যেভাবে মৎস্যাবতারের সূচনা হয়েছে, তার প্রথম বিশদ বর্ণনা আছে মৎস্য পুরাণের মধ্যেই, যদিও তার প্রাচীন উপাখ্যান-কল্পটি মৎস্যাবতারের মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে কেননা, সেই উপাখ্যান আছে বেদের অভিন্ন গ্রন্থনা শতপথ ব্রাহ্মাণের মধ্যে।
শতপথ ব্রাহ্মাণের বৈদিক ভাষায় ঘটনাটা একেবারেই মেদ বর্জিত, তথ্য নিবেদনের মতো। শতপথ বলেছে—সকালবেলায় সূর্যপুত্র মনু অর্থাৎ আমাদের মনু-মহারাজ হাত ধুচ্ছিলেন, যেমন সকালবেলায় উঠে এই পৃথিবীর সকলেই হাত ধোয়া—মনবে হ বৈ প্রাতঃ অবনেজ্যম্ উদকম্ অজর্হ্রুঃ। মনু দু হাতের অঞ্জলি ভরে জল নিয়েছেন মুখে-চোখে জল দেবার জন্য, অমনি তাঁর হাতের অঞ্জলিতে কোথা থেকে একটা ছোট্ট মাছ এসে পড়ল—তস্য অবনেনিজানস্য মৎস্যঃ পানী আপেদে। আমাদের পৌরাণিকেরা অবশ্য এই সরল ঘটনাটার মধ্যে তাঁদের কালের স্বাদ-গন্ধ মিশিয়ে বলেছেন—পুরাকালে সূর্যপুত্র মনু ছেলের হাতে রাজ্য ছেড়ে তপস্যা করতে চলে গিয়েছিলেন। মলয়-পর্বতের এক পাশে স্থিত হয়ে কঠিন তপস্যা করার পর ব্রহ্মা তাঁকে দেখা দিয়ে বর দিতে চাইলে। মনু বললেন—আমি অন্য কিছু চাই না, শুধু এইটুকু আমি চাই যে, প্রলয়কালে যখন সব কিছু ধ্বংসের পথে যাবে, তখন যেন চরাচরে অখিল প্রাণীদের আমি রক্ষা করতে পারি—ভবেয়ং রক্ষণায়া লং প্রলয়ে সমুপস্থিতি। ব্রহ্মা ‘তথাস্তু’ বলে চলে গেলেন।
মনু একদিন সকালে উঠে হাত ধুচ্ছিলেন, যেমনটা সব মানুষই ধোয়—এই বাক্যটাও পৌরাণিকের বড় বেশি মেদমর্জিত মনে হওয়ায় তিনি বললেন—তারপর মনু একদিন তাঁর আশ্রমে পিতৃতর্পণ করছিলেন। সেই সময়ে তাঁর হাতের জলাঞ্জলিতে কোথা থেকে এসে পড়ল এক পুঁটিমাছের মতো শফরী। সেই ক্ষুদ্র মীন মনুর মতো বিশাল বিদ্বান মানুষকে প্রায় আদেশ দিয়ে বলল—কিছুদিনের মধ্যেই প্রলয়-প্লাবন নেমে আসবে পৃথিবীতে, সব ভেসে যাবে, ভেসে যাবে সকল প্রাণী, সেই প্লাবন থেকে আমি বাঁচাব তোমায়। এক ক্ষুদ্র মীন কথা বলছে, সে প্রলয়-প্লাবন থেকে মনুকে রক্ষা করার কথা বলছে, অতএব এই ক্ষুদ্র মীন যে সাধারণ কোনও শফরী-মাত্র নায় সেটা অবধারণ করেই মনু বললেন—তা কীভাবে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব আমি ? মৎস্য বলল-তুমি আপাতত আমাকে একটা কলস-পাত্রে রাখ, তারপর যখন আমি