প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং

প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং।
বিহিতরহিত্রচরিত্রমখেদম্।।
কেশব ধৃতমীনশরীর জয় জগদীশ হরে।।
ক্ষিতিরতিবিপুলতরে তিষ্ঠতি তব পৃষ্ঠে।
ধরণিধরণকিণচক্রগরিষ্ঠে।।
কেশব ধৃতকূর্ম্মশরীর জয় জগদীশ হরে।।
বসতি দশনশিখরে ধরণী তব লগ্না।
শশিনি কলঙ্ককলেব নিমগ্না।।
কেশব ধৃতশূকররূপ জয় জগদীশ হরে।।
তব কর-কমলবরে নখমদ্ভুতশৃঙ্গং।
দলিতহিরণ্যকশিপুতনুভৃঙ্গম।।
কেশব ধৃতনরহরিরূপ জয় জগদীশ হরে।।
ছলয়সি বিক্রমণে বলিমদ্ভুতবামন।
পদনখনীরজনিতজনপাবন।।
কেশব ধৃতবামনরূপ জয় জগদীশ হরে।।
ক্ষত্রিয়রুধিরময়ে জগদপগতপাপং।
স্নপয়সি পয়সি শমিতভবতাপম্।।
কেশব ধৃতভৃগুপতিরূপ জয় জগদীশ হরে।।
বিতরসি দিক্ষু রণে দিক্পতিকমনীয়ং।
দশমুখমৌলিবলিং রমণীয়ম্।।
কেশব ধৃতরামশরীর জয় জগদীশ হরে।।
বহসি বপুষি বিশদে বসনং জলদাভং।
হলহতিভীতিমিলিতযমুনাভম্।।
কেশব ধৃতহলধররূপ জয় জগদীশ হরে।।
নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতং।
সদয়হৃদয়দর্শিতপশুঘাতম্।।
কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে।।
ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালং।
ধুমকেতুমিব কিমপি করালম্।।
কেশব ধৃতকল্কিশরীর জয় জগদীশ হরে।।
শ্রীজয়দেবকবেরিদমুদিতমুদারং।
শৃণু সুখদং শুভদং ভবসারম্।।
কেশব ধৃতদশবিধরূপ জয় জগদীশ হরে।।


অন্তঃকথন:
গীতগোবিন্দের বহু চর্চিত দশাবতার স্তোত্র। শাস্ত্র মতে ভগবানের অবতার সংখ্যার কোন সীমা নেই। তার মধ্যেও ভগবান কৃষ্ণের এই দশাবতার রূপ বহু প্রসিদ্ধ। ভগবান নানারূপে যুগে যুগে মর্ত্যে অবতরণ করেন। কেন করেন ? করেন আমাদেরই জন্য। 'যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/ অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম/ পরিত্রাণায় সাধুনাং/ বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং/ ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে' - যখন যখন ধর্ম গ্লানিময় হয়ে ওঠে, অধর্মের প্রতাপ বৃদ্ধি পায়, তখন তখন তিনি সাধুজনের রক্ষার্থে দুষ্কৃতিদের বিনাশ করে, ধর্মের পুনঃস্থাপনার জন্য মর্ত্যে আবির্ভুত হন। মনে রাখতে হবে ধর্ম বলতে এখানে কোন বিশেষ জাগতিক ধর্মমত নয়, ধর্ম মানে এখানে order- সামাজিক শৃঙ্খলা ও প্রাকৃতিক সুস্থিতি। অর্থাৎ, ধরিত্রীর চিরাচরিত প্রাকৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখতে সকলের মঙ্গলের জন্যই করুণাময় তিনি বারে বারে আমাদের মধ্যে নেমে আসেন। এই স্তোত্রে জয়দেব, দশাবতারের রূপবর্নার মধ্যে দিয়ে অবতারী কেশবের বন্দনাগান করেছেন। প্রথম শ্লোকে জয় দেব বলছেন, সৃষ্টির সেই আদি যুগে, মহাপ্রলয়ে ধরণী যখন জলমগ্না, তখন যে তুমি মৎস্যরূপে নৌকার মত বেদসমূহকে রক্ষা করেছিলে, মীনরূপধারী হে কেশব সেই তোমার জয় হোক! 