শ্রীশ্রী গুরু-পূর্ণিমা কীর্ত্তন

(শ্রীশ্রীনিত্যানন্দপ্রভুর ব্যাসপূজা)

‘‘শ্রীগুরু-প্রেমানন্দে নিতাই-গৌর-হরিবোল।।’’
‘‘ভজ নিতাই গৌর রাধে শ্যাম।
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।’’
জয় জয় সর্ব্ব-প্রাণনাথ বিশ্বম্ভর।’’

প্রাণভরে জয় দাও ভাই

প্রাণের প্রাণ গৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
শচীদুলাল-গৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই

‘‘জয় নিত্যানন্দ-গদাধরের ঈশ্বর।।
জয় জয় অদ্বৈতাদি-ভক্তের অধীন।
ভক্তিদান দেহ প্রভু উদ্ধারহ দীন।।’’

উদ্ধার করহ দীনে

প্রাণ-বিশ্বম্ভর নিজগুণে—উদ্ধার করহ দীনে
দীন-বৎসল গৌরহরি—উদ্ধার করহ দীনে
প্রাণের প্রাণ গৌরহরি—উদ্ধার করহ দীনে
অবিচারে,–নিজ-প্রেম-ভক্তি-দানে—উদ্ধার করহ দীনে
অযোগ্যতা জানি মনে—উদ্ধার করহ দীনে

একবার,–চাও হে করুণা-নয়নে
একবার,–তাও হে করুণা-নয়ন-কোণে

কলিহত-জীবের পানে—একবার,–চাও হে করুণা-নয়ন-কোণে

‘‘ভক্তিদান দেহ প্রভু উদ্ধারহ দীন।।
এই-রূপে নবদ্বীপে প্রভু বিশ্বম্ভর।
ভক্তিসুখে ভাসে লই সর্ব্ব-অনুচর।।
প্রভু-সঙ্গে মিলিলা সকল ভক্তগণ।
মহানন্দে অহনিশি করয়ে কীর্ত্তন।।
মিলিলা সকলভক্ত বই নিত্যানন্দ।
ভাই না দেখিয়া বড় দুঃখী গৌরচন্দ্র।।
নিরন্তর নিত্যানন্দ স্মরে বিশ্বম্ভর।
জানিলেন নিত্যানন্দ-অন্তর ঈশ্বর।
প্রসঙ্গে শুনহ নিত্যানন্দের আখ্যান।
সূত্ররূপে জন্ম কর্ম্ম কিছু কহি তান।।
রাঢ়-মাঝে একচাকা নামে আছে গ্রাম।
যঁহি জন্মিলেন নিত্যানন্দ ভগবান্‌।।
মৌড়েশ্বর নামে দেব আছে কতদূরে।
যাঁরে পূজিয়াছে নিত্যানন্দ-হলধরে।।
সেই-গ্রামে বৈসে বিপ্র হাড়াই-পণ্ডিত।
মহা-বিরক্তে প্রায় দয়ালু চরিত।।
তাঁর পত্নী পদ্মাবতী-নাম পতিব্রতা।
পরম-বৈষ্ণবী-শক্তি সেই জগন্মাতা।।
পরম-উদার দুই ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী।
তাঁর ঘরে নিত্যানন্দ জন্মিলেন আপনি।।
সকল পুত্রের জ্যেষ্ঠ নিত্যানন্দরায়।
সর্ব্ব সুলক্ষণ দেখি নয়ন জুড়ায়।।
তান বাল্য-লীলা আদিখণ্ডে সে বিস্তার।
এথায় কহিলে হয় গ্রন্থ বহুতর।।
এই মত কথো দিন নিত্যানন্দরায়।
হাড়ো-পণ্ডিতের ঘরে আছেন লীলায়।।
গৃহ ছাড়িবারে প্রভু করিলেন মন।
না ছাড়ে জননী-তাত দুঃখের কারণ।।
তিলমাত্র নিত্যানন্দ না দেখিলে মাতা।
যুগপ্রায় হেন বাসে ততোঽধিক পিতা।।
তিলমাত্র নিত্যানন্দ-পুত্রেরে ছাড়িয়া।
কোথাও হাড়াই-ওঝা না যায় চলিয়া।।
কিবা কৃষিকর্ম্মে কিবা যজমান-ঘরে।
কিবা হাটে কিবা ঘাটে যত কর্ম্ম করে।।
পাছে যদি নিত্যানন্দচন্দ্র চলি যায়।
তিলার্দ্ধে শতেকবার উলটিয়া চায়।।
পাছে যদি নিত্যানন্দচন্দ্র চলি যায়।
তিলার্দ্ধে শতেকবার উলটিয়া চায়।।
ধরিয়া ধরিয়া পুনঃ আলিঙ্গন করে।
ননীর পুতলি যেন মিলায় শরীরে।।
এইমত পুত্রসঙ্গে বুলে সর্ব্বঠাঁই।
প্রাণ হইলা নিত্যানন্দ শরীর হাড়াই।।
অন্তর্য্যামী নিত্যানন্দ ইহা সব জানে।
পিতৃসুখ-ধর্ম্ম পালি আছে পিতা-সনে।।
দৈবে একদিন এক সন্ন্যাসী সুন্দর।
আইলেন নিত্যানন্দ-জনকের ঘর।।
নিত্যানন্দ-পিতা তানে ভিক্ষা করাইয়া।
রাখিলেন পরম-আনন্দ-যুক্ত হৈয়া।।
সর্ব্বরাত্রি নিত্যানন্দ-পিতা তাঁর সঙ্গে।
আছিলেন কৃষ্ণ-কথা-কথন-প্রসঙ্গে।।
গন্তুকাম সন্ন্যাসী হইলা উষা-কালে।।
নিত্যানন্দ-পিতা-প্রতি ন্যাসিবর বোলে।।
সন্ন্যাসী বোলে এক ভিক্ষা আছয়ে আমার।
নিত্যানন্দ-পিতা বোলে, যে ইচ্ছা তোমার’।।
ন্যাসী বোলে করিবাঙ তীর্থ পর্য্যটন।
সংহতি আমার ভাল নাহিক ব্রাহ্মণ।।
এই যে সকল-জ্যেষ্ঠ-নন্দন তোমার।
কথোদিন লাগি দেহ সংহতি আমার।।
প্রাণ-অতিরিক্ত আমি দেখিব উহানে।
সর্ব্বতীর্থ দেখিবেন বিবিধ-বিধানে।।
শুনিয়া ন্যাসীর বাক্য শুদ্ধ-বিপ্রবর।
মনে মনে চিন্তে বড় হইয়া কাতর।।
প্রাণ ভিক্ষা করিলেন আমার সন্ন্যাসী।
না দিলেও ‘সর্ব্বনাশ হয়’ হেন বাসি।।
ভিক্ষুকেরে পূর্ব্বে মহাপুরুষ-সকল।
প্রাণ দান দিয়াছেন করিয়া মঙ্গল।।
রামচন্দ্র-পুত্র দশরথের জীবন।
পূর্ব্বে বিশ্বামিত্র তানে করিলা যাচন।।
যদ্যপিহ রাম-বিনে রাজা নাহি জীয়ে।
তথাপি দিলেন—এই পুরাণেতে কহে।।
সেই ত বৃত্তান্ত আজি হইল আমারে।
‘‘এ ধর্ম্ম-সঙ্কটে কৃষ্ণ ! রক্ষা কর মোরে।।’’
দৈবে সেই বস্তু, কেনে নহিব সেমতি
অন্যতা লক্ষ্মণ কেনে গৃহেতে উৎপিত।।
চিন্তিয়া ব্রাহ্মণ গেলা ব্রাহ্মণীর স্থানে।
আনুপূর্ব্ব কহিলেন সব বিবরণে।।
শুনিয়া বলিলা পতিব্রতা জগন্মাতা।
যে তোমার ইচ্ছা প্রভু ! সেই মোর কথা।।
আইলা সন্ন্যাসি-স্থানে নিত্যানন্দ-পিতা।
ন্যাসীরে দিলেন পুত্র নোঙাইয়া মাথা।।
নিত্যানন্দ লই চলিলেন ন্যাসিবর।
হেনমতে নিত্যানন্দ ছাড়িলেন ঘর।।
নিত্যানন্দ গেলে মাত্র হাড়াই-পণ্ডিত !
ভূমিতে পড়িলা বিপ্র হইয়া মূর্চ্ছিত।।
যে বিলাপ ক্রন্দন কহিব কোনজনে।
বিদরে পাষাণ-কাষ্ঠ তাহার শ্রবণে।।
ভক্তি-রসে জড় প্রায় হইলা বিহ্বল।
লোকে বোলে ‘হাড়ো-ওঝা’ হইয়া পাগল।।
তিনমাস না করিলা অন্নের গ্রহণ।
চৈতন্য প্রভাবেসবে রহিল জীবন।।
প্রভু কেনে ছাড়ে যার হেন অনুরাগ ?
বিষ্ণু-বৈষ্ণবের এই অচিন্ত-প্রভাব।।
স্বামিহীন দেবহূতি-জননী ছাড়িয়া।
চলিলা কপিল প্রভু নিরপেক্ষ হইয়া।।
ব্যাস হেন বৈষ্ণব জনক ছাড়ি শুক।
চলিলা উলটি নাহি চাহিলেন মুখ।।
শচী-হেন জননী ছাড়িয়া একাকিনী।
চলিলেন নিরপেক্ষ হই ন্যাসিমণি।।
পরমার্থে এই-ত্যাগ ত্যাগ কভু নহে।
এ-সকল কথা বুঝে কোন মহাশয়ে।।
এ-সকল লীলা জীব-উদ্ধার-কারণে।
মহাকাষ্ঠ দ্রবে যেন ইহার শ্রবণে।।
যেন পিতা হারাইয়া শ্রীরঘুনন্দনে।
নির্ভয়ে শুনিলে তাহা কাঁদয়ে যবনে।।
হেনমতে গৃহ ছাড়ি নিত্যানন্দ-রায়।
স্বানুভাবানন্দে তীর্থ ভ্রমিঞা বেড়ায়।।
গয়া, কাশী, প্রয়াগ, মথুরা, দ্বারাবতী।
নরনারায়ণাশ্রম গেলা মহামতি।।
বৌদ্ধাশ্রম দিয়া গেলা ব্যাসের আলয়।
রঙ্গনাথ, সেতুবন্ধ, গেলেন মলয়।।
তবে অনন্তের পুর গেলা মহাশয়।
ভ্রমেণ নির্জ্জন-বনে পরম-নির্ভয়।।
গোমতী, গণ্ডকী, গেলা সরযু, কাবেরী।
অযোধ্যা, দণ্ডকবন, বুলেন বিহরি।।
ত্রিমল্ল, বেঙ্কটনাথ, সপ্ত গোদাবরী।
বেরা মাহিষ্মতী, মনুতীর্থ, হরিদ্বার।
যঁহি পূর্ব্বে অবতার হইল গঙ্গার।।
এইমত যত তীর্থ নিত্যানন্দ-রায়।
সব দেখি পুন আইলেন মথুরায়।।’’

প্রভু নিতাই আইলা ব্রজে

সর্ব্বতীর্থ ভ্রমণ করে—প্রভু নিতাই আইলা ব্রজে
‘সর্ব্বতীর্থ ভ্রমণ করে’—
যত কৃষ্ণের বিহার ভূমি—সর্ব্বতীর্থ ভ্রমণ করে
প্রাণের,–ভাই কৃষ্ণ খুঁজে খুঁজে—সর্ব্বতীর্থ ভ্রমণ করে