বড় হয়ে যাব, তখন ওই পাত্রে আর আমাকে ধরানো যাবে না, তখন একটা পুকুর খুঁড়ে সেখানে ছেড়ে দেবে আমাকে। দেখবে, সেখানেও যখন আমি ধরছি না, অনেক বড় হয়ে গিয়েছি, তখন আমাকে তুমি সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে আসবে, তাতেই আমি ধ্বংস থেকে বাঁচব—যদা তাম্ অতিবর্ধা অথ মা সমুদ্রম্ অভ্যবঽরাসি তর্হি বা অতিনাস্ত্রো ভবিতাস্মীতি।
শতপথ ব্রাহ্মণের বিবরণে সেই ক্ষুদ্র মীন খুব তাড়াতাড়িই এক বড় মাছ (ঋষ) হয়ে উঠল। মনু তাকে সমুদ্রেও রেখে আললেন এবং সেই মৎস্য বলল—সেই প্রলয় দিন কিন্তু শীঘ্রই আসবে। তুমি একটা নৌকো বানিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। যখন প্রলয়-তরঙ্গ উঠবে, তুমি তখন উঠে পড়বে নৌকায়, তখন আমিও আসব তোমাকে রক্ষা করতে—ঔঘে উত্থিতে নাবমাপদ্যাসৈ ততস্তা পারয়িষ্যামীতি। শতপথের এই কাহিনি মৎস্য পুরাণে প্রায় প্রথম থেকেই অবতার-প্রামাণ্যের ভবিষ্যদ্ যুক্তি হয়ে ওঠে। মনু-মহারাজ অঞ্জলি-বদ্ধ শফরীকে প্রথমে তাঁর কমণ্ডলুতে রেখেছিলেন, পরে কমণ্ডলু থেকে একটা মণিকে অর্থাৎ কলসির মতো মৃৎপাত্রে। সেখানে মাছ এক রাতেই তিন হাত লম্বা হয়ে গেল এবং বড় হয়েই সে চেঁচাতে লাগল –আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও, আমি তোমার শরণাগত জীব—স মৎস্যঃ পাহি পাহীতি ত্বামহং শরণং গতঃ।
পুরাণের মৎস্য কাহিনীতে যেটা খুব খুব লক্ষণীয়ভাবে ধরা পড়ে, সেটা হল—অলৌকিক শক্তি এবং অলৌকিক বৃদ্ধি সম্পন্ন এই মৎস্যটি নিজের সুরক্ষার জন্য একটা মানুষের ওপর নির্ভর করছে। কমণ্ডলু থেকে মণিক, মণিকথেকে কূপ, কূপ থেকে গঙ্গা নদী, গঙ্গা থেকে সমুদ্র—অল্পতর জল থেকে বৃহৎ এবং বৃহত্তর এতগুলি জল-স্থানে মৎস্যের এই সংক্রমণের পুরো সময়টা জুড়ে তাঁর অলৌকিক আকার বৃদ্ধি অথচ প্রত্যেক বর্ধমান সময়ে এক জাগতিক মানুষের ওপর তাঁর নির্ভরতা—এই ‘ট্রেই্ট’গুলি বিরাট এবং অলৌকিকের সঙ্গে ক্ষুদ্র এবং লৌকিকের অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্কের সূচনা করে—এই সম্পর্কই ভবিষ্যতে ভগবান এবং ভক্তের পারস্পরিকতার অন্তরে পৌঁছবে। মৎস্য পুরাণে দেখচি, সে মৎস্য-শরীরে সমস্ত সমুদ্র পরিব্যাপ্ত হয়ে গেছে—যদা সমুদ্রমখিলং ব্যাপাসৌ সমুপস্থিতঃ। মনু তখন এই অলৌকিক