বিদ্যাপতি বৈষ্ণব কবি ছিলেন, বৈষ্ণব সাধক ছিলেন কিনা জানা নাই৷ অনেকের মত ইনি ছিলেন পঞ্চোপাসক ৷ তিনি কেবল রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার গানই লেখেননি ; তিনি অনেক বিষয়ে কাব্য-কবিতা লিখেছিলেন৷ নরনারীর প্রাকৃত অনুরাগের গানও তিনি লিখেছিলেন অনেক ৷ সেগুলোতে রাধা-কৃষ্ণের নাম নাই, এমন কি বৃন্দাবনের পটভূমিকাও নাই ৷ সেগুলোকেও সংগ্রাহকগণ বৈষ্ণব পদাবলীর অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন ৷ বাংলার পদকর্তারা প্রায় সকলেই সাধক-কবি ৷ তাঁরা জানতেন— তাঁদের দুর্লভ কবিশক্তিকে শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশে নিবেদন বা ব্রজলীলা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে বিনিয়োগ করা স্বধর্মচ্যুতি ৷ তাই তাঁদের “কানু বিনা গীত নাই ৷”
প্রশ্ন— গানমধ্যে কোন্‌ গান জীবের নিজ ধর্ম ?
উত্তর— রাধাকৃষ্ণের প্রেমকেলি যে গীতের কর্ম ৷ তাই তাঁরা তাঁদের দুর্লভ কবিশক্তিকে বিষয়ান্তরে নিয়োজিত করেননি ৷ ইহাতে বঙ্গসাহিত্যে বিষয়বৈচিত্র্য ও ভাববৈচিত্র্যের দিক্‌ থেকে হয়ত ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু পদাবলী-সাহিত্যের তথা প্রেমগীতি-রচনার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে ৷ গোবিন্দদাস ছিলেন একজন মহাকবি ৷ তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন শাক্ত, তাই তিনি প্রথম জীবনে হরগৌরীর স্তবও লিখেছিলেন৷ তিনি ভক্তই ছিলেন, তিনি নিজস্ব ভক্তিধারাকে শাক্তপথ হইতে বৈষ্ণবপথে প্রবর্তিত করেছিলেন ৷ তিনি যদি বৈষ্ণবধর্ম আশ্রয় না করতেন— তাহলে হয়ত তাঁর কাছ থেকে আমরা নানা বিষয়ের কবিতাও পেতে পারতাম ৷ কিন্তু তিনি পিতৃধর্ম পরিত্যাগ করে বৈষ্ণব হওয়ার পর আর অন্য বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করেননি, করলেও সে রচনার নিদর্শন আমরা পাইনি৷
তাঁর যে অসামান্য কবিশক্তি গঙ্গার বাহন হতে পারত, তাহা যমুনার অগাধ জলসঞ্চারী রোহিত হয়েই থাকল ৷
প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের অন্যান্য শাখা থেকেও বোঝা যায়, ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ই প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের একমাত্র বিষয়বস্তু ছিল ৷ তাহা হইতেও ধরে নেওয়া যেতে পারে, বৈষ্ণব কবিরা তাঁদের অসাধারণ কবিশক্তি ব্রজলীলা ও গৌরলীলা ছাড়া অন্য বিষয়ে প্রয়োগ করেননি৷ বোধ হয়, ইঁহারা মনে করতেন— এই দুই লীলা ছাড়া আর সবই অনিত্য ৷ অনিত্য বিষয়ে কবিশক্তির প্রয়োগ শক্তির অপব্যবহার । যা অনিত্য, যা ধর্মমূলক নয়, তাকে আশ্রয় করলে রচনা স্থায়ীও হবে না ৷ বোধ হয়, বিষয়ান্তর অর্থাৎ অনিত্য বিষয়ের চিন্তায় তাঁরা রসও পেতেনে না ৷ সেটি হয়ত তাঁদের চিত্তে রসসৃষ্টির কোন প্রেরণাই দিত না৷ অসাধারণ কবিপ্রতিভা যে অনিত্য বস্তুকেও নিত্য বস্তুতে পরিণত করতে পারে, হয়ত এ ধারণা তাঁদের ছিল না৷
শব্দালঙ্কার ও প্রাণহীন অর্থালঙ্কারের আতিশয্য বহু সংস্কৃত কাব্যকে দুষ্পাঠ্য করে তুলেছে৷ বৃন্দাবনলীলা, যা হৃদয়মাধুর্যের মহামহোৎসব, তাতে ঐ শ্রেণীর আলঙ্কারিক আতিশয্য আমরা প্রত্যাশা করিনি৷ কিন্তু বহু পদে আমরা ক্লিষ্ট কল্পনার ও শ্লিষ্ট জল্পনার আলঙ্কারিক প্রাধান্য দেখতে পাই৷ রূপবর্ণনার তো কথাই নাই— অভিসার, বিহার, মান ইত্যাদির বর্ণনাতেও আলঙ্কারিক চাতুর্যের পারিপাট্য খুব বেশি ৷ এছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে বক্রোক্তি ও শ্লেষের আতিশয্য দৃষ্ট হয় ৷ অনেক পদ স্বাধীন ভাবাবেগের বাণীরূপ নয়— রসশাস্ত্রের অনুশাসনেই পরিকল্পিত৷ মনে হতে পারে যে সব কবি প্রকৃত বৈষ্ণব ছিলেন না, তাঁরাই এইভাবে আলঙ্কারিক কৃতিত্ব দেখাতেন ৷ কিন্তু একথাও সত্য নয়৷ বিদ্যাপতি, রূপ ও গোবিন্দদাসের মত ভক্ত কবিও তাঁদের রচনাগুলিতে আলঙ্কারিক চাতুর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন ৷ প্রশ্ন হতে পারে তৃণাদপি সুনীচ বৈষ্ণব ভক্তেরা এই কৃতিত্ব দেখা্নোর লোভ সংবরণ করতে পারেননি কেন ?