প্রভু নিতাই আইলা ব্রজে

‘‘সব দেখি পুন আইলেন মথুরায়।।
চিনিতে না পারে কেহো অনন্তের ধাম।
হুঙ্কার করয়ে দেখি পূ্র্ব্ব-জন্ম-স্থান।
নিরবিধি বাল্যভাবে, আন নাহি স্ফুরে।
ধূলাখেলা খেলে বৃন্দাবনের ভিতরে।।
আহারের চেষ্টা নাহি করয়ে কোথায়।
বাল্যভাবে বৃন্দাবনে গড়াগড়ি যায়।।
কেহো নাহি বুঝে তান চরিত্র উদার।
কৃষ্ণরস বিনে আর না করে আহার।।
কদাচিত কোনো দিনে করে দুগ্ধ-পান।
সেহো যদি অযাচিত কেহো করে দান।।
এইমতে বৃন্দাবনে বৈসে নিত্যানন্দ।
নবদ্বীপে প্রকাশ হইলা গৌরচন্দ্র।।
নিরন্তর সঙ্কীর্ত্তন— পরম আনন্দ।
দুঃখ পায় প্রভু না দেখিয়া নিত্যানন্দ।।
নিত্যানন্দ জানিলেন প্রভুর প্রকাশ।
যে অবধি লাগি করে বৃন্দাবনে বাস।।
জানিঞা আইলা ঝাট নবদ্বীপ-পুরে
আসিয়া রহিলা নন্দন-আচার্য্যের ঘরে।।
নন্দন-আচার্য্য মহাভাগবতোত্তম।
দেখি মহা তেজোরাশি যেন সূর্য্য-সম।।
মহা-অবধূত-বেশ প্রকাণ্ড শরীর।
নিরবধি-গতি-স্থান দেখি মহা-ধীর।।
অহর্নিশি বদনে বোলয়ে কৃষ্ণনাম।
ত্রিভুবনে অদ্বিতীয় চৈতন্যের ধাম।।
নিজানন্দে ক্ষণে ক্ষণে করয়ে হুঙ্কার।
মহামত্ত যেন বলরাম-অবতার।।
কোটিচন্দ্র জিনিঞা বদন মনোহর।
জগত-জীবন হাস সুরঙ্গ অধর।।
মুকুতা জিনিঞা শ্রীদশনের জ্যোতি।
আয়ত অরুণ দুই লোচন-সুভাঁতি।।
আজানু-লম্বিত ভুজ, সুপীবর-বক্ষ।
চলিতে কমলবত পদযুগ দক্ষ।।
পরম-কৃপায়ে করে সভারে সম্ভাষ।
শুনিলে শ্রীমুখ-বাক্য কর্ম্ম-বন্ধ-নাশ।।
আইলা নদীয়াপুরে নিত্যানন্দ-রায়।
সকল-ভুবনে জয়জয়ধ্বনি গায়।।
সে মহিমা বোলে হেন কে আছে প্রচণ্ড।
যে প্রভু ভাঙ্গিলা গৌরসুন্দরের দণ্ড।।
বণিক অধম মূর্খ যে করিলা পার।
ব্রহ্মাণ্ড পবিত্র হয় নাম লৈলে যাঁর।।
পাইয়া নন্দনাচার্য্য হরষিত হৈয়া।
রাখিলেন নিজগৃহে ভিক্ষা-করাইয়া।।
নবদ্বীপে নিত্যানন্দ-চন্দ্র-আগমন।
ইহা যেই শুনে তারে মিলে প্রেমধন।।
নিত্যানন্দ-আগমন জানি বিশ্বম্ভর।
অনন্ত-হরিষ প্রভু হইলা অন্তর।।
পূর্ব্ব ব্যপদেশে সর্ব্ব-বৈষ্ণবের স্থানে।
ব্যঞ্জিয়া আছেন, কেহ মর্ম্ম নাহি জানে।।
‘আরে ভাই দিন দুইতিনের ভিতরে।
কোন মহাপুরুষ এক আসিব এথারে’।।
দৈবে সেইদিন বিষ্ণু পূজি গৌরচন্দ্র।
সত্বরে মিলিলা যথা বৈষ্ণবের বৃন্দ।
সভাকার স্থানে প্রভু কহয়ে আপনে।
‘আজি আমি অপরূপ দেখিলুঁ স্বপনে।।
তালধ্বজ এক রথ—সংসারের সার।
আসিয়া রহিলা রথ—আমার দুয়ার।।
তার পাছে দেখি এক প্রকাণ্ড-শরীর।
মহা এক স্তম্ভ কান্ধে, গতি নহে স্থির।।
বেত্র-বান্ধা এক কাণা-কুম্ভ বাম-হাথে।
নীলবস্ত্র-পরিধান, নীলবস্ত্র মাথে।।
বাম-শ্রুতিমূলে এক কুণ্ডল বিচিত্র।
হলধর হেন তান বুঝিয়ে চরিত্র।।
এই বাড়ী নিমাই পণ্ডিতের হয়ে হয়ে।
দশবার বিশবার এই কথা কহে।।
মহা-অবধূত-বেশ পরম প্রচণ্ড।
আর কভু নাহি দেখি এমন উদ্দণ্ড।।
দেখিয়া সম্ভ্রম বড় পাইলাঙ আমি।।
জিজ্ঞাসিল আমি, কোন মহাজন তুমি ?’।।
হাসিয়া আমারে বোলে এই ভাই হয়ে।
তোমার আমার কালি হৈব পরিচয়ে।।
হরিষ বাঢ়িল শুনি তাহার বচন।
আপনারে বাসোঁ মুঞি যেন সেই সম।।
কহিতে প্রভুর বাহ্য সব গেল দূর।
হলধর-ভাবে প্রভু গর্জ্জয়ে প্রচুর।।
‘মদ আন মদ আন’ বলি প্রভু ডাকে।
হুঙ্কার শুনিতে যেন দুই কর্ণ ফাটে।।
শ্রীবাসপণ্ডিত বোলে শুনহ গোসাঞি।
যে মদিরা চাহ তুমি, সে তোমার ঠাঞি।।
তুমি যারে বিলাও, সে-ই সে তারে পায়।
কম্পিত সকল-গণ, দূরে রহি চায়।।
মনেমনে চিন্তে সব বৈষ্ণবের গণ।
‘অবশ্য ইহার কিছু আছয়ে কারণ।।
আর্য্যা তর্জ্জা পাঢ়ে প্রভু অরুণ-নয়ন।
হাসিয়া দোলায় অঙ্গ—যেন সঙ্কর্ষণ।।
ক্ষণেকে হইলা প্রভু স্বভাব-চরিত্র।
স্বপ্ন-অর্থ সভারে বাখানে রামমিত্র।।
হেন বুঝি মোর চিত্তে লয় এই কথা।
কোন মহাপুরুষেক আসিয়াছে এথা।।
পূর্ব্বে মুঞি বলিয়াছোঁ তোমা সভার স্থানে।
কোন মহাজন-সনে হৈব দরশনে।।
চল হরিদাস চল শ্রীবাস-পণ্ডিত।
চাহ গিয়া দেখি কে আইলা কোন ভিত’।।
দুই মহাভাগবত প্রভুর আদেশে।
সর্ব্ব-নবদ্বীপ চাহি বুলয়ে হরিষে।
চাহিতে চাহিতে কথা কহে দুই-জন।
‘এ বুঝি আইলা কিবা প্রভু সঙ্কর্ষণ’।।
আনন্দে বিহ্বল দুঁহে চাহিয়া বেড়ায়।
তিলার্দ্ধেকো উদ্দেশ কোথাও নাহি পায়।।
সকল নদীয়া তিন-প্রহর চাহিয়া।
আইলা প্রভুর স্থানে কাহোঁ না দেখিয়া।।
নিবেদিল আসি দোঁহে প্রভুর চরণে।
‘উপাধিক কোথাহ নহিল দরশনে।।
কি বৈষ্ণব, কি সন্ন্যাসী, কি গৃহস্থ স্থল।
পাষণ্ডীর ঘর-আদি দেখিল সকল।।
চাহিলাঙ সর্ব্ব-নবদ্বীপ যার নাম।
সবে না চাহিল প্রভু, গিয়া আর গ্রাম।।
দোঁহার বচন শুনি হাসে গৌরচন্দ্র।
ছলে বুঝায়েন ‘বড় গূঢ় নিত্যানন্দ’।।’’

সেই’ত দেখতে পাবে তারে

প্রাণ-গৌর দেখাবে যারে—সেই’ত দখ্‌তে পাবে তারে

‘‘এই অবতারে কেহো গৌরচন্দ্র গায়।
নিত্যানন্দ নাম শুনি উঠিয়া পলায়।।
পূজয়ে গোবন্দি যেন না মানে শঙ্কর।
এই পাকে অনেক যাইব যম-ঘর।।
বড় গূঢ় নিত্যানন্দ এই অবতারে।
চৈতন্য দেখায় যারে সে দেখিতে পারে।
না বুঝি যে নিন্দে, তান চরিত্র অগাধ।
পাইয়াও বিষ্ণভক্তি হয় তার বাধ।।
সর্ব্বদা শ্রীবাস আদি তাঁর তত্ত্ব জানে।
না হইল দেখা কোন কৌতুক-কারণে।।
ক্ষণেকে ঠাকুর বোলে ঈষত হাসিয়া।
‘আইস আমার সঙ্গে সভে দেখি গিয়া’।।
উল্লাসে প্রভুর সঙ্গে সর্ব্ব-ভক্তগণ।
‘জয় কৃষ্ণ’ বলি সভে করিলা গমন।।
সভা লই প্রভু নন্দন-আচার্য্যের ঘরে।
জানিঞা উঠিলা গিয়া শ্রীগৌরসুন্দরে।।’’

গৌরসুন্দর জানে প্রাণে প্রাণে

নিতাই আছে কোন্‌ খানে—গৌরসুন্দর জানে প্রাণে প্রাণে
নিতাই সদাই তাঁরে টানে—গৌরসুন্দর জানে প্রাণে প্রাণে

‘‘বসিয়া আছয়ে এক পুরুষ-রতন।
সভে দেখিলেন যেন কোটি-সূর্য-সম।।
অলক্ষিত-আবেশ—বুঝন নাহি যায়।
ধ্যান-সুখে পরিপূর্ণ, হাসয়ে সদায়।।
মহাভক্তিযোগ প্রভু বুঝিয়া তাঁহার।
গণ-সহ বিশ্বম্ভর হৈলা নমস্কার।।’’

কখনও তো দেখে নাই

ভক্তিযোগ মূ্র্ত্তিমন্ত—কখনও তো দেখে নাই

তাই বুঝি নমস্কার করে

‘‘সম্ভমে রহিলা সর্ব্ব-গণ দাঁড়াইয়া।
কেহো কিছু না বোলয়ে রহিল চাহিয়া।।
সম্মুখে রহিলা মহাপ্রভু বিশ্বম্ভর।
চিনিলেন নিত্যানন্দ প্রাণের ঈশ্বর।।
বিশ্বম্ভর মূর্ত্তি যেন মদন-সমান।
দিব্য গন্ধ-মাল্য দিব্য বাস পরিধান।।
কি হয় কনক-জ্যোতি সে দেহের আগে।
সে বদন দেখিতে চাঁদের সাধ লাগে।।
সে দন্ত দেখিতে কোথা মুকুতার নাম।
সে কেশ-বন্ধান দেখি না রহে গেয়ান।।
দেখিতে আয়ত দুই অরুণ-নয়ান।
আর কি ‘কমল আছে’ হেন হয় জ্ঞান।।
সে আজানু দুই ভুজ, হৃদয় সুপীন।
তাহে শোভে শুভ্র যজ্ঞসূত্র অতি-ক্ষীণ।
ললাটে বিচিত্র উর্দ্ধ-তিলক সুন্দর।
আভরণ বিনে সর্ব্ব-অঙ্গ মনোহর।।
কিবা হয় কোটি-মণি সে নখ চাহিতে।
সে হাস দেখিতে কিবা করিব অমৃতে।।
নিত্যানন্দ সম্মুখে রহিলা বিশ্বম্ভর।
চিনিলেন নিত্যানন্দ আপন-ঈশ্বর।।
হরিষে স্তম্ভিত হৈলা নিত্যানন্দ-রায়।
একদৃষ্টি হই বিশ্বম্ভর-রূপ চায়।।’’

না চলে নয়ন-তারা

দু’নয়নে বহে ধারা—না চলে নয়ন-তারা

‘‘রসনায় লেহে যেন দরশনে পান।
ভুজে যেন আলিঙ্গন, নাসিকায়ে ঘ্রাণ।।
এইমত নিত্যানন্দ হইলা স্তম্ভিত।
না বোলেনা করে কিছু, সভেই বিস্মিত।।
বুঝিলেন সর্ব্ব-প্রাণ-নাথ গৌর-রায়।
নিত্যানন্দে জানাইতে সৃজিলা উপায়।।
ইঙ্গিতে শ্রীবাস-প্রতি বোলেন ঠাকুরে।
এক ভাগবতের বচন পঢ়িবারে।।
প্রভুর ইঙ্গিত বুঝি শ্রীবাস-পণ্ডিত।
কৃষ্ণ-ধ্যান এক শ্লোকে পঢ়িলা ত্বরিত।।
শুনিমাত্র নিত্যানন্দ শ্লোক-উচ্চারণ।
পড়িলা মূর্চ্ছিত হৈয়া—নাহিক চেতন।।
আনন্দে মূর্চ্ছিত হৈলা নিত্যানন্দ-রায়।
‘পঢ় পঢ়’ শ্রীবাসেরে গৌরাঙ্গ শিখায়।।
শ্লোক শুনি কথোক্ষণে হইলা চেতন।
তবে প্রভু লাগিলেন করিতে ক্রন্দন।।
পুনঃ পুনঃ শ্লোক শুনি বাঢ়য়ে উন্মাদ।
ব্রহ্মাণ্ড ভেদয়ে হেন শুনি সিংহনাদ।।
অলক্ষিতে অন্তরীক্ষে পড়য়ে আছাড়।
সভে মনে বাসে, কিবা চূর্ণ হৈল হাড়।।
অন্যের কি দায়, বৈষ্ণবের লাগে ভয়।
‘রক্ষ কৃষ্ণ ! রক্ষ কৃষ্ণ’! সভেই স্মরয়।।
গড়াগড়ি যায় প্রভু পৃথিবীর তলে।’’

আজ সে বিহরে ধরণী-বুকে

যে স্বরূপ ধরে ধরণীরে—আজ সে বিহরে ধরণী-বুকে

‘‘কলেবর পূর্ণ হৈল নয়নের জলে।।
বিশ্বম্ভর-মুখ চাহি ছাড়ে ঘনশ্বাস।
অন্তরে আনন্দ-ক্ষণেক্ষণে মহাহাস।।
ক্ষণে নৃত্য, ক্ষণে গড়ি, ক্ষণে বাহু-তাল।
দেখিয়া অদ্ভুত কৃষ্ণ-উন্মাদ আনন্দ।
সকল-বৈষ্ণব-সঙ্গে কান্দে গৌরচন্দ্র।।’’

প্রেম বটে ত আপনার

কিন্তু—কখনও দেখে নাই বিকার তার—প্রেম বটে ত আপনার

পুনঃপুনঃ বাঢ়ে সুখ অতি অনিবার।
ধরেন সভেই—কেহো নারে ধরিবার।।
ধরিতে নারিলা যদি বৈষ্ণব-সকলে।
বিশ্বম্ভর লইলেন আপনার কোলে।।’’

সেই-নিত্যানন্দে কেবা ধরে

যে জন ধরে বিশ্বম্ভরে—সেই-নিত্যানন্দে কেবা ধরে
বিনা প্রাণ-বিশ্বম্ভরে—সেই-নিত্যানন্দে কেবা ধরে

‘‘বিশ্বম্ভর-কোলে মাত্র গেলা নিত্যানন্দ।
সমর্পিয়া প্রাণ তানে হইলা নিষ্পন্দ।।
যার প্রাণ, তানে নিত্যানন্দ সমর্পিয়া।’’

নিত্যানন্দ হইলা আশ্বস্ত

পাইয়া প্রাণ-গৌরচন্দ্র—নিত্যানন্দ হইলা আশ্বস্ত

‘‘আছেন প্রভুর কোলে অচেষ্ট হইয়া।।
ভাসে নিত্যানন্দ চৈতন্যের প্রেমজলে।
শক্তিতে লক্ষ্মণ যেহেন রাম-কোলে।।
প্রেমভক্তি-বাণে মূর্চ্ছা গেলা নিত্যানন্দ।
নিত্যানন্দ কোলে করি কান্দে গৌরচন্দ্র।।
কি আনন্দ-বিরহ হইল সর্ব্বগণে।
পূর্ব্বে যেন শুনিয়াছি শ্রীরাম-লক্ষ্মণে।।
গৌরচন্দ্রে নিত্যানন্দে স্নেহের যে সীমা।
শ্রীরাম-লক্ষ্মণ বই নাহিক উপমা।।
বাহ্য পাইলেন নিত্যানন্দ কথোক্ষণে।
হরি ধ্বনি জয় ধ্বনি করে সর্ব্বগণে।।
নিত্যানন্দ ‘কোলে’ করি আছে বিশ্বম্ভর।
বিপরীত দেখি মনে হাসে গদাধর।।’’

এ-যে আশ-মিটান লীলা রে
রাধার ছিল মনের ব্যাথা

শুনিয়া বিবর্ত্ত-কথা—রাধার ছিল মনের ব্যথা
‘শুনিয়া বিবর্ত্ত-কথা’—
সখীগণের মুখে—শুনিয়া বিবর্ত্ত-কথা

রাধার ছিল মনের ব্যথা
আমি কি দেখতে পাব

এই বিবর্ত্ত-বিলাস-রঙ্গ—আমি কি দেখতে পাব

আজ,–গদাধরের মনে আনন্দ

দেখিয়া সে বিবর্ত্ত-রঙ্গ—আজ,–গদাধরের মনে আনন্দ

গদাধর হাসে মনে মনে বলে
যে সর্ব্ব-প্রকারে ধরে

সেই আজ বুকের উপর—যে সর্ব্ব-প্রকারে ধরে

বিপরীত গতি রে

বিলাস-বিবর্ত্ত-লীলায়—বিপরীত গতি রে
বিলাসী-বুকে বিলাস বিহরে—বিপরীত গতি রে

বুঝি,–তাই নিল নিজ-কোণে

সদাই তারে করেছে কোলে—বুঝি,–তাই নিল নিজ-কোলে

‘‘যে অনন্ত নিরবধি ধরে বিশ্বম্ভরে।
আজি তাঁর গর্ব্ব চূর্ণ কোলের ভিতর।।
নিত্যানন্দ-প্রভাবের জ্ঞাতা গদাধর।
নিত্যানন্দ জ্ঞাতা গদাধরের অন্তর।।
নিত্যানন্দ দেখিয়া সকল ভক্তগণ।
নিত্যানন্দময় হৈল সভাকার মন।।
নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র দোঁহে দোঁহা দেখি।
কেহো কিছু না বোলে, ঝরয়ে মাত্র আঁখি।।’’

নব-অনুরাগের এই ত ধারা।

দোঁহে হৈলা,–থাকিত পারা ঠউর হারা—নব-অনুরাগের এই ত ধারা
না সরে রা নয়নে ধারা—নব-অনুরাগের এই ত ধারা

এ যে, –পহিলহি রাগ হে

রাসরসের পরিণতির—এ যে,–পহিলহি রাগ রে
বিলাস-বিবর্ত্ত-বিলাস-রঙ্গের—এ যে,–পহিলহি রাগ রে

দিনে দিনে বাড়য়ে

অবধি ত কেউ না পাবে—দিনে দিনে বাড়বে

‘‘দোঁহে দোঁহা দেখি বড় বিবশ হইলা।
দোঁহার নয়ন-জলে পৃথিবী ভাসিলা।।
বিশ্বম্ভর বোলে শুভ দিবস আমার।
দেখিলাম ভক্তিযোগ চারি-বেদ-সার।।’’

দেখিলাম তোমায় নিত্যানন্দ

চারি-বেদ-সার ভক্তি মূর্ত্তিমন্ত—দেখিলাম তোমায় নিত্যানন্দ

তাই,–তোমার নাম নিত্যানন্দ

তোমাতে আশ্রয়ের নিত্যত্ব—তাই,–তোমার নাম নিত্যানন্দ

‘‘এ কম্প, এ অশ্রু, এই গর্জ্জন হুঙ্কার।
এহ কি ঈশ্বর-শক্তি বই হয় আর।।
সকৃৎ এ ভক্তিযোগ নয়নে দেখিলে।
তাহারেও কৃষ্ণ না ছাড়েন কোনো-কালে।।
বুঝিলাম ঈশ্বরের তুমি পূর্ণ-শক্তি।’’

আবেশে বলেন গৌরহরি

আপন-নিতাই-রহস্য-কথা—আবেশে বলেন গৌরহরি

ইঙ্গিতেতে বলছেন প্রভু

এ যে,–আত্মগোপনকারী লীলা—ইঙ্গিতেতে বলছেন প্রভু
নিতাই,–তুমি আমার পূর্ণশক্তি—ইঙ্গিতেতে বলছেন প্রভু

কিবা বুঝলে বল ভাই

পূর্ণ-শক্তি বলতে—কিবা বুঝলে বল ভাই

‘‘বুঝিলাম ঈশ্বরের তুমি পূর্ণ-শক্তি।
তোমা ভজিলে সে জীব পায় কৃষ্ণ-ভক্তি।।
তুমি কর চতুর্দ্দশ-ভুবন পবিত্র।
অচিন্ত্য, অগম্য, গূঢ় তোমার চরিত্র।।
‘তোমা’ লখিবেক হেন আছে কোন জন।
মুর্ত্তিমন্ত তুমি কৃষ্ণপ্রেমভক্তি-ধন।।’’

কৃষ্ণপ্রেমভক্তির মূরতি

সত্য সত্য নিতাই তুমি—কৃষ্ণপ্রেমভক্তির মূরতি

‘‘তিলার্দ্ধ তোমার সঙ্গ যে জনার হয়ে।
কোটি পাপ থাকিলেও তার মন্দ নহে।।
বুঝিলাঙ—কৃষ্ণ মোর করিব উদ্ধারে।
‘তোমা’ হেন সঙ্গ আনি দিলেন আমারে।।
মহাভাগ্যে দেখিলাম তোমার চরণ।
তোমা ভজিলে সে পাই কৃষ্ণপ্রেম-ধন।।
আবিষ্ট হইয়া প্রভু গৌরাঙ্গ-সুন্দর।
নিত্যানন্দ স্তুতি করে, নাহি অবসর।।
নিত্যানন্দ-চৈতন্যের অনেক আলাপ।
সব কথা ঠারেঠারে, নাহিক প্রকাশ।।
প্রভু বোলে, জিজ্ঞাসা করিতে বাসি ভয়।
কোন দিগ হৈতে শুভ করিলা বিজয়।।
‘এই প্রভু অবতীর্ণ’ জানিলেন মর্ম্ম।
করযোড়করি বোলে হই বড় নম্র।।
প্রভু স্তুতি করে, শুনি লজ্জিত হইয়া।
ব্যপদেশে সর্ব্বকথা কহেন ভাঙ্গিয়া।।
নিত্যানন্দ বোলে ‘তীর্থ করিল অনেক।
দেখিল কৃষ্ণের স্থান যতেক যতেক।।
স্থান মাত্র দেখি, কৃষ্ণ দেখিতে না পাই।
জিজ্ঞাসা করিল তবে ভাল লোক ঠাঁই।।
সিংহাসন-সব কেনে দেখি আচ্ছাদিত।
কই ভাই সব। কৃষ্ণ গেলা কোন ভিত।।
তারা বোলে—কৃষ্ণ গিয়াছেন গৌড়দেশে।
গয়াকরি গিয়াছেন কথোক দিবসে।।
নদীয়ায় শুনি বড় হরি-সঙ্কীর্ত্তন।
কেহো বলে তথায় জন্মিলা নারায়ণ।।
পতিতের ত্রাণ বড় শুনি নদীয়ায়।
শুনিয়া আইলুঁ মুঞি পাতকী এথায়।।’
প্রভু বোলে ‘আমরা সকলে ভাগ্যবান্।
তুমি-হেন ভক্তের হইল উপস্থান।।
আজি কৃতকৃত্য হেন মানিল আমরা।
দেখিল যে তোমার আনন্দ-বারি-ধারা।।’
হাসিয়া মুরারি বোলে ‘তোমরা তোমরা’।
উহা ত না বুঝি কিছু আমরা-সভারা।।
শ্রীবাস বোলেন ‘উহা আমরা কি বুঝি।
মাধব-শঙ্কর যেন দোঁহে দোঁহা পূজি’।।
গদাধর বোলে ভাল বলিলা পণ্ডিত।
সেই বুঝি যেন ‘রাম-লক্ষ্মণ-চরিত’।।
কেহো বোলে ‘দুইজন যেন দুই কাম’।
কেহো বোলে ‘দুইজন কৃষ্ণ-বলরাম’।।
কেহো বোলে, আমি কিছু বিশেষ না জানি।
কৃষ্ণকোলে যেন ‘শেষ’ আইলা আপনি’।।
কেহো বোলে ‘দুই সখা যেন কৃষ্ণার্জ্জুন’।
সেইমত দেখিলাম স্নেহ পরিপূর্ণ’।।
কেহো বোলে ‘দুইজনে বড় পরিচয়।
কিছু না বুঝিয়ে সব ঠারে কথা কয়’।।
এইমত হরিষে সকল-ভক্ত-গণ।
নিত্যানন্দ-দরশনে কহেন কথন।।
নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র দোঁহে দরশন।
ইহার শ্রবণে হয় বন্ধ বিমোচন।।
‘‘সখী, সখা, ভাই, ছত্র, শয়ন, বাহন।
নিত্যানন্দ বই অন্যে নহে কোনজন।।
নানারূপে সেবে প্রভু আপন ইচ্ছায়।
যারে দেন অধিকার, সেইজন পায়।।
আদি দেব মহাযোগী ঈশ্বর-বৈষ্ণব।
মহিমার অন্ত ইহা নাহি জানে সব।।
‘‘না জানিঞা নিন্দে’ তাঁর চরিত্র অগাধ।
পাইয়াও বিষ্ণুভক্তি হয় তার বাধ।।
চৈতন্যের প্রিয়-দেহ নিত্যানন্দ-রাম।
হউ মোর প্রাণনাথ এই মনস্কাম।।
তাহান প্রসাদে হৈল চৈতন্যেতে রতি।
তাহান আজ্ঞায়ে লিখি চৈতন্যের স্তুতি।।
‘রঘুনাথ’ ‘যদুনাথ’ যেন নামভেদ।
এইমত ভেদ ‘নিত্যানন্দ’ ‘বলদেব’।।
সংসারের পার হই ভক্তির সাগরে।
যে ডুবিবে সে ভজুক নিতাই-চান্দেরে।
যেবা গায় এই কথা হইয়া তৎপর।
গোষ্ঠী সহ বরদাতা তারে বিশ্বম্ভর।।
জগতে দুর্ল্লভ বড় বিশ্বম্ভর-নাম।
সেই প্রভু চৈতন্য সভার ধন প্রাণ।।
হেনমতে নিত্যানন্দ-সঙ্গে কুতূহলে।
কৃষ্ণ-কথা-রসে সভে হইলা বিহ্বলে।।’’

বহুদিন পরে এসেছেন নিতাই

কতদিন বৃন্দাবনে থাকি—বহুদিন পরে এসেছেন নিতাই

উৎকণ্ঠায় রয়েছেন নিতাই
হইল মধুর মিলন

মধুর শ্রীনবদ্বীপে—হইল মধুর মিলন
প্রভু-নিতাই প্রাণ-গৌরাঙ্গের—হইল মধুর মিলন
‘প্রভু-নিতাই প্রাণ-গৌরাঙ্গের’—
নন্দনাচার্য্যের ঘরে—প্রভু-নিতাই প্রাণ-গৌরাঙ্গের

হইল মধুর মিলন
দোঁহে চিনিলেন দোঁহারে

দোঁহে দোঁহার গলা ধরে—দোঁহে চিনিলেন দোঁহারে

‘‘সভে মহাভাগবত পরম উদার।
কৃষ্ণ-রসে মত্ত সভে করেন হুঙ্কার।’’

সভে মহাশক্তিধর

পরাণ-গৌরাঙ্গ-কিঙ্কর-সভে মহাশক্তিধর

‘‘হাসে প্রভু নিত্যানন্দ চারিদিগে দেখি।’’

নিতাই-মত্ততা যায় বেড়ে

গৌর গৌরগণ হেরে—নিতাই-মত্ততা যায় বেড়ে
মাতাল দেখে মাতাল মাতে—নিতাই-মত্ততা যায় বেড়ে(মাতন)

‘‘বহয়ে আনন্দ-ধারা সভাকার আঁখি।।’’

সভারি নয়নে ধারা

দেখি নিতাইচাঁদের ধারা—সভারি নয়নে ধারা
‘দেখি নিতাইচাঁদের ধারা’
গৌরপ্রেমে মাতোয়ারা—দেখি নিতাইচাঁদের ধারা
গৌরপ্রেম-মদিরা পানে ভোরা—দেখি নিতাইচাঁদের ধারা

আঁখি-ধারা পড়ছে ঝরি

প্রেম-মদিরা পান করি—আঁখি-ধারা পড়ছে করি

(মাতন)

‘‘দেখিয়া আনন্দ মহাপ্রভু বিশ্বম্ভর।
নিত্যানন্দ-প্রতি কিছু বলিলা উত্তর।
শুন শুন নিত্যানন্দ শ্রীপাদ গোসাঞি।
ব্যাসপূজা তোমার হইব কোন ঠাঞি।
কালি হৈব পৌর্ণমাসী-ব্যাসের পূজন।
আপনে বুঝিয়া বোল, যারে লয় মন।।
নিত্যানন্দ জানিলেন-প্রভুর ইঙ্গিত।
হাতে ধরি আনিলেন শ্রীবাস-পণ্ডিত।।
হাসি বোলে নিত্যানন্দ ‘‘শুন বিশ্বম্ভর।
ব্যাসপূজা এই মোর বামনের ঘর।।’’

পূজিব ব্যাসদেবে রে

নিতাই আনন্দ বলে—পূজিব ব্যাসদেবে রে
এই বামুনের ঘরে—পূজিব ব্যাসদেবে রে

‘‘শ্রীবাসের প্রতি বোলে প্রভু বিশ্বম্ভর।
বড় ভার লাগিল যে তোমার উপর।।
পণ্ডিত বোলেন ‘প্রভু’ কিছু নহে ভার।
তোমাদের প্রসাদে সব ঘরেই আমার।।
বস্ত্র, মুদ্‌গ, যজ্ঞসূত্র, ঘৃত, গুয়া, পান।
বিধিযোগ্য যত সজ্জ—সব বিদ্যমান।।
পদ্ধতি-পুস্তক মাত্র মাগিয়া আনিব।
কালি মহাভাগ্যে ব্যাস-পূজন দেখিব।।’’

শ্রীবাস মনে মনে গণে
না জানি কোন খেলা খেলে

ব্যাস-পূজার ছল করে—না জানি কোন খেলা খেলে

দেখিয়াছি ব্যাস-পূজন

জনমিয়া অনেক বার—দেখিয়াছি ব্যাস-পূজন

কাল,–প্রাণ-ভরে দেখবো

ব্যাস-পূজা অভিনব—কাল,–প্রাণ-ভরে দেখবো

দেখিয়া জুড়াব হিয়া

নিতাইচাঁদের ব্যাস-পূজা—দেখিয়া জুড়াব হিয়া

(মাতন)

‘‘প্রীত হৈলা মহাপ্রভু শ্রীবাসের বোলে।
হরি হরি ধ্বনি কৈলা বৈষ্ণব-সকলে।।’’

আনন্দে বলে হরি হরি

সভার মনেতে আনন্দ ভারি—আনন্দে বলে হরি হরি

বলে,–কাল দেখব নয়ন-ভরি

ব্যাস-পূজা দেখাবেন গৌরহরি—বলে,–কাল দেখব নয়ন-ভরি

ব্যাস-পূজা করবে নিতাই

নয়ন-ভরে দেখব সভাই—ব্যাস-পূজা-করবে নিতাই

(মাতন)

‘‘বিশ্বম্ভর বোলে ‘‘শুন শ্রীপাদ গোসাঞি।
‘শুভকর’ সভে পণ্ডিতের ঘর যাই।।
আনন্দিত নিত্যানন্দ প্রভুর বচনে।
সেই ক্ষণে আজ্ঞা লই করিলা গমনে।।
সর্ব্ব-গণে চলিলা ঠাকুর বিশ্বম্ভর।
রাম-কৃষ্ণ বেঢ়ি যেন গোকুল-কিঙ্কর।।’’

নিতাই-গৌর ঘিরে সভ-পরিকর

যেন,–রামকৃষ্ণ বেঢ়ি গোকুলকিঙ্কর—নিতাই-গৌর ঘিরে সভ-পরিকর

‘‘প্রবিষ্ট হৈলা মাত্র শ্রীবাসমন্দিরে।
বড় কৃষ্ণানন্দ হৈল সভার শরীরে।।
কপাট পড়িল তবে প্রভুর আজ্ঞায়।’’

নিতাই পেয়ে তাই ত গোপন

নিতাই বড় গূঢ়-রতন—নিতাই পেয়ে তাই ত গোপন

‘‘আপ্তগণ বিনে আর যাইতে না পায়।।
কীর্ত্তন করিতে আজ্ঞা করিলা ঠাকুর।
উঠিল কীর্ত্তনধ্বনি, বাহ্য গেল দূরে।।’’
‘‘ব্যাস-পূজা—অধিবাস উল্লাস কীর্ত্তন।
দুই প্রভু নাচে, বেঢ়ি গায় ভক্তগণ।।
চির-দিবসের প্রেমে চৈতন্য-নিতাই।
দোঁহে দোঁহা ধ্যান করি নাচে একঠাঁই।।
হুঙ্কার করয়ে কেহো কেহো বা গর্জ্জন।
কেহো মূর্চ্ছা যায়, কেহো করয়ে ক্রন্দন।।
কম্প, স্বেদ, পুলকাশ্রু, আনন্দ-মূর্চ্ছিত।
ঈশ্বরের বিকার—কহিতে জানি কত।।
স্বানুভাবানন্দে নাচে প্রভু দুই জন।
ক্ষণে কোলাকুলি করি করয়ে ক্রন্দন।।’’

ভাসে দোঁহে নয়নজলে

দোঁহে দোহায় কোলে করে—ভাসে দোঁহে নয়নজলে

‘‘দোঁহায় চরণ দোঁহে ধরিবারে চাহে।’’

ইঙ্গিতে জানাইছেন রহস্য

আমা দোঁহার এই তত্ত্ব—ইঙ্গিতে জানাইছেন রহস্য

‘‘পরম-চতুর দোঁহে কেহো নাহি পায়ে।।
পরম-আনন্দে দোঁহে গড়াগড়ি যায়।’’

ভাগ্যবতী নদীয়াভূমি

এ ভাগ্য পায় নাই ব্রজভূমি—ভাগ্যবতী নদীয়া ভূমি
ধরে,–নিতাইগৌরগুণমণি—ভাগ্যবতী নদীয়াভূমি

ধরণীর সুসম্পদ

নিতাইগৌরাঙ্গ-পদ—ধরণীর সুসম্পদ

‘‘আপনা না জানে দোঁহে আপন-লীলায়।।
বাহ্য দূর হইল, বসন নাহি পরে।
ধরয়ে বৈষ্ণবগণ, ধরন না যায়ে।।
যে ধরয়ে ত্রিভুবন কে ধরিব তারে।
মহামত্ত দুই প্রভু কীর্ত্তনে বিহরে।।
বোল বোল’ বলি ডাকে শ্রীগৌরসুন্দর।।
সিঞ্চিত আনন্দ-জলে সর্ব্ব-করেবর।।
চিরদিনে নিত্যানন্দ পাই অভিলাষে।।’’

সর্ব্বতীর্থে করেছে ভ্রমণ

দেখিবারে নয়নরঞ্জন—সর্ব্বতীর্থে করেছে ভ্রমণ

কোথাও না পেয়ে সন্ধান

সর্ব্বত্র আচ্ছাদিত সিংহাসন—কোথাও না পেয়ে সন্ধান

বড়-ক্লেশ পেয়েছে মনে

খুঁজে খুঁজে দেখা না পেয়ে—বড়-ক্লেশ পেয়েছে মনে
প্রিয়-সঙ্গ হারাইয়ে—বড়-ক্লেশ পেয়েছে মনে

পাইয়া সর্ব্বধনে

আজ বহু অন্বেষণে—পাইয়া সর্ব্বস্বধনে

ভ্রমি ভ্রমি পেয়েছেন এবার

সর্ব্বস্বধন তাঁর—ভ্রমি ভ্রমি পেয়েছেন এবার

সর্ব্ব-তীর্থ পর্য্যটন করি’

তবে পেয়েছেন গৌরহরি—সর্ব্ব-তীর্থ পর্য্যটন করি’

[মাতন]

“বাহ্য নাহি আনন্দ-সাগর-মাঝে ভাসে।।”

খেলে গৌর সিন্ধুকূলে

নিতাই-তরঙ্গে হেলে দুলে—খেলে গৌর সিন্ধুকূলে

‘‘বিশ্বম্ভর নৃত্য করে অতি-মনোহর।
নিজ-শির লাগে গিয়া চরণ-উপর।।
টলমল ভূমি নিত্যানন্দ-পদতলে।
ভূমিকম্প-হেন মানে বৈষ্ণব-সকলে।।’’

আনন্দ আর ধরে না

ভাগ্যবতী ধরণীর—আনন্দ আর ধরে না

ধরণী প্রেমে টলমল করে

প্রেমের মূরতি দোঁহায় হৃদে ধরে—ধরণী প্রেমে টলমল করে

‘‘এইমত আনন্দে নাচেন দুই নাথ।
সে উল্লাস কহিবারে শক্তি আছে কাত।।
নিত্যানন্দ প্রকাশিতে প্রভু বিশ্বম্ভর।
বলরাম ভাবে উঠে খট্টার উপর।।
মহামত্ত হৈলা প্রভু বলরাম-ভাবে।
‘মদ আন মদ আন’ বলি’ ঘন ডাকে।।
নিত্যানন্দ-প্রতি বোলে শ্রীগৌরসুন্দর।
‘ঝাট দেহ’ মোরে ‘ঽল মুঘল সত্বর’।।
পাইয়া প্রভুর আজ্ঞা প্রভু-নিত্যানন্দ।
করে দিলা, কর পতি লৈলা গৌরচন্দ্র।।
কর দেখে কেহো আর কিছুই না দেখে।
কেহো বা দেখিল ‘হল মুষল’ প্রত্যক্ষে।।
যারে কৃপা করে সেই ঠাকুরে, সে জানে।
দেখিলেও শক্তি নাহি কহিতে কথনে।।
এ-বড় নিগূঢ়-কথা কেহো মাত্র জানে।
নিত্যানন্দ ব্যক্ত সেই-সব-জন-স্থানে।।’’

সেই,–নিতাই-রহস্য জানতে পায়

গৌর-চরণ যে ধরে হিয়ায়—সেই,–নিতাই-রহস্য জানতে পায়

‘‘নিত্যানন্দ-স্থানে হল-মুষল লইয়া।
‘বারুণী বারুণী’ প্রভু ডাকে মত্ত হৈয়া।।
কারো বুদ্ধি নাহি স্ফুরে, না বুঝে উপায়।
অন্যোহন্যে সভার বদন সভে চায়।।
যূগতি করিয়া সভে মনেতে ভাবিয়া।
ঘট-ভরি গঙ্গাজল সভে দিল লৈয়া।।
সর্ব্ব-জন দেই জল, প্রভু করে পান।
সত্য যেন কাদম্বরী পীয়ে হেন ভান।।
চতুর্দ্দিগে রামস্তুতি পঢ়ে ভক্তগণ।
‘নাঢ়া নাঢ়া’ নাঢ়া’ প্রভু বোলে অনুক্ষণ।।
সঘনে ঢুলায় শির ‘নাঢ়া নাঢ়া’ বোলে।
‘নাঢ়ার সন্দর্ভ কেহো না বুঝে সকলে।।
সভে বলিলেন ‘প্রভু ! নাঢ়া’ বোল কারে।
প্রভু বোলে ‘আইলুঁ মুঞি’ যাহার হুঙ্কারে।।’’

‘নাঢ়া’ বলিলাম তায়

যে,–আমা আনিতে কৈল হুঙ্কার—‘নাঢ়া’ বলিলাম তায়

‘‘অদ্বৈত-আচার্য্য’ বলি কথা কহ যার।
সেই ‘নাঢ়া’ লাগি মোর এই অবতার।।’’

