যমুনা কিনারে

খোঁপা পরতেখ মোর ত্রিদশ ঈশ্বর হর

খোঁপা পরতেখ মোর ত্রিদশ ঈশ্বর হর
কেশপাশে নীল বিদ্যমানে। এআ।
সিসের সিন্দুর সূর ললাটে তিলক চাঁদ
নয়নত বসএ মদনে ।।এআ।।
সুণ বড়ায়ি ল
বোল গিআঁ গোবিন্দক বাতে।এআ।
তীন ভূবন বীর রাখএ যৌবন ধন
কি করিতেঁ পারে জগন্নাথে ।। (এআ।।) ধ্রু।।
নাসা বিনতানন্দন পাণ্ডু গণ্ডু পাশে কণ্ণ
বিম্বওষ্ঠ পুষ্পদন্ত সঙ্গে।
কুচযুগ যুধিষ্ঠির বাহু নিতম্ব যুগলে
মাঝ দেশে সিংহ বিদ্যমানে।।
জঘনে বসে নূপুর আতিশয় রুচি গুরু
পদনখ নক্ষত্রগণে।।
হাথে ধরী ধনু বাণে কাহ্ন আসু বিদ্যমানে
তভোঁ তাক নাহিঁ মোর ডরে।
বোল দূতা কাহ্ন পাশে গাইল বড়ু চণ্ডীদাসে
দেবী বাসলীর বরে।।

অন্তঃকথন:
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বস্ত্রহরণ খন্ডে ভগবান কৃষ্ণ লীলাচ্ছলে রাধারানী সহ সকল গোপীদের বস্ত্রহরণ করে লুকিয়ে রাখলেন। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর কাপড়্গুলি ফিরিয়ে দিলেও রাধারানীর হারটি কানাই কিছুতেই দিলেন না। তখন ক্রূদ্ধা রাধারানী মাতা যশোদার কাছে গিয়ে কৃষ্ণের নামে নালিশ জানালেন। রাধার মুখে এ হেন অভিযোগ শুনে মাতা যশোমতী পুত্রকে ডেকে তিরষ্কার করলেন। কাহ্ন মায়ের কাছে কিছুতেই দোষ স্বীকার করেন না, উল্টে বলেন দোষ রাধারই। মায়ের সম্মুখে যাই বলুন না কেন রাধিকা গিয়ে যশোদার কাছে নালিশ করাতে কৃষ্ণ তো মনে মনে অতিশয় ক্রূদ্ধ হয়ে উঠলেন। ভাবতে লাগলেন কিকরে রাধা রানীকে শাস্তি দেওয়া যায়! বাণ খন্ডে দেব দামোদর বড়াই এর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন তিনি পুষ্পধনু থেকে পঞ্চ ফুলবাণ নিক্ষেপ করবেন রাধিকার উদ্দেশ্যে। যেমন কর্ম তার উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু এতবড় শাস্তি দেওয়ার আগে অপরাধীকে ক্ষমা চাওয়ার একটা সুযোগ ও তো দিতে হয়! তাই বড়াই গিয়ে শ্রীমতীকে জানালেন অপমানিত কানাই কিন্তু তোমাকে পুষ্প শর হানবেন বলে ঠিক করেছেন, তুমি এখন শীঘ্র গিয়ে তার পায়ে ধরো। বড়াই এর কথা শুনে রাধারানী কিন্তু মোটেই ভয় পেলেন না। আপন দীপ্ত অহংকারে তিনি বড়াই কে এই গানে বললেন- আমার খোঁপা প্রত্যক্ষ দেবের দেব মহাদেব, আমার কেশপাশে সুগ্রীব সেনাপতি নীল বিদ্যমান,আমার সিঁথির উজ্জ্বল রক্তবর্ণ সিন্দুর আসলে সূর্য আর কপালের তিলক শুভ্র তিলক চন্দ্র। আমার দুই নয়নে স্বয়ং মদনদেব অবস্থান করছেন, মানে কিনা আমার কটাক্ষই মদন বাণ স্বরূপ। অর্থাৎ কৃষ্ণের মদন শর আমার কিই বা করতে পারে? রাধিকা বড়াইকে বললেন, শোনো বড়াই কৃষ্ণকে গিয়ে বলো যে আমার যৌবনধন ত্রিভূবনের শ্রেষ্ঠ বীরসকল রক্ষা করছেন, জগন্নাথ সেখানে কি ক্ষতি করবেন। জেনে রাখো আমার তীক্ষ্ণ নাসিকা রক্ষা করছেন বিনতা নন্দন গরুড়, পান্ডুবর্ণ গন্ড দেশের রক্ষক মহারাজ পাণ্ডু, বরূণ পাশ কর্ণ দ্বয়ের এবং গন্ধর্বরাজ পুষ্পদন্ত বিম্বৌষ্ঠের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। আমার কুচযুগে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির,দীর্ঘ দন্ডবৎ বাহুতে দন্ডধারী যম এবং অঙ্গে সুগ্রীব সানন্দে বসবাস করেন। অর্থাৎ তাঁরা সকলে আমার রক্ষাকর্তা। এছাড়াও আমার নাভিদেশে দৈত্যপতি বলি, নিতম্বযুগলে বেণপুত্র পৃথু এবং ক্ষীন কটিদেশে সিংহ বাস করেন। কি মনোহর ভাবে বললেন শ্রীমতি গুরুভার নিতম্ব যুগল তাঁর পৃথু অর্থাৎ পৃথুল আর ক্ষীন কটি সেতো পশুরাজ সিংহেরই হয়, আর নাভিতলে তাঁর যে ত্রিবলি রেখা শোভমান। তাঁর পুরুষ্ট জঘনে যেন পুরুরাজ বাস করেন আর আর উজ্জ্বল পদনখে নক্ষত্ররাজির অধিষ্ঠান। এই ভাবে রাধিকা নিজমুখে নিজ রূপের ধার ও ভার বুঝিয়ে দিয়ে বড়াইকে বললেন, এই আমার সামনে যতই কানাই ধনুর্বাণ নিয়ে আসুক না কেন আমি কোন ভয় পাই না। এমন অহঙ্কার ভরা বানী রাধা বড়াইকে বললেন কৃষ্ণকে গিয়ে বলতে। একদিকে আনঙ্গধনু হস্তে টংকারোদ্যত ভগবান কৃষ্ণ আর অন্যদিকে গরবিনী সাক্ষাৎ মদন স্বরূপা রাধারানী।এই নাহলে কৃষ্ণলীলা জমবে কেন? এই গানটির বিশেষত্ব রাধারানীর নিজমুখে নিজ ঐশ্বর্য বর্ননা। শ্লেষ অলংকারের মধ্যে দিয়ে কবি শ্রীমতির প্রতিটি অঙ্গের সৌন্দর্য বর্ননা করতে গিয়ে প্রতি অঙ্গের রক্ষকের কথাও বর্ননা করেছেন। আসলে রাধারানীর ঐ অতুল রূপরাশিই তো তাঁর অস্ত্র স্বরূপ,তাঁর অঙশোভাই তো তাঁর রক্ষক ! পুষ্প শরে তাঁর ভয় কি?

পদকর্তা:বড়ু চন্ডীদাস
রাগ:ধানুষী
তাল:লঘুশেখর
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী