যমুনা কিনারে

এ সখি পেখলুঁ এক অপুরূপ

এ সখি পেখলুঁ এক অপুরূপ।
সুনইত মানবি সপন সরূপ।।
কমল জুগল পর চাঁদক মাল।
তাপর উপজল তরুণ তমাল।।
তাপর বেঢ়ল বিজুরিলতা।
কালিন্দি তীর ধীর চলি জাতা।।
সাখাসিখর সুধাকর পাঁতি।
তাহি নব পল্লব অরুনক ভাঁতি।।
বিমল বিম্বফল জুগল বিকাস।
তাপর কীর থীর করু বাস।।
তাপর চঞ্চল খঞ্জন জোর।
তাপর সাপিনি ঝাঁপল মোর।।
এ সখি রঙ্গিনি কহল নিসান।
হেরইতে পুনি হমে হরল গিআন।।
করি বিদ্যাপতি এহ রস ভান।
সুপুরুখ মরম তুহুঁ ভল জান।

অন্তঃকথন:
শ্যাম সন্দর্শনের পর শ্রীমতী সখীদের কাছে সেই অনুপম অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছেন! কিন্তু গুরুজন মাঝে সবার সামনে কি করেই বা নিজের মনের আবেগ প্রকাশ করেন!সখীদের কাছে কোন মুখে প্রিয়রূপ ব্যাখান করেন! তাই রাধিকা আন কথার আড়ালে কৃষ্ণ কথা বলে চলেন। রাই বলছেন, সই, সে কী এক অপরূপ দৃশ্য দেখলাম! শুনলে মনে হবে যেন স্বপ্ন। দেখলাম যুগল কমলের ওপর চাঁদের মালা, তার ওপর তরুণ তমাল তরু উৎপন্ন হয়েছে, সেই তরুতে আবার বিজলীলতা বেষ্টন করে আছে। এমন অদ্ভুত সে তরু আবার কালিন্দী তীর ধরে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। সেই তমাল তরুতে সূর্যের আভার মত নব পল্লব, আর শাখার শিখরে সুধাকর পংক্তি। আর জানো সেই তমাল তরুতে যুগল বিম্ব ফল ফলেছে! ভাবতে পারো সেই বিম্ব ফলের ওপর শুক পাখি স্থির হয়ে বসে আছে। তার ওপর এক জোড়া চঞ্চল খঞ্জন, আর তারও ওপরে ময়ূরের পুচ্ছ সাপিনীকে ঢেকে রেখেছে। এতেক বলে শ্রীমতী উচ্চারণ করলেন যে তিনি যা বলেছেন সকলই সঙ্কেত বাক্য। শ্রীমতীর সখীরাও তো রঙ্গ পরায়ণ, তাই সেই রঙ্গিনি সখীকে এই দৃশ্য দেখে তাঁর বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলার কথাও বললেন রাধিকা। রূপক অলঙ্কারের আড়ালে আসলে এই পদে কী বললেন শ্রীমতী? রাধারানী বললেন, কালিন্দী তীরে তিনি চলমান শ্যামল তমাল তরুর মত শ্যামকে দেখেছেন! তাঁর যুগল চরণকমলের ওপর নখচন্দ্রমার মালা। আর সেই শ্যাম-তমাল তরুর অঙ্গ ঘিরে ছিল বিজুরিরেখার মতন পীতবসন। তা সেই পীতবসন বনমালী যাকে কিনা শ্রীমতী বলছেন বিজলিরেখায় জড়ানো তমাল তরু, সেই তরুর অরুণাভ নবপল্লব তো আসলে মাধবের দুটি বিভাময় করতল, সেই করতল শিখরে সুধাকর নখর পংক্তি। এখন এই শ্যাম-তমালে বিম্ব ফলের মত রস-মধুর দুটি ওষ্ঠাধর শ্রীমতীর নজরে পড়বে না তা কি হয়? আর সেই বিম্বৌষ্ঠের ওপরে শুকপাখির মত মাধবের তীক্ষ্ণ নাসা অচঞ্চল। শুক-নাসা অচঞ্চল হলে কি হবে নয়ন-খঞ্জন দুটি যে সদা চঞ্চল! আর তারও ওপরে সাপিনীর মত শ্যামের কেশপাশ যে ময়ূর পুচ্ছে শোভিত! মনে কি হয় না ময়ূরের ভয়ে কেশসর্প বাঁধা পড়ে আছে? এমন রূপ দেখে শ্রীমতী তো হৃদয় হারাবেনই! বিদ্যাপতি বলছেন এমন সুপুরুষের মর্ম একমাত্র তুমিই জানো শ্রীরাধিকা! এই পদটি ভাবমাধুর্যে ও গঠন সৌকর্যে অনুপম! রাজসভার কবি বিদ্যাপতির অলংকার খচিত, রত্ন ঝলমল এই পদ। অতিশয়োক্তি অলংকারের চমৎকার নিদর্শন পদটি। এখানে উপমেয় শ্রীকৃষ্ণকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে উপমান তমালতরু। কিন্তু সবচাইতে বড় কথা এত অলংকারের ঝলসানিতে পদটির ভাবরূপ বিন্দুমাত্র খণ্ডিত তো হয়ই নি বরং শতগুণে বেড়ে গেছে! এখানেই বিদ্যাপতির কৃতিত্ব।।

পদকর্তা:বিদ্যাপতি
রাগ:অজ্ঞাত
তাল:অজ্ঞাত
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী