোখ দিয়েছেন একটা—যো নো’নেকমদান্ধানাং বিভ্রশং চক্ষুরাদিশৎ।
বলি আবারও তাঁর পিতামহ প্রহ্লাদের প্রসঙ্গ তুললেন এবং প্রহ্লাদকে আমরা বলি-বন্ধনের এই আকালিক ঘটনায় উপস্থিতও দেখতে পাচ্ছি ভাগবত পুরাণে, দেখতে পাচ্ছি ভগবান ব্রহ্মাকেও। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা হল—এই একটা ঘটনা ঘটল যেখানে তিন ভুবনের পুরমেশ্বর বিষ্ণু বলির বিরুদ্ধে কোনও আসুরিক বা দানবীয় অভিযোগ আনতে পারছেন না। এমনকী তাঁকে বরুণের পাশে বেঁধে ফেলাটাও তাঁর দিক থেকে বাড়াবাড়ি রকমের আগাম সতর্কতা বলে মনে হচ্ছে। বামনদেবকে অবশেষে ভাববাচ্যে বলতে হচ্ছে—এই মানুষটার ধনৈশ্বর্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে, প্রশাসকের পদ থেকে চ্যুত, জ্ঞাতি পরিজনেরা একে ত্যাগ করেছে, আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি এই মানুষটার সঙ্গে ছলনা করেছি—প্রথমে ত্রিপাদভূমির যাচনা করে তার সহজ সরল মনে সামান্য-সাধারণ এক দানের প্রতিভাস তৈরি করে। আমি তারপর বিরাট-রূপে তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিয়েছি সম্পূর্ণ ছলনা করে, কিন্তু বলিরাজ তার সত্য ত্যাগ করেনি—ছলৈকুরত্তঃ ময়া ধর্মো নায়ং ত্যজতি সত্যবাক্। বামন-বিষ্ণু বলিকে জায়গা দিলেন সুতলে, পৃথিবীর নিম্নদেশের সপ্ততলের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটিতে। তাঁকে সবিনয়ে প্রায় লজ্জিত হয়েই বললেন—সাবর্ণি মনুর অন্তর হলেই সেই মন্বন্তরে স্বর্গের ইন্দ্র হবে তুমি, কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত তুমি সুতলে থাকো। আমার সুদর্শন-চক্র তোমাকে সবরকম সুরক্ষা দেবে এবং আমিও আমার অনুচরদের নিয়ে সব সময় তোমার কাছাকাছি থাকব—সদা সন্নিহিতং বীর তত্র মাং দ্রক্ষ্যসে ভবান্।
পৌরাণিকরা বুঝিয়ে দিলেন—বামন-বিষ্ণু দেবতাদের অধিকার ফিরিয়ে দিলেন বটে, সমস্ত জগৎকে তিনি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর সর্বব্যাপক ভূমার মহিমা, কিন্তু তাঁর সেই তৃতীয় পদ—যে পদের মধ্যে বৈদিকদের মধু মেশানো আছে, যে পদের মহিমায় আকাশ চক্ষুর মতো—শুধু জ্ঞানীরা যে পরম পদকে ধ্যানযোগে দেখতে পান, সেই পরম পদের স্থান হল দৈত্যের মাথায়। এবং সে পরম পদ স্থাপনের জন্য ভগবানের কত কাণ্ড, যিনি ভ্রকুটীটিমাত্রে জগৎ সংহার করতে পারেন, তিনি আপন পদ মর্ত্য মানুষের মাথায় রাখবেন বলে নেমে আসছেন ভুঁয়ে। ভগবান হয়ে তিনি ছলনা-চাতুরি করে মিথ্যা কথা বলছেন শরণাগত বলিরাজের মাহাত্ম্য বাড়ানোর জন্য। রসিক-সুজনেরা বলছেন—রসশাস্ত্রের এই তো আরম্ভ। স্বয়ং ভগবান তাঁর বিশাল ব্যাপ্তির আত্মারাম অধিকার নিয়ে আর তৃপ্ত থাকতে পারছেন না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলেছে—বিশাল সেই অদ্বৈত ব্যাপ্তি নিয়েও সেই পরম পুরুষের আর ভালো লাগছিল না, কেননা একা একা ভালো লাগে না—স বৈ নৈব রেমে, যস্মাদ্ একাকী ন রমতে। নিজের অদ্বৈত ব্যাপ্তি মুছে দিয়ে এই তিনি বামন হয়ে নেমে এলেন ছুতোয়—আপন আস্বাদনের জন্য—আস্বাদনের জন্য দ্বিতীয় লাগে। তিনি যে এত বড়, এই তিন ভুবনের প্রভু, সেই প্রভুত্ব আস্বাদনের জন্যও একটা মানুষ লাগে, যাঁর মাথায় নিজে সেধে রাখতে হয় সেই মধুস্যন্দী চরণ—তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদ্ম—এবং মানুষ বলবে—তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে/ তুমি তাই এসেছ নিচে/ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর/ তোমার প্রেম হত যে মিছে।