'কেশব ধৃত মীন শরীর জয় জগদীশ হরে'। এই স্তোত্রে বেদসমূহ বলতে অবশ্যই কোন গ্রন্থের কথা বলা হচ্ছে না। বিদ ধাতু জাত বেদ এখানে জ্ঞানের স্বরূপার্থে, সৃষ্টির প্রতিরূপার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাহলে জয়দেব বলতে চাইছেন, অনন্ত জলরাশির তলায় সৃষ্টি যখন নিমজ্জিতপ্রায়, তখন সৃষ্টি রক্ষার্থে জীবের জন্মবীজ স্বরূপ জ্ঞানকেই তিনি নিমজ্জনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, মৎস্যরূপে-নৌকার ন্যায়। বিষ্ণুর সেই সৃস্টি রক্ষাকারী মীনাবতারের জয়গানই কবি গাইলেন প্রথম স্তোত্রে। বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার কূর্ম।সমুদ্রমন্থনকালে মন্থনদন্ডরূপ মন্দর পর্বত কে পৃথিবীর কেন্দ্রে স্থির রাখার জন্য ভগবান  পরিগ্রহ করেছিলেন কূর্মরূপ। পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন মন্দর পর্বত কে। প্রকৃতপক্ষে সমুদ্রমন্থনের তাড়ণায় পৃথিবীর ভারসাম্য যাতে হারিয়ে না যায় তাই পৃথিবীর ভরকেন্দ্রকেই নিজ পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন তিনি। সেই ভার তিনি এখনো নামাননি তাই আজও পৃথ্বী স্থির রয়েছে। জয়দেব  তাঁর মহাকবিজনচিত সরস দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন ভূভার ধারণের জন্য তাঁর কূর্ম শরীর পৃষ্ঠে কিণাঙ্ক রেখা। সেই রেখা আসলে তাঁর ক্ষমতার প্রতীকও বটে। পৃথিবীর ঘর্ষণে তাঁর পিঠে কিণাঙ্ক অর্থাৎ কড়া পড়ে গেছে। এই কিণাঙ্ক রেখা তাঁর শোভা। কবি জয়দেব, কিণাঙ্করেখা শোভিত কেশবের কূর্ম অবতারের জয়গান গাইছেন, তিনি বলছেন,  হে কেশব , যে তোমার অতিবিপুল পৃষ্ঠে পৃথিবী স্থির হয়ে আছেন, আর সেই ক্ষিতিভার ধারণের জন্য যে তোমার কূর্মশরীরপৃষ্ঠে কিণাঙ্করেখা শোভমান, সেই তোমার জয় হোক! পুরাণ বলে, সৃষ্টির অতিপ্রসবহেতু ধরণী যখন রসাতলে তলিয়ে গিয়েছিলেন ,তখন শ্রীহরি একশৃঙ্গী বরাহরূপ ধারণ করে আপন একদন্ত শীর্ষে পৃথিবীকে সমুদ্রতলদেশ হতে উদ্ধার করে আনেন। আসলে বসুন্ধরা হরিপ্রিয়া। তাঁর দুঃখ ভগবান সইতে পারেন না। তাই বারে বারে তাঁকে উদ্ধার করে নেমে আসেন। বরাহ অবতারে তাঁর রক্ষকের ভূমিকাটি যেমন স্পষ্ট, তেমনি ব্যঞ্জিত তাঁর প্রেমিক রূপটিও। উদ্ধারকালে পরমপুরুষ তিনি, ধরণীকে একশৃঙ্গে কর্ষণ করে নব সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন।শৃঙ্গার রসে তাঁর বরাহমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে আছে। জয়দেব গাইছেন, হে কেশব, চন্দ্রে যেমন কলঙ্ক মগ্ন হয়ে থাকেন, তেমনই বরাহরূপধারী যে তোমার শুভ্র দশনশিখরে শ্যমলিম ধরণী লগ্ন হয়ে আছেন, সেই তোমার জয় হোক! শুভ্র জ্যোতির্ময় চন্দ্রের মাঝে কলঙ্করেখার অবস্থানে তার শোভা যেমন বহুগুণায়িত হয়, তেমনি ঘটেছে এ ক্ষেত্রেও। মহাভারতে আছে , এই বরাহ 'একশৃঙ্গী মহাদ্যুতিম'- একশৃঙ্গী সেই বরাহ অপরূপ দ্যুতিমান। শ্যামল ধরণী তাঁর সেই বিভার পাশে কলঙ্করেখাবৎ, প্রেমিকার মত সংলগ্ন  হয়ে থেকে তাঁর রূপ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছেন। কবি সেই যুগল সৌন্দর্যেরই জয়গান করেছেন। তিনবার মানবেতর রূপে অবতীর্ণ হবার পর চতুর্থবার কেশব ধারণ করলেন অর্ধমানব-অর্ধপশু নৃসিংহরূপ। কেন এই রূপ? হিরণ্যকশিপুর জন্য। দুর্দান্ত দানব হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার কাছে বর পেয়েছিলেন দেবতা মানব দানব কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না, তিনি দিনেও মরবেন না রাতেও না, স্থলে জলে অন্তরীক্ষে কোথাও না এমনকী কোন অস্ত্রাঘাতেও না। এ হেন বর পেয়ে হিরণ্যকশিপু যখন দুর্দম অত্যাচারী হয়ে বলদর্পী মদমত্ত হয়ে উঠলেন, তখন তাঁর অত্যাচারের হাত থেকে দেব ও মানব কে বাঁচাতে তিনি নর-দেব-দানবের বাইরে গিয়ে নর-সিংহ রূপ ধারণ করে হত্যা করলেন হিরণ্যকশিপুকে। তবে এই অবতরণের পেছনে একটা অন্য স্নেহ-মধুর গল্পও রয়েছে। আর সেই উপাখ্যানটি ছাড়া এই অবতরণের নিহিতার্থ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হিরণ্যকশিপুর মত দানবের ঘরেই জন্মালেন প্রহ্লাদ। যে প্রহ্লাদ হরি বিনে আর কিছু জানেন না। অমন প্রতাপশালী পিতাকে ছেড়ে তিনি কিনা ভজনা করেন শ্রীহরির। হিরণ্যকশিপুই বা মেনে নেবেন কেন? তিনি এমন সন্তানকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন! তখন ভক্তের প্রাণরক্ষার্থে  একটি স্তম্ভ ভেদ করে আবির্ভূত হলেন ভগবান। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। স্তম্ভের মধ্যেও তিনি থাকেন। আমরা চর্ম চক্ষে দেখতে পাই না এই শুধু। প্রহ্লাদ তাঁর ভক্ত চোখে দেখতে পেয়েছিলেন।  এই অবতারে সরাসরি ভক্ত -ভগবান সম্পর্ক স্থাপিত হল। উন্মত্ত ক্রোধে যে হস্তনখরের আঘাতে হিরণ্যকশিপুর দেহ ছিন্ন করলেন তিনি, সেই নখরযুক্ত হাতই আবার পরম মমতায় স্থাপন করলেন প্রহ্লাদের মাথায়। জয়দেব তাঁর সেই নখরযুক্ত হস্তের কথা উল্লেখ করে বলছেন, হে কেশব,হে জগদীশ যে তোমার করকমলের অদ্ভুত নখের আঘাতে হিরন্যকশিপুর দেহ বিগলিত হয়, নরহরিরূপধারী সেই তোমার জয় হোক। হরি শব্দের আর এক অর্থ সিংহ। হরি বন্দনায় নরহরি শব্দটির ব্যবহার অপরূপ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। এই যে জয়দেব সব কিছু ছেড়ে নখরযুক্ত হস্তের কথা বললেন তার কিন্তু একটা পরম্পরা আছে। ধ্বনিবাদের প্রণেতা আনন্দবর্ধন স্বয়ং কৃষ্ণের অন্যসব রূপ বাদ দিয়ে নরহরি রূপের আশীর্বাদই দিয়েছেন আমাদের। তিনি নৃসিং হের নখে রক্ত দেখেন নি, দেখেছেন চন্দ্রকৌমুদীর ছায়া। আসলে এই নখরক্তের নিষ্ঠুরতার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ভক্তের আর্তির প্রতি করূণা। তাই কবি জয়দেবও তাঁর নরহরি রূপবর্ননায় সেই নখরযুক্ত করকমলের কথাই উল্লেখ করলেন! নৃসিংহ অবতারে যেমন বিশেষ ভাবে বন্দনীয়  তাঁর করকমল তেমনি পরবর্তী বামন অবতারে তাঁর পবিত্র ত্রি-পাদ সকল কালের সকল ভক্ত-মনীষাকে ভাবিয়ে তুলেছে।জলচর মীন, উভচর কচ্ছপ, স্থলচর বরাহ, অর্ধমানব নরহরির পর  বিষ্ণু ধারণ করলেন প্রথম মানব রূপ, এই বামন অবতারে। যদিও মানব কিন্তু আকারে প্রকারে তিনি অদ্ভুত। তিনি ত্রিপাদবিশিষ্ট, আকৃতিতে ক্ষুদ্র,  আবার তিনিই আসলে বৃহত্তম, তাঁর আকারের আসলে সীমা পাওয়া যায় না। জয়দেব তাঁর বন্দনা করতে গিয়ে বলছেন,  'ছলয়সি বিক্রমণে বলিমদ্ভুতবামন' অর্থাৎ হে কেশব তুমি অদ্ভুত বামন রূপে ত্রিপাদ ভূমি চেয়ে বলিকে ছলনা কর। তোমার পদনখ স্পৃষ্ট নীর সকল মানুষের পবিত্রতা বিধান করছে। হে  কেশব 'ধৃতবামনরূপ' তোমার জয় হোক। বামনরূপে তিনি তাঁর শক্তির বিক্রম দেখালেন না। এখানে জয়দেব যে 'বিক্রমণ' শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেখানে ক্রম অর্থ পরিক্রমা। বেদে আছে বিষ্ণু তাঁর এই ত্রিপাদে সূর্যসম জগৎ পরিক্রমন করেন 'বিচক্রমে পৃথিবীমেষ এতাং/ ক্ষেত্রায় বিষ্ণুর্মনুষে দশ্যমান' অর্থাৎ তিনি মানুষের জন্য, মানব জাতির মঙ্গলের জন্য ত্রিপাদে জগৎ পরিক্রমা করেন। বিষ্ণুর এই তৃতীয় পদের কথা আজও আমরা সকল পূজা মন্ত্রের সূচনা বলে থাকি। তো বামন অবতারে, ভগমান বটু বামন সেজে গেলেন দৈত্যরাজ বলির কাছে দক্ষিণা নিতে। বলি কিন্তু খারাপ লোক নন, অত্যাচারী রাজাও নন। নিজ বলে এবং গুরু শুক্রাচার্যের সহায়তায় তিনি জয় করেছেন তিন লোক। তারপর করছেন মহা যজ্ঞ। সকল ব্রাহ্মণ কে তিনি দেবেন প্রার্থিত দান এই তাঁর মনোবাসনা। তিনি সৎ, ধার্মিক। এ হেন বলির মনে জন্ম নেওয়া ত্রিভুবনজয়দর্পের অবসান ঘটাতে এবং স্বর্গচ্যুত দেবতাদের আবাস ফিরিয়ে দিতে বামন বেশে কেশব গেলেন তার কাছে। যেহেতু বলি ধার্মিক তাই এবার আর বিক্রম প্রদর্শনের প্রয়োজন নেই। তিনি আশ্রয় নিলেন ছলনার। দান হিসেবে চাইলেন তাঁর তিনটি পদ স্থাপনের জন্য উপযুক্ত ভূমি। বলি সম্মত হলে তিনি প্রকাশিত হলেন প্রকৃত রূপে, দুটি পদবিস্তারেই অধিকার করে নিলেন স্বর্গ মর্ত্য অন্তরীক্ষ। এইবার  তৃতীয় পদ তিনি কোথায় রাখেন? বলি পেতে দিলেন আপন মস্তক। শরণাগতের শিরে ভগবানের চরণ নেমে এল যেন। এই প্রথম তিনি ভক্তকে তাঁর চরণে ঠাঁই দিলেন। এবং বলিকে তিনি পাতালে স্থাপন করে নিজে তাঁর দ্বারী হয়ে রইলেন। বামন অবতারে কৃষ্ণের লীলার তাৎপর্য তাঁর রূপের মতই অনন্ত সম্ভাবনাময়। জয়দেব তাঁর শ্লোকের দ্বিতীয়াংশে যে কথা বলছেন তার অর্থ হল এই , বিষ্ণুর চরণ জাত গঙ্গার পবিত্র জলধারা সকল লোকের মঙ্গল সাধন করছে। যে বামনের চরণ ধুলিতে ভক্তের নতশির আশ্রয় পায়, সেই চরণের স্পর্শে পূত হয়ে জলধারা মনুষ্য সমাজের জীবন ধারণের সহায়ক হয়ে ওঠে। কেশবের বামন অবতারের সেই চরণ বন্দনাই করেছেন কবি জয়দেব। পরবর্তী শ্লোকে জয়দেব পরশুরাম অবতারের জয়গান গেয়েছেন। হে কেশব, তুমি একবিংশবার ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করে  সেই রক্তস্নানে ধরণীর পাপ দূর কর ও সেই পাপজনিত তাপ প্রশমিত কর। ভৃগুপতি রূপধারী তোমার জয় হোক। পরশুরাম ভার্গব। তিনি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের দ্বন্দে ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করেছিলেন একা। আসলে এই বিনাশ ক্ষত্রিয়দের নয়। তিনি বিনাশ করেছিলেন পাপ এর। ক্ষাত্রতেজ অর্থাৎ পেশীগততেজ জাত পাপের বিনষ্টি ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রাহ্মন্যের অর্থাৎ জ্ঞানের। ক্ষত্রিয়দের পাপের তাপে উত্তপ্ত ধরণীকে শোণিত সলিলে বারংবার স্নান করিয়ে শীতল করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ধর্মের, যে ধর্মের কথা আমরা আগেই বলেছি। কবি জয়দেব এই সকল কথাই নির্বাচিত শব্দে প্রকাশ করলেন, ভাবুক রসিক তাঁর নিহিত অর্থ খুঁজে পাবেন। সপ্তমবার শ্রীরামচন্দ্র রূপে তিনি নেমে এলেন  অযোধ্যায়। হত্যা করলেন রাবণকে। প্রতিষ্ঠা করলেন রামরাজ্য। জয়দেব বলছেন, হে কেশব, তুমি  যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণের দশমস্তক দিকপতি গণের উদ্দ্যেশ্যে দশদিকে আহুতি দিয়েছিলে, রামরূপধারী তোমার জয় হোক। দিকপতি গণ বলতে এখানে দশ দিশির অধিষ্ঠাত্রী ইন্দ্র বরুণাদি দেবতাদের কথা বলা হয়েছে, যাঁদের সকলকেই রাবণ কোন না কোন ভাবে অসম্মানিত করেছিলেন। তাঁদের কাম্য বস্তু  রাবণ ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। তাই  শ্রীরামচন্দ্র তাঁর রণযজ্ঞের আহুতি হিসেবে রাবণের দশ মস্তক এই দশদিক পালকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন তাঁদের কামনার পূরণ করেছিলেন। শ্রীরামের জয়গান গাইতে গিয়ে সেই কথাই জয়দেব বলতে চেয়েছেন এখান। অষ্টম বার কেশব যখন নিজে ধরায় নেমে এলেন, তখন তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন অবতার হলধারী বলরাম। তাঁর শুভ্রবরণ আর পরিধানে নীল বসন। কথিত আছে একবার তিনি যমুনার সঙ্গে মিলিত হতে  চাইলে যমুনা অরাজী হন। তখন তিনি তাঁর হল দ্বারা কর্ষণ করে যমুনাকে বৃন্দাবনের দিকে নিয়ে যাবেন এমন কথা বললে যমুনা ভীতা হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এই কর্ষণের মধ্যে কৃষির সুত্রপাতের  ইঙ্গিত অতি প্রকট। কবি জয়দেব, এর মধ্যে আবিষ্কার করলেন অপরূপ সৌন্দর্য। তিনি বলছেন, হে কেশব, তোমার শুভ্র দেহে বসনের জলদ বরণ আসলে তোমার কর্ষণ ভয়ে ভীতা যমুনার নীলকান্তিই প্রকাশ করে। হলধারী রূপধারী হে কেশব তোমার জয় হোক। ভীত প্রেমিকার গাত্রবর্ণ তিনি বসনে ধারণ করেন, এমনই তাঁর প্রেম! আবার এই যে বসনের জলদ বর্ণের কথা বলা হয়েছে তা কৃষ্ণের গাত্র বর্ণও বটে। এই বারের লীলায়, বলরাম কৃষ্ণের অগ্রজ রূপে জন্মেলেও তিনি যে আসলে কৃষ্ণের ভাবেই ভাবিত হয়ে সকল কাজ করবেন, তারই প্রতীক হিসেবে যেন তিনি বস্ত্রে ধারণ করলেন কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ। এই ভাবে জয়দেবের একটি শ্লোকের মধ্যে হাজারো নিহিতার্থ লুকিয়ে থাকে। তাঁর করুণা শুধু মানবের প্রতিই নয়, মানবেতর প্রাণীকূলের প্রতিও তাঁর সমান দৃষ্টি। তাই তো তিনি ধারণ করলেন বুদ্ধ রূপ। নিবৃত্ত করতে চাইলেন মানুষকে  পশুবধ থেকে। প্রচার করলেন অহিংসার ধর্ম। জয়দেব কিভাবে দেখছেন এই অবতারকে?  তিনি লিখছেন হে কেশব, যজ্ঞে পশুবধের আধিক্য দেখে তুমি পশুদের প্রতি করুণা পরবশ হয়ে যজ্ঞবিধির প্রবর্তক বেদ সমুহের নিন্দা কর। বৌদ্ধ দর্শন নাস্তিক অর্থাৎ বেদে বিশ্বাস করে না। জয়দেব তার অন্তরালের কারণ টিকে দেখতে চাইলেন। সকলকিছুর  মূল সেই করুণা। সেই করুণা সর্ব জীবে। যাতে জীবের বিনাশ সাধন হয় এমন কিছুতেই মত নেই তাঁর। তাই তিনি বেদেরও নিন্দা করেন।