গৌরহরি বলে ‘বার বার’

নাঢ়া-লাগি মোর অবতার—গৌরহরি বলে ‘বার বার’

আমার,–গোলোকের আসন নড়ে

অদ্বৈতের প্রেমাহুঙ্কারে—আমার,–গোলোকের আসন নড়ে

‘‘মোহরে আনিলা নাঢ়া বৈকুণ্ঠ-থাকিয়া।
নিশ্চিন্তে রহিল গিয়া হরিদাস লৈয়া।।
সঙ্কীর্ত্তন-আরম্ভে মোহর অবতার।
ঘরে ঘরে, করিমু কীর্ত্তন-পরচার।।
বিদ্যা, ধন, কুল, জ্ঞান, তপস্যার মদে।
মোর ভক্ত-স্থানে যার আছে অপরাধে।।
সে অধম-সভারে না দিমু প্রেমযোগ।
নগরিয়া-প্রতি দিমু ব্রহ্মাদির ভোগ।।
শুনিয়া আনন্দে ভাসে সব-ভক্তগণ।
ক্ষণেকে সুস্থির হৈলা শ্রীশচীনন্দন।।
‘কি চাঞ্চল্য করিলাঙ ?’ প্রভু জিজ্ঞাসয়ে।
ভক্তসব বোলে ‘কিছু উপাধিক নহে’।।
সভারে করেন প্রভু প্রেম-আলিঙ্গন।
অপরাধ মোর না লইবা সর্ব্ব-ক্ষণ।।
হাসে সর্ব্বভক্তগণ প্রভুর কথায়।
নিত্যানন্দ-মহাপ্রভু গড়াগড়ি যায়।।’’

নিতাই আমার মহাসুখী

গৌরাঙ্গ-প্রকাশ দেখি’—নিতাই আমার মহাসুখী

এই ভাব নিতাইচাঁদের মনে

সবাই ভজুক গৌরধনে—এই ভাব নিতাইচাঁদের মনে

নিতাইচাঁদের বড় উল্লাস

দেখিয়া গৌরাঙ্গ-প্রকাশ—নিতাইচাঁদের বড় উল্লাস

‘‘সম্বরণ নহে নিত্যানন্দের আবেশ।
’প্রেমরসে বিহ্বল হইলা প্রভু শেষ’’।।
ক্ষণে হাসে, ক্ষণে কাঁদে, ক্ষণে দিগম্বর।
বাল্যভাবে পূর্ণ হইল সর্ব্ব-কলেবর।।
কোথা বা থাকিল দণ্ড, কোথা কমণ্ডুল।
কোথা বা বসন গেল, নাহি আদি মূল।।
চঞ্চল হইলা নিত্যানন্দ মহাধীর।
আপনে ধরিয়া প্রভু করিলেন স্থির।।’’

তারে,–আর কে রাখিবে ধরে

যে আপনি ধরণী ধরে—তারে,–আর কে রাখিবে ধরে
বিনা প্রভু বিশ্বম্ভরে—তারে,–আর কে রাখিবে ধরে

‘‘চৈতন্যের বচন-অঙ্কুশসবে মানে।
নিত্যানন্দ মত্ত-সিংহ আর নাহি জানে।।
‘স্থির হও, কালি পূজিবারে চাহ ব্যাস’।
স্থির করাইয়া প্রভু গেলা নিজ-বাস।।
ভক্তগণ চলিলেন আপনার ঘরে।
নিত্যানন্দ রহিলেন শ্রীবাস-মন্দিরে।।
কথো রাত্রে নিত্যানন্দ হুঙ্কার করিয়া।
নিজ দণ্ড-কমণ্ডলু ফেলিলা ভাঙ্গিয়া।।’’

সূচনা হল রে

এই ত দণ্ডভঙ্গ-লীলার—সূচনা হল’ রে

‘‘কে বুঝয়ে ঈশ্বরের চরিত্র অখণ্ড।
কেনে ভাঙ্গিলেন নিজ কমণ্ডলু দণ্ড।।’’

এই অনুভব হয়

পরম-করুণ শ্রীগুরু-কৃপায়—এই অনুভব হয়

দণ্ড-ভঙ্গের এই মর্ম্ম

আমার প্রভু-নিত্যানন্দের—দণ্ড-ভঙ্গের এই মর্ম্ম

এখন নয় দণ্ড ধরবার

এযে,–অহৈতুকী কৃপা করবার—এখন নয় দণ্ড ধরবার

‘‘প্রভাতে উঠিয়া দেখে রামাই-পণ্ডিত।
ভাঙ্গাদণ্ড-কমণ্ডলু দেখিয়া বিস্মিত।।
পণ্ডিতের স্থানে কহিলেন ততক্ষণে।
শ্রীবাস বোলেন ‘যাও ঠাকুরের স্থানে’।।’’

আমরা কি-বুঝি বল

পাগলের কার্য্য জানে পাগল—আমরা কি-বুঝি বল

‘‘রামাইর মুখে শুনি আইলা ঠাকুর।
বাহ্য নাহি নিত্যানন্দ হাসেন প্রচুর।।
দণ্ড লইলেন প্রভু শ্রীহস্তে তুলিয়া।
চলিলেন গঙ্গাস্নানে নিত্যানন্দ লৈয়া।।
শ্রীবাসাদি সভেই চলিলা গঙ্গাস্নানে।
দণ্ড থুইলেন প্রভু গঙ্গায়ে আপনে।।
চঞ্চল সে নিত্যানন্দ না মানে বচন।
তবে একবার প্রভু করয়ে গর্জ্জন।।
কুম্ভীর দেখিয়া তারে ধরিবারে যায়।’’

পাগল নিতাই রে

গৌরাঙ্গ-প্রেমে—পাগল নিতাই রে

‘‘গদাধর শ্রীনিবাস করে ‘হায় হায়’।।
সাঁতারে গঙ্গার মাঝে নির্ভয়-শরীর।
চৈতন্যের বাক্যে মাত্রে কিছু হয় স্থির।।
নিত্যানন্দ-প্রতি ডাকি বোলে বিশ্বম্ভর।
‘ব্যাসপূজা আসি ঝাট করহ সত্বর’।।
শুনিয়া প্রভুর বাক্য উঠিলা তখনে।
স্নান করি গৃহে আইলেন প্রভু-সনে।।
আসিয়া মিলিলা সব-ভাগবতগণ।
নিরবধি ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ করিতে কীর্ত্তন।।’’

উঠিল আনন্দ-রোল

শ্রীবাস-অঙ্গন-মাঝে—উঠিল আনন্দ-রোল

‘‘শ্রীবাস-পণ্ডিত ব্যাস-পূজার আচার্য্য।
চৈতন্যের আজ্ঞায় করেন সর্ব্ব-কার্য্য।।
মধুর মধুর সভে করেন কীর্ত্তন।
শ্রীবাস-মন্দির হৈল বৈকুণ্ঠ-ভবন।।’’

আনন্দের পাথার বয়ে যায়

শ্রীবাস-মন্দিরে আজ—আনন্দের পাথার বেয়ে যায়
ব্যাসদেবের পূজা-লীলায়—আনন্দের পাথার বয়ে যায়

‘সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞাতা সেই ঠাকুর-পণ্ডিত।
করিলা সকল কার্য্য যে বিধিবোধিত।।
দিব্য-গন্ধ সহিত সুন্দর বনমালা।
নিত্যানন্দ-হাথে দিয়া বলিথে লাগিলা।।
‘শুন শুন নিত্যানন্দ ! এই মালা ধর।
বচন পঢ়িয়া ব্যাসদেবে নমস্কার।।
শাস্ত্রবিধি আছে মালা আপনে সে দিবা।
ব্যাস তুষ্ট হৈলে, সর্ব্ব-অভীষ্ট পাইবা’।।
যত শুনে নিত্যানন্দ করে ‘হয় হয়’।
কিসের বচন-পাঠ প্রবোধ না লয়।।’’

নিতাইর মন মানে না

প্রাণ-গৌরাঙ্গের সেবা বিনা—নিতাইর মন মানে না

স্বপ্নেও না আনে অন্য

কত-গুণের প্রভু নিত্যানন্দ—স্বপ্নেও না জানে অন্য
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বিনা—স্বপ্নেও না জানে অন্য

তাই,–‘‘কিসের বচন-পাঠ-প্রবোধ না লয়।।
কিবা বোলে ধীরে ধীরে, বুঝন না যায়।’’

পাগলের বুলি কে বুঝ্‌বে বল

পাগল হৃদে ধরে না-হলে পাগল—পাগলের বুলি কে বুঝ্‌বে বল

খুঁজে মালা-পরাবার গলা

নিতাই হাথে করি মালা—খুঁজে—মালা-পরাবার গলা

বলে,–কৈ সে গলা কৈ

নিতাই মালা হাথে বলে—বলে,–কৈ সে গলা কৈ
যে গলায় মালা সদাই দেই—বলে,–কৈ সে গলা কৈ

‘‘কিবা বোলে ধীরে ধীরে বুঝন না যায়।
মালা হাথে করি পুনঃ চারিদিকে চায়।।’’

সেই,–গলা খুঁজে পায় না

যে গলায় মালা পরাণ স্বভাব—সেই,–গলা খুঁজে পায় না
যার গলায় মালা পরাতে সাধ—সেই,–গলা খুঁজে পায় না

(মাতন)
সেই,–গলা খুঁজে নাহি পায়

মারা পরাবে যে গলায়—সেই,–গলা খুঁজে নাহি পায়
মালা হাতে নিতাই চারিদিকে চায়—সেই,–গলা খুঁজে নাহি পায়

আর কারেও জানে না

সেবার পাত্র গৌর বিনা—আর কারেও জানে না
সেবাবিগ্রহ নিতাই-সোণা—আর কারেও জানে না

‘‘যার মন্ত্রেতে সকল-মূর্ত্তিতে বৈসে প্রাণ।
সেই প্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচন্দ্র ভগবান্‌।।’’

আর,–কার পূজা কর্‌বে নিতাই
তাই,–গলা খুঁজে খুঁজে বেড়ায়

গৌর-গলায় দিবে বলে—তাই—গলা খুঁজে খুজে বেড়ায়

আর কারে সেবিবে নিতাই

বিনা—পরতত্ত্ব-সীমা শ্রীচৈতন্য-গোঁসাই—আর কারে সেবিবে নিতাই

প্রাণ-বিশ্বম্ভর হয়

সর্ব্ব,–লীলা-রস-তত্ত্বময়—প্রাণ-বিশ্বম্ভর হয়

তাই বেড়ায় খুঁজে খুঁজে

নিতাই মালা হাতে—তাই বেড়ায় খুঁজে খুঁজে
গৌর-গলায় দিবে বলে—তাই বেড়ায় খুঁজে খুঁজে

‘‘প্রভুরে ডাকিয়া বোলে শ্রীবাস উদার।
‘না পূজেন ব্যাস এই শ্রীপাদ তোমার’।।
শ্রীবাসের বাক্য শুনি শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর।’’

প্রাণে প্রাণে জেনেছেন প্রভু

নিতাই আমায় খুঁজে-বেড়াইছেন—প্রাণে প্রাণে জেনেছেন প্রভু

প্রাণে প্রাণে পড়েছে টান

নিতাই করিছে তার অনুসন্ধান—প্রাণে প্রাণে পড়েছে টান

আর কি প্রভু রইতে পারে

প্রাণের নিতাই খুঁজিছে তারে—আর কি প্রভু রইতে পারে
নিতাই,–খুঁজিছে গলা পূজিবে বলে—আর কি প্রভু রইতে পারে

‘‘ধাইয়া সম্মুখে প্রভু আইলা সত্বর।।’’

ধেয়ে এলেন সেই কালে

নিতাইচাঁদের অগ্রেতে—ধেয়ে এলেন সেই কালে

‘‘প্রভু বলে নিত্যানন্দ শুনহ বচন।
মালা দিয়া ঝাট কর’ ব্যাসের পূজন।।
দেখিলেন নিত্যানন্দ প্রভু বিশ্বম্ভর।’’

নিতাই করে দরশন

সম্মুখে বাঞ্ছিত ধন—নিতাই করে দরশন

সেই গলা সম্মুখে এল

যে গলা নিতাই খুঁজিতেছিল—সেই গলা সম্মুখে এল

দেখিয়া সেই বিশ্বম্ভরে

যাঁরে খুঁজিতেছিল নিতাই অন্তরে—দেখিয়া সেই বিশ্বম্ভরে
আপনার সম্মুখে—দেখিয়া সেই বিশ্বম্ভরে

আনন্দ আর ধরে না রে

যাঁকে,–খুঁজিতেছিল সম্মুখে—আনন্দ আর ধরে না রে

আনন্দ আর ধরে না রে

মালা দিবার গলা পেয়ে—আনন্দ আর ধরে না

‘‘মালা তুলি দিল তাঁর মস্তক উপর।’’