এর একটা উত্তর আছে৷ ভক্ত কবিরা আলঙ্কারিক কলাচাতুর্য সৃষ্টিকেও উপাসনা বা সাধনার অঙ্গীভূত মনে করতেন ৷ গায়ক-ভক্ত যেমন কলাকৌশলময় সঙ্গীতের দ্বারা, নটী-উপাসিকা বা দেবদাসী যেমন নৃত্যের দ্বারা, সুবাদক যেমন বাদ্যের দ্বারা উপাসনা করে, জগদানন্দের মত কবিরাও তেমনি ভাষা-ছন্দের মণ্ডনশিল্পের দ্বারা উপাসনা করেছেন ৷ যার যা সম্বল, যার যা শক্তি ভগবানের উদ্দেশ্যে তার সমর্পণই উপাসনা ৷ দেবতার শৃঙ্গারবেশরচনা যেমন পরিচর্যা বা উপাসনার অঙ্গ, লীলাবর্ণনায় আলঙ্কারিক চাতুর্যসৃষ্টিও তেমনি সাধক-কবিদের ছিল সাধনারই অঙ্গ ৷ যাঁর এই রসচাতুর্যসৃষ্টির শক্তি আছে, যাঁর বিধিদত্ত সৌকণ্ঠ্য আছে, তিনি যদি তা রাধাশ্যামের সেবায় নিবেদন না করেন— তা হলে সেবাপরাধ হবে, কবিদের সম্ভবতঃ এই ধারণা ছিল ৷
শুধু কাব্য ও সঙ্গীত নয়, রূপ গোস্বামী যে রসশাস্ত্রের গ্রন্থ লিখেছিলেন— তাও তিনি শ্রীকৃষ্ণেরই সেবা বলেই মনে করেছেন৷ গোস্বামী প্রভু উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থ সমাপন করে বলেছেন—
‘হে দেব, দুর্গম মহাঘোষ সাগরোৎপন্ন এই উজ্জ্বলনীলমণি আপনার মকরকুণ্ডল পরিসরে সেবকজনোচিত ভজনা করুক৷’
গোস্বামী প্রভুদের অলঙ্কারকৌস্তুভ, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, ভক্তিরসামৃতশেষ ইত্যাদি অলঙ্কারের পুস্তকে প্রত্যেক দৃষ্টান্তটি রাধাকৃষ্ণের লীলা অবলম্বনে রচিত ৷
হরিনামামৃত ব্যাকরণ শুধু ব্যাকরণবিদ্যা শিক্ষাদানের জন্য নয়— হরিনামে দীক্ষাদানের জন্যও ৷ হরিভক্তিপ্রচারের জন্য ও বৈষ্ণবসমাজকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য হরিভক্তিবিলাস নামে স্মৃতিগ্রন্থও রচিত হয়েছিল ৷ এইভাবে এই সকল বৈষ্ণবাচার্যগণ নানাবিদ্যার গ্রন্থ রচনাচ্ছলেও শ্রীকৃষ্ণেরই ভজনা করেছেন ৷
তাঁদের বিবিধবিষয়ক বিদ্যা যেন ভারস্বরূপ হয়ে উঠেছিল,— চিরসুন্দরকে নিবেদন করে তাঁরা ভারমুক্ত হয়েছেন ৷ বিদ্যার নৈবেদ্য যেন ভক্তির তুলসীপত্রে সুবাসিত হয়ে দেবপ্রসাদরূপে ভক্তজনের আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে ৷