বিভূতি দেখে ভয় পাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে বুঝতে পারছেন যে, এই ব্যাপ্ত রূপই ভগবান বিষ্ণুর অথবা জগৎকারণে ব্রহ্মের সর্বব্যাপ্ত বিশ্বরূপ। মনু তখনই বলে ফেললেন—আপনি নিশ্চয়ই সেই জগদ্ব্যাপী ভগবান, আপনি এখন এই বিপুল মৎস্য-শরীর ধারণ করে আমার ভয় উৎপাদন করছেন—জ্ঞাতস্ত্বং মৎস্যরূপেণ মাং খেদয়সি কেশব।
পুরাণের কথকতায় মৎস্য-শরীরের অবতার মাহাত্ম্য স্পষ্ট হয়ে যায় প্রথম থেকেই। মনুর ‘রিয়ালাইজেশন’ সম্পূর্ণ হতেই তাঁর সংজ্ঞা—মৎস্যরূপী জনার্দনাঃ। মনুকে তিনি বলেন—অচিরেই ‘সশৈল-বন-কাননা’ এই পৃথিবী জলে জলময় হয়ে যাবে। আমি দেবতাদের দিয়ে কেটি নৌকো তৈরি করিয়ে রেখেছি। প্রলয়-প্লাবন এলে তুমি স্বেজজ, উদ্ভিজ্জ এবং জরায়ুজ—সমস্ত প্রকারের প্রাণীকে এই নৌকায় করে আমার শৃঙ্গে বেঁধে রাখবে সেই নৌকো। এইভাবে তুমি নিজেও রক্ষিথ হবে এবং রক্ষা করবে অন্য প্রাণীদের। লক্ষণীয়, পুরাণে মনু একা নন। যে নৌকোর কথা বলা হচ্ছে, সেটা দেবতাদের শরীর দিয়ে তৈরি—নৌরিয়ং সর্বদেবানাং নিকায়েন বিনির্মিতা। এক অধ্যায় পরেই এই নৌকোর সংজ্ঞা হবে ‘বেদনৌকা’। বেদ মানে জ্ঞান। সেই জ্ঞান-গর্ভ নৌকোর মধ্যে সমস্ত প্রাণীর বীজরাশি স্থাপন করে সেই মৎস্য–দত্ত রজ্জু বেঁধে রাখতে হবে তাঁর শৃঙ্গে—বেদানাবমিমাং গৃহ্য সত্ত্ব-বীজানি সর্বশঃ। সেই বিশাল মৎস্য আরও একটা কথা বললেন। বললেন—তুমি থাকবে একা, দেবতারাও থাকবেন না তখন—একঃ স্থাস্যলি। তার মানে, আর যা কিছুই থাকবে তা বীজের প্রকারেই—ত্বয়া সার্ধমিদং বিশ্বং স্থাস্যতি অন্তরসংক্ষয়ে—এবং পুনরায় সৃষ্টি সময় আবার সেগুলির ব্যক্ত স্বরূপ তৈরি হবে। এইভাবে প্রলয়ান্তে চাক্ষুষ মনুর কাল শেষ হয়ে গেল—মৎস্য-দেব বলেছেন—আমি আবারও বেদসমূহ প্রবর্তিত করব—বেদান্ প্রবর্তয়িষ্যামি তৎসর্গাদৌ মহীপতে।
কবি জয়দেবের বিখ্যাত দশাবতার—স্তুতিতে পৌরাণিক পরম্পরাটাই শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে উঠল। তিনি বললেন—পৃথিবী যখন সেই ‘প্রলয়-পয়োধি-জলে’ নিমগ্ন হল, তখন তুমি মৎস্য-শরীরে বেদকে ধারণ করেছিলে, নিজের চরিত্রে ঘনিয়ে এনেছিলে জলে ভাসমান নৌকোর ভাব—আমাদের জন্যই নিজের কষ্ট গণ্য করোনি তুমি—ধৃতবানসি বেদম্। বিহিত-বহিত্র-চরিত্রম্ অখেদম্।