নিতাইচাঁদ সেবা করে

নিজ সেব্য-নিধি পেয়ে—নিতাইচাঁদ সেবা করে

কাঁদে নিতাই প্রেম-ভরে

মালা দিয়ে বিশ্বম্ভরে—কাঁদে নিতাই প্রেম-ভরে

নিতাইর মন আন জানে না

প্রাণ-গৌরাঙ্গের সেবা বিনা—নিতাইর মন আন জানে না

‘‘চাঁচর-চিকুরে মালা শোভে অতি ভাল।
ছয়-ভুজ বিশ্বম্ভর হৈলা তৎকাল।।’’

হইল ষড়্‌ভুজ-ধারী

নিতাই-করের মালা পরি—হইল ষড়্ভুজ-ধারী

‘‘শঙ্ঘ, চক্র, গদা, পদ্ম, শ্রীহল, মুষল।’’

গৌরের এবে নব ষড়্‌ভুজ

নিতাইচাঁদে দেখায় রূপ—গৌরের এবে নব ষড়্‌ভুজ

জানাইলেন ভক্তগণে

এ ষড়্‌ভুজ দেখাইয়ে—জানাইলেন ভক্তগণে

অভিন্ন তনু বটে

আমি আর নিত্যানন্দ—অভিন্ন তনু বটে

প্রাণভরে গাও ভাই

শ্রীগুরুচরণ হৃদে ধরে—প্রাণভরে গাও ভাই
অভিন্ন চৈতন্য নিতাই—প্রাণভরে গাও ভাই

‘‘দেখিয়া বিস্মিত হৈলা নিতাই বিহ্বল।।
ষড়্‌ভুজ দেখি মূর্চ্ছা পাইলা নিতাই।’’

হইল নিতাই মুরছিত

দেখি স্বরূপ মনের মত—হইল নিতাই মুরছিত

‘‘পড়িলা পৃথিবী-তলে ধাতু মাত্র নাই।।
ভয় পাইলেন সব বৈষ্ণবের গণ।
‘রক্ষ কৃষ্ণ রক্ষ কৃষ্ণ’ করেন স্মরণ।।
হুঙ্কার করেন জগন্নাথের নন্দন।
কক্ষে তালি দেই ঘন-বিশাল-গর্জ্জন।।’’

গৌরহরির মনে উল্লাস

দেখি নিতাইচাঁদের প্রকাশ—গৌরহরির মনে উল্লাস

‘‘মূর্চ্ছা গেল নিত্যানন্দ ষড়্‌ভুজ দেখিয়া।
আপনে চৈতন্য তোলে গায়ে হাত দিয়া।।
উঠ উঠ নিত্যানন্দ ! স্থির কর চিত।
সঙ্কীর্ত্তন শুন—যে তোমার সমীহিত।।
যে কীর্ত্তন নিমিত্ত করিলা অবতার।
সে তোমার সিদ্ধ হইল কিবা চাহ আর।।
তোমার সে প্রেমভক্তি তুমি প্রেমময়।
বিনে তুমি দিলে, কারো ভক্তি নাহি চাহ হয়।।
আপনা সম্বরি উঠ, নিজ-জনে চাহ।
যাহারে তোমার ইচ্ছা তাহারে বিলাহ।।’’

অবিচারে কর দান

চির অনর্পিত প্রেমধন—অবিচারে কর দান

প্রেম বিলাও জগভক্তি

পাত্রাপাত্র না বিচারি—প্রেম বিলাও জগভরি

আমি,–তারি হব অবিচারে

তুমি আমায়,–যারে দিবে ইচ্ছা করে—আমি,–তারি হব অবিচারে

আমি তোমায় দিলাম ভার

আমার,–বিশ্বম্ভর নাম পূর্ণ করিবার—আমি তোমায় দিলাম ভার

আবেশে বলেন গৌরহরি

‘‘তিলার্দ্ধেক নিত্যানন্দে যাহার দ্বেষ রহে রে।
ভজিলেহ সে কভু আমার প্রিয় নহে রে।।’’

আমি,–বাঁধা তারি প্রেমপাশে

নিতাই,–তোমাকে যে ভালবাসে—আমি,–বাঁধা তারি প্রেমপাশে

(মাতন)
তারে বিকাইব অবিচারে

যে ভজে তোমারে—তারে বিকাইব অবিচারে

‘‘পাইয়া চৈতন্য প্রভু—প্রভুর বচনে।
হইলা আনন্দময় ষড়্‌ভুজ দর্শনে।।
যে অনন্ত-হৃদয়ে বৈসেন গৌরচন্দ্র।
সেই প্রভু অবিস্ময় জান নিত্যানন্দ।।’’


অনন্তরূপে সেবা করে
সেবা-বিগ্রহ নিতাই আমার—অনন্তরূপে সেবা করে

‘‘ছয়-ভুজ-দৃষ্টি তানে কোন অদভুত।
অবতার অনুরূপ এসব কৌতুক।।
রঘুনাথ-প্রভু যেন পিণ্ডদান কৈলা।
প্রত্যক্ষ হইয়া আসি দশরথ লৈলা।।
সে যদি অদ্ভুত, তবে এহো অদভুত।
নিশ্চয় সকল এই কৃষ্ণের কৌতুক।।
নিত্যানন্দ-স্বরূপের স্বভাব সর্ব্বথা।
তিলার্দ্ধেকো দাস্যভাব না হয় অন্যথা।।
লক্ষ্মণের স্বভাব সে হেন অনুক্ষণ।
সীতা-বল্লভের দাস্যে মন প্রাণ ধন।।
এই মত নিত্যানন্দ-স্বরূপের মন।
চৈতন্যচন্দ্রের দাস্য প্রতি অনুক্ষণ।।
যদ্যপিহ অনন্তদ ঈশ্বর নিরাশ্রয়।
সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের হেতু জগন্ময়।।
সর্ব্ব-সৃ্ষ্টি-তিরোভাব যে সময়ে হয়ে।
তখনো অনন্তরূপ সত্য বেদে কহে।।
তথাপিহ শ্রীঅনন্তদেবের স্বভাব।
নিরবধি প্রেম-দাস্যভাবে অনুরাগ।।
যুগে যুগে—প্রতি-অবতারে—অবতারে।
স্বভাব তাঁহার দাস্য, বুঝহ বিচারে।।
শ্রীলক্ষ্মণ-অবতারে অনুজ হইয়া।
নিরবধি সেবেন অনন্ত, দাস হইয়া।।
অন্ন-পানী-নিদ্রা ছাড়ি শ্রীরামচরণ।
সেবিয়াও আকাঙ্ক্ষা না পূরে অনুক্ষণ।।
জ্যেষ্ঠ হইয়াও বলরাম-অবতারে।
দাস্যযোগ কভু না ছাড়িলেন অন্তরে।।
‘স্বামী’ করিয়াও সে বোলে কৃষ্ণপ্রতি।
ভক্তি বই কখনো না হয় অন্যমতি।।
সেই প্রভু আপনে অনন্ত মহাশয়।
নিত্যানন্দ-মহাপ্রভু জানিহ নিশ্চয়।।
ইহাতে যে নিত্যানন্দ বলরাম প্রতি।
ভেদ-দৃষ্টি হেন করে সে-ই মূঢ়মতি।।
সেবাবিগ্রহের প্রতি অনাদর যার।
বিষ্ণুস্থানে অপরাধ সর্ব্বথা তাহার।।
ব্রহ্মা-মহেশ্বর-বন্দ্য যদ্যপি কমলা।
তভু তাঁর স্বভাব, চরণসেবা-খেলা।।
সর্ব্ব-শক্তি-সমন্বিত ‘শেষ’ ভগবান্‌।
তথাপি স্বভাব-ধর্ম্ম সেবা সে তাহান।।
অতএব তান যেন স্বভাব কহিতে।
সন্তোষ পায়েন প্রভু সকল হইতে।।
ঈশ্বর-স্বভব সে—কেবল ভক্তিবশ।।
বিশেষ প্রভুর সুখ শুনিতেই যশ।।
স্বভার কহিতে বিষ্ণু-বৈষ্ণবের প্রীত।
অতএব বেদে কহে স্বভাব-চরিত।।
বিষ্ণু-বৈষ্ণবের তত্ত্ব যে কহে পুরাণে।
সেইমত লিখি আমি পুরাণ-প্রমাণে।।
নিত্যানন্দ-স্বরূপের এই বাক্য মন।
‘চৈতন্য ঈশ্বর, মুঞি তাঁর একজন’।।
অহর্নিশ শ্রীমুখে নাহিক অন্যকথা।
‘মুঞি তাঁর, সেহো মোর ঈশ্বর সর্ব্বথা’।।
চৈতন্যের সঙ্গে যে মোহোর স্তুতি করে।
সে-ই সে মোহোর ভৃত্য, পাইবেক মোরে।।
আপনে কহিয়া আছেন ষড়্‌ভুজদর্শনে।
তান প্রীতে কহি তান এ সব কথনে।।
পরমার্থে নিত্যানন্দ তাহান হৃদয়ে।
দোঁহে দোঁহে দেখিতে আছেন সুনিশ্চয়ে।।
তথাপিহ অবতার-অনুরূপ খেলা
করেন ঈশ্বর-সেবা, বুঝ তান লীলা।।
সহজে স্বীকার প্রভু করয়ে আপনে।
তাহা গায় বর্ণে’ বেদে ভারতে পুরাণে।।
যে কর্ম্ম করয়ে প্রভু, সেই হয় বেদ।
ভাহি গায় সর্ব্ব-বেদ ছাড়ি সর্ব্ব-ভেদ।।
ভক্তিযোগ বিনে ইহা বুঝন না যায়।
জানে জন-কথো গৌরচন্দ্রের কৃপায়।।
নিত্য শুদ্ধ জ্ঞানবন্ত বৈষ্ণব-সকল।
তবে যে কলহ দেখ, সব কুতুহল।।
ইহা না বুঝিয়া কেনোকোনো বুদ্ধি-নাশ।
এক বন্দে, আর নিন্দে, যাইবেক নাশ।।
বৈষ্ণব-হিংসার কথা সে থাকুক দূরে।
সহজ-জীবেরে যে অধম পীড়া করে।।
বিষ্ণু পূজিয়াও যে প্রজার দ্রোহ করে।
পূজাও নিস্ফল হয়, আরো দুঃখে মরে।।
‘সর্ব্বভূতে আছেন শ্রীবিষ্ণু না জানিয়া।
বিষ্ণু-পূজা করে অতি প্রাকৃত হইয়া।।
এক হস্তে যেন বিপ্র-চরণ পাথালে।
আর হস্তে ঢিলা মারে মাথায় কপালে।।
এ সব লোকের কি কুশল কোন ক্ষণে।
হইয়াছে হইবেক ?—বুঝ ভাবি মনে।।
যত পাপ হয় প্রজাগণের হিংসনে।
তার শতগুণ হয় বৈষ্ণব নিন্দনে।।
শ্রদ্ধা করি মূর্ত্তি পূজে, ভক্ত না আদরে।
মূর্খ-নীচ-পতিতেরে দয়া নাহি করে।।
‘ভক্তাধম’ শাস্ত্রে কহে এ-সব জনারে।
‘প্রভু’ ‘অবতার’ যেই জন ভেদ করে।।
এক অবতার ভজে, না ভজয়ে আর।
কৃষ্ণ-রঘুনাথে করে ভেদ-ব্যবহারে।।
বলরাম-শিব প্রতি প্রীতি নাহি করে।
‘ভক্তাধম’ শাস্ত্রে কহে এ সব-জনারে।।
প্রসঙ্গে কহিল ভক্তাধমের লক্ষণে।
পূর্ণ হৈলা নিত্যানন্দ ষড়্‌ভুজ-দর্শনে।।
এই নিত্যানন্দের ষড়্‌ভুজ-দরশন।
ইহা যে শুনয়ে—তার বন্ধ-বিমোচন।।
বাহ্য পাই নিত্যানন্দ করেন ক্রন্দনে।
মহানদী বহে দুই কমল-নয়নে।।
‘সভা’ প্রতি মহাপ্রভু বলিলা বচন।
‘পূর্ণ হৈল ব্যাস-পূজা করহ কীর্ত্তন।।’
পাইয়া প্রভুর আজ্ঞা সভে আনন্দিত।
চৌদিগে উঠিল কৃষ্ণধ্বনি আচম্বিত।।
নিত্যানন্দ-গৌরচন্দ্র নাচে এক ঠাঞি।
মহামত্ত দুই ভাই, কারো বাহ্য নাঞি।।
সকল বৈষ্ণব হৈলা আনন্দে বিহ্বল।।
ব্যাসপূজা-মহোৎসব মহাকুতূহল।
কেহো নাচে, কেহো গায়, কেহো গড়ি যায়।।
সভেই চরণ ধরে, যে যাহার পায়।।
চৈতন্যপ্রভুর মাতা—জগতের আই।
নিভৃতে বসিয়া রঙ্গ দেখেন তথাই।।
বিশ্বম্ভর নিত্যানন্দ দেখি দুইজনে।
‘দুইজন মোর পুত্র’ হেন বাসে মনে।।
ব্যাসপূজা-মহোৎসব পরম উদার।
অনন্ত-প্রভু সে পারে ইহা বর্ণিবার।।
সূত্র আমি কিছু কহি চৈতন্যচরিত।
যে-তে-মতে কৃষ্ণ গাইলেই হয় হিত।।
দিন অবশেষ হৈল ব্যাস-পূজা-রঙ্গে।
নাচেন বৈষ্ণবগণ বিশ্বম্ভর-সঙ্গে।।
পরানন্দে মত্ত মহাভাগবতগণ।
‘হা কৃষ্ণ’ বলিয়া সভে করেন ক্রন্দন।।
এইমতে নিজ ভক্তিযোগ প্রকাশিয়া।
স্থির হৈলা বিশ্বম্ভর সর্ব্বগণ লৈয়া।।
ঠাকুর-পণ্ডিত-প্রতি বোলে বিশ্বম্ভর
‘ব্যাসের নৈবেদ্য সব আনহ সত্বর।।’
ততক্ষণে আনিলেন সর্ব্ব-উপহার।
আপনেই প্রভু হস্তে দিলেন সভার।।
প্রভুর হস্তের দ্রব্য পাই ততক্ষণ।
আনন্দে ভোজন করে ভাগবত-গণ।।
যতেক আছিল সেই বাড়ীর ভিতরে।
সভারে ডাকিয়া প্রভু দিলা নিজ-করে।।
ব্রহ্মাদি পাইয়া যাহা ভাগ্য-হেন মানে।
তাহা পায় বৈষ্ণবের দাস-দাসীগণে।।
এসব কৌতুক যত শ্রীবাসের ঘরে।
এতেকে শ্রীবাস-ভাগ্য কে বলিতে পারে।।
এইমত নানা-দিন নানা সে কৌতুকে
নবদ্বীপে হয়, নাহি জানে সর্ব্বলোকে।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দচান্দ জান।
বৃন্দাবনদাস তছু পদযুগে গান।।’’