কারণ বেদ প্রবর্তিত যজ্ঞের নামে  অকারণে বহু প্রানীর বিনষ্টি ঘটছিল। তাই করূণার প্রতিমুর্তি বুদ্ধের আবির্ভাব। সেই করুণাঘনের বন্দনাই করলেন জয়দেব। বিষ্ণুর শেষ অবতার কল্কি। জয়দেবের বর্ননায় তিনি ম্লেচ্ছসমূহকে বধ করার জন্য ধূমকেতুর মতকরাল তরবারি নিষ্কাসন করেন। সেই ভয়ংকর কল্কিরূপের বন্দনা করেন কবি। ম্লেচ্ছ তাদেরকেই বলা হত যারা শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ করতে পারতেন না। অর্থাৎ যাঁরা আর্য ভাষা ও আর্য ভাবধারার  সমুন্নত আদর্শকে অশুদ্ধির দ্বারা কলুষিত করছে তাদের সমূলে বিনষ্ট করার জন্যই তাঁর কল্কি রূপ ধারণ। ধর্মের প্রতিষ্ঠার্থে তিনি ভয়াল ভয়ংকর। ভীষণের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে তাঁর মঙ্গলবোধ। যিনি বোঝেন তিনি ভীষণের বন্দনায় আনন্দ পান, যেমন কবি জয়দেব। এই দশাবতার মধ্যে গীতগোবিন্দের টীকাকার পূজারী গোস্বামী দশটি রসের প্রকাশের কথা বলেন। মীন বীভৎস রস, কূর্ম অদ্ভুত রস,বরাহ ভয়ানক রস, নৃসিং হ বাৎসল্য রস, বামন সখ্যরস, পরশুরাম রৌদ্ররস, রামচন্দ্র করুণরস, হলধর হাস্যরস, বুদ্ধ শান্ত রস এবং কল্কি বীর রসের অধিষ্ঠাতা।আর তিনি অর্থাৎ কেশব , উজ্জ্বলনীলমণিকার শ্রীরূপ গোস্বামীর মতে, তিনি 'অখিলরসামৃতমূর্তি', তার মধ্যেই সকল রসের অধিষ্ঠান। তিনি নররূপে জন্মালেও তিনি অবতার নন, অবতারী। ভাগবত পুরাণ বলে, " এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগনবান্‌ স্বয়ম্‌" অর্থাৎ কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, তাঁরই কলায় বিভিন্ন অবতার জন্ম গ্রহন করেন। জয়দেব দশাবতার স্তোত্রে আসলে দশাবতারের জয়গানের মধ্য অবতারী কেশবেরই জয়গান করেছেন।'কেশব, ধৃতদশবিধরূপ, জয়জগদীশ হরে।'
পদকর্তা:জয়দেব
রাগ:মালব
তাল:রূপক
সংকলন:দেবহূতি সরকার

keyboard_arrow_left keyboard_arrow_right
সন্ধিনী
অভিসার আক্ষেপানুরাগ কুঞ্জভঙ্গ খণ্ডিতা গীতগোবিন্দ গোষ্ঠলীলা দানলীলা দূতী ধেনুবৎস শিশুহরণ নৌকাখন্ড পূর্বরাগ বংশীখণ্ড বিপরীত বিলাস বিরহ বৃন্দাবনখন্ড ব্রজবুলি বড়াই বড়াই-বচন--শ্রীরাধার প্রতি মাথুর মাধবের প্রতি দূতী মান মানভঞ্জন মিলন রাধাকৃষ্ণসম্পর্ক হীন পরকীয়া প্রেমের পদ রাধা বিরহ রাধিকার মান লখিমাদেবি শিবসিংহ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শ্রীকৃষ্ণের উক্তি শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ শ্রীকৃষ্ণের মান শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ংদৌত্য শ্রীগুরু-কৃপার দান শ্রীরাধা ও বড়াইয়ের উক্তি-প্রত্যুক্তি শ্রীরাধার উক্তি শ্রীরাধার প্রতি শ্রীরাধার প্রতি দূতী শ্রীরাধার রূপবর্ণনা শ্রীরাধিকার পূর্বরাগ শ্রীরাধিকার প্রেমোচ্ছ্বাস সখীতত্ত্ব সখীর উক্তি সামোদ-দামোদরঃ হর-গৌরী বিষয়ক পদ