আজ ব্যাস-পূজনের তিথি

সেই,–আষাঢ়ী পৌর্ণমাসী—আজ ব্যাস-পূজনের তিথি

আজ শ্রীগুরু-পূজনের তিথি
শিখাইলেন শ্রীগুরু-পূজা

ব্যাস-পূজার ছলে নিতাই আমার—শিখাইলেন শ্রীগুরু-পূজা

নিতাই-পূজিল ব্যাস-পূজা-ছলে
শ্রীগুরু-পূজা কৈল প্রচার

পূজক-শিরোমণি নিতাই আমার—শ্রীগুরু-পূজা কৈল প্রচার

আপনি আচরি শিখাইলেন

আজ,–গুরু-পুজা-তিথি বলে—আপনি আচরি শিখাইলেন

শিখাতে এসেছেন জগতের

আপনি আচরণ করে—শিখাতে এসেছেন জগতেরে

নৈলে,–তার আবার কে পূজ্য

অভিন্ন চৈতন্য নিত্যানন্দ-নৈলে,–তার আবার কে পূজ্য
সর্ব্বোপরি তত্ত্ব শ্রীনিত্যানন্দ—নৈলে,–তার আবার কে পূজ্য

নিতাই কার পূজা করবে

সবাই ত তারে পূজবে—নিতাই কার পূজা করবে

শিখাইলেন শ্রীগুরু-পূজা

জগৎ-গুরু শ্রীগৌর পূজি—শিখাইলেন শ্রীগুরু-পূজা
জগৎ-গুরু নিত্যানন্দ—শিখাইলেন শ্রীগুরু-পূজা
‘জগৎ-গুরু নিত্যানন্দ’—
অভিন্ন চৈতন্য তনু—জগৎ-গুরু নিত্যানন্দ

শিখাইলেন শ্রীগুরু-পূজা

ব্যাসপূজার ছলে—শিখাইলেন শ্রীগুরু-পূজা

প্রাণ কেঁদে কেঁদে উঠেছে
আজ,–সেই শুভ পৌর্ণমাসী

শ্রীগুরু-পূজনের তিথি—আজ,–সেই শুভ পৌর্ণমাসী

আমরা,–কিছুই ত জানতাম না

আজ,–গুরু-পূজনেুর তিথি বলে—আমরা,–কিছুই ত জানতাম না
ব্যাস-পূজার কি রহস্য—আমরা,–কিছুই তা জানতাম না
এই তিথির, কি ব্যবহার আমরা,–কিছুই ত জানতাম না

কৃপা করে জানাইলেন

পরম-করুণ শ্রীগুরুদেব-কৃপা করে জানাইলেন
এই নীলাচলে বসে—কৃপা করে জানাইলেন
‘এই নীলাচেল বসে’—
এই দিনে এই খানে—এই নীলাচেল বসে

কৃপা করে জানাইলেন

কেমন করে গুরু-পূজা করতে হয়—কৃপা করে জানাইলেন

ইঙ্গিত করে জানাইছেন

এমনি গুরু-পূজা করতে হয়—ইঙ্গিত করে জানাইছেন
নিজ-শ্রীগুরুদেবে পূজি—ইঙ্গিত করে জানাইছেন
তাঁর প্রভু গৌরহরিকে পূজি—ইঙ্গিত করে জানাইছেন
ব্যাস-পূজার কি মর্ম্ম—ইঙ্গিত করে জানাইছেন

আজ,–প্রাণ কেঁদে কেঁদে উঠছে

সেই,–পূণ্য-তিথির আগমনে—আজ,–প্রাণ কেঁদে কেঁদে উঠ্‌ছে
শ্রীগুরু-পূজা করব বলে—প্রাণ কেঁদে কেঁদে উঠছে

একবার এস হে

নিতাই-গৌর-প্রেমের পাগল—একবার এস হে

কোথাও ত যাও নাই তুমি
তুমি যে বাঁধা পড়ে আছ
তাঁরা সবাই আছে রে

যাঁরা,–এসেছে তোমার সেবা ভুঞ্জিতে—তাঁরা সবাই আছে রে

এসেছেন বন্দীশালা হতে

তোমার প্রাণ রাধাকান্ত—এসেছেন বন্দীশালা হতে

এসেছেন চিত্রকূট হতে

ব্রহ্মচারীরে স্বপ্ন দিয়ে—এসেছেন চিত্রকূট হতে
তোমার প্রাণ রাধাবিনোদ—এসেছেন চিত্রকূট হতে

এসেছেন প্রাণ-নিতাই-গৌর

মহানগরী হতে—এসেছেন প্রাণ-নিতাই-গৌর

এসেছেন শ্রীঅচ্যুতানন্দ

শ্রীসীতানাথের স্বরূপ-এসেছেন শ্রীঅচ্যুতানন্দ
আউলিয়া মঠ হতে—এসেছেন শ্রীঅচ্যুতানন্দ

সবাই এসেছেন তোমার কাছে

তোমার সেবা-সুখ ভুঞ্জিতে—সবাই এসেছেন তোমার কাছে

তুমি,–কেমন করে কোথায় যাবে

তাঁদের প্রেম-সেবা ছেড়ে—তুমি,–কেমন করে কোথায় যাবে

তোমার সেবা তুমিই করছ
আমাদের কৃতার্থ করছ

তার উপলক্ষ করে—আমাদের কৃতার্থ করছ

তুমি কোথাও যাও নাই
লুকায়ে করছ সেবা

তোমার সর্ব্বস্বধন লয়ে—লুকায়ে কর্‌ছ সেবা

লুকায়ে থেকে দেখ্‌ছ

তোমার,–আজ্ঞা-পালন করি কিনা—লুকায়ে থেকে দেখ্‌ছ

আজ একবার এস হে

আজ,–শ্রীগুরু-পূজনের দিন—আজ একবার এস হে

বড় সাধে এসেছি ভাই ভাই মিলে

তোমার আকর্ষণে নীলাচলে—বড় সাধে এসেছি ভাই ভাই মিলে

বড় সাধ ছিল মনে
দেখিব গৌরাঙ্গ-ধনে

আমরা তোমার আনুগত্যে—দেখিব গৌরাঙ্গ-ধনে

তোমার সনে দেখব গোর

ভক্ত-সম্মিলন-লীলায়—তোমার সনে দেখ্‌ব গোরা
কালি-সমর্পণ-লীলায়—তোমার সনে দেখ্‌ব গোরা
গুণ্ডিচা-মার্জ্জন-লীলায়—তোমার সনে দেখ্‌ব গোরা
মধুর-জলকেলি-রঙ্গে—তোমার সনে দেখব গোরা
‘মধর-জলকেলি-রঙ্গে—তোমার সনে দেখব গোরা
‘মধুর-জলকেলি-রঙ্গে’—
ইন্দ্রদ্যুম্নের নীলজলে—মধুর-জলকেলি-রঙ্গে

তোমার সনে মধুর গোরা

মধুর-ভোজন-রঙ্গে—তোমার সনে দেখব গোরা
আইটোটা-উপবনে—তোমার সনে দেখব গোরা

মধুর—কীর্ত্তন-নটন-রঙ্গে

জগন্নাথের রথের আগে—মধুর-কীর্ত্তন-নটন-রঙ্গে

দর্শন-আসা না মিটিল

রথযাত্রা করাইল—দর্শন-আশা না মিটিল

বুকের সাধ বুকেই থাকল
আজ,–প্রাণের আশা জেগেছে

শ্রীগুরু-পূজার তিথি জেনে—আজ,–প্রাণে আশা জেগেছে

আজ বড় প্রাণ কাঁদিছে

তোমায় দেখবার লাগি’—আজ বড় প্রাণ কাঁদিছে

একবার এস হে

হা শ্রীগুরুদেব—একবার এস হে

বড় সাধে গেঁথেছি মালা

সুগন্ধি-সুকোমল-পুষ্পে—বড় সাধে গেঁথেছি মালা
তোমার গলায় পরাব বলে—বড় সাধে গেঁথেছি মালা

বড় সাধে ঘসেছি চন্দন

কর্পূরাদি-সুগন্ধি—দ্রব্য-যোগে—বড় সাধে ঘসেছি চন্দন
করিবারে তোমার অঙ্গ লেপন—বড় সাধে ঘসেছি চন্দন

অঙ্গীকার কর হে

নিজগুণে আমাদের পূজা—অঙ্গীকার কর হে

উপেক্ষা কর না

আমরা স্বতন্তরী বলে যেন—উপেক্ষা কর না
তোমার আজ্ঞা পালন করি না বোলে—উপেক্ষা কর না

শকতি ত নাই আমাদের

তোমার আজ্ঞা পালনের—শকতি ত নাই আমাদের
আমরা অভিমান স্বতন্তরী—শকতি ত নাই আমাদের

তাইতে হয়ে যায়

কৃপা করে যাও করাও—তাইতে হয়ে যায়

আজ একবার এস হে

অদোষ-দরশী-স্বভাবে—আজ একবার এস হে

নিজগুণে কর অঙ্গীকার

আমাদের পূজা-উপাচার—নিজগুণে কর অঙ্গীকার
আমাদের নাই সেবা অধিকার—নিজগুণে কর অঙ্গীকার

আমাদের সেবা অধিকার নাই

আমরা অপরাধী সবাই—আমাদের সেবা অধিকার নাই

অঙ্গীকার কর নিজগুণে

অদোষ-দরশী-স্বভাবে—অঙ্গীকার কর নিজগুণে

একবার এস হে
তেমনি করে একবার এস

এই তোমার বাসগৃহে—তেমনি করে একবার এস

তেমনি করে বস হে

এই তোমার বসবার আসনে—তেমনি করে একবার এস

তেমনি করে বস হে

এই তোমার বসবার আসনে—তেমনি করে বস হে

পরাই তোমায় মাল্য চন্দন

ভাই ভাই মিলে মন-সাধে—পরাই তোমায় মাল্য চন্দন
প্রীতিদানে দাও আলিঙ্গন—পরাই তোমায় মাল্য চন্দন

নিজ-শক্তি সঞ্চারিয়ে

কৃপা করে পরশিয়ে—নিজ-শক্তি সঞ্চারিয়ে

আশ্বাসবাণী দাও আমাদের
দাও দাও বল দাও

অপরাধ ক্ষমা করে—দাও দাও বল দাও
কৃপামিঠে চেয়ে আমাদের পানে—দাও দাও বল দাও
মৃদু মন্দ হেসে হেসে—দাও দাও বল দাও

একবার এস হে
এইখানে নিশ্চয় আছ তুমি

এই ত তোমার বসতি-ভূমি—এইখানে নিশ্চয় আছ তুমি

তবে কেন দেখা দিছ না
তাইতে দেখা দিছ না

আমাদের,–পূজা বুঝি লবে না—তাইতে দেখা দিছ না
‘আমাদের,–পূজা বুঝি লবে না’—
আমরা অপরাধী বলে—আমাদের,–পূজা বুঝি লবে না

তাইতে দেখা দিছ না
তুমি,–জেনেই তা করেছ গ্রহণ

স্বতন্ত্রতার মুরতি মোরা—তুমি,–জেনেই ত করেছ গ্রহণ

স্বতন্ত্রতা স্বভাব মোদের

দয়া করা স্বভাব তোমার—স্বতন্ত্রতা স্বভাব মোদের

তুমি কেন স্বভাব ছাড়বে

আমরা ত স্বভাব ছাড়ি নাই—তুমি কেন স্বভাব ছাড়বে

একবার দেখা দাও
সবাই ত জেনেছে

আমরা তোমার বলে—সবাই ত জেনেছে
‘আমরা তোমার বলে’—
যদিও হই স্বতন্তরী—আমরা তোমার বলে

সবাই ত জেনেছে
একবার দেখা দাও

অপরাধ ক্ষমা করে—একবার দেখা দাও

যদি,–আমার সেবা না কর গ্রহণ

অপরাধী স্বতন্তরী বলে—যদি,–আমার সেবা না কর গ্রহণ

আর সকলের বাসনা কর পূরণ
এসেছে তোমার দাসদাসীগণ

লয়ে তোমার পূজার উপকরণ—এসেছে তোমার দাসদাসীগণ
আজ,–শ্রীগুরু-পূজার তিথি জেনে—এসেছে তোমার দাসদাসীগণ
গুরু-পূজার সন্ধান লয়ে—এসেছে তোমার দাসদাসীগণ

আজ,–সবে মিলে এসেছে

আজ বড় আশা করে—আজ,–সবে মিলে এসেছে
তোমার পূজা করবে বলে—আজ,–সবে মিলে এসেছে

একবার তাদের দাও দরশন

কর তাদের বাসনা পূরণ—একবার তাদের দাও দরশন
আমি একা বাকী থাকি—একবার তাদের দাও দরশন

তেমনি করে কও কথা

সবার,–নাম ধরে ডেকে ডেকে—তেমনি করে কও কথা
প্রেমদিঠে চেয়ে অমিয়া-ভাষে—তেমনি করে কও কথা

সবাই তোমার সেবা করুক

দেখে আমি সুখী হব—সবাই তোমার সেবা করুক

না করলেও করতে পার

অভিমানে,–আমাদের উপহার গ্রহণ—না করলেও করতে পার
কত দুঃখ,–দিয়েছি দিতেছি বলে—না করলেও করতে পার
‘কত দুঃখ,–দিয়েছি দিতেছি বলে—
আমরা স্বতন্ত্রতা করে—তোমায় কত দুঃখ,–দিয়েছি দিতেছি বলে

না করলেও করতে পার
কিন্তু অনেকে এসেছে

যারা তোমায় দেখে নাই—কিন্তু অনেকে এসেছে

তোমার পদে বিকায়েছে

তোমার গুণ শুনে মুগ্ধ হয়ে—তোমার পদে বিকায়েছে

তাদের সেবা অঙ্গীকার কর
প্রাণভরে দেখব

তারা তোমার সেবা করবে—প্রাণভরে দেখ্‌ব

একবার দেখা দাও

নিতাই-গৌর-প্রেমের পাগল—একবার দেখা দাও

আর এক নিবেদন
এসেছেন মহান্ত-বৈষ্ণবগণ

গৌরগণ জগন্নাথের গণ—এসেছেন মহান্ত-বৈষ্ণবগণ
শ্রীগুরুপূজা-উৎসব জেনে—এসেছেন মহান্ত-বৈষ্ণবগণ
তোমার প্রীতি-আকর্ষণে- এসেছেন মহান্ত-বৈষ্ণবগণ

এসেছেন নিত্যানন্দের গণ
এসেছেন সীতানাথের গণ
এসেছেন নরহরির গণ
এসেছেন অভিরামের গণ
অনেকেই ত এসেছেন
আমরা ত জানি না

তাঁদের আদর সম্ভাষণ—আমরা ত জানি না

তুমি,–কর আদর সম্ভাষণ,

যথাযোগ্য যাঁরে যেমন—তুমি,–কর আদর সম্ভাষণ

পরাও মাল্য চন্দন

মর্য্যাদা করে তুমি—পরাও মাল্য চন্দন

একবার দেখা দাও

মহান্তগণের প্রীতে—একবার দেখা দাও

করেছি মোরা ভোগের আয়োজন

ভিক্ষা করে কত সাধে—করেছি মোরা ভোগের আয়োজন
ভিক্ষা করে কত সাধে’—
ভাই ভাই মিলে দ্বারে দ্বারে—ভিক্ষা করে কত সাধে

করেছি মোরা ভোগের আয়োজন

তোমার,–নিতাই-গৌর-সীতানাথের—করেছি মোরা ভোগের আয়োজন
জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার—করেছি মোরা ভোগের আয়োজন
করিয়ে তোমার চরণ—করেছি মোরা ভোগের আয়োজন

আপনি এসে খাওয়াও হে

সবার ভোগ অন্তে—আপনি এসে খাওয়াও হে

আপনি করাও প্রসাদ ভোজন

বৈষ্ণব-মহন্তগণে—আপনি কারও প্রসাদ ভোজন
জগন্নাথের গণে—আপনি করাও প্রসাদ ভোজন
….. প্রীতি করে বসায়ে—আপনি করাও প্রসাদ ভোজন

নয়ন ভরে দেখি মোরা

….. আদর কি করতে হয়—নয়ন ভরে দেখি মোরা

তেমনি করে এস হে

ভাবাবেশে ঢুলি ঢুলি—তেমনি করে এস হে
নিতাই গৌরাঙ্গ বলি—তেমনি করে এস হে
আমার প্রিয়গণ-সঙ্গে—তেমনি করে এস হে

সবাকারে লয়ে এস

একে একে যাদের লুকায়ে রেখেছ—সবাকারে লয়ে এস

তোমরা সবাই এস হে

কোথা শ্রীনবদ্বীপদাদা—তোমরা সবাই এস হে
কোথা শ্রীগোবিন্দদাদা—তোমরা সবাই এস হে

সঙ্গে করে লয়ে এস

তোমাদের প্রাণ রাধারমণে—সঙ্গে করে লয়ে এস

এস গোকুলচন্দ্র দাস

প্রেমদাদা অটলদাদা—এস গোকুলচন্দ্র দাস

এস প্রাণের ভাই ফণী

তোমার বাবার সাথে এস—এস প্রাণের ভাই ফণী

এস প্রিয় কৃষ্ণদাস

এস পরমানন্দদাদা—এস প্রিয় কৃষ্ণদাস

আসে পাশে ঘিরে ব’স

প্রাণ রাধারমণ লয়ে—আসে পাশে ঘিরে ব’স

তেমনি করে পূজা কর

আজ শ্রীগুরু-পূজনের তিথি—তেমনি করে পূজা কর
কোথায় শ্রীললিতা দিদি—তেমনি করে পূজা কর
নন্দ-পরমানন্দ লয়ে—তেমনি করে পূজা করে

নয়ন ভরে দেখব
সেবা ত কিছু জানি না

তোমরা সেবা করেছ সেবা জান—সেবা ত কিছু জানি না

শ্রীগুরু-পূজনের করেছি আয়োজন

তোমাদের শ্রীগুরুসেবা করি’ স্মরণ—শ্রীগুরু-পূজনের করেছি আয়োজন

মনসাধে সাজাও তোমরা

তোমাদের প্রাণ রাধারমণে—মনসাধে সাজাও তোমরা

দেখে নয়ন জুড়াই মোরা
করবে,–তেমনি করে প্রসাদ ভোজন

মহান্তগণের ভোগ-অবশেষে—করবে,–তেমনি করে প্রসাদ ভোজন
তাঁদের অধরামৃত লয়ে—করবে,–তেমনি করে প্রসাদ ভোজন
প্রাণ রাধারমণ লয়ে—করবে,–তেমনি করে প্রসাদ ভোজন
মণ্ডলী বন্ধন করে—করবে,–তেমনি করে প্রসাদ ভোজন

প্রেম দিঠে চেয়ে করবে আজ

শ্রীঅদ্বৈত বিনোদ দাস—প্রেম দিঠে চেয়ে করবে আজ্ঞা
গাইতে নিতাইগৌর-গুণ-গাঁথা—প্রেম দিঠে চেয়ে করবে আজ্ঞা

বড় দেখতে সাধ মোদের
মহাপ্রসাদ ভোজন-কালে

নিতাইগৌর-কথা-প্রসঙ্গে—মহাপ্রসাদ ভোজন-কালে

চারিদিকে উঠুক্‌ রোল

নিতাইগৌর-হরিবোল—চারিদিকে উঠুক্‌ রোল

হবেন পাগল ভাবাবিষ্ট
প্রভু বড় ভালবাসে

এই শাক শুকতা—প্রভু বড় ভালবাসে

বড় ভালবাসে গৌর-সোণা

এই অন্ন-ব্যঞ্জন-পিঠা-পানা—বড় ভালবাসে গৌর-সোণা

এই কথা বলতে বলতে
হইবেন ভাবাবিষ্ট
একবার দেখাও হে

সেই ভাবাবিষ্ট মুরতি-খানি—একবার দেখাও হে

কেউ যে কথা কইছ না

লুকায়ে লুকায়ে সবাই আছ—কেউ যে কইছ না

আর কারে বলব
ও প্রাণ রাধাকান্ত

ঠাকুর-নরোত্তমের প্রাণধন—ও প্রাণ রাধাকান্ত

তুমি আইলা বন্দীশালা হইতে

যার সেবা-সুখ ভোগ করিতে—তুমি আইলা বন্দীশালা হইতে

ও প্রাণ রাধাবিনোদ
তুমি আইলা চিত্রকূট হইতে

যার সেবা-সুখ ভুঞ্জিতে—তুমি আইলা চিত্রকূট হইতে
তোমার সেবক,–ব্রহ্মচারীকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে—তুমি আইলা চিত্রকূট হইতে

ও প্রাণের নিতাইগৌর
তোমরা আইলা মহানগরী-হতে

যার সেবা-সুখ ভোগ করিতে—তোমরা আইলা মহানগরী-হতে

বল,–রাধাবিনোদ রাধাকান্ত

নিতাই গৌর অচ্যুতানন্দ—বল,–রাধাবিনোদ রাধাকান্ত

বল,–কোথা সে লুকায়ে আছে
তার সেবা-সুখে আছ মেতে

ত্রিকাল-সত্য-লীলায়—তার সেবা-সুখে আছ মেতে

একবার দেখাও হে

তোমাদের প্রিয় সেবকেরে—একবার দেখাও হে
শ্রীগুরু-পূজনের দিনে—একবার দেখাও হে
লুকায়ে লুকায়ে কোথা বিহরে—একবার দেখাও হে

আমরা তার কর্‌ব পূজন

করবে মহাপ্রসাদ ভোজন—আমরা তার করব পূজন

একবার এস হে

নিতাই-গৌর-প্রেমের পাগল—একবার এস হে

বসবে তুমি নিরজনে

ভোজনান্তে আচমন করে—বসবে তুমি নিরজনে

আমরা করব তাম্বূল সমর্পণে
করবে তাম্বূল চর্ব্বণে

গৌর-কথা-আলাপনে—করবে তাম্বূল চর্ব্বণে
আমরা কর্‌ব চামর ব্যজনে—কর্‌বে তাম্বূল চর্ব্বণে

তাম্বূল চর্ব্বণ করতে করতে
যাবে তুমি বিশ্রাম-ঘরে

আমাদের,–প্রসাদ-সেবায় আজ্ঞা দিয়ে—যাবে তুমি বিশ্রাম-ঘরে

আমরা, প্রেমানন্দে নাচ্‌ব

তোমার অধরামৃত পেয়ে—আমরা, প্রেমানন্দে নাচ্‌ব
তোমার বলে বলী হয়ে—আমরা, প্রেমানন্দে নাচ্‌ব

প্রাণভরে গাইব

ভাই ভাই এক-প্রাণে—প্রাণভরে গাইব
তোমার প্রাণারাম নাম—প্রাণভরে গাইব

হৃদিপটে এঁকে নিব

শ্রীগুরু-পূজনের ছবি—হৃদিপটে এঁকে নিব

পাগল হয়ে বেড়াব
যারে দেখ্‌ব তারে বলব

‘‘ভজ নিতাই গৌর রাধে শ্যাম।
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।
‘‘গৌরহরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল।’’
‘‘শ্রীগুরু-প্রেমানন্দে নিতাই-গৌর-হরিবোল।।’’



অভিসার আক্ষেপানুরাগ কুঞ্জভঙ্গ খণ্ডিতা গীতগোবিন্দ গোষ্ঠলীলা দানলীলা দূতী ধেনুবৎস শিশুহরণ নৌকাখন্ড পূর্বরাগ বংশীখণ্ড বিপরীত বিলাস বিরহ বৃন্দাবনখন্ড ব্রজবুলি বড়াই বড়াই-বচন--শ্রীরাধার প্রতি মাথুর মাধবের প্রতি দূতী মান মানভঞ্জন মিলন রাধাকৃষ্ণসম্পর্ক হীন পরকীয়া প্রেমের পদ রাধা বিরহ রাধিকার মান লখিমাদেবি শিবসিংহ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শ্রীকৃষ্ণের উক্তি শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ শ্রীকৃষ্ণের মান শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ংদৌত্য শ্রীগুরু-কৃপার দান শ্রীরাধা ও বড়াইয়ের উক্তি-প্রত্যুক্তি শ্রীরাধার উক্তি শ্রীরাধার প্রতি শ্রীরাধার প্রতি দূতী শ্রীরাধার রূপবর্ণনা শ্রীরাধিকার পূর্বরাগ শ্রীরাধিকার প্রেমোচ্ছ্বাস সখীতত্ত্ব সখীর উক্তি সামোদ-দামোদরঃ হর-গৌরী বিষয়ক পদ